আল্লামা আবদুল হামিদ (রহ.) অনুপ্রেরণার উৎস সাধক
খালেদ রাসেল
ভূমিকা: যাদের বৃক্ষের ফল আমরা ভোগ করছি তাদের স্মৃতিচারণ আমাদের জন্য কর্তব্য বরং পাথেয়। কুরআনের বাণী উচ্চারণ মধ্য দিয়ে মহান সাধকের জীবন দর্শন আলোচনা করা সমীচীন মনে করছি, কেননা নিম্নোক্ত আয়াতে যেন মহান সাধকদের আদর্শিক প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়েছে। ‘তোমাদের নিকট আলো তথা হেদায়তের নির্দেশনা এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা এ উভয় বস্তুর মাধ্যমে হেদায়ত বা সরল পথ দেখিয়ে থাকেন।’ সুতারাং আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু লোকটিকে আমাদের সরল চোখে, সরল মনে সে দলের অন্তরভুক্ত ভাবছি। যাদের থাকে নববী আদর্শ তাদেরকে মানবকুল শ্রদ্ধাভরে বিনয়ের সাথে হৃদয়ের মণিকোঠায় সাদরে গ্রহণ করে। জৈনক ফার্সি কবি যথার্থই বলেছেন,
যদি না থাকে উত্তম চরিত্র,
সুন্দর অবয়ব নয় কিছু।
যদি না হয় ফুলে সুগন্ধি,
হয় না সেটি উপযুক্ত হবার বাগান বন্দী।
জন্ম ও পরিচয়: নাম আবদুল হামিদ, পিতা রুস্তম আলী মুন্সী, মাতা সুয়াজান। তিনি বংশগত দিক থেকে আরবীয় বংশোদ্ভুত ছিলেন। ১৮৬৯ খ্রি. মোতাবেক ১২৮৭ হি. সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত সুপ্রসিদ্ধ উত্তর মাদার্শা গ্রামে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
বাল্যকাল ও শিক্ষা জীবন: আল্লামা আবদুল (রহ.) শৈশবকাল থেকেই ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেন। নিজের কাছেও তা খুব আকৃষ্ট হয়ে উঠে। বাঙালি মুসলিম ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রথমে নিজ গৃহে পরে মক্তবে গিয়ে কুরআন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ইসলামি জীবন পরিচালনার শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতপর তিনি স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেন। দীনের প্রতি বেশি আগ্রহী হওয়াতে অত্যধিক শিক্ষা লাভের আশায় চট্টগ্রাম শহরের মুহসিনিয়া মাদরাসা (প্রতিষ্ঠা: ১৮৭৪, বর্তমান মুহসিন কলেজ)-এ ভর্তি হয়ে প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে লেখা-পড়া শেষ করেন। তাঁর ছিল জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা, তাই তিনি একাডেমিক পড়া-লেখা শেষ করে লাইব্রেরির দারস্থ হন। কুরআন, হাদীস, ফিকহ, আকাইদসহ বিভিন্ন বিষয়ের নির্ভরযোগ্য পুস্তিকাদি সংগ্রহ করে গবেষণায় একাগ্রচিত্তে নিমগ্ন হন। তিনি নির্ভর যোগ্য কিতাবাদি অধ্যয়ন করে সহীহ আকিদা-বিশ্বাস, প্রমাণিত সুন্নাতসমূহ চর্চার চেষ্টায় থাকেন। ¯^xq সমাজকে সরল পথের দিশা দিতে যথেষ্ট তত্ত্ব-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে কর্ম জীবন অতিবাহিত করার মনস্থ করেন।
কর্মজীবন ও সমাজ সংস্কারে অবদান: তিনি সমসাময়িককালে সমাজ ব্যবস্থাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভঙ্গুর অবস্থায় দেখতে পান, ফলে হৃদয়ে খুব ব্যথা অনুভব হলে এর সংস্কারের পন্থা খুঁজতে থাকেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরছি।
১. মক্তবপ্রতিষ্ঠা: কর্মজীবনের সূচনাতে আল্লামা আবদুল হামিদ (রহ.) খন্দকিয়াতে একটি মক্তব চালু করেন। উক্ত মক্তবে শিশু থেকে বৃদ্ধাদের সহ তিনি পাঠদান করতে থাকেন। এছাড়াও অনেক জায়গাতে মক্তব প্রতিষ্ঠায় নিরলস ভূমিকা পালন করেন। যার ফল এ অঞ্চলের মানুষ আজও ভোগ করছে। এদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ না হলে আজকের মুসলিম সমাজ সহীন কুরআন-হাদিসের শিক্ষা পাওয়া অধিক দুষ্কর বিষয় হতো।
