পাপ ও অপরাধ নিয়ে সেক্যুলার ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক আলোচনা
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
[পাপ ও অপরাধের পার্থক্য প্রসঙ্গে একটা ফেইসবুক নোটের ওপর এটি একটি ঘরোয়া আলোচনা। পাপ ও অপরাধ, এ দুটো আলাদা ব্যাপার। পাপের বিচার করবেন স্রষ্টা। আর অপরাধের বিচার করবে মানুষ তথা মানুষের সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রতিষ্ঠান। এই আলোচনাতে দেখানো হয়েছে, এটি হচ্ছে সেক্যুলার প্যারাডাইম উদ্ভূত ধারণা। ইসলামি প্যারাডাইমে পাপ ও অপরাধ স্বরূপত অভিন্ন। সব অপরাধই পাপ। সব পাপই অপরাধ। তবে ইহকাল ও পরকালের ভাগাভাগি এবং কর্মসম্পাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তা হিসেবে মানুষ ও খোদার জুরিসডিকশান, এরিয়াগত স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পর্কের কারণে মানুষ কেবলমাত্র অপরাধের বিষয়েই কনসার্ন হয়, হতে পারে এবং হওয়া উচিত।]
অনিরুদ্ধ অনিক নামে একজন ‘ইসলামিক থিয়লজিতে পাপ ও অপরাধ’ শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেছেন। এ আর্টিকেলটিতে তিনি দেখিয়েছেন, যেগুলো হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক, সেগুলো পাপের বিষয়। আর যেগুলো হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক, সেগুলো অপরাধের বিষয় হতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহর হক যদি নষ্ট করা হয়, তাহলে পাপ হবে। আর যদি বান্দার হক নষ্ট করা হয়, তাহলে সেটা অপরাধ হবে। আল্লাহর হক যখন নষ্ট করা হয়, তখন অনুশোচনার মাধ্যমে আমরা তওবা করে সেটার রেমেডি পেতে পারি। আর বান্দার হক নষ্ট করা হলে আইনের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
পরবর্তীতে তিনি বলেছেন, একটি ঘটনা একই সাথে অপরাধ এবং পাপ দুটিই হতে পারে।
তারপর তিনি লিখেছেন, একজন মানুষ নামায আদায় করলো কি না, রোযা রাখলো কি না, এগুলো আদায় না করলে যে পাপ হয়, থিওলজি অনুসারে তা বিচারের দায় কেবল আল্লাহর এবং তা হবে পরকালে। মানুষ বড়জোর তাকে উপদেশ দিতে পারে। দুনিয়ার কোনো বান্দার ক্ষমতা নেই এ পাপের বিচার করার। মতাদর্শিক সন্ত্রাসীরা মূলত এ কাজটি করার চেষ্টা করে। যেটি প্রকারান্তরে দুনিয়ায় আল্লাহর খেলাফতের ভুল বা সংকীর্ণ অর্থ বুঝ নিয়ে God play তথা আল্লাহর ওপর আল্লাহগিরি করার মতো ব্যাপার (নাউযু বিল্লাহ)।
তারপর তিনি মানুষের পারসোনাল প্রাইভেসি নিয়ে লিখেছেন, পারসোনাল বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নিয়ে কথা বলা ইসলামের থিওলজি বিরুদ্ধ। এখানে হযরত ওমর (রাযি.)-এর একটা ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, একজন ব্যক্তি তার নিজের ঘরে একটা অপরাধ করছিলো। সেটা দেখে হযরত ওমর (রাযি.) তার বিচার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিটি উল্টো হযরত ওমর (রাযি.)-কে দোষারূপ করে বসলো যে, তিনি তার প্রাইভেসি নষ্ট করেছেন।
তারপর তিনি লিখেছেন, কোনো মুসলিমের অধিকার থাকতে পারে না কুরআন পড়তে না পারার কারণে কোনো নন-মুসলিমকে গলা কেটে হত্যা করার। তারপর লিখেছেন, সন্তানের মাথার মোরাল গ্যাপের জায়গাটাকে কেউ যেন ধর্মের নাম দিয়ে, অধর্ম দিয়ে সেজন্য শৈশবেই তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিন।
এই হচ্ছে সাদামাটাভাবে আর্টিকেলটির মূলকথা। এখানে দেখানো হয়েছে, আসলে পাপ ও অপরাধ দুটি আলাদা জিনিস।
পাপের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে এবং অপরাধের সম্পর্ক বান্দার সাথে সাদামাটাভাবে এটুকু ঠিকই আছে। কিন্তু সমস্যা হলো যখন আমরা বলি, এটি হচ্ছে পাপ এবং এটি হলো অপরাধ। এভাবে যখন আমরা অনেকটা সাদাকালো বাইনারির মতো ব্যাপারটাকে দেখি, তখনই সমস্যা। এক্ষেত্রে সেক্যুলার প্যারাডাইমের অবস্থান হলো ব্যক্তির অনৈতিক কাজ যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজকে এফেক্ট না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ব্যক্তির কোনো অনুচিত কাজ যদি সমাজ বা রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন সমাজ বা রাষ্ট্রের আইন সেখানে প্রযোজ্য হবে।
ইনফ্যাক্ট, আপনার কি মনে হয়, সেক্যুলার প্যারাডাইমে পাপ বলে কিছু আছে? ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে পাপ বা পাপবোধ থাকবে কেন?
শ্রোতা: ধর্মটা তো বিশ্বাসের ব্যাপার। ওরা যেটা বিশ্বাস করছে, সেটাও তো ওদের একটা ধর্মই তো!
আমি: সেক্যুলারিজম একটা ধর্ম, নাকি? সেক্যুলারিজম!
শ্রোতা: না, মানে, ওটা তো ওদের একটা বিশ্বাস। আমরা যেমন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস রাখছি, কেউ কেউ যেমন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস রাখছে, তেমনি ওটাও তো ওদের একটা বিশ্বাস। তো, ওখানেও তো ভালো-খারাপের ধারণা থাকবে।
আমি: হ্যাঁ, ভালো-খারাপের ধারণা তো থাকবেই। কিন্তু যখন আমরা পাপ ধারণাটির (sin) কথা বলি, তখন সেটি তো!
