মহা আক্রমণের মুখে তুরস্ক: আত্মসমর্পন নয়, লড়াই
ইবরাহীম কারাগুল
(ইবরাহীম কারাগুল তুরস্কের ইনি সাফাক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। কারাগুলের জন্ম ১৯৬৯ সালে ট্র্যাবসনের সালপজারী জেলার সিনলিস গ্রামে। ডকুজ ইয়েলুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে লেখাপড়া শেষ করে তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিদেশি সংবাদ সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। জুলাই ২০১২ সালে তিনি ইনি সাফাক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হন। ঐতিহ্যবাদী এই তুর্কি সাংবাদিকের কলামের বৈশিষ্ট্য হলো তাতে একটিভিজমের বহিপ্রকাশ থাকে। তবে লেখার গভীরতা ও সাহসিকতার বিশেষ প্রকাশের জন্য তুরস্কে তিনি বেশ জনপ্রিয় কলাম লেখক। যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক অর্থনৈতিক লড়াইয়ের উপর তার লেখাটির একটি বিশেষ মাত্রার তাৎপরয রয়েছে। মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের হুমকির বিষয়টি এখন তুরস্কে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু।)
তারা খোলাখুলিভাবে তুরস্ককে হুমকি দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিচ্ছেন, তার সহকর্মীরা হুমকি দিচ্ছেন, তার আর্থিক চক্র হুমকি তৈরি করছে, তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপকরা হুমকি দিচ্ছেন আর হুমকি তৈরি করছেন তার বৈদেশিক বিষয় দেখাশোনাকারীরাও। মার্কিন প্রশাসন রাশিয়া, চীন ও ইরানের সাথে শুরু হওয়া সংঘাতের চতুর্থ ফ্রন্টটি চালু করেছে তুরস্কের সাথে।
যারা ১৫ জুলাই ২০১৬ সালে তুরস্কের উপর আক্রমণ করেছিল, যারা তুর্কিদেরকে ট্যাঙ্কের নিচে পিষেছিল, তুর্কিদের বুকে গুলি ছুঁড়েছিলো এবং গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দেশটিকে এনে হাজির করেছিল আর নানামুখি আক্রমণ করেছিল, তাদের সবাই, তাদের প্রতিটি দল, তাদের গোপন সদর দপ্তর এখন আবার মাঠে নেমেছে।
তারা সবাই একসঙ্গে তুরস্ককে আক্রমণ করছে। এটি একটি অর্থনৈতিক যুদ্ধ। এই অপারেশন তুরস্কের পতন ঘটাতে, তুর্কিদের নতজানু করতে এবং অর্থনৈতিকভাবে তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য একটি প্রচেষ্টা। এটি কোনভাবেই যাজক অ্যান্ড্রু ব্রুনসনের বিষয়ে সীমিত নয়। এটি ফাতুল্লাহ টেরর অর্গানাইজেশনের (ফেটো) সদস্যদের মুক্তি দেয়ার বিষয়েও সীমাবদ্ধ নয়, যারা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে দেশের ভেতরে কাজ করেছেন।
বিষয়টি ব্রুন্সসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, একটি মহা সংগ্রাম চলছে …
এটি একটি রাজনৈতিক আক্রমণও। এটি সমগ্র মার্কিন প্রশাসন এবং এর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের তুরস্ককে স্তব্ধ করার একটি উদ্যোগ। এটি জুলাই ১৫ তারিখের অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার এজেন্ডার বাস্তবায়ন।
এটি খোলাখুলিভাবে তুরস্কে আঘাত হানার একটি প্রচেষ্টা, যা তারা এই অঞ্চলে নিখুঁত, নীরবে, বিচ্ছিন্নভাবে করেনি আর দেশটির ক্রমবর্ধমান ও শক্তিশালী হওয়াকে তারা প্রতিরোধ করছে।
এটি তুরস্ককে শাস্তি দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা, যে দেশটি এশিয়ার ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারা নিপীড়িত হতে অস্বীকার করে, যে এক শতাব্দীর পরে একটি নতুন বিকাশের যুগ শুরু করেছে এবং যে বৈশ্বিক ক্ষমতার পরিবর্তনে বড় শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে
এটি তুরস্কের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের প্রচেষ্টা, যে সেলজুক, উসমানীয় এবং রিপাবলিকান যুগের পর, নতুন যুগেও রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, যে আবারো ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে এবং এ জন্য এটি পরিবর্তিত হচ্ছে।
এটি হলো তুরস্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পা, যা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, আর বিচ্ছিন্ন হয়ে এটি বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার পালাবদলে আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে, যা কেবল তুরস্কের জন্যই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বে এক উন্মাদনা টেনে এনেছে।
