তাবলিগ জামায়াতের সংস্কার সময়ের দাবি
মূল: সাইয়েদ সালমান হোসাইনী নদভী
অনুবাদ: জহির উদ্দিন বাবর
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকে শতাব্দীতে এমন এক বা একাধিক লোককে পাঠান যারা দীন সংস্কারের কাজ আঞ্জাম দেন। দীন যেভাবে এসেছিল সেভাবে তারা উপস্থাপন করেন। এর মাধ্যমেই দীন টিকে থাকার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) ইন্তেকালের আগে বলেছিলেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, এই দুটি জিনিসকে তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখলে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। এর একটি হলো কুরআনে কারিম আর অপরটি হলো হাদিস বা সুন্নতে নববি। এজন্য উম্মতের সবার ঐক্যমতে প্রত্যাবর্তনস্থল হচ্ছে কুরআন ও হাদিস। প্রত্যেক যুগে কোনো ব্যক্তি, আন্দোলন, দল, বা যেকোনো প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বারস্থ হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহর। এটিই একমাত্র পরিমাপযন্ত্র। এটাকে পাশ কাটিয়ে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের কথাকে বুনিয়াদি কথা মনে করলে সৃষ্টি হবে ভ্রষ্টতা। এজন্য প্রত্যেকের কথাকে এই দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ করা উচিত।
ইমাম মালেক (রহ.)-এর একটি প্রসিদ্ধ উক্তি আছে। মসজিদে নববীতে রওজায়ে আতহারের পাশে বসে তিনি বলেছিলেন, সবার কথা শোনাও যায় আবার তা প্রত্যাখ্যানও করা যায়। একমাত্র এই রওজায় যিনি আছেন অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সা. ছাড়া। কারণ তাঁর কথায় এমন কোনো বিষয় নেই যা ছেড়ে দিলেও চলবে। প্রতিটি কথাই নিতে হবে এবং কথাগুলো মস্তিষ্কে সজীব রাখতে হবে।
চৌদ্দ শতকে আল্লাহ তাআলা যাদের দ্বারা সংস্কারমূলক কাজ নিয়েছেন এর মধ্যে আছেন মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি, মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর নাম। তাদের প্রত্যেকের সংস্কারমূলক কাজের ময়দান ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কেউ হাদিসের ময়দানে সংস্কারমূলক কাজ করেছেন, কেউ সুন্নত জিন্দা এবং বিদআত মিটিয়ে দিতে কাজ করেছেন, কেউ এই উপমহাদেশে ইসলামকে টিকিয়ে রাখা এবং রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। আবার কেউ মুসলমানদেরকে মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং ঈমানি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার ময়দানে সংস্কারমূলক কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর যে বুনিয়াদি কাজ ছিল তা ছিল দীনের একদম প্রাথমিক পর্যায়ের, সূচনা পর্বের। তিনি নিজে তাঁর মালফুজাতে এটা স্পষ্ট করে বলেছেন, এগুলো হলো দীনের ‘আলিফ’ ‘বা’ (প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ), দীনের আরও অনেক কিছু বাকি। তিনি তাঁর মালফুজাতে বিভিন্ন স্থানে ইশারা করেছেন এবং কখনও স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি ওই দিনের অপেক্ষায় যেদিন মসজিদ থেকে জিহাদের জন্য মুজাহিদ বাহিনী যাত্রা করবে।
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব আলেমকে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হিসেবে মনে করা হতো তাদের মধ্যে মাওলানা এহতেশামুল হাসান, মাওলানা মনজুর নোমানী এবং মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনজন হলেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর প্রকৃত মুখপাত্র। তাঁরা যখন তাবলিগের কাজে পুরোপুরি লেগেছিলেন তখন মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে ইলিয়াস (রহ.