ভালবাসার নিরঙ্কুশ অধিকার একমাত্র আল্লাহর
আবিদুর রহমান তালুকদার
(ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন। এ ঋতুতে প্রবাহিত হয় প্রাকৃতিক আবহ ও অল্লাহর অনুগ্রহের অনন্ত ফল্গুধারা। মহিমান্বিত ভাষা আন্দোলনের কারণে এ মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম একটি দীনি আন্দোলন। ১৯৫২ সালে এ দেশের এক দল দীনদার শিক্ষবিদের নেতৃত্বে এ আন্দোলনের সূচনা। বাংলা ভাষাভাষী জাতি-গোষ্ঠীর এ আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারী আর্ন্তজতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। পরিতাপের বিষয় হলো, গৌরবের এ মাসকে কলুষিত করার নিমিত্তে দীর্ঘদিন যাবত একটি ঘৃণ্য প্রয়াস লক্ষণীয়। সমাজে অশ্লীলতা প্রচারের সঙ্গে জড়িত একটি অভিশপ্ত গোষ্ঠী নারী-পুরুষের অনৈতিক-অবাধ মেলামেশাকে সামাজিকভাবে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্ঠায় লিপ্ত। ‘ভালবাসা দিবস’ নামে তারা একটি দিবসের প্রবর্তন করে। ইহকাল ও পরকালে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি অবধারিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা মুসলিম সমাজে অশ্লীলতার ব্যাপকতা পছন্দ করে, দুনিয়া-আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আল্লাহ তাআলা যা জানেন তোমরা তা জানো না।’ (সুরা আল-নুর: ১৯) বক্ষমাণ প্রবন্ধে ভালাবাসার স্বরূপ, প্রকৃতি ও অধিকার কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলোচনা করা হয়েছে।)
কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি মনের আকর্ষণ বা টান হলো মহব্বত বা ভালবাসা। ভালবাসার অধিকার অবদানের ভিত্তিতে নির্ণেয়। যুক্তির বিচারে গায়রুল্লাহর প্রতি ভালবাসার নিবেদন এক প্রকারের শিরক। হাদিস শরিফে দুনিয়ার প্রতি ভালাবাসাকে সকল পাপের উপসর্গ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তবে অনুমোদনসাপেক্ষে এটি সীমিত আকারে বৈধ ও নিবেদনযোগ্য। এ ভালবাসা পদে পদে নিয়ন্ত্রিত ও বিধিবদ্ধ। যখনই এটি আল্লাহর মহব্বতে অন্তরায় হয়, অথবা দীনের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার বৈধতা অক্ষতু্ন থাকে না। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ اِنْ كَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَاَبْنَآؤُكُمْ وَاِخْوَانُكُمْ وَاَزْوَاجُكُمْ وَ عَشِيْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ ا۟قْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسٰكِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَيْكُمْ مِّنَ اللّٰهِ وَرَسُوْلِهٖ وَجِهَادٍ فِيْ سَبِيْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰى يَاْتِيَ اللّٰهُ بِاَمْرِهٖؕ ۰۰۲۴
‘যদি তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন, পাড়া-পড়শি, গচ্ছিত ধন-সম্পদ, লোকসানমুক্ত ব্যবসায়-বাণিজ্য ও পছন্দনীয় ঘর-বাড়ী তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রসূল ও জিহাদ থেকে অধিকতর প্রিয় হয়, তবে আল্লাহর শাস্তির অপেক্ষা করো।’[1]
শরীয়তের বিধিমতে কিছু কিছু মহব্বত প্রশংসনীয়, আর কিছু নিন্দনীয়। কিছু ভালবাসা স্বভাবজাত ও সৃষ্টিগত। আর কিছু স্বপ্রণোদিত ও অর্জিত। এক প্রকারের মহব্বত মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় প্রকার ভালবাসার চর্চা কদমার্ক্ত ও কলুষযুক্ত।
ভালবাসা আল্লাহর রহমতের অবিচ্ছেদ্য অংশ
রহমান ও রহিম আল্লাহর মহান দুটি গুণ। ভালবাসা (মাওয়াদ্দাত বা মহব্বত) তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে রহমত শব্দটি উপর্যুক্ত শব্দ দুটি থেকে ব্যাপক অর্থবোধক। যা মানবীয় গুণাবলিরও অংশবিশেষ। রহমতের অংশ হিসেবে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি তার মহব্বত প্রকাশ করেন। তদুপরি সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার মহব্বত একান্ত স্বভাবিক। সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ، قَالَ: «إِذَا أَحَبَّ اللهُ الْعَبْدَ نَادَىٰ جِبْرِيْلَ: إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحْبِبْهُ، فَيُحِبُّهُ جِبْرِيْلُ، فَيُنَادِيْ جِبْرِيْلُ فِيْ أَهْلِ السَّمَاءِ: إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبُّوْهُ، فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ، ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ القَبُوْلُ فِي الْأَرْضِ».
