তালিবুলু ইলম সাথীদের জন্য উপকারী কিছু তথ্য
মাহফুয আহমদ
এক. নির্ভরযোগ্য সূত্রে পূর্বসূরি মনীষীদের জীবনচরিত অধ্যয়নে আগ্রহী তালিবুল ইলম বন্ধুগণ নিম্নোক্ত কিতাবগুলো সংগ্রহ করত পড়ে নিতে পারেন। নিজে সংগ্রহ করা সম্ভবপর না হলে মাদরাসার মাকতাবা, বিজ্ঞ আলেমের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, কোনো পাবলিক লাইব্রেরি কিংবা নিদেনপক্ষে অনলাইন থেকে পিডিএফ ডাউনলোড-এসবের কোনো একটির সহযোগিতা নিতে পারেন। বস্তুত এই কিতাবগুলো অনেক সমৃদ্ধ এবং বহুবিধ উপকারের সমন্বয়কারী।
কয়েকটি কিতাবের নাম: আত-তাবাকাতুল কুবরা; তাজ উদ্দীন ইবনুস সুবকী (রহ.), তারতীতুব মাদারিক; কাযী ইয়ায (রহ.), যায়লুত তাবাকাত; ইবনু রাজাব হাম্বলী (রহ.), ওয়াফায়াতুল আ’য়ান; ইবনু খাল্লিকান (রহ.), মু’জামুল উদাবা ও মু’জামুল বুলদান; ইয়াকুত আল-হামাওয়ী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা; শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহ.), আল-ওয়াফী ফীল ওয়াফায়াত; সাফাদী, আল-আ’লাম; যিরিকলী প্রভৃতি।
তাজ উদ্দীন ইবনুস সুবকী (রহ.) প্রণীত তাবাকাতুশ শাফিয়িয়া আল-কুবরার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান গ্রন্থাদি থেকে তিনি বহু ফিকহি নুসূস উল্লেখ করেছেন; যেগুলো সচরাচর ফিকহ বিষয়ক কিতাবাদিতেও পাওয়া যায় না। আর লেখক কর্তৃক আলোচিত মনীষীর ব্যাপারে পর্যালোচনা ও মন্তব্য করার রীতি যাহাবী (রহ.) থেকে শুরু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যাহাবীর পর ইবনে কাসীর (রহ.)ও এই রীতি অবলম্বন করেছেন। এরপর লেখকগণ জীবনী বিষয়ক গ্রন্থাদিতে সত্য-মিথ্যা বা সবল-দুর্বল নিরীক্ষণ না করে বিশদ লেখার রীতি আবিষ্কার করেছেন। হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) এসে আবার এই রীতির বিপরীতে সত্য-মিথ্যা বা সবল-দুর্বল যাচাই করে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ প্রণয়নের রীতি পুনর্জীবিত করেন। তাঁরপরেও অনেক লেখক এই নীতি অনুসরণ করেই জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
দুই. হানাফী ফিকহ অবলম্বনে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণকারী তালিবুল ইলম সাথীদের জন্য উচিত হলো, নিম্নোদ্ধৃত পূর্ববর্তী মনীষীদের গ্রন্থাদি বেশি বেশি অধ্যয়ন করতে থাকা:
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.),
ইমাম মুহাম্মদ (রহ.),
ইমাম তাহাওয়ী (রহ.),
ইমাম আবু যায়দ দাব্বুসী (রহ.),
ইমাম কারখী (রহ.),
ইমাম আবু বকর জাসসাস (রহ.),
ইমাম বাযদাওয়ী (রহ.) ও
ইমাম সারাখসী (রহ.)।
তিন. ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করেন এমন যে কারো নিকট আল্লামা যারকাশী (রহ.) এই নামটি অপরিচিত নয়। তবে এখানে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসলামি ইতিহাসে যারকাশী নামে দু’জন মনীষী পরিচিতি লাভ করেছেন।
-হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী আল্লামা যারকাশী। শারহুল খারকীর রচয়িতা তিনি। মৃত্যু: ৭৭২ হিজরী।
-শাফিয়ী মাযহাবের অনুসারী আল্লামা যারকাশী। উলুমুল কুরআন শাস্ত্রের জগদ্বিখ্যাত এবং সর্বমহলে সমাদৃত গ্রন্থ আল-বুরহান ফি উলুমিল কুরআন তাঁরই রচনা। তাছাড়া উসূলুল ফিকহ বিষয়ে তিনি আল-বাহরুল মুহীত নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। মৃত্যু: ৭৯৪ হিজরী।
চার. ইমাম তিরমিযী (রহ.) সংকলিত আস সুনান কিতাবটি অপরাপর সুনানের চেয়ে কিছু ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন-
-ইমাম তিরমিযী (রহ.) হাদীস বর্ণনার পাশাপাশি সেই হাদীসের শাস্ত্রীয় স্তর তথা সহীহ-যয়ীফ ইত্যাদি উল্লেখ করে দেন।
-তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর নিকট সমাদৃত ইমামগণ, যেমন-আবু হানিফা, মালিক, শাফিয়ী, আহমদ (রহ.) প্রমুখের মাযহাব বা মতামত উল্লেখ করে দেন।
-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আর কোন কোন সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে সে দিকেও ইঙ্গিত করে দেন।
-বিশেষত তিনি হাদীস ও রিজালুল হাদীস সংক্রান্ত ইমাম বুখারী (রহ.)-এর বহু মত ও মন্তব্য পরবর্তীদের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।