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁকে এই কাজের গুরুদায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। নিজ বংশেরই আরেকজনের কাছে মহান এই কাজের জিম্মাদারি স্থানান্তরিত হয়। মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) বিস্ময়কর কিছু কাজ আঞ্জাম দেন। তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতেন, সবার কথা শুনতেন। সবাইকে মূল্যায়ন করতেন। দাওয়াতে দীনের যোগ্য মুখপাত্র হিসেবেই তিনি দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.)-এর যুগেও এই কাজের ধারা অব্যাহত থাকে এবং কাজকে গতিশীল করতে পূর্ববর্তী বুজুর্গদের চিন্তাধারা অনেকটাই সক্রিয় পাওয়া যায়। তাবলিগি আন্দোলনে ইলম ও চিন্তার প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে মাওলানা এহতেশামুল হাসান, মাওলানা মনজুর নোমানী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) যেহেতু চিন্তামূলক কোনো কিতাব লিখেননি, তাওয়াত ও তাবলিগ বিষয়ে তাঁর লেখালেখি নেই এজন্য তিনি এই অঙ্গনের লেখক হিসেবে সামনে আসেননি। এজন্য চিন্তা ও দাওয়াতি ক্ষেত্রে নির্দেশনামূলক কাজ তাদের জিম্মায় রয়ে যায়। মাওলানা মনজুর নোমানী এবং মাওলানা আলী মিয়া নদভী (রহ.)-এর চিন্তা, দাওয়াত ও ইসলাহি সাহিত্য ছিল তাবলিগের মূল ভাণ্ডার। মাওলানা এহতেশামুল হাসান (রহ.)-এর ইসলাহি কিতাবাদিও ছিল। তাবলিগের জিম্মাদারেরা সবাই তাদের কিতাবই পড়তেন। ইলমপ্রিয় কেউ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হলে তাদের কিতাবাদি পড়া আবশ্যকীয় ছিল।
অন্যদিকে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর বক্তব্য ছিল, তিনি বারবার স্পষ্ট করে এ কথা বলেছেন যে, আমার এই আন্দোলন আর মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর কিতাব (দুটির সমন্বয় দরকার)। আফসোস, এর ওপর আমল হলে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আন্দোলনের রূপ লাভ করতো। কিন্তু উপমহাদেশে পরবর্তী সময়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বিরোধ ও দেশ ভাগাভাগির ঘটনা এটা বাস্তবায়ন হতে দেয়নি।
মোটকথা তাবলিগ জামায়াত নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মাথায় যে নকশা ছিল, বিভিন্ন সময় তার থেকে যা স্পষ্ট হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত সবার দায়িত্ব। এটা তাদের কাছে আমানত। এই জামায়াতের লোকেরা যদি ইলিয়াস (রহ.)-এর সেই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন না করে তবে তারা এই আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকার দাবি করতে পারেন না। ধরে নেয়া হবে তারা প্রতিষ্ঠাতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছেন।
এই তাবলিগ জামায়াতকে পুরো শরিয়ত মনে করার জন্য মাওলানা থানভী (রহ.)-এর কিতাবের দরকার ছিল। তিনি ছিলেন সব জ্ঞানের ভাণ্ডার, সব সংস্কারকের শীর্ষে। এটা স্পষ্ট যে, পরবর্তী সময়ে এই কাজের পূর্ণতা, চিন্তার বিস্তৃতি এবং দাওয়াতি নির্দেশনা স্থির করার জন্য মাওলানা মনজুর নোমানী, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী, মাওলানা এহতেশামুল হক কান্ধলবী এবং মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.)-এর কিতাবাদির সহযোগিতা দরকার ছিল। (দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।)
পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারণা তাবলিগের মারকাজের বক্তব্যে পাওয়া যাবে না না। স্পষ্ট শুনে রাখুন, বর্তমান তাবলিগ জামায়াতের দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে কোনো চিন্তা মিলবে না। মারকাজে এখন এমন কেউ নেই যারা উম্মাহকে পদ দেখাতে সক্ষম। এজন্য মারকাজের দায়িত্বশীলদের এখন কোনো ফতোয়া বা সিদ্ধান্তমূলক কোনো বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না। এটা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। দায়িত্বশীলদের উচিত এই কাজের বাইরে থাকা বড় বড় আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া, যেমন ইলিয়াস (রহ.) তাঁর যুগের বড় আলেমদের শরণাপন্ন হতেন। পরামর্শ নেয়ার জন্য তাদের দরবারে গিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। হজরত শাইখুল হিন্দু (রহ.)-এর দরবারে হাজির হতেন, যিনি হিন্দুস্তান স্বাধীন করার আন্দোলনে ছিলেন অগ্রসেনানী।