‘আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন জিবরিল (আ.)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি। সুতরাং তুমিও তাকে মহব্বত করো। অতপর জিবরিল আসমানের অধিবাসীদের নিকট এ ঘোষণা প্রচার করে দেন। এতে আসমানের অধিবাসীরা তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। এভাবে পৃথিবীতে তার গ্রহণযোগ্যতার সূচনা হয়।’’[2]
আল্লাহর রহমতের ব্যাপকতা প্রসঙ্গে মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে,
عَنِ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ، يَقُولُ: «جَعَلَ اللهُ الرَّحْمَةَ مِائَةَ جُزْءٍ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعَةً وَتِسْعِيْنَ وَأَنْزَلَ فِي الْأَرْضِ جُزْءًا وَاحِدًا، فَمِنْ ذَلِكَ الْـجُزْءِ تَتَرَاحَمُ الْـخَلَائِقُ، حَتَّىٰ تَرْفَعَ الدَّابَّةُ حَافِرَهَا عَنْ وَلَدِهَا، خَشْيَةَ أَنْ تُصِيْبَهُ».
‘আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমতকে একশ ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি নিজের জন্য ৯৯ টি রেখে দেন এবং একটি রহমত পৃথিবীতে বণ্টন করে দেন। একটি রহমতের কারণে সৃষ্টিজগত পরস্পরের প্রতি মায়া-মমতা ও সম্প্রীতি প্রকাশ করে। যার কারণে জীব-জন্তু নিজ বাচ্ছার ওপর বিপদের আশঙ্কায় স্বীয় পা উপরে তোলে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে।’’[3]
অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, জিন, ইনসান, চতুষ্পদ জন্তু ও কীট-পতঙ্গ আল্লাহ প্রদত্ত একটি রহমতের কারণে পরস্পরের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে থাকে। তবে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য ৯৯ টি রহমত রিজার্ভ রেখেছেন। যা তিনি কিয়ামতের দিন প্রকাশ করবেন। সুরা আল-রুমের ২১ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنْ اٰيٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَيْهَا وَ جَعَلَ بَيْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَّ رَحْمَةً١ؕ اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّقَوْمٍ يَّتَفَكَّرُوْنَ۠۰۰۲۱
‘তাঁর একটি নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তেমারা তাদের নিকট শান্তি লাভ করো। তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা (মাওয়াদ্দাত) ও (রহমত) মায়া-মমতা দান করেছেন।’[4]
আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর প্রতি মহব্বত একটি মৌলিক ইবাদত
আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.) এর প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করা একটি মৌলিক ইবাদত। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর এটি ফরযে আইন। যা ইমানের একটি পূর্বশর্তও বটে। গাইরুল্লাহ’র প্রতি অবাধ আকর্ষণ ও অনৈতিক ভালবাসার নিন্দায় আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ اَنْدَادًا يُّحِبُّوْنَهُمْ۠ كَحُبِّ اللّٰهِ١ؕ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اَشَدُّ حُبًّا لِّلّٰهِ١ؕ وَلَوْ يَرَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْۤا اِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ١ۙ اَنَّ الْقُوَّةَ لِلّٰهِ جَمِيْعًا١ۙ وَّاَنَّ اللّٰهَ شَدِيْدُ الْعَذَابِ۰۰۱۶۵
‘কতিপয় মানুষ আল্লাহর প্রতিপক্ষে কিছু অংশিদার সাব্যস্ত করেছে। সে সকল শরিকদের প্রতি তাদের ভালবাসা ঠিক আল্লাহকে ভালবাসার অনুরূপ। আর মুমিনগণ ভালবাসার ক্ষেত্রে আল্লাহকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।’[5]
বুখারী ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ h، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ^ قَالَ: «فَوَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ، لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّىٰ أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ».