শ্রোতা: পাপ তো কেবল পরকালের সাথে রিলেটেড।
আমি: এ জন্য সেক্যুলার সমাজে পাপের ধারণা থাকার কথা নয়। তাই না? তবে সেক্যুলার সমাজে নৈতিকতার ধারণা থাকবে। নৈতিকতাকে যখন সমাজ বা রাষ্ট্রশক্তি কোয়ান্টিফাই করে যে, এই পরিমাণ আচরণ হলে তা নৈতিক হবে, বা না হলে তা অনৈতিক হবে; অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কোয়ান্টিটির বাইরে গেলে সমাজ সেটিকে আইন হিসেবে দেখে। নৈতিকতার সবগুলো বিষয় তো সাধারণত আইনের বিষয় নয়। যদিও একদৃষ্টিতে আইনের বিষয়গুলো এক ধরনের নৈতিকতারও ব্যাপার। তবে আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ফারাক আছে, এক ধরনের কনফ্লিক্টও আছে।
তাহলে সেক্যুলার সমাজে আইন ও নৈতিকতার ধারণা থাকবে, তবে পাপের ধারণা থাকবে না। পাপের ধারণা থাকবে নন-সেক্যুলার সমাজে। আমরা একটি ইসলামি সমাজ বা ধর্মীয় সমাজের কথাই ধরি, যেখানে পাপ হচ্ছে আল্লাহর দিক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার, আর অপরাধ হলো সমাজের দিক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। যদি তাই হয়, তাহলে সেক্যুলার সমাজে পাপের ধারণা থাকার কথা নয়। রাষ্ট্র ইনভলভ হবে অপরাধের সাথে, পাপের সাথে নয়। তাহলে কেউ নামায না পড়লে তা পাপ হিসেবে গণ্য হবে, অপরাধ হিসেবে নয়। আবার কেউ যদি যাকাত আদায় না করে, তাহলে তা একইসাথে পাপ ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে!
শ্রোতা: আচ্ছা, স্যার! একেক দেশে তো একেক রকম নিয়ম। যেমনথ আমাদের দেশে নামায না পড়লে সরকার হস্তক্ষেপ করছে না, কিন্তু সৌদি আরবে করছে। তাহলে ওই দেশে পাপীদের ক্ষেত্রে কেন সরকার হস্তক্ষেপ করছে?
আমি: হ্যাঁ, এই আর্টিকেলে লেখক সেটিই বলার চেষ্টা করেছেন যে, পাপের বিষয়গুলো তো আল্লাহ পরকালে বিচার করবেন এবং পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন। সেজন্য পাপের বিষয়গুলোকে নিয়ে রাষ্ট্রের কনসার্ন হওয়া বা কাউকে শাস্তির আওতায় আনা অথবা বাধ্য করা আদৌ উচিত নয়। তাতে করে কী হলো? যে ইবাদতটি আমার আল্লাহর ভয়ে করার কথা, সেটি আমি সরকারের ভয়ে করছি। এতে করে মূল ব্যাপারটিই কম্প্রোমাইজ হয়ে গেলো। সে জন্য রাষ্ট্রের দিক থেকে পাপের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য বলা হচ্ছে। রাষ্ট্র শুধু অপরাধের বিষয়গুলো দেখবে। আর অপরাধের বিষয় হচ্ছে যেগুলো হক্কুল ইবাদ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক নষ্ট করা কি পাপের কাজ নয়? দুনিয়াতে কিন্তু সব পাপের শাস্তি হচ্ছে না। যে পাপগুলো আমাদের সামাজিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শুধু সেগুলোরই শাস্তি হচ্ছে।
এটুকু পর্যন্ত আলোচনা করলে আমাদের কাছে মনে হয় যেন আর্টিকেলের বক্তব্য ঠিকই আছে। এখানে যাদেরকে চরমপন্থী বলা হচ্ছে, তারা কী করছে? তারা পাপের বিষয়গুলোকে অপরাধ হিসেবে ধরছে এবং সমাজের ওপর তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। এটি হচ্ছে এই আর্টিকেলের বক্তব্য।
প্রাথমিকভাবে এ কথাগুলোকে আমার কাছে ঠিকই বলে মনে হয় আরকি। কিন্তু আমি যে বলেছিলাম, এই আর্টিকেলটির ক্রিটিক করবো সেটি হচ্ছে, আমরা যদি একটা সেক্যুলার সমাজ ব্যবস্থার দিক থেকে দেখি, যেখানে পাপের ধারণা থাকবে না। এর পরিবর্তে থাকবে নৈতিক চেতনা। তুমি যদি তোমার উদ্বৃত্ত সম্পদ বিলিয়ে দাও, যেভাবে বিল গেটস তার উদ্বৃত্ত সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছে মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে, সেটা ভালো। কিন্তু না দিলে? সে যদি বলে, আমি শুধু সরকারকে ট্যাক্স দেবো, এর বাইরে আর কোনো কিছু দেবো না। তাহলে বোঝা গেলো, আইন তাকে বাধ্য করছে না। কিন্তু নৈতিকতার দৃষ্টিতে, আমরা বলছি, তার জন্য এটি ঠিক নয়। কারণ এত সম্পদ দিয়ে সে কী করবে? তাই না?
সে জন্য সেক্যুলার সমাজব্যবস্থার মধ্যে পাপের ধারণা থাকবে না। কারণ এখানে তো সমাজটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষভাবে। তাহলে ধর্ম যেখানে নেই, সেখানে ঈশ্বর বা খোদার কাছে জবাবদিহিতাু এসব প্রসঙ্গও সেখানে থাকবে না। তবে সেখানে নৈতিকতার প্রসঙ্গ থাকবে। নৈতিকতা ও আইনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া, বৈপরিত্য, সমন্বয়, সম্পর্ক ইত্যাদি প্রসঙ্গ থাকবে। তাহলে রাষ্ট্র বা সরকার কনসার্ন হবে তার লিগ্যাল আসপেক্ট থেকে, মোরাল আসপেক্ট থেকে নয়। রাষ্ট্র মোরাল আসপেক্ট ডেভেলপ করার জন্য কন্ট্রি বিউট করবে, কিন্তু কেউ যদি হাই-লেভেল মোরালে না চলে লো-লেভেল মোরাল মেনে চলে, তাহলে তাকে সরকার এ জন্য কোনো শাস্তির সম্মুখীন করবে না।
কিন্তু একটা ধর্মভিত্তিক সমাজের মধ্যে বা আমরা যদি একটা ইসলামি সমাজের কথা বলি, সেখানে কিন্তু পাপের ধারণা থাকবে। পাপ ও অপরাধ উভয় ধারণাই থাকবে। তাহলে সেক্যুলার প্যারাডাইমের মধ্যে প্রাইভেট ও পাবলিকের যে ডিস্টিংশন, সেটি ইসলামি প্যারাডাইম বা ইসলামি সমাজের মধ্যে কতটুকু প্রযোজ্য?