পাঁচ. ইমাম আবদুর রাহমান ইবনে আবী হাতিম (রহ.) (জন্ম: ২৪০ হি. = মৃত্যু: ৩২৭ হি.)-কে একবার ইমাম আবু বকর ইবনে খুযায়মা (রহ.) (জন্ম: ২২৩ হি. = মৃত্যু: ৩১১ হি.) সম্পর্কে (হাদীস শাস্ত্রে তাঁর মান, বিশ্বস্ততা, নির্ভরযোগ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে) জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি প্রতি উত্তরে বলে দিলেন, ‘দূর হও! তাঁকে (ইবনে খুযায়মাকে) আমাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, আমাদেরকে তাঁর সম্পর্কে নয়; তিনি তো অনুসৃত ইমাম।’ (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা; যাহাবী, ১৪/৩৭৬)
সুবহানাল্লাহ! এমনই ছিলো পূর্বসূরি আলেমদের বিনয়, ন্যায়নিষ্ঠতা এবং মানুষের স্তর অনুযায়ী মূল্যায়নের অকৃত্রিম চিত্র। অন্যের বেলায় মুখ খুলতে আমাদেরও এমন দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ছয়. উজবেকিস্তানের বুখারায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত কতজন মনীষী; যাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা বিশ্ব আলোকিত হচ্ছে এবং হতে থাকবে ইন শা আল্লাহ।
-মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল। ইমাম বুখারী। জন্ম: ১৯৪ হি. = মৃত্যু: ২৫৬ হি.। সহীহ আল-বুখারী।
-আবু হাফস আল-বুখারী আল-হানাফী। মুহাদ্দিস ও ফকীহ। জন্ম: ১৫০ হি. = মৃত্যু: ২১৭ হি.।
-এছাড়া আবু যাকারিয়া আল-হাফিয, আবুল আব্বাস আল-হাম্বলী আল-বুখারী এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা (রহ.)।
সাত. ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর জগদ্বিখ্যাত সহীহ গ্রন্থটি শুরু করেছেন আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস দিয়ে আর শেষ করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাহাবী আবু হুরায়রা (রাযি.)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস দিয়ে।
এই কর্মপন্থা থেকে হাদীস বিশেষজ্ঞ আলেমগণ চমৎকার একটি তত্ত্ব উদঘাটন করেছেন। বস্তুত উমর ছিলেন পবিত্র কুরআন গ্রন্থাকারে মলাটবদ্ধ করণের প্রথম প্রস্তাবকারী; তিনি ছিলেন ওহী মাতলু বা আল-কুরআনের সংরক্ষণ কর্মের অন্যতম একজন অতন্দ্রপ্রহরী। আর আবু হুরায়রা ছিলেন হাদীসের সর্বোচ্চ সংখ্যার বর্ণনাকারী; তিনি ছিলেন ওহী গায়রে মাতলু’ বা সুন্নাহর সংরক্ষণ কর্মের অন্যতম একজন অতন্দ্রপ্রহরী।
তো ইমাম বুখারী সহীহ হাদীস সংবলিত তাঁর বিশুদ্ধতম গ্রন্থটি এই দু’জন সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হাদীস দ্বারা সূচনা ও সমাপ্তি করে সম্ভবত এই কথাই বুঝিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআন ও সুন্নাহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছেন যুগে যুগে নিবেদিতপ্রাণ পুণ্যাত্মাদের মাধ্যমে।
আট. ইমাম কুদুরী (রহ.) (মৃ. ৪২৮ হি.) তাঁর প্রসিদ্ধ আল-মুখতাসার গ্রন্থটি সংকলন করেছিলেন স্বীয় পুত্র মুহাম্মদ এর জন্য। কিন্তু আদরের পুত্র মুহাম্মদ যুবক বয়সেই মারা যান। তবে তার জন্য সংকলিত ওই গ্রন্থ থেকে অদ্যাবধি উম্মাহ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে। বস্তুত এটি হানাফী ফিকহের অন্যতম একটি গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত, সমাদৃত এবং বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।
অনেক সময় এমন হয়, লেখক বা সংকলক কল্পনাও করতে পারেন না যে; তাঁর রচনাটি ওই স্তরে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইখলাস ও ফলপ্রসূতার কারণে গ্রন্থটিকে কবুল করে নেন এবং পাঠকদের নিকট গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় বানিয়ে দেন।
নয়. মুসতালাহুল হাদীস বিষয়ে ইবনুস সালাহ (রহ.) (মৃ. ৬৪৩ হি.) রচিত গ্রন্থটি এ শাস্ত্রের জন্য শ্রেষ্ঠতম কর্মসমূহের একটি। কিতাবটি তিন নামে পরিচিত:
১. মা’রিফাতু আনওয়ায়িল হাদীস,
২. উলুমুল হাদীস ও
৩. মুকাদ্দামাতু ইবনিস সালাহ।
তৃতীয় নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তারপর দ্বিতীয়টি। আর ইবনুস সালাহ নিজে কিতাবটির জন্য যে নাম রেখেছিলেন এবং স্পষ্ট উল্লেখও করেছিলেন সেটি হলো প্রথম নাম। সেজন্য এই কিতাবের কোনো কোনো নুসখার (সংস্করণের) কাভারে সবকটি নামই জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
দশ. এটি ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ.) (জন্ম: ৬৩১ হিজরী, মৃত্যু: ৬৭৬ হিজরী) এর ইখলাসের বরকত এবং আল্লাহ তায়ালার নিকট তাঁর মাকবুলিয়াতের পরিচয় যে, তাঁর সংকলিত আরবাঈন (চল্লিশ হাদীস) গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে উম্মাহর নিকট সমাদৃত হয়েছে। বস্তুত উম্মাহর অনুসৃত প্রায় সকল মাযহাবের বিজ্ঞ আলেমগণ তাঁর কিতাবটির শারহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। এমনকি কোনো মাযহাব অনুসরণ করেন না; সমকালীন এরকম আলেমগণও গ্রন্থটির গুরুত্ব অনুধাবন করত রকমারি কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
অনুসৃত মাযহাবগুলোর যেসব জগদ্বিখ্যাত আলেম এই গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন তাঁদের কয়েকজন হলেন:
-আল্লামা ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)। জন্ম: ৬২৫ হিজরী, মৃত্যু: ৭০২ হিজরী। স্বীয় পিতার কাছ থেকে মালিকী মাযহাবের শিক্ষা লাভ করেন আর স্বীয় উসতায ইযযুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম (রহ.)র কাছ থেকে শাফিয়ী মাযহাবের শিক্ষা লাভ করেন। গ্রন্থের নাম: শারহুল আরবাঈন আন নাওয়াওয়ীয়া।
-আল্লামা আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে ফারহ আল-ইশবীলি (রহ.)। জন্ম: ৬২৫ হিজরী, মৃত্যু: ৬৯৯ হিজরী। শাফিয়ী মাযহাবের অনুসারী। গ্রন্থের নাম: শারহুল আরবাঈন আন নাওয়ায়ীয়া।
-আল্লামা ইবনে রাজাব হাম্বলী (রহ.)। জন্ম: ৭৩৬ হিজরী, মৃত্যু: ৭৯৫ হিজরী। হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। গ্রন্থের নাম: জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম। অবশ্য তিনি আরও আটটি হাদীস সংযুক্ত করে সংখ্যা পঞ্চাশে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।
-আল্লামা ইবনে হাজার আল-হায়তামী (রহ.)। জন্ম: ৯০৯ হিজরী, মৃত্যু: ৯৭৩ হিজরী। শাফিয়ী মাযহাবের অনুসারী। গ্রন্থের নাম: আল-ফাতহুল মুবীন বিশারহিল আরবাঈন।
-আল্লামা মোল্লা আলী আল-কারী (রহ.)। মৃত্যু: ১০১৪ হিজরী। হানাফী মাযহাবের অনুসারী। গ্রন্থের নাম: আল-মুবীনুল মুঈন লিফাহমিল আরবাঈন। ড. হামজা আল-বাকরী এর তাহকীকসহ বইটি ছেপে এসেছে।
তবে প্রথমোক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থটির ব্যাপারে প্রাজ্ঞ হাদীস বিশারদ শায়খ মুহাম্মদ ওয়াইল আল-হাম্বলী হাফিযাহুল্লাহ (যাঁকে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী সাহেবও সমীহ করেন)-দ্বিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এটি ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)-এর লেখা শারহ নয়। কেননা
১. ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)-এর জীবনালেখ্য রচনাকারী কেউ তাঁর লিখিত গ্রন্থাদির তালিকায় এই শারহের কথা উল্লেখ করেননি।
২. ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.) বয়সে ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ.)-এর চেয়ে বড়; যদিও তিনি নাওয়াওয়ীর পরে ইন্তেকাল করেছেন।
৩. এই শারহে ইমাম নাওয়াওয়ীর অনেক উক্তি বিবৃত হয়েছে। অথচ ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)-এর গ্রন্থাদিতে সচরাচর ইমাম নাওয়াওয়ীর কোনো উক্তি পাওয়া যায় না।
৪. এই শারহে দুটি মাওযূ হাদীসও উদ্ধৃত করা হয়েছে। অথচ এটি ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)-এর নিয়ম পরিপন্থী।
৫. এই শারহে আল-মানযুমাতুল বায়কুনিয়ার উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। অথচ বায়কুনী (রহ.) ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)-এর অনেক পরে ইন্তেকাল করেন।
৬. এ শারহে সা’দ তাফতাযানী (রহ.)-এরও উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। অথচ তাফতাযানী ইবনু দাকীকিল ঈদ (রহ.)-এর কয়েক দশক পরে ইন্তেকাল করেন।