দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.)
এহসান বিন মুজাহির
মহান আল্লাহর অগণিত নেয়ামতরাজির মধ্যে দৃষ্টিশক্তি এক মহানেয়ামত। দৃষ্টিশক্তি নামক মহানেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়েছেন মহান ব্যক্তিত্ব অনেকেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবাদের জামাতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছিলেন। মেধা, প্রতিভা ও জ্ঞানের দিক থেকে ছিলেন অসাধারণ। জীবন চলার পথে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও উদারমনা। অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রিয়নবী (সা.)-এর মজলিসে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন। নবীজির সোহবত পেয়ে কুরআন-হাদীসের প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি ছিলেন। কিন্তু তার রূহানি দৃষ্টি এত প্রখর ছিল যে, অন্ধ হয়েও নবী (সা.)-কে চিনে ঈমান এনেছিলেন এবং তার দীনী বিষয়ে জানার আগ্রহের কারণে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে আল্লাহ কুরআনের আয়াত নাযিল করেছেন ‘আবাসা ওয়াতাওয়াল্লা আন জা আহুমুল আলা’—এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে নবী (সা.) তাকে এত ভালোবাসতেন মদিনার বাইরে সফরে গেলে উম্মে মাকতুমকে মদিনার অস্থায়ী শাসক নিয়োগ করে যেতেন। অন্ধ সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রাযি.)-এর একটি ঘটনা ইমাম বগভি (রহ.) এভাবে বর্ণনা করেন যে, একদা একটি দীনী মজলিসে লোকদিগকে (মক্কার কাফের নেতাদের) দীনী উপদেশদানে মগ্ন ছিলেন। এ অবস্থায় আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রাযি.) ওই মজলিসে প্রবেশ করেই রাসূল (সা.)-কে একটি জিজ্ঞাসার জন্য বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। অন্ধত্বের কারণে একথা জানতে পারেননি যে, রাসূল (সা.) অন্যের সঙ্গে জরুরি আলোচনারত আছেন। এ মুহূর্তে মাকতুম (রাযি.) এভাবে প্রশ্ন করা ও তাৎক্ষণিক জওয়াবের জন্য পীড়াপীড়ি করা রাসূল (সা.) কাছে বিরক্তিকর ছিল। এ বিরক্তির প্রধান কারণ ছিল এই যে, আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রাযি.) ঈমানের ওপর ছিলেন অনড় এবং সর্বদা রাসূলের মজলিসে থাকতেন।
তার এ প্রশ্নের জবাব অন্যসময় জেনে নিতে পারতেন। তার উত্তর বিলম্বিত করে দেয়ার মধ্যে ধর্মীয় ক্ষতির কোনো আশঙ্কা ছিল না। (তাফসিরে মাজহারি)। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রাযি.) ব্যাকুল হৃদয়ের আর্তি আল্লাহর কাছে পছন্দ লেগেছিল বিধায় তিনি রাসূল (সা.) কে সতর্ক করে দেয়ার জন্য মহাগ্রন্থ কুরআনে কারিমের সূরা ‘আবাসার’ প্রথম কটি আয়াত তার শানে অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ তার কাছে এক অন্ধ আগমন করল। আপনি কী জানেন? সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো বা উপদেশ গ্রহণ করত এবং উপদেশে তার উপকার হতো। পরন্ত যে বেপরোয়া আপনি তার চিন্তায় মশগুল সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোনো দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে এলো, এ অবস্থায় যে, সে ভয় করে। কিন্তু আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। (সূরা আবাসা: ৩০:১-৬ তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন)
পরে রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.)-কে দেখে বলতেন, সম্ভাষণ সেই ব্যক্তির জন্য, যার কারণে আমাকে কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। রাসূল আরও বলতেন, ‘হে আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম তোমার কি কোনো জরুরত আছে? কোনো কিছু জানতে চাইলে আমাকে নির্দ্বিধায় বল! রাসূল (সা.) মাকতুম (রাযি.)-কে অনেক সময় মদিনায় খলিফা মনোনীত করে যুদ্ধে গমন করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.) লোকদের নামায পড়াতেন। দীন সম্পর্কে জ্ঞান দান করতেন। তিনি অনেক যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। যখন হিযরতের ধারা শুরু হলো তখন নবী করিম (সা.)-এর আগেই মাকতুম হিযরত করে মদিনায় বসবাস শুরু করেন। পবিত্র কুরআনের আরও দুটি আয়াত তার ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আয়াতের প্রথমাংশ, ‘যেসব মুহাজির জিহাদে না গিয়ে বসে আছে তারা এবং যারা আল্লাহর রাসায় জিহাদকারী তারা সমান হতে পারে না।’ ওই আয়াত নাজিল হলে মাকতুম (রাযি.) চিন্তিত হলেন, কারণ অন্ধত্বের কারণে তিনি জিহাদে শরিক হতে পারছিলেন না। তিনি রাসূল (সা.)-এর কাছে অপারগতার কথা তুলে ধরলেন। তখন আয়াতের পরের অংশ অবতীর্ণ হয়, ‘তা ছাড়া যাদের সমস্যা রয়েছে, তাদের জিহাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। উম্মে মাকতুম (রাযি.)-এর অন্তর জিহাদের প্রেরণায় ছিল উদ্বেলিত। অপারগ থাকার পরেও তিনি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
একদা যুদ্ধে অংশ নিয়ে যুদ্ধের সেনাপতির কাছে আবেদন করেন যুদ্ধের পতাকা তার হাতে দেয়ার জন্য। কারণ আমি অন্ধ থাকার কারণে পালাতে পারব না। ওমর (রাযি.)-এর যুগে তিনি ইরানের সঙ্গে ‘কাদিসিয়ার’ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, এ যুদ্ধে তার পরনে লৌহবর্ম এবং হাতে কালো পতাকা ছিল। হযরত যুবাইর ইবনে বাক্কার (রাযি.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.) কাদিসিয়ার যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন। হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.) হুজুর (সা.) থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুনানের কিতাবাদিতে তার বর্ণনা রয়েছে। আবদুুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ, আবদুর রহমান ইবনে আবু লায়লাসহ জগদ্বিখ্যাত অনেক হাদীসবিশারদ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেন।