জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-১১ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

 

প্রাচীন সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান মানুষ ও মানবতার জাগরণে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় উল্লেখযোগ্য অবদানের মাধ্যমে দেশের কল্যাণ ও শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। বাঙালি মুসলমানরা কখনোই তাদের ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাকে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনায় নেয়নি। বরং এ অঞ্চলের মুসলিম কবি, লেখক, গবেষক ও সাহিত্য গ্রষ্টাদের অবদানে আজ আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এতটা সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে রূপ নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তা প্রকৃত প্রস্তাবে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামল থেকে। গুপ্তদের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, পাল ও সেন আমলে সে ধারা অব্যাহত থাকে। তবে বাংলা দেশের ¯^vaxb শাসক পালদের আমলে দেশীয় ভাষা হিসেবে প্রথম বাংলার চর্চা শুরু হয়। বাংলা দেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে ¯^vaxb পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পরবর্তীকালে সেন আমলে বাংলা ভাষার চর্চা না হলেও এ ভাষার নিজস্ব সত্তা একেবারে লোপ পায়নি। অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের আগমনের পর মুক্ত পরিবেশে সাধারণের মুখের ভাষা বাংলার ব্যাপক চর্চার সুযোগ ঘটে। সে হিসেবে বাংলা ভাষা-সাহিত্য তথা তাবত বাঙালির জন্য ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ এক মহা ঐতিহাসিক ক্ষণ। তুর্কি মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বঙ্গদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলমান শাসক হুসেন শাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলিম সম্রাটরা বাংলা ভূখণ্ডে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এসব ইতিহাস সামনে রেখে দীনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, ‘মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বললে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গ-ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।’

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আজকে যে সুবিস্তৃত ও দিগন্তব্যাপী ঔজ্জ্বল্য, এই যে জগৎজোড়া খ্যাতি ও সমৃদ্ধি সৌরভে সমুজ্জ্বল, তার স্থপতি নির্ণয়ে আমাদের যেতেই হয় বাংলার সুলতানি আমলে। আর সেই সুলতানি আমলই হচ্ছে বাংলার সোনালি যুগ। সে যুগ যেমন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সোনালি ছিল, তেমনি সামাজিক দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শান্তি ও সমৃদ্ধির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়েও ছিল সোনালি যুগ; তেমনিভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও সোনালি যুগ ছিল সেটি। বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় সুলতানগণ বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেন, তা স্বাধীন ইলিয়াস শাহি সালতানাত নামে দীর্ঘ দুইশ’ বছরের অধিককাল স্থায়ী ছিল। এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক বিস্তার ঘটে। বাংলা সাহিত্যের এই বিস্তারের নব নব অধ্যায় পরবর্তীকালেও নির্মিত হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলিম কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার কদর সমুম্নত রাখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে নযুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশে ন যায়। ‘ সেকালের অন্যান্য মুসলিম কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শেখ ফয়জুল্লাহ, শাহ গরীবুল্লাহ, শেখ চান্দ, সৈয়দ আলাওল, নওয়াজিস খান, সৈয়দ মুহম্মদ আকবর, আলি রজা, দৌলত কাজী, মুহম্মদ কবির, দোনাগাজী চৌধুরী, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মামুদ, দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তদানীন্তন মুসলিম কবিরা ধর্মান্ধতা ও তৎকালীন মোল্লাতন্ত্রের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে নির্দ্‌িবধায় মাতৃভাষা বাংলাতে ধর্মকথা লিখে গেছেন। বড়ূ চন্ডীদাসের সমসাময়িক শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা তদানীন্তন বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে রামায়ণ ও মহাভারতের স্থান অধিকার করে নেয়। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা নিবেদন করে সগীর জানান, দশুনিয়াছি মহাজনে কহিতে কখন/ রতন ভান্ডার মধ্যে বচন সে ধন/বচন রতন মণি যতনে পুরিয়া/প্রেমরসে ধর্মবাণী কহিমু ভরিয়া। ‘নিজ ভাষা বাংলার প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে নবী-ভস্‌ট্ম, রসুল-বিজয়, ইবলিস-নামা, শব-ই-মিরাজ প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা আরেক মুসলিম কবি সৈয়দ সুলতানের কবিতায়: ‘কিন্তু যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন/ সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন।’

মোটকথা বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশে মুসলমান লেখকদের বাংলা সাহিত্যে অবদান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস বাংলা সাহিত্য, কাজী আবদুল মান্নানের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মুসলিম বাংলা সাহিত্য, গোলাম সাকলায়েনের মুসলিম সাহিত্য সাহিত্যিক, পূর্বপাকিস্তানের সুফী-সাধক প্রভৃতি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত|

বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্যচর্চা অনেক আগে থেকে শুরু হলেও মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং বিংশ শতকের শুরুতে মুসলমানদের সাহিত্য সাধনার নবতর ধারা সূচিত হয়। এ সময়ে মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা অনবদ্য অবদান রেখেছেন, তাদের কয়েকজন হলেন-কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪ খ্রি.), শেখ ফজলল করিম (১৮৮২-১৯৩৬ খ্রি.), আব্বাসউদ্দীন (১৯০১-১৯৫৯ খ্রি.), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১ খ্রি.), কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১ খ্রি.), মুন্সি মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭ খ্রি.), মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০ খ্রি.) ও মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৯ খ্রি.) প্রমুখ। তাদের রচিত সাহিত্যে সমাজ সংস্কারের চিন্তা-চেতনা, জাতীয় ঐতিহ্যের ধ্যান-ধারণা, আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান প্রতিফলিত হয়।

এ সময়ের মুসলমানদের রচিত সাহিত্যে ইসলামের মানবতাবাদ, সম্প্রীতি ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। এ দেশের নবপ্রজন্মের গবেষকদের কাছে আমাদের তাগিদ হলো উল্লিখিত কিংবদন্তি মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের কাব্য ও সাহিত্যচর্চার প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোকে বর্তমান প্রজন্মের বৃহত্তর স্বার্থে তুলে ধরা এবং ইসলামের সত্যিকার সর্বজনীন রূপটিকে জনসমক্ষে পরিস্টম্ফুট করা।

লেখক গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