জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংস্কৃতির ইতিহাস এবং বাঙালির সংস্কৃতি

সংস্কৃতির ইতিহাস এবং বাঙালির সংস্কৃতি

সংস্কৃতি সম্পর্কে কথা বলাটা একটু কঠিন। কঠিন এই কারণে যে, সংস্কৃতিকে যেমন ধরা যায় না তেমনি ছোয়াও যায় না, তাছাড়া কঠিন তরল বা বায়বীয় কোনো পদার্থের মতো সংস্কৃতিকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে পাওয়া যায় না। তবু সংস্কৃতি বলে একটা কিছু যে আছে তা চেতনাসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তিই উপলব্দি করেন এবং অনুভব করেন। সংস্কৃতি বিমূর্ত বিষয়-উপলব্দির বিষয়, অনুভবের বিষয়, হৃদয় বা বুদ্ধি দিয়ে বুঝবার বিষয়। সংস্কৃতির কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব না থাকার ফলে সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা অনেকটা অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো ব্যাপার। সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা যতই আলোচনা করি, যতই মত বিনিময় করি, মনে হয় কোনো দুইজন ব্যাক্তির ধারণা হুবুহু এক হবে না। সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশ্রুত জীবনচেতনা। সংস্কৃতির কথা যখন আমরা বলি তখন মনে রাখতে হবে, সকলের সংস্কৃতি এক নয়। আমরা কার সংস্কৃতির বিকাশ চাই? কার উন্নতি চাই? দাসের এক সংস্কৃতি, গরিবের এক সংস্কৃতি, অস্পৃশ্যের এক সংস্কৃতি, হিন্দুর এক সংস্কৃতি, বৌদ্ধের এক সংস্কৃতি, মুসলমানের এক সংস্কৃতি। অন্যদিকে প্রভুর এক সংস্কৃতি, ধনীর এক সংস্কৃতি, ব্রাহ্মণের এক সংস্কৃতি, ধর্মব্যবসায়ীর এক সংস্কৃতি, মুনাফেকের এক সংস্কৃতি, প্রতারকের এক সংস্কৃতি, মিথ্যাবাদীর এক সংস্কৃতি। একদিকে জালেমের সংস্কৃতি, আর একদিকে মজলুমের সংস্কৃতি। মূলত যখন সংস্কৃতি ঐক্যের মাধ্যমে একাকার হয়ে যায় অর্থাৎ সকলেই একই ধরনের সংস্কৃতি পালনে ব্রতী হয় বা সকলের সংস্কৃতিতেই সকলের অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকে তখন ঐ অবস্থাকেই বলে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা। সুতরাং বলা যায় সংস্কৃতি বহতা নদীর মতো প্রবাহমান গতিশীল। আমরা এক কথায় বলতে পারি, জীবিকাসম্পৃক্ত জীবের সার্বক্ষণিক ও বহুধা অভিব্যাক্তিই সংস্কৃতি। নানারকম প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ প্রকৃতি আর পরিবেশকে জয় করার চেষ্টা করে আসছে। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে গিয়ে মানুষ যেসব চিন্তা-ভাবনা করছে এবং জীবনের প্রয়োজনে যা কিছু উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করেছে এর সবকটাকেই বলা হয় সংস্কৃতি। বাংলা সংস্কৃতি শব্দটি এসেছে ইংরেজি culture শব্দ থেকে। সংস্কৃতির খাঁটি বাংলা হলো কৃষ্টি। কৃষ্টি শব্দের অর্থ হলো কর্ষণ বা চাষ। ষোলো শতকের শেষার্ধে ফ্রান্সিস বেকন সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে culture শব্দটি ব্যবহার করেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইমারসন (Emerrson) cultureকে পূর্ণভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। সাধারণভাবে বলা যায় মানবসৃষ্ট জীবনপ্রণালীই হলো সংস্কৃতি। কোনো সমাজের সংস্কৃতি বলতে ওই সমাজের মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালীকে বোঝায়। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক সৃষ্টি। মানুষ তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে যা কিছু সৃষ্টি করেছে তাই সংস্কৃতি। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী রবার্টসন (Robertson) তাঁর Sociology গ্রন্থে বলেন, সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজসৃষ্ট বা সমাজ কর্তৃক উৎপাদিত বিষয়বস্তু বা দ্রব্যসামগ্রী যা সমাজের সকলেই একত্রে ধারণ করে এবং যা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনযাত্রা প্রণালীর সূচনা করে। সংস্কৃতি বস্তুগত ও অবস্তুগত সকল কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে। এবার আসা যাক বাঙালি সংস্কৃতিতে। নানা কারণে বাঙালি সংস্কৃতিকে মিশ্র সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে। তবে বাংলার সংস্কৃতি মিশ্র উপাদানে গড়ে উঠলেও তার নিজস্ব কিছু উপাদান রয়েছে। যেগুলো প্রাচীন কাল থেকে বহমান রয়েছে; এর সাথে মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগেও কিছু যোগ রয়েছে। লোকসাহিত্য ছাড়া, লোকসংগীত, গীতিকা, ধাঁধা, রূপকথা উপকথা: ধর্মীয় রীতিনীতি, সংগীত, উৎসব, খেলাধুলা, প্রথা-নিয়ম, প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন, কুটির ও হস্তশিল্প, পারিবারিক ও সামাজিক দিক প্রভৃতি হলো বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

সংস্কৃতির উপর্যুক্ত সংজ্ঞা থেকে বাঙ্গালি সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব। সাধারণত বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলতে বাংলা ভাষাভাষী লোকদের বহুরূপী মনোভাব, ভাবধারা, মননশীলতা, সাহিত্য ও শিল্পকলার সংমিশ্রণকে বুঝি। ব্যাপক অর্থে, বাঙ্গালি সংস্কৃতি হচ্ছে বাংলার সমাজ ও মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিপ্রথা, আচার-অনুষ্টান, মূল্যবোধ, আদর্শ এবং লোকাচার বা আচরণের উৎসাহ, প্রতীক বা লক্ষণ বা চিহ্ন, ভাষা বা জ্ঞানবিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তির জটিল সমন্বয়। অর্থাৎ বাঙ্গালি সংস্কৃতি বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের পর থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাঙালি গোষ্ঠী বিভিন্ন বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ আলেখ্য বিশেষ। পরিশেষে বলা যায় যে, আবহমানকাল ধরে বাঙ্গালী জাতির চিরাচরিত জীবনধারা তথা ধ্যানধারণা, খাদ্যাভ্যাস, পেশাক-পরিচ্ছেদ, কথা বলার ধরন, বাসগৃহ, শিল্পসাহিত্য, ধর্মকর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান উদযাপন, জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশ্বাস, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের জটিল কাঠামোবদ্ধ রূপকে একত্রে বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলা হয়। তবে বাঙ্গালি সংস্কৃতির যথার্থ ইতিহাস আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। কাজটি অনেকটা দুরূহ এবং দুস্কর। তবে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে আছে। কাব্য-সাহিত্য, ছড়া-প্রবাদ-প্রবচন, ধাধায়, মন্দির, মসজিদ, দুর্গ, প্রাসাদ গাত্রে পাওয়া যাবে বাঙালি সংস্কৃতির নিদর্শন। সুতরাং বাঙালি সংস্কৃতির যে উপকরণ রয়েছে তা মানুষের হৃদয়ে জেগে থাকুক এটাই সকলের কামনা।

আজহার মাহমুদ

বিবিএ (অনার্স), হিসাববিজ্ঞান বিভাগ (প্রথম বর্ষ)

ওমরগনি এমইএস  কলেজ, চট্টগ্রাম

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