প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়, ইসলামি সমাজের মধ্যেও এগুলো প্রযোজ্য। এই আর্টিকেলে হযরত ওমর (রাযি.)-এর যে ঘটনাটির উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি একজনের ঘরের ভেতরে ঢুকে তাকে মদপান করতে দেখলেন এবং তাকে শাস্তির আদেশ দিলেন। তখন সেই ব্যক্তিটি বললো, অনুমতি ছাড়া আমার ঘরের ভেতর আপনি ঢুকলেন কেন? এবং ঢুকে আমি কী করছি, তা দেখেছেন। এটি তো আপনি অন্যায় করেছেন। তখন হযরত ওমর (রাযি.) ওই ব্যক্তির কথাগুলো মেনে নেন।
এ ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট-পাবলিক একটা ডিফারেন্স আছে। কেউ অনেক বেশি ইবাদত করলো, কেউ তেমন ইবাদত করলো না। আবার কেউ আসলে রোযা রাখলো না, কিন্তু প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়াও করলো না, রোযাদারের মতোই চলাফেরা করলো। এমতাবস্থায় আল্লাহর কাছে সে গুনাহগার হবে, কিন্তু আইন তাকে কিছু বলবে না। পাবলিক-প্রাইভেটের মধ্যে এই যে পার্থক্য, এটি ইসলামের অনেক বিষয়েও প্রযোজ্য বলে মনে হয়। এই আর্টিকেলে যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছে, অর্থাৎ হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল ইবাদ। আল্লাহর হকের ক্ষেত্রে হলো পাপ-পূণ্যের ব্যাপার, আর বান্দার হকের ক্ষেত্রে হলো আইনের ব্যাপার।
কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, ইসলামিক প্যারাডাইম তথা ইসলামি চিন্তাভাবনায় জীবনের ধারণা সেক্যুলার ধারণা থেকে ভিন্ন। ইসলামিক প্যারাডাইমে জীবন হলো নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক একটি ব্যাপার। এই জগতে আসার আগেও আমরা ছিলাম রুহ হিসেবে এবং এই জগতের পরবর্তী জগৎ-আলমে বরযাখ (মৃত্যুপরবর্তী জগৎ), তারপর ইয়াওমুল কিয়ামাহ (কিয়ামত দিবস), তারপর জান্নাত বা জাহান্নামের চিরন্তন ঠিকানা। এই প্যারাডাইমটা তো সেক্যুলার সমাজে নেই।
তারপর ধরেন, সামাজিক উন্নয়ন প্রসঙ্গ। অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয় সামাজিক শৃঙ্খলা ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য। ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক উন্নয়নের ধারণাটাও একটু ডিফারেন্ট। কারণ মানুষ শুধুমাত্র খেয়ে-পরে বেঁচে থাকলেই তো হলো না। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষকে ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হবে, একইসাথে তাকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে, ভালো মুসলমানও হতে হবে। আমরা যদি মুসলমানদের কথা ধরি আরকি, যদিও রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলমান ছাড়াও অন্য নাগরিকরাও থাকবে। তাহলে মানুষের উন্নয়নের ইসলামি ধারণা অন্যান্য ধারণা থেকে ভিন্ন। কিন্তু তারমানে এই নয়, সে খেতে পারুক বা না পারুক, উপোস থাকুক, পরনের কাপড় থাকুক বা না থাকুক, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকুক বা না থাকুক, সে খালি নামায-রোযা করবে এবং উন্নত আধ্যাত্মিকতার অধিকারী হবে। এটিও নয়। দুনিয়া ও আখেরাতের এই ধরনের বাইনারি ইসলামে খুব একটা কার্যকরী নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলামি প্যারাডাইমে সমাজ, ব্যক্তি বা জীবন সম্পর্কিত ধারণা সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। সেই হিসেবে এখানে উন্নয়নের ধারণাও ভিন্ন।
ইসলামি প্যারাডাইমে আল্লাহর সাথে কৃত অপরাধকে আমরা পাপ বলছি। আর বান্দার সাথে কৃত অপরাধকে অপরাধ বলছি।
অপরাধ নিয়ে সমাজ কনসার্ন হয়। কিন্তু সমাজ কি সব ধরনের অপরাধ নিয়ে কনসার্ন হয়? সেক্যুলার সমাজের কথা যদি ধরেন, সেখানে সমাজ কী করে? সেখানে কতগুলো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয় যে, এটি এটি হলে তা অপরাধ, কিংবা এটি এটি হলে তা অপরাধ হবে না। তাই না? তাহলে সেক্যুলার সমাজে কোনো অপরাধকে কীসের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়? একটি সামাজিক নৈতিকতা তথা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নৈতিকতার আলোকে অপরাধ চিহ্নিত করা হয়।
তাহলে এই নৈতিক চেতনা আমাকে মানতেই হবে কেন? আমার তো এর সাথে দ্বিমত থাকতে পারে। আমি মনে করতে পারি, হোমো সেক্সুয়ালিটি খারাপ। কিন্তু সমাজের বাদবাকি লোকেরা মনে করছে হোমো সেক্সুয়ালিটি খারাপ নয়। তাই এটি আপনাকে মানতে হবে। একেবারে আপনার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ার আগ পর্যন্ত আপনি এটার প্রতিবাদ করতে পারবেন না। তাহলে সমাজের একজন সদস্য হিসেবে আমার মতামতটি সমাজের কাছে সেক্রিফাইস হয়ে যাচ্ছে না?