‘আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কখনো মুমিন হতে পারো না, যতক্ষণ না পিতা-মাতা, ছেলে-সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে আমার ভালবাসা তোমাদের অন্তরে বেশি না হয়।’’[6]
পিতা-মাতা ও সন্তানের পারস্পরিক মহব্বত সহজাত ও জন্মগত
সহজাত বা সৃষ্টিগত ভালবাসা হলো পিতা-মাতা ও সন্তানের পারস্পরিক মহব্বত। যা মানুষের স্বভাবের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রধান কারণ ও এক প্রকারের ইবাদত। আল্লাহ তাআলা মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের ভালবাসাকে নিজের আনুগত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি বলেন,
وَقَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ۠ اِحْسَانًاؕ ۰۰۲۳
‘তোমার রব এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না। আর মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ করো।’[7]
মাতাপিতার প্রতি সন্তানের মহব্বত তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নিবেদিত। আবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার সহজাত ভালবাসার কোনো তুলনা হয় না। এ বিবেচনায় সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও পালনকর্তা হিসেবে আল্লাহর প্রতি বান্দার মহব্বত জন্মগত ও স্বভাবগত হওয়াই ছিল বাঞ্চনীয়। কিন্তু বান্দার স্বাধীন সত্ত্বার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা এটি বান্দার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। একটি মৌলিক ইবাদত হিসেবে আল্লাহ তাআলা এটি জিন-ইনসানের ওপর চাপিয়ে দেননি। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মাখলুকের ভালবাসা একান্ত ইচ্ছাধীন। ইবাদতের অংশ হিসেবে এটি র্চচা ও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। মাতা-পিতার প্রতি মহব্বত ইবাদতের অংশ হলেও এটিকে মানব স্বভাবের অংশীভূত কারর নেপথ্য কারণ হলো, কঠিন বিষয়ের সহজিকরণ এবং মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বস্তুকে সহজলভ্য করা আল্লাহর বিধিবদ্ধ নীতি। শরীয়ত বান্দার ওপর সাধ্যাতীত কোনো বিধান প্রবর্তন করেনি। তবে তুলনামূলকভাবে কঠিন হুকুম পালনে বান্দার অপারগতার কারণে শরীয়তের শাস্তি অত্যন্ত লঘু। সহজ বিধান পালনে অবহেলার অপরাধেই দণ্ডবিধি কার্যকর হয়। মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ সন্তানের স্বভাবের অংশ হওয়া সত্ত্বেও কেউ এতে অবহেলা করলে তার জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এবং মাতা-পিতার প্রতি অবাধ্য হওয়াকে ৭টি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পরিবার-পরিজনের প্রতি
ভারসাম্যপূর্ণ ভালবাসা
এ ভালবাসা সহজাত হলেও ক্ষেত্রবিশেষে চর্চানির্ভর। মানুষ সাধারণত স্ত্রী-সন্তানের প্রতি অন্তরের বিশেষ টান বা আকর্ষণ অনুভব করে। আবার স্ত্রী-পরিজন সুদর্শন, ধার্মিক অথবা সৎগুণাবলিসম্পন্ন হলে তার মাত্রা হয় আরো বর্ধিত। তেমনিভাবে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার মায়া-মমতাও জন্মগত। কোনো সন্তানের প্রতি পিতার অত্যধিক মহব্বত অথবা একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অন্তরের বিশেষ টান দোষণীয় নয়। পরিবারের সদস্য বা স্ত্রীর-পরিজনের প্রতি ভালবাসা সহজাত হওয়ার কারণে এটি কারো আয়ত্বাধীন থাকে না। তবে সুযোগ-সুবিধা ও লেন-দেনসহ যে সকল বিষয় মানুষের একান্ত আয়ত্বাধীন, সেখানে কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়াই হলো অপরাধ। এমন ঘটনা স্বয়ং রসূল (সা.)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَقْسِمُ بَيْنَ نِسَائِهِ، فَيَعْدِلُ. قَالَ عَفَّانُ: وَيَقُوْلُ: «هَذِهِ قِسْمَتِيْ»، ثُمَّ يَقُوْلُ: «اللَّهُمَّ هَذَا فِعْلِيْ فِيْمَا أَمْلِكُ، فَلَا تَلُمْنِيْ فِيْمَا تَمْلِكُ وَلَا أَمْلِكُ».