এটি তাদের আক্রমণ যারা চার শতাব্দী পরে একতরফাভাবে বিশ্বের শাসন করার লাইসেন্সটি হারিয়ে ফেলছে, যারা আবার সেই একই ক্ষমতায় কোনভাবে পৌঁছাতে পারছে না।
তার অর্থনৈতিক যুদ্ধ রাশিয়াতে, অর্থনৈতিক যুদ্ধ ইরানে, অর্থনৈতিক যুদ্ধ চীনে, অর্থনৈতিক যুদ্ধ তুরস্কের বিরুদ্ধে। তারা শীঘ্রই জার্মানির পাশাপাশি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ, দক্ষিণ আমেরিকান দেশ এবং এশিয়ান দেশগুলির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
বিশ্বব্যাপি একটি নতুন লুটপাট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রয়েছে তারা
একটি নতুন এবং বড় ধরনের বিশ্বব্যাপী লুণ্ঠন পরিকল্পনা সক্রিয় করা হয়েছে। তারা আজ যা তুরস্কে করছে তার উদ্দেশ্য হলো, গত ১৫ বছরে দেশটি যা অর্জন করেছে তা এখন লুটপাট করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম এখন পশ্চাদপদ এক সময়ের মধ্যে রয়েছে। তারা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো তা অচল হয়ে পড়েছে এবং এখন আর সেটি নিয়ে সামনে আগানো যাবে না। এ কারণে তারা বিশ্বের সহায় সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য পাগলের মত হামলে পড়েছে।
সমগ্র পৃথিবী আজ হুমকির মধ্যে। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি সব অর্থনৈতিক পদক্ষেপ। শীঘ্রই, আমরা রাজনৈতিক এবং সামরিক পদক্ষেপও দেখতে পাব। সামনে এক ধরনের ঝড় ধেয়ে আসছে। বিশ্বের, সব দেশকে এই নতুন লুঠের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সংঘবদ্ধভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোন কিছু করার মতো এক ভারসাম্যহীন দেশ
সারা বিশ্বের সাথেই যুদ্ধরত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটা তার বিশ্বাসযোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং বন্ধুত্ব হারিয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে দূরবর্তী পূর্ব এশিয়ার আমেরিকা পর্যন্ত সারা বিশ্বে কোন না কোন ধরনের অস্বস্তি শুরু হয়েছে। এটি একটি ভারসাম্যহীন দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোন কিছু করতে পারে এ দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রশ্নে ডলারের বিপরীতে নতুন একটি বিনিময় হার বা সাধারণ মুদ্রার ব্যবস্থা, স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার করে বাণিজ্য, পশ্চিমা সরকারের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষুব্ধতার কারণ। এই সব বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিপত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ। তাকে প্রত্যাখ্যান এবং আধিপত্য স্বীকার করতে অস্বীকৃতির এক নজির। এটি সমগ্র বিশ্বজুড়ে একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় পরিণত হয়েছে।
কেউই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একাত্ম থাকার কথা এখন উল্লেখ করতে চায় না, তাদের শুধু পাশাপাশি দেখা যায়। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা অর্থনৈতিক যুদ্ধের ঘোষণাপত্র। এরপর আমরা রাজনৈতিক এবং অর্থনীতির বাইরে অন্য ক্ষেত্রেও প্রতিক্রিয়া জানাব। এ কথার মানে কি দাঁড়ায়? সামরিক প্রতিক্রিয়া? এই ভাবে বিশ্ব এক বিপজ্জনক পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের আত্মসমর্পণ করা কি উচিত? এটি হবে আত্মহত্যা। এটি হবে ধ্বংস, ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যাওয়া…
সুতরাং আমরা কি করতে যাচ্ছি? আমরা কি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি? আমরা কি ভিক্ষা করতে যাচ্ছি কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলার দিয়ে চাপ দিচ্ছে, কারণ ডলার ছাদে আঘাত করেছে, কারণ তুর্কি পণ্যগুলির উপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে? আমরা একটি ইতিহাস, একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনা, একটি জাতির মহান অগ্রযাত্রা পরিত্যাগ করতে যাচ্ছি?