ইনফ্যাক্ট, আমরা সমাজটা গড়ে তুলি, পাবলিক ইন্টারেস্টগুলো গড়ে তুলি সে জন্যেই। প্রত্যেকে যদি সবসময় তার পারসোনাল ইন্টারেস্ট নিয়েই থাকে, তাহলে তো আর সমাজ গঠিত হবে না। সমাজ মানে হলো একটি সেক্রিফাইসের ব্যাপার, মেনে নেয়ার ব্যাপার। আমরা যদি শুধু নিজেরটা নিয়েই থাকি, তাহলে সমাজের কার্যকারিতা থাকে না। অতএব সমাজের স্বার্থটা আমাদের মানতে হয়। কিন্তু আমরা কী মানবো, তা কে ঠিক করবে?
আমি সমাজের সদস্য হলে সমাজের কথাকে মানতে হবে। সমাজ কারা তৈরি করে? সবাই মিলে তৈরি করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একটি সেক্যুলার সমাজে অন্য আরেকটি সেক্যুলার সমাজের বিবেচিত অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। অর্থাৎ সেক্যুলার সমাজগুলোতেও অপরাধের বিষয়গুলো সমান নয়। একটি অপরাধকে কোনো সমাজে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, আরেকটি সমাজে তাকে অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না, বা সেই মাত্রার অপরাধ মনে করা হচ্ছে না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি ও সমাজের এই যে পার্থক্য, সেটির অবস্থান সেক্যুলার সমাজে। সেক্যুলার বা ইসলামি সমাজ, যাই হোক না কেন, সবগুলো অপরাধই কি রাষ্ট্র দেখতে পায়? যেমন ধরো, আইন তো কাজ করে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। সাক্ষ্যটা কীসের? সত্যতার। মানে, ঘটনার বাস্তবতার আরকি। কিন্তু সাক্ষ্য ও বাস্তবতা বা সত্যতা কি এক? আমরা কিন্তু দেখি, সাক্ষ্য ও সত্যতা ডিফার করে। তাই না? তাহলে আইন যেভাবে প্রয়োগ করা হয়, অপরাধকে যেভাবে দেখা হয়, এর ভিত্তিতে অপরাধী যে সত্যিই অপরাধী, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও আমরা আইনের মাধ্যমে তা সাব্যস্ত করি।
তাহলে আমরা যে বলি, এটা হলো পাপ; এর মানে হলো এটি অনৈতিক ও অন্যায়। তাই না? আল্লাহর দৃষ্টিতে পাপের মানে হচ্ছে নৈতিকতার খেলাপ। আইন ও নৈতিকতার মধ্যে যে পার্থক্য, সেটি তো আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু আল্লাহর দিক থেকে সবই নৈতিকতার ব্যাপার। আল্লাহর দৃষ্টিতে, আপনি ভালো কাজ করলে পুণ্য হবে, খারাপ কাজ করলে পাপ হবে। তাই আল্লাহর কাছে পাপ ও অপরাধের মধ্যে পার্থক্য নেই। তাহলে আল্লাহ যেটিকে ভালো বলছেন, সেটিকে প্রয়োগ করাই তো সমাজের কাজ। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে সমাজ তা প্রয়োগ করবে? এই প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আইন বা শাস্তির প্রসঙ্গ তো আপেক্ষিক একটি ব্যাপার।
তাহলে কোনো একটা পাপ কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না কেন? যেমন, কেউ নামায পড়ছে না। এ জন্য রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্রে যদি নামায পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ থাকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি নিজেকে মুসলমান দাবি করে, তাহলে সে নামায পড়বে। আর যদি নামায না পড়ে, তাহলে সে নিজেকে মুসলমান দাবি করবে না। ব্যাপারটা তো এমন নয়ু নিজেকে মুসলমান দাবি না করলে কেউ রাষ্ট্রে থাকতেই পারবে না। ধরুন, কেউ মুসলমান হলো, কিন্তু ইসলামকে মানলো না; সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তাকে কিছু করতে পারবে কিনা? এই আর্টিকেলের বক্তব্য অনুসারে কর্তৃপক্ষ তাকে কিছু করতে পারবে না। তাই যদি হয়, তাহলে তো অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে। যেমন, যাকাত। ধরুন, কেউ বললো, আমি জনকল্যাণ করবো, কিন্তু যাকাত যেভাবে হিসাব-নিকাশ করে দিতে হয়, সেভাবে দেবো না। এমনিতেই দেবো। তাহলে তো সেটা যাকাত হবে না। তখন সে বলতে পারে, পাবলিক ইন্টারেস্টের কারণে আমি আমার ইনকামের ৫ পার্সেন্ট দিচ্ছি। এই ৫ পার্সেন্ট যে সে দিলো, তাতে সমাজের উপকার হলো, কিন্তু শরীয়ত পালন তো হলো না। এ রকম পরিস্থিতিতে ইসলামি কর্তৃপক্ষ কি তাকে বাধ্য করতে পারবে? এভাবে নামায, যাকাত, রোযা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যদি বাধ্য করতে না পারে, তাহলে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে কেন পারবে?
শ্রোতা: অন্য ক্ষেত্রগুলো বলতে?
আমি: মানে, সমাজের আরো যত বিষয়গুলো আছে আরকি। ধরুন, কেউ যদি লিভিং টুগেদার করে উইথ রেজিস্ট্রেশন ইন দ্য রেজিস্ট্রি অফিস। অর্থাৎ বিয়ে ছাড়াই শুধু রেজিস্ট্রি করলো। আসলে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এক ধরনের আকদ কায়েম হয়, মানে সম্মতিটা প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আকদ ও রেজিস্ট্রেশন কিন্তু এক জিনিস নয়। দুটি আলাদা ব্যাপার। এভাবে ইসলামের সবগুলো বিষয়কেই যদি কেউ তার নিজের মতো করে মানে, যেখানে মুসলমানরাই ইসলাম মানার ক্ষেত্রে বাধ্য নয়, সেটি কীভাবে ইসলামি সমাজ হয়? এটা খুব ভ্যালিড একটা প্রশ্ন নয় কি?