‘আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) স্ত্রীদের মাঝে ন্যায়পরায়নতার সঙ্গে রাত যাপনের পালা বণ্টন করার পর বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার আয়ত্বাধীন বিষয়ে সমতা ও ইনসাফ রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যে বিষয়টি (মনের টান) আমার আয়ত্বাধীন নয়, তাতে সমতার ক্ষেত্রে ত্রুটি হলে আমাকে ক্ষমা করবেন।’’[8]
ইমাম নাসায়ী ও হাকিম বর্ণনা করেন,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: «مَنْ كَانَ لَهُ امْرَأَتَانِ يَمِيْلُ لِإِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَدُ شِقَّيْهِ مَائِلٌ».
‘আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যার দুটি স্ত্রী আছে। তাদের মধ্যে কারো প্রতি একপেশে আচরণ করলে, কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার একটি অঙ্গ এক পাশে হেলে পড়বে।’’[9]
সন্তানের প্রতি ন্যায়বিচার বিষয়ে তিনি ইরশাদ করেন,
عن مُحارِبِ بنِ دِثارٍ؛ قَالَ: سَمِعْنَا النعمانَ بنَ بَشيرٍ وهو يَخطُبُ على المنبرِ؛ قال: تصدَّق عليَّ أبي بصدقةٍ، فقالت عَمرةُ بنتُ رواحةَ– وهي أمُّ النعمانِ: لا أرضى حتى تُشهِدَ عليها رسولَ اللهِ ﷺ. فأتى بَشيرٌ رسولَ اللهِ ﷺ فقال: إني تصدّقتُ على ابني بصدقةٍ، فقالت عَمرةُ بنتُ رواحةَ– وهي أمُّ النعمانِ: لا أرضى حتى تُشهِدَ عليها رسولَ اللهِ ﷺ؛ قال: «لَكَ بَنُونَ غَيْرُهُ؟» قال: نعم. قال: «فَكُلَّهُمْ أَعْطَيْتَ مِثلَ الَّذِي أَعْطَيْتَ هَذَا؟» قال: لا. قال: «هَذَا جَوْرٌ؛ فَلا تُشْهِدْنِي عَلَيْهِ. اتَّقُوا اللهَ وَاعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلادِكُمْ كَمَا تُحِبُّونَ أَنْ يَبَرُّوكُمْ» . قال: فرجع أبي في صدقتِه.