থানভী (রহ.)-এর ব্যাপারে হজরত ইলিয়াস (রহ.) স্পষ্ট বলেছেন, তাঁর কিতাবাদি আমার এই আন্দোলনের পাঠ্য। কারণ তিনি আকিদা, ইবাদত, সামাজিকতা, আখলাক, লেনদেনসহ দীনের প্রতিটি দিকের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। এমনকি মেয়েদের জন্য ‘আলেমা কোর্স’ সম্পন্ন করতে গিয়ে বেহেশতি জেওরের মতো কিতাব রচনা করেছেন।
এই ধারায় যদি তাবলিগের কার্যক্রম চলতো তাহলে এটা হতো একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আন্দোলন। দীনের সব শাখায় বিস্তৃত হতো এর কাজ। পরবর্তী সময়ে শুধু ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় কার্যক্রম। দীনের অন্য শাখাগুলো যে পরিত্যাগ করা হয়েছে তাই নয়, বরং বিভিন্নভাবে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়েছে। কখনও মাদরাসার প্রয়োজন অস্বীকার, কখনও খানকার প্রয়োজন অস্বীকার, কখনও সংগঠনের প্রয়োজন অস্বীকার, কখনও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অস্বীকার করা হয়েছে। এগুলো যে শুধু অজ্ঞতাসুলভ কথা তাই না, বরং ইসলামের মর্যাদা ও বিশালত্বের পরিপন্থী। সাধারণ মানুষ তো মারকাজকে মনে করছে হেদায়াতের ভাণ্ডার। অথচ সেখানে দীনকে উপস্থাপন করা হচ্ছে খণ্ডিতভাবে।
মোটকথা এই কাজের ক্ষেত্রে এখন প্রয়োজন হলো মুফতী ও আলেমদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। কারণ তাদের ওপর আস্থা ও নির্ভরতা বিগত চৌদ্দশ বছর ধরে চলে এসেছে। আলেমদের শরণাপন্ন হওয়ার যে ধারা শত শত বছর ধরে চলে এসেছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। হজরত মাওলানা আলী মিয়া নদভী (রহ.) ১৯৪০ সালে নদওয়াতুল ওলামায় তাবলিগের কাজ শুরু করেন। পরে মাওলানা ইলয়াস (রহ.)-কে নদওয়ায় দাওয়াতও দেন। তিনি সেখানে আসেন এবং লক্ষ্মৌতে তাবলিগের মারকাজও স্থাপিত হয়। সেই মারকাজে মাওলানা মনজুর নোমানী এবং আলী মিয়া নদভী (রহ.) নিয়মিত বয়ান করতেন। আলী মিয়া নদভী (রহ.) দাওয়াতি কাজের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে মারকাজে সংগ্রামী সাধকদের জীবনী আলোচনা শুরু করেন। সেই আলোচনাই পরে ‘দাওয়াতে তারিখ ও আজিমত’ (সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস) নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি ধর্মান্তরিতের বিরুদ্ধে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.)-এর অবদান তুলে ধরেন, হজরত হাসান বসরী (রহ.) সমাজ সংশোধনে যে ভূমিকা পালন করে তা তুলে ধরেন, চার ইমাম আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ী ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর ফিকাহশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের কথা আলোচনা করেন। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি প্রমুখ হাদিসের ইমামরা হাদিসশাস্ত্রে কী অবদান রেখে গেছেন তা তুলে ধরেন, আকিদার ক্ষেত্রে ইমাম আবুল হাসান আশআরী, ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি প্রমুখের সাধনার কথা তুলে ধরেন, ‘কুরআন সৃষ্টি’ আব্বাসি যুগের এই ফেতনা মোকাবেলায় আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) যে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন তা আলোচনা করেন। ইমাম গাজালী ও মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহ.)-এর ইসলাহী প্রচেষ্টার ওপর আলোকপাত করেন। কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কর্মময় জীবনের আলোচনা করেছেন। তৃতীয় খণ্ডে হিন্দুস্তানের সুফিয়ায়ে কেরামের কথা তুলে ধরেছেন। চতুর্থ খণ্ডে মুজাদ্দিদে আলফে সানী এবং পঞ্চম খণ্ডে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)-এর আলোচনা করেছেন। পাঁচ খণ্ডের এই কিতাবে আলী মিয়া নদভী (রহ.) এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন যে, দাওয়াতি কাজের এই ধারা কোনো যুগেই বন্ধ ছিল না। শিকলের দানার মতো প্রতি যুগেই তা অব্যাহত ছিল। হাদিসে নবী করীম (সা.) যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন হয়েছে।
চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকে হজরত মাওলানা ইলয়াস (রহ.) যে কাজ শুরু করেন এটা নতুন কোনো কাজ না। এটা ওই শিকলেই একটি দানা ছিল। তবে সেই যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য ছিল তাঁর এই আন্দোলন। এজন্য ইলয়াস (রহ.) বলতেন, দাওয়াতের পদ্ধতি, বিষয়বস্তু এবং দাওয়াতের কর্মকৌশল পরিবর্তনশীল। প্রয়োজনের কথ বিবেচনা করে কাজ করতে হবে। এজন্য একই যুগে নানা ধরনের সংস্কারমূলক কাজ আঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। চৌদ্দ শতকে সংস্কারমূলক কাজ হজরত থানভী (রহ.)ও করেছেন, হজরত মাদানী (রহ.)ও করেছেন, হজরত ইলিয়াস (রহ.)ও করেছেন। তাদের কর্মক্ষেত্র ছিল পৃথক পৃথক। কিন্তু তাঁরা কেউ কারও কাজকে অস্বীকার করতেন না। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) কখনও মাওলানা মাদানী বা মাওলানা থানভী (রহ.)-এর কোনো কাজকে অস্বীকার করতেন না। অথচ তাদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন বরং কর্মক্ষেত্রে সুস্পষ্ট একটি বিভাজন ছিল। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক। মাওলানা মাদানী (রহ.) ছিলেন কংগ্রেসের সমর্থক। মওলানা ইলয়াস (রহ.)ও ছিলেন মাওলানা মাদানী (রহ.)-এর দিকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইলিয়াস (রহ.) বলতেন, মাওলানা থানভী (রহ.)-এর কিতাবাদি পড়ো। এতবড় মতপার্থক্য, কেউ পাকিস্তানের পক্ষে, আবার কেউ হিন্দুস্তানের পক্ষে, তবুও তাদের চিন্তার ঐক্য অটুট ছিল। সবার দৃষ্টি ছিল ইসলামের উন্নতি আর মুসলমানদের সংশোধনের দিকে। ওই সময় মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ফিকরে ইসলামি ও ফিকহে ইসলামির মুজাদ্দিদ ছিলেন। এজন্য মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) বলেছিলেন, তাঁর কিতাবাদি পড়া চাই। সেই সময় কোনো কারণে এটা করা না হলে তার অর্থ এই নয় যে, আগামীতে এটা করা যাবে না। এখন যে কেউ এই প্রশ্ন করতে পারে, আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর কিতাবাদি তাবলিগের নেসাবে নেই কেন? শুধু ফাজায়েলে আমল আর মুনতাখাব হাদিসের আলোচনা কেন? এই দুটি কিতাব তো দীনের একটি ছোট অংশের পরিচয় বহন করে।
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা। সুতরাং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ীই এই কাজ বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। কিন্তু এই উপমহাদেশে কোনো আন্দোলনই স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। একজন ব্যক্তিকে ঘিরে আন্দোলন শুরু হয়, তিনি নেই সেই আন্দোলনও নেই। হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর আন্দোলন টিকেনি। শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ.)-এর আন্দোলন, সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর আন্দোলন সবগুলোর একই পরিণতি হয়েছে। ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান কিছুই আর বাকি নেই।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর আন্দোলন ভারতবর্ষের জন্য এতটাই প্রয়োজন ছিল যে, এই আন্দোলন না হলে গোটা ভারতবর্ষ ইসলামবিচ্যুত হয়ে যেত। বাদশা আকবরের যে ফেতনার মোকাবেলা মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) করেছেন এর কোনো দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে নেই। কিন্তু আজ তাঁর স্মৃতিবিজড়িত সেরহিন্দে গেলে দেখবেন সেখানে বিদআতের আখড়া বসেছে। যে সেরহিন্দ ইসলামি আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিল সেই সেরহিন্দে এখন এর কোনো ছিটেফোঁটাও নজরে আসবে না। এটাই হলো আল্লাহর নেজাম। রাত শেষে দিন, এদিকের সূর্য অস্ত গিয়ে অপর দিকে উঠবে। আমার খুব আশঙ্কা হচ্ছে, তাবলিগের মতো একটি সম্ভাবনাময় কাজও সেই পরিণতির দিকেই যাচ্ছে কি-না।
দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাবলিগ জামায়াতের দ্বারা কাজ নিয়েছেন। কিন্তু এখন এই ইদানীং কাজে বিভাজন ও বিভক্তির ধারা শুরু হয়ে গেছে। কিতাব ও সুন্নাহ এবং ওলামায়ে কেরাম এই কাজের প্রত্যাবর্তনস্থল থাকবে কি-না তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটা না থাকলে পরিণতি খুব ভয়াবহ হবে। এই তাবলিগ জামায়াত একটি ফেরকায় রূপান্তর হবে। গোমরাহির পথ খুলে যাবে। লোকদের মধ্যে বাড়াবাড়ি সৃষ্টি হবে, কট্টরপন্থা জন্ম নেবে। ব্যক্তিকেই দীন মনে করতে থাকবে। দীনকে কোনো বিশেষ স্থানের বরকত হিসেবে গণ্য করা শুরু হবে। সেখান থেকেই হবে ভুলের সূচনা। বাড়তে থাকবে বিভাজন।
এজন্য আমার বিশেষ অনুরোধ হলো, এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আলেমদের ইলমি কথাবার্তা বেশি বেশি বলতে হবে। কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে কথা বলতে হবে। এখানে কী হচ্ছে, ওখানে কী হচ্ছে, অমুক মুরব্বি কী বলেছেন, রায়বেন্ডে কী হচ্ছে, কাকরাইলে কী হচ্ছে এটা কখনও কোনো দলিল হতে পারে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারত কোনোটাই দলিল নয়। দলিল হলো আল্লাহর কিতাব, রাসুল সা.-এর সুন্নত ও তরিকা। আর এই ইলম সংরক্ষণ হচ্ছে মাদরাসাগুলোতে। মাদরাসার প্রত্যেকেই ‘আলেমে রব্বানী’ এটা হয়ত নয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে ‘ওলামায়ে রব্বানী’ সবসময় মাদরাসায় থাকেন এবং থাকবেন। কিতাব ও সুন্নাহর সংরক্ষণ সেই মাদরাসাতেই হচ্ছে। সঠিক ফতোয়া আসে সেখান থেকেই। এজন্য অন্য কোনো মারকাজের এই অধিকার নেই যে, তারা ফতোয়া জারি করে দেবে। তারা যদি আলেমদের চেয়ে অগ্রসর হয়ে, দারুল ইফতাকে পাশ কাটিয়ে নিজেরাই ইজতেহাদ করা শুরু করে, এই অনুমতি তাদেরকে কখনও দেওয়া হয়নি।
আমাদেরকে সংযুক্ত থাকতে হবে বিগত চৌদ্দশ বছর ধরে চলা ওই মারকাজের সঙ্গে যেখানে অনেক মুজাদ্দিদ, সংশোধনকারী, দা’য়ী এসেছেন। এক এক সময় হাজার হাজার সংশোধনকারী সেখানে জড়ো হয়েছেন। ওলামায়ে কেরামের জীবনী পড়ে দেখুন, এক এক শতাব্দীতে হাজার হাজার বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তাদের বরকতেই গোটা উম্মতের মধ্যে দীন এখনও সংরক্ষিত আছে। মরক্কো থেকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া কোটি কোটি মানুষের মধ্যে যে দীন সংরক্ষিত তা চৌদ্দশ বছর ধরেই সংরক্ষিত আছে। আর তা সেখানকার সংস্কারক, সংশোধক ওলামায়ে কেরাম, ফকীহ, মুফতীদের দ্বারাই সংরক্ষিত। কোনো দল বা জামায়াত থাকুক আর না থাকুক দীন সংরক্ষিত থাকবে। দীনের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এর জন্য আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যে, প্রতিটি দেশেই আল্লাহর কিতাবের হাফেজ, ব্যাখ্যাকারক, হাদিসের ধারক, ফিকাহর গবেষক সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ইন শা আল্লাহ তারা সবসময়ই থাকবেন।
এজন্য এই মাপকাঠি সামনে নিয়ে কথা বলতে হবে। কোনো বিষয়ে একটু গভীরভাবে ভাবলেই বেরিয়ে আসবে কোনটা হক আর কোনটা বাতিল, কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ, ভালো কোনটা আর খারাপ কোনটা। সব বিষয় শূরা আর আমিরের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। এটা শুধু শৃঙ্খলার জন্য করা হয়ে থাকে। কোনো পারস্পরিক ঝগড়া, গোষ্ঠীগত বিভেদকে দাওয়াতি কাজের সঙ্গে যুক্ত করা ঠিক হবে না। আল্লাহ তাআলা কোনো ঝগড়ার সঙ্গে দীনকে যুক্ত করেননি। দীনের অবস্থান এর অনেক ওপরে। দীন তার গতিতেই চলবে। তাবলিগের কাজ যেখানেই আছে সেখানে যেমন দীন আছে তেমনি যেখানে নেই সেখানেও দীন আছে। সবখানেই দীনের ওপর কিছু না কিছু কাজ হচ্ছে। ভারতে কাশ্মির থেকে কেরালা পর্যন্ত সবখানেই কোনো না কোনোভাবে মুসলমান দীনের সঙ্গে যুক্ত আছে। এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সবাই তাবলিগ জামায়াতের দ্বারাই দীনের সঙ্গে যুক্ত। এটা নিছক ধারণা। যারা এই ধারণা পোষণ করেন তারা ভুলের মধ্যে আছেন। এই ভুল থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