মনে করেন, যাদের টাকা পয়সা আছে, অর্থাৎ হজ করার সামর্থ্য আছে, তারা হজ করবে। এটা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। এখন কোনো ধনী মুসলমান যদি হজ করতে না যায় এবং আরজ আলী মাতুব্বুরের মতো যদি সে বলে, আমি হজ করবো কেন, কুরবানী করবো কেন? এসব অর্থ বরং আমি সাধারণ গরীব লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেবো। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা না করে অন্যভাবে দেখলে, তার এই কাজটা তো বরং আরো ভালো। একজনের হজ করার কয়েক লাখ টাকার খরচ দিয়ে একজন স্টুডেন্টের ৩/৪ বছরের পড়াশোনার খরচ অনায়াসেই চালানো যায়। তাহলে সামর্থ্যহীন একজন ছাত্রকে পড়ালেখার আর্থিক যোগান দেওয়া ভালো, নাকি সেখান থেকে ঘুরে আসা ভালো, যার কোনো প্রোডাক্টিভিটি নেই? এমনিতে কিছু প্রোডাক্টিভিটি তো থাকেই। আমরা যদি এখানে একটা গানবাজনার অনুষ্ঠান করি, সেখানে কিছু লোকেরা চানাচুর বেঁচবে, কিছু টিকেট বিক্রি হবে, কিছু লোকেরা গাড়ি করে আসবে, ফলে গাড়িওয়ালারা ভাড়া পাবে। মানুষ যখনই নড়াচড়া করে, তখনই সেখানে একটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তৈরি হয় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা উপযোগিতাও তৈরি হয়। কিন্তু আসলে প্রোডাক্টিভিটি বলতে যে উৎপাদনের ব্যাপারটা বোঝায়, এটি তো সেটি নয়। যদি তা না হয়, সেক্ষেত্রে কেউ যদি কুরবানী না দিয়ে বা হজের টাকা দিয়ে জনকল্যাণ করতে চায়, সেটি তো প্রোডাক্টিভিটি হিসেবে বেটার। যদিও হজ বা কুরবানীর একটি অর্থনৈতিক দিক আছে। ইনফ্যাক্ট, মানুষ এমন এক অর্থনৈতিক জীব, এর ইকোনোমিক আসপেক্ট ছাড়া কোনো কিছু হতেই পারে না। যখনই মানুষ কোনো কিছু করে, তখনই একটা অর্থনৈতিক ব্যাপার ঘটে।
তাহলে একটি ইসলামি সমাজে শরীয়ত মানা বা না মানার ব্যাপারে মুসলমানরা যদি পুরোপুরি স্বাধীন হয়, তাহলে গোড়াতেই ওই প্রশ্নটা চলে আসেু ইসলামটা কেন? সেটিই মানার আর দরকার কী? আমরা নিজেরাই তো নিজেদের ভালোমন্দ নির্ধারণ করতে পারি। যখন আমাদের গরম লাগে, তখন আমরা বুঝি একটু ঠাণ্ডা হওয়া উচিত। আবার যখন আমাদের ঠাণ্ডা লাগে, তখন বুঝি এখন আমাদের একটু উষ্ণতা দরকার। তাহলে আমাদের শৈত্য বা উষ্ণতার যে চাহিদা, তা তো আমরা সবাই বুঝি। ভালো এবং মন্দের নৈতিকতার ধারণাও তো সে রকমই। সব মানুষের জন্য খাবার, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা তথা কীভাবে মানুষের কল্যাণ হয়, সেটি তো আমরা বুঝি। মোটাদাগে মানুষের যেসব কল্যাণ তথা মৌলিক অধিকারের ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য তো আমাদের কাছে আসমান থেকে ওহী নাযিল করে বোঝানোর দরকার নেই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা পাপ ও অপরাধের মধ্যে পার্থক্য করছি, সেই ভিত্তিটা কিন্তু আল্টিমেটলি আমাদেরকে ইসলামি প্যারাডাইম থেকে সরিয়ে সেক্যুলার প্যারাডাইমে নিয়ে যায়। কারণ আমরা আমাদের ভালোমন্দ নিজেরা নির্ধারণ করতে পারছি। ওয়েলবিং বা ওয়েলফেয়ার ডেভেলপমেন্ট কী, আমরা তা বুঝি। তাই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সব মানুষ কি খাবার, বাসস্থানসহ অন্যান্য সব সুবিধা পেয়েছে? পায়নি। সব মানুষ যদি সব সুবিধা না পেয়ে থাকে, তাহলে আসুন সেটার জন্য কাজ করি, পরিশ্রম করি, কষ্ট করি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চলুন প্রয়োজনে আমরা লড়াই করি। এখানে ধর্ম আসবে কেন? ধর্ম তো একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ধর্ম একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, আর সামাজিক বিষয়গুলো হলো ধর্মনিরপেক্ষ। তো, এটা হচ্ছে আল্টিমেটলি একটা ধর্মনিরপেক্ষ প্যারাডাইম। কেউ সে প্যারাডাইমের পক্ষে থাকতে পারে। অন্য একটি আলোচনায় আমি দেখিয়েছি, ইসলামি সমাজ বলতে আমরা প্রচলিত অর্থে যা বুঝে থাকি, আসলে তা নয়। ইসলামি সমাজটা ধর্মনিরপেক্ষ লোকদের কাছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ, আর ইসলামের পক্ষের লোকদের কাছে সেটি হলো একটি ইসলামি সমাজ। এটা কীভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নটি নিয়ে আমি অন্য সময় আলোচনা করেছি, প্রয়োজনে পরে আবার করতে পারবো।
তাহলে পাপ হলো ব্যক্তিগত, আর অপরাধ হলো সামাজিক এই ধারণাটি আল্টিমেটলি সেদিকেই নিয়ে যায় যে, ধর্ম হলো ব্যক্তিগত, আর সমাজ হলো ধর্মনিরপেক্ষ, যেখানে ধর্ম কোনোভাবেই সমাজকে প্রভাবিত করতে পারবে না, সমাজের মধ্যে ধর্মের কোনো প্রভাব থাকবে না। এই জিনিটা কিন্তু আসলে ইসলামি সমাজকে আর কম্প্লাই করে না। মানে ধর্ম সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এটাও একটা এক্সট্রিম; আর ধর্ম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত চয়েসের মধ্যে থাকবে, এটি হলো আরেকটি এক্সট্রিম।
তাহলে কেউ যদি হজ না করে জনকল্যাণ করতে চায়, এটি তো তার পাপ হওয়ার কথা, অপরাধ হওয়ার কথা নয়। কেউ যদি কুরবানীর নিয়ম না মেনেই কুরবানী করে, ধরুন বিসমিল্লাহ না বলেই জবাই করে, অথবা জবাই-ই করলো না, তাতে অসুবিধা কী?