‘নু’মান ইবনু বশির মিম্বরে খুতবা প্রদানরত অবস্থায় বলেন, আমার বাবা আমাকে একটি বিশেষ উপঢৌকন দিলেন, নু’মানের মা ওমরা বিনতু রাওয়াহা বলেন, রসূল (সা.)-এর অনুমোদন ছাড়া এটি আমি মানতে পারি না। তিনি রসূল (সা.) এর নিকট বিষয়টি উত্থাপন করলেন, রসূল (সা.) বললেন, আপনার কি এছাড়াও আরো সন্তান আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রসূল (সা.) বললেন, তাদেরকেও কি আপনি অনুরূপ দাক্ষিণ্য প্রদান করেছেন? বললেন, না। রসূল (সা.) বললেন, এটা এক প্রকার জুলুম। এমন অন্যায় কাজে আমাকে সাক্ষ্য না রাখাই উত্তম। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মাঝে বৈষম্যহীন ও ইনসাফ-পূর্ণ আচরন করো। যেভাবে তাদের নিকট থেকেও তোমরা বৈষম্যহীন আচরণ আশা করো।’[10]
যুবক-যুবতীর অনৈতিক ভালবাসা
যাদের সঙ্গে বিয়ে-শাদি বৈধ, তাদের প্রতি ভালবাসার নিবেদন শুধুমাত্র হারামই নয়; এমন পরিবেশে সহাবস্থানও হারাম। কোনো নারী-পুরুষের অন্তরে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুর্ঘটনাক্রমে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হলে তাদের করণীয় হলো, আল্লাহর ভয়ে দৃষ্টি অবনত রাখা এবং গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। সুযোগ ও সামর্থ সাপেক্ষে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। অন্যথায় নিজের মনকে নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্ঠা করা। যাতে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা যায়। এ ক্ষেত্রে সে সবর ও ধৈর্যধারণের পুরষ্কার লাভ করবে। আল্লাহর ভয়ে পাপ-পঙ্কিলতার পথ থেকে ফিরে আসাই হলো সবর। কুরআন-সুন্নাহে সবরের পুরষ্কার হলো সব আমলের চেয়ে অধিক। হাদিস শরিফে এ বিষয়ে ধৈর্যধারণকারীদের শহিদের মর্যাদা দান করা হয়েছে এবং তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। হাদিসটি ইবনু আব্বাস (রাযি.) থেকে মওকুফ (موقوف) এবং আয়িশা (রাযি.) থেকে মরফু’ ((مرفوع বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইবনু তাইমিয়া আমরাযুল কুলুব কিতাবে খতিব বাগদাদি এর বরাতে হাদিসটি বর্ণনা করেন, হাদিসটি নিম্নরূপ:
«مَنْ عَشِقَ وَكَتَمَ وَعَفَّ وَصَبَرَ غَفَرَ اللهُ لَهُ وَأَدْخَلَهُ الْـجَنَّةَ».
‘কোনো নারী-পুরুষ কারো প্রতি অকৃষ্ট হবার পর যদি তা গোপন রাখে এবং সততার পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’
আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘কোনো নারী-পুরুষ কারো প্রতি প্রেমাসক্ত হবার পর যদি তা গোপন রাখে এবং সততার পথ অবলম্বন করে মৃত্যুবরণ করে, সে শহিদের মর্যদা লাভ করবে।’
এ হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধের ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের বিপরীতধর্মী আলোচনা লক্ষ করা যায়। মুহাদ্দিসদের একটি অংশের পর্যালোচনায় আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযি.) বর্ণিত মওকুফ হাদিসটি যয়িফ হলেও আয়িশা (রাযি.) বর্ণিত হাদিসটি সহিহ হওয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার লাভ করে। ইমাম যারকাশি আল-তাযকিরা কিতাবে হাফিয বুরহানুদ্দিন আল-বিকায়ী আসওয়াকুল উশশাক’ কিতাবে এবং হাফিয আলাউদ্দিন মুগলাতায়ী الواضح المبين في ذكر من استشهد من المحبين কিতাবে বিশুদ্ধতার দিকটি প্রধান্য দেন। ইমাম যুরকানী المقاصد الحسنة গ্রন্থে হাদিসটি হাসান বলে অভিমত প্রকাশ করেন। বিশিষ্ট হাদিস গবেষক ও মিসরীয় মুহাদ্দিস আবুল ফয়েয আল-গুমারী (১৩২০-১৩৮০ হি.) হাদিসটির ওপর নাতিদীর্ঘ গবেষণাপূর্বক তার বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছেন। তিনি درء الضعف عن حديث من عشق فعف (مَنْ عَشِقَ وَكَتَمَ فَعَفَّ শীর্ষক হাদিসটির দুর্বলতা প্রতিরোধ) নামে ১৪০ পৃষ্ঠার একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রণয়ন করেন।[11]
এ হাদিসের ওপর আবু আবদুর রহমান ইবনু আকিল আয-যাহিরীও একটি গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেন। তিনি মরফু হাদিসটি যয়িফ এবং মওকুফ হাদিসটির বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছেন। মুহাদ্দিসগণের অভিমত হলো, হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধ যাই হোক না কেনো, মূলত এখানে মর্যাদাটি হলো ধৈর্য ও সবরের। আল্লাহর ভয়ে ও নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদপূর্বক সে এ মর্যাদায় উপনিত হয়েছে। আল্লাহর ভয়ে পাপকর্ম থেকে ফিরে আসার একমাত্র পুরষ্কার হলো জান্নাত। অর্থের বিবেচনায় হাদিসটির বিশুদ্ধতায় কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবের সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং নিজের নফসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, জান্নাতই হলো তার ঠিকানা।’ (আল-নাযিআত: ৪০) অন্য আয়াতে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি তার রবের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দুটি জান্নাত।’ (আল-রহমান: ৪৬)
যুবক-যুবতীর অবৈধ ভালবাসার ক্ষেত্রে করণীয়
নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ সৃষ্টি হলে তাদের পারস্পরিক বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াই হলো উত্তম ব্যবস্থা। ইমাম ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «لَـمْ نَرَ – يُرَ – لِلْمُتَحَابَّيْنِ مِثْلُ النِّكَاحِ».