যে কেউ যেকোনো ভালো কাজ করুক তা স্বীকার করা উচিত। কিন্তু এই স্বীকার করার অর্থ এই নয় যে, বাড়াবাড়ি করা, অন্যের ভালো কাজগুলোকে অস্বীকার করে বসা। উসুল মেনে কাজ করলে সবই ঠিক আছে। কোনো মারকাজে উসুল না মানলে দ্বিতীয় তৃতীয় মারকায হবে। এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো জায়গা বা ব্যক্তিকে মহান হিসেবে ধরা যাবে না। প্রকৃত মহান একমাত্র আল্লাহ। তার পরে রাসুল, কুরআন, ঈমান, ইসলাম, তিন মসজিদ মসজিদে নববী, মসজিদে হারাম ও মসজিদে আকসাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আর কারও বিশেষ মর্যাদা নেই।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর যুগে সেরহিন্দের বিশেষ মর্যাদা ছিল। শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ.)-এর যুগে ফুলাতের আর সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর যুগে ছিল তাকিয়া’র মর্যাদা। কিন্তু তা আর নেই। আল্লাহর দীন কোনো মাটির সঙ্গে যুক্ত নয়। এর সঙ্গে কারও আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। যেখানে কাজ হবে সেখানেই দীন স্থানান্তর হবে। মারকাজ ছিল সেরহিন্দ, ফুলাত, তাকিয়া, এরপর মারকাজ হলো দিল্লির নিজামুদ্দীন। এখন কী হবে সেটা আল্লাহ জানেন। আল্লাহর যা মঞ্জুর তাই করবেন। এজন্য অন্তর থেকে সবধরনের কল্পনাবিলাস ঝেড়ে ফেলা উচিত। প্রত্যাবর্তন করা উচিত আল্লাহর কাছে, কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসুলের দিকে। ফিরে যাওয়া উচিত সেই নীতি ও বিধানের দিকে যার ওপর ওলামায়ে রব্বানী ঐক্যবদ্ধ।
আমি তাবলিগের দায়িত্বশীলদের কাছে নিবেদন করেছিলাম তারা যেন একবার আলেমদের সঙ্গে বিশেষ করে দেওবন্দ, মাজাহিরুল উলুম এবং নদওয়াতুল ওলামার সঙ্গে বসেন। সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেন। সম্মিলিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে কোনটা শুদ্ধ কোনটা ভুল, কী সংযোজন করা উচিত, কী বাদ দেওয়া দরকার এ বিষয়গুলো সিদ্ধান্ত নিন। দীনি ক্ষেত্রে অপেক্ষার পলিসি চলে না। কোনো বিষয় ভুল হলে সেটা ভুলই, সেটা স্বীকার করার সৎসাহস থাকতে হবে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতো বিজ্ঞজনের সঙ্গে তাঁর ছাত্র আবু ইউসুফ (রহ.) দ্বিমত করেছেন। যেখানে তিনি এবং ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) মনে করেছেন আমাদের উস্তাদ ভুল করছেন সেখানে তারা অকপটে আদবের সঙ্গে বলে দিয়েছেন। আমাদের ফিকহি কিতাবাদিতে এসব মতপার্থক্যের কথা আলোচনা করা হয়েছে। দ্বীনি ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা আছে। দীন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত না, একমাত্র রাসুলুল্লাহ সা. ছাড়া। অথবা রাসুল সা. যেসব ব্যক্তিকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন যেমন আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী (রাযি.), খোলাফায়ে রাশেদিন। এরপর সমস্ত সাহাবায়ে কেরামকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সামষ্টিকভাবে সমস্ত সৃষ্টির ওপর তাদের প্রাধান্য। মোটকথা, উম্মতকে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করা ওলামায়ে কেরামের ওপর ফরজ। এজন্য তাদের উচিত এই দায়িত্বটুকু পালন করা।
[মূল উর্দু লেখাটি মাওলানা সালমান হোসাইনী নদভী দা. বা.-এর ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া]