সমাজে তো অমুসলিমরাও নাগরিক হিসেবে থাকে। ইসলামি সমাজ মানে তো আর নেসেসারিলি মুসলিম মেজরিটি সমাজ নয়। যদিও পপুলার একটি মিথ হলো, ইসলামি সমাজ মানে মুসলিম মেজরিটি সমাজ, বা মুসলিমদের সমাজ, অথবা মুসলমানরা সেখানে প্রথম শ্রেণির নাগরিক, বাকিরা সেখানে কাইন্ড অব সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। এটি আসলে ভেরি রং কনসেপ্ট। কারণ প্রফেট হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় যে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, সেখানে তো মুসলমানরা খুব অল্পসংখ্যক ছিলো। হিজরতের পর মদীনায় আনসার-মুহাজির মিলিয়ে মুসলমানদের সংখ্যা এক দশমাংশেরও কম ছিলো। মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ এক দশমাংশ মুসলমান ছিলো। অবশ্য পরবর্তীতে খুব দ্রুত তা বাড়তে থাকে। তাহলে মুসলিম সোসাইটি বলতে not society or a state which is for the Muslims only, or not that Muslims are the first class citizen and rest of all others are second class citizen| তা যদি হয়, তাহলে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকরাও সবকিছু সমানভাবে পাবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুসলমানরা ধর্মীয় চেতনা থেকে যে কাজগুলো করবে (যেমন- হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক), সে কাজগুলোই কিন্ত অন্যরা ব্যক্তিগত, সামষ্টিক বা সামাজিক চেতনা থেকে করবে। যেমন- মুসলমানরা নামায পড়ে। তাহলে অন্যরা কী করবে? অন্যরা মেডিটেশন করবে। তাহলে ইসলামি সমাজে কী অমুসলিম সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মেডিটেশন করতে হবে? না, নট দ্যাট। কিন্তু যারা মেডিটেশন করবে না, তারা নিজেদেরকে সাইকোলজিক্যালি কুল অ্যান্ড কা’ম রাখবে, ইন ডিফারেন্ট ওয়েজ, হুইচ ইজ অ্যা কাইন্ড অব মেডিটেশন। এমন তো বলতে হয় না যে, হ্যাঁ, আমি মেডিটেশন করছি। কাজের ফাঁকে আপনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, এটাও এক ধরনের মেডিটেশন। হতে পারে আপনি জানেনই না যে, এটা একটি মেডিটেটিভ প্রসেস। তাই না?
তাহলে যারা ইবাদত করে না, তারাও কোনো না কোনোভাবে ইবাদতের সামাজিক তাৎপর্য হাসিল করে। কথার কথা, যারা ভাত খায় না, তারা রুটি খায়। শরীর তো দুটি থেকে একই ধরনের পুষ্টি গ্রহণ করে। তাই না? মুসলিম সমাজে আমরা রোযা রাখি। কিন্তু যারা রাখে না, তারা কী করবে? তারা কি সকাল-বিকাল খেতেই থাকবে? না, তারাও কিন্তু এক ধরনের ফাস্টিং করে এবং সে জন্যই সকাল বেলার নাস্তার নামই হলো ব্রেকফাস্ট। সারারাত আমরা না খেয়ে থাকি, সকালবেলায় আমরা এক ধরনের ইফতারি করি, সামথিং লাইক দিস। ফাস্টিংকে ব্রেক করা হয়। তাহলে ফাস্টিং ইজ অ্যা মাস্ট। তাই না? লোকেরা কি শুধু খেতে থাকবে, খেতে খেতে মোটা হয়ে মারা যাবে? একটি ভালো রাষ্ট্রের জন্য ওবেসিটি ইজ নট অ্যা গুড থিং। ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথম পদ্ধতিই হলো খাবার নিয়ন্ত্রণ করা। তাই না?
তো, এখন আমরা যেভাবে বছরে একমাস সকাল-সন্ধ্যা রোযা রাখি, এছাড়াও কিন্তু মুসলমানরা রোযা রাখতে পারে, বা রাখেও। শারীরিক অসুবিধার কারণে মুসলিম মহিলাদের (যারা সংখ্যায় মুসলমানদের প্রায় অর্ধেক) যেসব রোযা রমজান মাসে ছুটে যায়, সেগুলো তারা অন্য সময় পূরণ করে। অর্থাৎ রমজানের বাইরেও তারা বাধ্যতামূলকভাবে রোযা রাখে। এটি আপনি আজকে রাখবেন না কালকে রাখবেন, সেটি ভিন্ন কথা; কিন্তু আপনাকে তো রাখতেই হচ্ছে। তারমানে, মুসলমানরাও যে একেবারে শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়েই ফাস্টিং করে, সেটিও নয়। আবার ধরেন নফল রোযার কথা। নফলের নিয়তে রোযা রাখলেন। আমাদের এক কলিগ ব্যাচেলর ডরমেটরিতে থাকতেন। তিনি করতেন কী, সকালবেলা নফল রোযার নিয়ত করে ফেলতেন। পরে বাইরে কোথাও ভালো খাবার-দাবার পেলে তা ভেঙ্গে ফেলতেন। হা হা হা। নফল রোযার ক্ষেত্রে কিন্তু এটি করা যায়।
শ্রোতা: ফরজ রোযার ক্ষেত্রে কি সকাল বেলায়ও নিয়ত করা যায়?
