ধর্মীয় সভা-সম্মেলনের তাৎপর্য ও উপকারিতা
আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ আবদুল হালীম বুখারী (দা. বা.)
[এটি মূলত আগামী ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতি ও জুমাবার ২০১৯) জামিয়ার অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলনের প্রস্তুতি উপলক্ষে জামিয়ার মেহমানখানায় অনুষ্ঠিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের এক সাধারণ সভায় দেওয়া উদ্বোধনী বক্তব্যের সারনির্যাস। এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে কওমি মাদরাসাসমূহের উদ্যোগে আয়োজিত বার্ষিক দীনী মাহফিলের গুরুত্ব ও উপকারিতার ওপর চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে এবং আকাবির কর্তৃক প্রচলিত বার্ষিক মাহফিলগুলোকে হেকমতপূর্ণ দীনী দাওয়াতের অন্যতম অংশ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বক্তব্যটি গ্রন্থনা করেন পটিয়া আল জামিয়ার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মদ সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী—সম্পাদক)]
نحمده ونصلى علىٰ رسوله الكريم، أما بعد!
সম্মানিত মাশায়েখে ই’যাম ও আসাতেযায়ে কেরাম! প্রত্যেক বছর আমাদের মাদরাসাগুলোতে জলসা (সভা-সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের পূর্বপুরুষ আকাবিরগণ এ সভা-সম্মেলনের উপকারিতা উপলব্ধি করেছেন, তাই এ ধারাবাহিকতা চলে আসছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اُدْعُ اِلٰى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ؕ ۰۰۱۲۵
‘তোমরা হিকমত ও কৌশলে এবং ভাল ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তার দিকে মানুষকে আহ্বান কর।’[1]
একটি হাদিসে কুদসীতে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ h، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ^: «يَقُوْلُ اللهُ تَعَالَىٰ: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِيْ بِيْ، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِيْ، فَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِيْ نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِيْ نَفْسِيْ، وَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِيْ مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِيْ مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ».
‘হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি মানুষের সাথে তাদের ধারণা অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকি। তারা আমাকে স্মরণ করলে আমি তাদের সঙ্গে থাকি। তারা যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে/একাকি স্মরণ করে আমিও তাদেরকে মনে মনে/একাকি স্মরণ করি। আর তারা যদি কোন সভা-সম্মেলনে আমার আলোচনা করে আমিও তাদের আলোচনা এর চেয়ে উত্তম সভা-সম্মেলনে করি অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাহফিলে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করি।’’[2]
তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বিভিন্ন মাহফিলে বয়ান করেছেন। এমনকি জিনদেরকে নিয়েও ইশার নামাযের পর সম্মেলন করেছেন। লায়লাতুল জিনের হাদিস পড়লে তা বোঝা যায়।
عَنْ عَامِرٍ، قَالَ: سَأَلْتُ عَلْقَمَةَ هَلْ كَانَ ابْنُ مَسْعُوْدٍ شَهِدَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ لَيْلَةَ الْـجِنِّ؟ قَالَ: فَقَالَ عَلْقَمَةُ، أَنَا سَأَلْتُ ابْنَ مَسْعُوْدٍ فَقُلْتُ: هَلْ شَهِدَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ لَيْلَةَ الْـجِنِّ؟ قَالَ: لَا وَلَكِنَّا كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ذَاتَ لَيْلَةٍ فَفَقَدْنَاهُ فَالْتَمَسْنَاهُ فِي الْأَوْدِيَةِ وَالشِّعَابِ. فَقُلْنَا: اسْتُطِيْرَ أَوِ اغْتِيْلَ. قَالَ: فَبِتْنَا بِشَرِّ لَيْلَةٍ بَاتَ بِهَا قَوْمٌ فَلَمَّا أَصْبَحْنَا إِذَا هُوَ جَاءٍ مِنْ قِبَلَ حِرَاءٍ. قَالَ: فَقُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ فَقَدْنَاكَ فَطَلَبْنَاكَ فَلَمْ نَجِدْكَ فَبِتْنَا بِشَرِّ لَيْلَةٍ بَاتَ بِهَا قَوْمٌ، فَقَالَ: «أَتَانِيْ دَاعِي الْـجِنِّ فَذَهَبْتُ مَعَهُ فَقَرَأْتُ عَلَيْهِمُ الْقُرْآنَ»، قَالَ: فَانْطَلَقَ بِنَا فَأَرَانَا آثَارَهُمْ وَآثَارَ نِيرَانِهِمْ وَسَأَلُوهُ الزَّادَ، فَقَالَ: لَكُمْ كُلُّ عَظْمٍ ذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ يَقَعُ فِيْ أَيْدِيكُمْ أَوْفَرَ مَا يَكُونُ لَـحْمًا وَكُلُّ بَعْرَةٍ عَلَفٌ لِدَوَابِّكُمْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: «فَلَا تَسْتَنْجُوا بِهِمَا فَإِنَّهُمَا طَعَامُ إِخْوَانِكُمْ».