‘ইবনু আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বা অন্তরের ভালবাসা সৃষ্টি হলে, তাদের উত্তম চিকিৎসা হলো, উভয়ের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করা।’’[12]
কোনো নারী-পুরুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি আকর্ষণবোধ করা এক প্রকারের মানসিক রোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রূপ-লাবণ্যের মোহে এ রোগে আক্রান্ত হয়। এমন রোগে সাধারণত ঐ সকল মানুষই আক্রান্ত, যাদের অন্তর আল্লাহর মহব্বত-শুন্য থাকে। ভালবাসা নামের এ সকল মনোরাগ এক প্রকারের জটিল ব্যাধী। যার নিরাময়ে ইসলামি শরীয়ত বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের চেষ্টাসহ দৃষ্টি অবনত রাখা, এ বিষয়ে চিন্তামগ্নতা পরিহার করা, সামর্থসাপেক্ষে বিয়ে করা। অন্যথায় রোযা পালন করা।
লেখক: পিএইচ-ডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[1]. আল-কুরআন, সুরা আত-তাওবা, ৯: ২৪
[2]. বুখারী: সহিহ আল-বুখারী (বাংলাদেশ: মুওয়াসসাসা আল-ইসলামিয়া, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৫ হি.), পৃ. ১৪, খ. ৮, হাদিস: ৬০৪০
[3]. মুসলিম: সহিহ মুসলিম (বৈরুত: দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবি, সম্পাদনা: মুহাম্মদ ফুয়াদ আবদুল বাকি), খ. ৪, পৃ. ১৭, হাদিস: ২৭৫২
[4]. আল-কুরআন, সুরা আর-রুম, ৩০:২১
[5]. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৬৫
[6]. বুখারী: সহিহ আল-বুখারী (বাংলাদেশ: মুওয়াসসাসা আল-ইসলামিয়া, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৫ হি.), খ. ১, পৃ. ১৯, হাদিস: ১৩
[7]. আল-কুরআন, সুরা আল-ইসরা, ১৭:২৩
[8]. আহমদ ইবনু হাম্বল: মুসনদ (বৈরুত: মুওয়াসসাসা আল-রিসালা, প্রথমসংস্করণ, ১৪২১/২০০১), খ. ৪২, পৃ. ৪৬, হাদিস: ২৫১১১
[9]. নাসায়ী: সুনানুন নাসায়ী (হালাব: মাকতাব আল-মাতবুআত আল-ইসলামিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৬ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ৬৩, হাদিস: ৩৯৪২
[10]. আল-তাবরানি: আল-মু’জাম আল-কবীর (প্রথম সংস্করণ, ২০০৬ খ্রি.), খ. ২১, পৃ. ৮০, হাদিস: ৭৬
[11]. আলগুমারী, আহমদ ইবনে সিদ্দিক: দারউদ দুফ আন হাদিসি মান আশিকা ওয়া কাতামা ওয়া আফফা (কায়রো: দারুল মুসতাফা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯২, পৃ. ৭
[12]. ইবনু মাজাহ: সুনান ইবনু মাজাহ (দারু আল-রিসালাহ আল-আলামিয়া: প্রথম সংস্করণ, ২০০৯ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৫৪, হাদিস: ১৮৪৭