আমি: অবশ্যই। নিয়ত করা মানে কী? শুধুমাত্র নিয়তের কথাগুলো উচ্চারণ করা তো আর নিয়ত করা বোঝায় না।
শ্রোতা: মানে, ইচ্ছাটা থাকা?
আমি: হ্যাঁ, সেটাই। নামায ও রোযার প্রসঙ্গ বললাম। এবার হজের কথা ধরেন। আমরা মক্কা শরীফে গিয়ে হজ করি। মদীনায় যাওয়া তো হজের অংশ নয়। এটি এক ধরনের ট্যুর। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা তো বলেছেন, তোমরা জমিনে ঘুরে ফিরে বেড়াও। আমার নিদর্শন ইত্যাদি দেখো। তাহলে অন্যান্য নাগরিকরাও ট্যুর করবে। কিন্তু তাদের মধ্যে ওই ধর্মীয় চেতনা থাকবে না। তারা একজাক্টলি মক্কাতেই যাবে, এমন না। আমরাও তো একজাক্টলি মক্কাতে যাই, এমন তো না। মক্কাতে যারা যায়, তারা মদীনা থেকেও ঘুরে আসে। হজ করার সময় ফ্লাইট যদি অন্য কোথাও থামে, সেখানেও তারা ঘুরাফেরা করে।
শ্রোতা: অনেকে তো শপিংও করে নিয়ে আসে।
আমি: হ্যাঁ, এবং সেটি জায়েয। আমি বলতে চাচ্ছি, একটি ইসলামি সমাজে মুসলমানরা ধর্মীয় চেতনা থেকে যা কিছু করে, সেটি হক্কুল্লাহ হোক বা হক্কুল ইবাদ হোক, অন্যান্য নাগরিকও কিন্তু সে কাজগুলো করে। সে কাজগুলো তারা তাদের মতো করে করে। যেমন- আমরা যাকাত দেই। যাকাত হলো শতকরা আড়াই শতাংশ। অন্যান্য ধনীরা কি গরীবদের জন্য ব্যয় করবে না?
এই যে সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি), এই টার্মটা কিন্তু কোনো ইসলামি টার্ম নয়। এটি ওয়েস্টার্ন করপোরেট কালচার থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের ইনকামের একটা অংশ সমাজের জন্য ব্যয় করে। কোনো কোনো রাষ্ট্র আছে, আমি গ্রেট ব্রিটেনের কথা জানি, যারা তাদের টোটাল জাতীয় ইনকামের এক বা দুই শতাংশ তৃতীয় বিশ্বের জন্য ব্যয় করে। তারা যে নানা ধরনের সাহায্য-সহায়তা করে, সেগুলো কিন্তু ওই ফান্ড থেকে করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যার সম্পদ নেই বা ঘাটতি আছে, তার জন্য সম্পদশালীরা ব্যয় করে।
যাকাত হলো একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাট। আড়াই শতাংশের পরিবর্তে এটি তিন শতাংশ হলেও কোনো অসুবিধা নেই, ক্ষেত্রবিশেষে এক বা দুই শতাংশ হলেও কোনো অসুবিধা নেই। এটি ১০ শতাংশও হতে পারে। যা হোক, এই আড়াই শতাংশ যাকাত দেওয়ার পর বাকি সাড়ে ৯৭ শতাংশ অর্থ একজন মুসলমান কী কাজে ব্যয় করবে? আমি অনেক আলেমের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তাদের ধারণা হলো, যাকাত আদায়ের পর বাকি অর্থ সে যে কোনো জায়েয কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এটি তার অধিকার। কিন্তু এ কথাটি ঠিক নয়। রাষ্ট্র চাইলে এখান থেকে আরো শতকরা ১০-২০ টাকা বা যে কোনো পরিমাণ অর্থ কেটে রাখতে পারে। কথাটা বোঝার চেষ্টা করেন, যাকাতের টাকা তো গরীবদেরকে দেওয়া হবে। তাহলে সরকার চলবে কীভাবে? রাস্তাঘাট কীভাবে হবে?
শ্রোতা: সরকারি ফান্ড থেকে।
আমি: সরকারি ফান্ড কোত্থেকে আসবে?
শ্রোতা: ট্যাক্স থেকে।
আমি: সেটাই তো বলছি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যাকাত হলো ধর্মীয় ট্যাক্স বা ধনীর ওপর গরীবের ট্যাক্স। তাহলে ধনীর ওপর সরকারের ট্যাক্স কোথায়? ওটার কোনো পরিমাণ তো কুরআন-হাদীসে নির্ধারণ করা নেই। একে ফরজও করা হয়নি, হারামও করা হয়নি। তার মানে এটি মুবাহ। প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি একে আরোপও করতে পারেন, প্রয়োজন না থাকলে এটি সম্পূর্ণ বাদও দিতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে যাকাতের বিষয়টাও কিন্তু অন্যান্য নাগরিকরা তাদের মতো করে করবে।
তারপর বিয়ের ব্যাপারটিই দেখেন। আমাদের সবকিছুরই তো আল্লাহ সাক্ষী আছেন। তারপরও বিবাহযোগ্য নর-নারী ন্যূনতম সাক্ষী বা শর্তগুলো পালন করার মাধ্যমে পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয় এবং পারিবারিক জীবনযাপন করে। এরমধ্যেও যে ধর্মীয় চেতনা কাজ করে, সেটি তো একটি হক্কুল ইবাদ। রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকরা এটি কীভাবে ফলো করবে? তারা কি যে কেউ, যে কারো সাথে, যে কোনো সময় সম্পর্ক করবে, কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না এমন? অর্থাৎ ধর্মীয় বন্ধনের বাইরে যারা জীবনযাপন করবে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক বা সংখ্যালঘিষ্ঠ হোক, তারা কি অবাধ জীবনযাপন করবে? নিশ্চয় নয়। তারা একটি পারিবারিক জীবনযাপন করবে। এ জন্য তারা একটি বৈবাহিক সম্পর্ক তথা সামাজিক স্বীকৃতি বা সমাজের অবগতির মাধ্যমে তা করবে।
তাহলে আমরা এমন কোন হক্কুল ইবাদ খুঁজে পাই, যা শুধু মুসলমানদের ব্যাপার? যেমন, মনে করেন যুদ্ধ। মুসলমানরা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ করবে। কিন্তু দেশ আক্রান্ত হলে অমুসলিম নাগরিকরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? না, তারাও কিন্তু লড়াই করবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা যত কাজই ধর্মীয় চেতনা থেকে করি, এই সবগুলো কাজই রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকরা ধর্মীয় চেতনা ছাড়াই করবে, করতে তারা কোনো না কোনোভাবে বাধ্য। কারণ মানুষ হিসেবে আমাদের সবাইকেই খেতে হয়। শুধু মুসলমানরা খায়, বাকিরা বাতাস খায়, তা নয়।
আমাদের শারীরিক ও মানসিক কিছু মৌলিক দিক জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই সমান। আমি বলতে চাচ্ছি, হক্কুল্লাহ হিসেবে আমরা যা কিছু করি, তা তো আমাদের নিজস্ব পাপ-পুণ্যের ব্যাপার। আর হক্কুল ইবাদকে পাপ-পুণ্য হিসেবে বিবেচনার সাথে সাথে আমরা আইন ও নৈতিকতার ব্যাপার হিসেবেও ধরতে পারি। একজন মুসলমানের কাছে ইবাদতের বিষয়গুলো যদি ব্যক্তিগত হয়, আর মুয়ামালাতের বিষয়গুলো যদি সামাজিক হয়।
শ্রোতা: মুয়ামালাত বলতে কী বোঝায়?