‘আমের (রহ.) বলেন, আমি আলকমা (রহ.) (ইবনে মাসউদ রাযি.-এর ছাত্র)-কে জিজ্ঞাসা করলাম ইবনে মাসউদ (রাযি.) কি জিনের রজনীতে রাসুলের সাথে ছিলেন? তখন তিনি বলেন, আমি একথা ইবনে মাসউদ (রাযি.)-কে জিজ্ঞাসা করে ছিলাম যে, জিনের রজনীতে রাসুলের সাথে কী কেউ ছিলেন? তখন তিনি বলেন, না। তবে হ্যাঁ, এক রজনীতে আমরা রাসূলের সাথে ছিলাম। হঠাৎ আমরা তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। আমরা তাঁকে শহর-উপত্যকায় তালাশ করলাম। আমরা তাঁকে পেলাম না। তখন আমরা বললাম, হয়তো তাঁকে গুম করা হয়েছে কিংবা খুন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা খুবই মন্দভাবে রাত যাপনক রলাম। সকালবেলা তিনি হেরার দিক থেকে আমাদের দিকে আগমন করলেন। তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে হারিয়ে আমরা অনেক খোজাখুঁজি করেছি। তবে আপনাকে পেলাম না। তাই আমরা অস্থির অবস্থায় রাত যাপন করেছি। তখন তিনি বলেন, ‘আমার নিকট জিনের পক্ষ থেকে আহ্বানকারী এসেছে। আমি তার সাথে চলে গিয়েছিলাম। আমি তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছি (ওয়ায-নসীহত করেছি)।’ তিনি বলেন, অতঃপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে চললেন আর আমরা তাদের পদচিহ্ন ও আগুনের চিহ্ন দেখলাম। তারা রাসুলের নিকট খাবার চাইলেন। সুতরাং তিনি তার আলোচনা করলেন। অতঃপর রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা হাড্ডি এবং গোবর দ্বারা ঢিলা-কুলখ নেবে না। কেননা তা তোমাদের ভাই জিনজাতির খাবার।’’[3]
তেমনি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের খুতবায় সাহাবায়ে কেরামকে ওয়ায-নসীহত করেন। আর ওই ওয়ায মহিলারা পেছনে থাকার কারণে শুনতে পায়নি (যেহেতু তখন মাইকের ব্যবস্থা ছিল না) তাই, রাসুল (সা.) হযরত বিলাল (রাযি.)-কে সাথে নিয়ে মহিলাদের ক্যাম্পে গিয়ে পুনরায় আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহিলারা নিজেদের স্বর্ণের গহনা খুলে সাদকা করে দেন। হযরত বিলাল (রাযি.) কাপড়ের কোণায় করে সেগুলো সংগ্রহ করেছেন।
عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: سَمِعْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ، يَقُوْلُ: «أَشْهَدُ أَنِّي شَهِدْتُ الْعِيْدَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ^، فَبَدَأَ بِالصَّلَاةِ قَبْلَ الْـخُطْبَةِ، ثُمَّ خَطَبَ فَرَأَىٰ أَنَّهُ لَـمْ يُسْمِعَ النِّسَاءَ فَأَتَى النِّسَاءَ فَوَعَظَهُنَّ، وَذَكَّرَهُنَّ وَأَمَرَهُنَّ بِالصَّدَقَةِ وَمَعَهُ بِلَالٌ قَائِلٌ بِثَوْبِهِ هَكَذَا أَيْ فَاتِحَهُ فَجَعَلَتِ الْمَرْأَةُ تُلْقِي الْـخُرْصَ، وَالْـخَاتَمَ، وَالشَّيْءَ».