২. দাওয়াত: মানুষের ঘর, মসজিদ, বিভিন্ন জায়গাতে স্বউদ্যোগে ইসলামের মর্মবাণী আহরণ করার জন্য সকলের কাছে দাওয়াত দেন, মানুষকে আল্লাহ অভিমুখী করার চেষ্টা করেন। যেন কুরআনের বর্ণিত আয়াতের প্রতিচ্ছবি তাঁর মাঝে প্রতিফলিত হয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের অনুসরণ করো যারা (দীনের ক্ষেত্রে) বিনিময় দাবি করে না তারাই হেদায়ত প্রাপ্ত।’ (সুরা ইয়াসিন) সকল নবীদেরও একই ভাষ্য ছিল যা করআনে অমর বাণী হয়ে আছে, ‘ঈমানের দাওয়াতের বিনিময়ে আমি পারিশ্রমিক চায় না।’ (সুরা আর-রুম) তাই বলতে পারি এসব মনীষীগণ এ সুন্নত জারি রাখার অদম্য সাহস দেখিয়েছেন।
৩. বিদআত দূরিকরণ: তাঁর সময়কালে তিনি দেখলেন সকল মানুষ বিদআত কুসংস্কার, সামাজিক অবক্ষয়ে নেমে আসছে, তখন এসব কিছুকে দূরীকরণে আবদুল হামিদ (রহ.) বিরাট ধরণের ভুমিকা রাখেন। প্রতিনিয়ত তিনি অভিনব পদ্ধতিতে বিদআতের কুফল, শরীয়তসম্মত আ’মলের সুফলের ধারণা দিতে থাকেন। এতে তিনি অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা পুঁজারী ধর্ম বিকৃতকারী কিছু লোকের সৎ আহবান সহ্য হয়নি বলে তাকে মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। তিনি সুন্নাহর প্রতি জনমত তৈরী করা এবং গনসচেতনতা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এসব কষ্টে তিনি বিচলিত হননি রবং আল্লাহর করআনের বাণী আকড়ে ধরেছেন, ‘আপরাহ্নের শপথ! মুমিন ও যারা সৎকর্ম করে আর সত্যের পথে আহ্বান করে, (দীনের তরে কষ্ট পেলে) ধৈর্য ধারণ করে তারা ব্যতিত মানবকুল মহা ক্ষতিতে নিমজ্জিত।
৪. ছোট্ট পরিসর থেকে দীনী পরিবেশকে বিশাল আকার দেওয়া চিন্তা: আল্লামা আবদুল হামিদ (রহ.) কাজের পরধি কীভাবে বড় করা যায় সে চিন্তায় পড়ে। এই চিন্তার ফলস্বরূপ তিনি নিজ গ্রাম মাদার্শাতে একটি দীনী প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এ খেদমতের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে আল্লামা আবদুল হামিদ (রহ.) ১৯০১ সালে এশিয়া বিখ্যাত তথা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী যার সুনাম খ্যাতি, সেবা সর্বজন স্বীকৃত, যার ফল্গুধারা সর্বত্র বিস্তৃত, উত্তর চট্টলার ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষা নিকেতন, ইলমে নববীর ঝর্ণাধারা দারুল উলুম হাটহাজারীর গোড়াপত্তন করেন। উনার সাথে আরও তিন রত্ন যোগ হয় তারা হলেন, আল্লামা জমির উদ্দীন (রহ.) আল্লামা সুফি আযিযুর রহমান (রহ.) আল্লামা হাবিবুল্লাহ (রহ.) এ চারজন ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠে আজকের দীন হেফাজতের রক্ষাকবচ হাটহাজারী আরবি বিশ্ব বিদ্যালয়।
আরও একটি দীনী এদারা প্রতিষ্ঠা করে যা বর্তমানে জামিয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম ফতেফুর নামে পরিচিত। আল্লাহ এ মহান ব্যক্তির কবরকে নয়নাভিরাম জান্নাতে পরিণত করুন!আমিন। এসব মনীষীদের থেকে নিশ্চয় আমাদের প্রজন্মের অনেক কিছু শিখার আছে, অনুকরণ করার আছে।
৫. সংঘঠন: তিনি ইসলাম প্রচারের মাধ্যমকে শিক্ষা কেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ রাখেন নি, ভিন্নপন্থা হিসেবে তিনি সংঘঠন গড়ে তুলেন। এর মাধ্যমে সামাজিক, ধর্মীয় বিবিধ সেবা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তুলেন। ফটিকছড়িতে দৌলতপুর, মাইজবান্ডার, কোটের পাড় এবং আনোয়ারার বিভিন্ন গ্রামে সংস্থা তৈরী করে দীনের সেবার প্রচার-প্রসার করতে থাকেন।
বিদায়াত উচ্ছেদ: তিনি বিদআত-শিরক, কুপ্রথা-কুসংস্কার, কবর পূঁজা, মাজার পূঁজা ইত্যাদি উচ্ছেদে বিরাট ধরণের অবদান রাখেন। তিনি বিভিন্ন মুনাযিরা তর্কের মাধ্যমে সঠিক ইসলামকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, ফলে অনেক সময় বিদ্বেষমূলকভাবে অবুঝ মানুষদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
৭. আদর্শ জীবন: তিনি আদর্শ তথা নববী সুন্নত অনুরকরনে পরিপূর্ণ চর্চাকারী ছিলেন। তিনি নিজ পোষাক-পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে সফরের যাবতীয় জিনিসপত্রেও সুন্নত অনুসরণ করতেন। সুন্নতই যেন তাঁর প্রাণ।
৮. রচনাসমগ্র: এত ব্যস্ত সময়ের মাঝেও তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন। (ক) তুহফাতুল মুমিনীন, (খ) মাসায়েলে রামাযান, (গ) ফাযায়েলে ঈদগাহ, (ঘ) ফাযায়েলে ইতিকাফ।
৯. অভিনব পদ্ধতিতে দীনী মেহনত: আল্লামা আবদুল হামিদ (রহ.) যখন দীনের দাওয়াত দিতে বের হতেন তখন কেবল খাওয়ার জন্য শোকনো চিড়া নিয়ে যেতেন। কোনো মসজিদে ঈমান-কুরআন-হাদিসের আলোচনার আগে তা পুকুরে ভিজিয়ে রাখতেন, দীনের মেহনত শেষে উক্ত চিড়া খেয়ে আবার ইসলামি বিপ্লবের নেশায় ব্যস্ত থাকতেন। এ কথাগুলো এখনো এ অঞ্চলের মূখে প্রতিনিয়ত শোনা যায়। এভাবেই সুখ-বিলাস ত্যাগ করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনে সদা বিভোর ছিলেন।
১০. জীবিকা অর্জন: রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘দু’হাতের উপার্জনের চেয়ে অধিক উত্তম খাবার আমি খাইনি।’ ঠিক সে হাদিসের আ’মল বাস্তবায়ন করেছেন দেওবন্দর অনুসারী এ আকাবির আল্লামা আবদুল হামিদ রহ। তিনি নিজে চাষাবাদ করতেন। আবার একই সাথে মাদরাসার পাঠদান, সভা-ওয়ায-মাহফিল ইত্যাদিতেও ঈমানী দায়িত্ব পালন করতেন। একমাত্র হালাল জীবিকার জন্য নিজ হাতে জমিতে, ক্ষেতে, মাঠে কাজ করতেন।
১১. চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। সাদামাটা জীবন তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি দুনিয়া বিমূখ, স্বার্থত্যাগী, পরোপকারী আলোকিত সাধক ছিলেন। তিনি মাদরাসা থেকে বেতন ভাতা গ্রহণ, ওয়াজের প্রচলিত টাকা নিতেন না। বরং অনেক কষ্টের বিনিময়ে হাদিয়া গ্রহণ করতেন।
তিনি অমায়িক চত্রিরের মানুষ ছিলেন। জীবনে কারো সাথে তাঁর উচ্চ-বাচ্য হয়েছে এমন নজির নেই বললে ভুল হবে না। সদা সুন্নাতের পাবন্দি করে চলতেন। হাসিমুখে কুশল বিনিময় করতেন এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চলতেন। চলেফেরায় বিনয়ীভাব সদা দৃশ্যমান ছিল এই আল্লাহর অলির মাঝে।
১২. মনীষীদের উক্তি: জিরি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) প্রায় বলতেন, ‘আমরা কেউ আবদুল হামিদের সিকান্দারী জরিপের বাইরে যেতে পারিনি।’ মুফতিয়ে আজম আল্লামা ফয়জুল্লাহ (রহ.) বলতেন, ‘আবদুল হামিদ সমসাময়িক কালের মুজাদ্দিদ ছিলেন।’
মৃত্যু: মহান এ মনীষী ৩১ মার্চ ১৯২০ মোতাবেক ১৩৩৮ হিজরিতে ইহকাল ত্যাগ করেন। তার বংশধর প্রপৌত্র মাওলানা মাহমুদুল হাসান তাঁর প্রতিষ্ঠিত দীনী ইদারার জামিয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম ফতেপুরের পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। আল্লাহ তাআলা এই সফল মনীষীদের জীবন থেকে আদর্শ গ্রহণ করার তাওফিক দিন! আমীন!
শেষকথা: এসব অলিদের জীবন থেকে বর্তমান প্রজন্মের অনেক কিছু নেয়ার আছে, শিখার আছে। আমাদের সমাজের যে অবক্ষয় দিন দিন আমরা অবলোকন করছি; তা থেকে উত্তোরণের পথ হলো আল্লাহর অলিদের তথা রাসূলের আদর্শকে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। ইন শা আল্লাহ তখনই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ভিত মজবুত হবে এবং একটি আদর্শ জীবন পদ্ধতি গড়ে উঠবে।