আমি: মুয়ামালাত হলো হক্কুল ইবাদ। মানে সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলো। এটি আরবী শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো লেনদেন। পারস্পরিক ইন্টার্যাবকশনের যে ব্যাপারটা, সেটাই আরকি।
হক্কুল ইবাদ বা মুয়ামালাতের বিষয়গুলোকে একজন মুসলমান ব্যক্তিগত হিসেবে পালন করতে অসুবিধা কী? একই কাজ তো ধর্মীয় চেতনা ও পদ্ধতি বাদ দিয়ে অমুসলিম নাগরিকরাও করছে। তাহলে একজন মুসলমান কেন ধর্মীয় চেতনা ও পদ্ধতি বাদ দিয়ে এসব কাজ করতে পারবে না?
শ্রোতা: তাহলে যেমন ধরেন, হজ। হজ, যাকাত এগুলোর তো একটা নির্দিষ্ট নিয়ম ইসলামে আছে।
আমি: শুধু নিয়ম নয়, এগুলোর মধ্যে একটা সেন্টিমেন্ট বা নিয়তের ব্যাপার আছে। এটাও মাস্ট। নিয়ত ও কাজের পদ্ধতি, দুটোই কিন্তু ইসলাম মোতাবেক হতে হবে।
শ্রোতা: তাছাড়া এগুলো তো আখেরাতের সাথে সম্পর্কিত। আপনি যদি এগুলো ইসলাম মোতাবেক না করেন, তাহলে তো পাপ হবে।
আমি: হ্যাঁ, পাপ হবে। কিন্তু রাষ্ট্র কেন সে ব্যাপারে আমাকে কনসার্ন করবে?
শ্রোতা: হজ ও যাকাতের বেলায় তো রাষ্ট্র কনসার্ন করছে না।
আমি: তাহলে ধনীরা হজ না করলেও রাষ্ট্র তাদেরকে কিছু বলবে না। আচ্ছা, তারা যদি কুরবানী না করে? কেউ যদি এমনিতে আড়াই শতাংশের বেশি সিএসআর করে, কিন্তু যাকাত না দেয়, এই আর্টিকেলের লেখক অনিরুদ্ধ অনিকের বক্তব্য অনুসারে, রাষ্ট্র তাকে কি বাধা দিতে পারবে? পারবে না। তাহলে একজন মুসলমান নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বাধীন। ইসলাম যেভাবে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ করতে বলে, সে যদি সেটা করতে অস্বীকার করে; তবে এমনিতে সাধারণ নাগরিকরা দেশের নিরাপত্তার জন্য যেভাবে কাজ করে, সেভাবে সে কাজ করবে। এতে সমস্যা কী? অন্যান্য নাগরিকরাও তো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলো নিচ্ছে। তাদেরও এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা আছে। তাদের এক ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। দেশের প্রতিরক্ষার মধ্যেও তাদের এক ধরনের অংশগ্রহণ আছে। অর্থনীতির মধ্যেও তাদের অবদান আছে। জনকল্যাণে তাদের কন্ট্রিবিউশন আছে। তাই না? রাষ্ট্রের অপরাপর নাগরিকরা এই সুবিধাগুলো পাচ্ছে এবং তারা এই কাজগুলো করছে। তাহলে একজন মুসলিম নাগরিক করতে পারবে না কেন?
এখন আমরা যদি মনে করি, তার করতে না পারার কোনো কারণ আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, তারমানে সে করতে পারবে। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকই যদি ইসলামি শরীয়াহকে শরীয়াহ হিসেবে মানতে বাধ্য না হয়, তাহলে এখন আমরা কোন পর্যায়ে চলে আসলাম? আমরা এ পর্যায়ে আসলাম যে, ধর্মটা হচ্ছে একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর সমাজটা হচ্ছে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপার।
তাহলে ধর্মটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। ফলে আপনি চাইলে এটি করতে পারেন। সমাজ আপনাকে সেটি এলাউ করছে। এটি এমন সেক্যুলারিজম নয়, যেখানে আপনি ধর্ম মানতে পারবেন না।
এই যে আপনি বোরকা ও স্কার্ফ পরেছেন, এটি কেন করছেন? আপনি হয়তো মনে করছেন, আল্লাহ তায়ালা পর্দা করার হুকুম দিয়েছেন, সেজন্য আমি তা পালন করছি। এই হুকুম পালন করতে গিয়ে আপনার অনেক ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। অন্যদিকে, কেউ মনে করতে পারেু রোদ, ধূলাবালি অথবা আনএক্সপেক্টেড এটেনশন ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য আমি বোরকা বা হিজাব পরছি। এমনটি কেউ মনে করতে পারে না? একই কাজ ভিন্ন ভিন্নভাবে করতে পারে।
চলবে…