‘হযরত আতা (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.)-কে বলতে শুনেছি, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি রাসুলের সাথে ঈদে শরিক হয়েছি। তিনি খুতবার পূর্বে নাময আদায় করলেন। অতঃপর খুতবা দিলেন। আমি লক্ষ করলাম যে, তিনি মহিলাদেরকে শোনাতে পারেননি। তাই তিনি তাদেরকে পৃথকভাবে ওয়ায করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন। তাদেরকে সদকার জন্য আদেশ করেন। তাঁর সাথে হযরত বেলাল (রাযি.) ছিলেন। তিনি তার চাদর বিছিয়ে দেন। মহিলারা সেখানে নিজেদের কানের দুল, আংটি ও অন্যান্য জিনিস প্রদান করেন।’[4]
আল-হামদু লিল্লাহ আমাদের জামিয়ায়ও প্রতিবছর জলসা হয়ে থাকে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য মানুষের হিদায়ত। একজন মানুষও যদি এ জলসার মাধ্যমে হিদায়তপ্রাপ্ত হয় তাহলে এটি আমাদের জন্য বড় পাওয়া। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (রাযি.)-কে বলেন, তোমার প্রচেষ্টায় আল্লাহ যদি একজন মানুষকেও হিদায়ত দান করেন তাহলে তা আরবের লাল লাল উট (যা খুবই মূল্যবান) সবগুলো সাদকা করার চেয়েও উত্তম।[5]
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، أنَّ النَّبيَّ ﷺ قَالَ لِعَليًّ: «فَوَاللهِ لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا، خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ».
এজন্যেই কিছুদিন পড়া-শোনা বন্ধ করে, জামিয়ার সকল বিভাগে ছুটি ঘোষণা করে এ জলসার ইহতিমাম করা হয়। এবছরও ফ্রেরুয়ারি মাসের ৭-৮ তারিখ আমাদের জলসার সময় নির্ধারিত হয়েছে। দেশ-বিদেশের ওলামায়ে কেরামকে দাওয়াত করা হয়েছে। দেওবন্দের বর্তমান শায়খে সানি আল্লামা কমরুদ্দীন সাহেবকে দাওয়াত করা হয়েছে। শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর নাতি মুফতি আফফান সাহেবকেও দাওয়াত করা হয়েছে। তাঁরা উভয়জন ইন শা আল্লাহ তাশরিফআনবেন।
অতএব জামিয়ার সকল হিতাকাঙ্ক্ষীদের নিকট জলসার দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি এবং জলসার সার্বিক কামিয়াবির জন্য সকলের নিকট দুআ কামনা করছি। আল্লাহ আমাদের জলসাকে ভরপুর কামিয়াব করুন এবং হিদায়তের মাধ্যম বানান, আমিন।
সংকলন:
মুহাম্মদ সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
[1] আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬:১২৫
[2] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ১২১, হাদীস: ৭৪০৫
[3] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৩৩২, হাদীস: ৪৫০
[4] আন-নাসায়ী, আস-সুনানুল কুবরা, মুআস্সিসা আর-রিসালা, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ৩০০, হাদীস: ১৭৭৯
[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ১৮, হাদীস: ৩৭০১