যদি সেটিই হয় বাস্তবতা তবে কেন ১৫ জুলাই অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম, কেন আমরা গাজী পার্কের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম, কেন আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এখনো প্রতিবাদ করি, কেন সিরিয়া থেকে আমাদের ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করি?
পেছন ফেরা মানে আত্মহত্যা। এটি হবে ধ্বংস, ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যাওয়া, নিজেকে ডুবিয়ে দেয়া, সঙ্কুচিত করা, ২১ শতকের এবং ভবিষ্যতের জন্য হার মানা। আমরা এটা কখনোই করব না। আমরা আমাদের মাতৃভূমির জন্য সংগ্রামের মতো একটি অর্থনৈতিক সংগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছি। আমরা এই ক্ষুধার্ত নেকড়েদের কাছে আত্মসমর্পণ করবো না, এই জাঁকালো, এই লুটেরা যারা জাতীয় ও স্থানীয় সব কিছু আক্রমণ করছে তাদের কাছে নত হবো না।
আমাদের প্রতিরোধ ছাড়া কোন বিকল্প নেই!
আমাদের সামনে সত্যিই অন্য কোন বিকল্প নেই। প্রতিরোধ ছাড়া কোন পথ নেই, মহান সংগ্রামের জন্য এবং নিজেদের তুলে ধরা ছাড়া আমাদের কোনও বিকল্প নেই। যারা বলে আমরা করছি করছি তারা মিথ্যা বলছে। যারা বলে আমরা করছি তারা বিশ্বের মহা জাগরণকে বুঝতে পারে না অথবা বাইরের এই আক্রমণে ভেতরের অংশীদার হিসাবে কাজ করছে।
এই জাতি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছে। এই জাতি আনাতোলিয়ার মাধ্যমে সমগ্র অঞ্চলকে শাসন করেছে। এই দেশ যে ইউরোপের দরজা তা প্রমাণ করেছে। এই জাতির একটি অনন্যসাধারণ রাজনৈতিক সম্পদ আছে। এই জাতি একা এই অঞ্চলে হাজার বছরের ইতিহাস তৈরি করেছে। এটাকে কারো খাটো করে দেখা উচিৎ নয় অথবা কারো হালকাভাবে নেওয়াও ঠিক হবে না। আমরা এমন একটি জাতি যে সফলভাবে কঠিন সময় অতিক্রম করে এবং এমন একটি মুহূর্তে তারা নিজেদের পুনর্বিন্যস্ত করে যখন বলে ‘সে সময়টি চলে গেছে।
আমরা আবার এটি করতে পারবো। আমরা গত ১৫ বছরে এই পথ ধরে চলছি। আমরা চালিয়ে যেতে যাচ্ছি। আমরা মহা সংহতি অব্যাহত রাখতে যাচ্ছি দ্বিধাবিহীন ঝাঁকুনি ছাড়া। আপনি মহা প্রদর্শন ছাড়া বিজয় অর্জন করতে পারবেন না। মূল্য পরিশোধ না করে একটি মহান রাষ্ট্র হওয়া যাবে না; একটি অঞ্চলকে বিনির্মাণ করা যাবে না, একটি মহান রাষ্ট্র হওয়ার আগে ইতিহাস লেখা যাবে না।
আতঙ্ক নয়, এটি একটি মহা সংগ্রাম আছে। এটা কোন বেঠিক দাবি নয়, জয় আমাদের হবে, আমরা ভীত বা আতঙ্কিত হবো না। আমরা প্রকাশ্য হুমকির মুখে নীরব থাকছি না, ব্ল্যাকমেইল বা আমাদের জাতির ও দেশের লক্ষ্যকে হেয় করার কাজে আমরা নীরব থাকব না। এই কাজ করার সময়, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভিতর থেকে আমাদের বধ করার চেষ্টা করবে তাদের জন্য আমরা ক্ষমা করতে যাচ্ছি না। আমরা যারা সুযোগ হিসাবে এটিকে গ্রহণ করতে চাইছে এবং অভ্যন্তরে কিছু চাতুরীর পরিকল্পনা করতে সুযোগ নিতে চাচ্ছে তারা কখনও সফল হবে না।
আমরা জিতব। এটা কোন বেঠিক দাবি নয়। আমরা একমাত্র দেশ নই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধে রয়েছে প্রায় সমগ্র বিশ্বই এখন এ যুদ্ধে রয়েছে। এটি একটি বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক প্রদর্শনী। এটি একটি বিশাল ক্ষমতা বদলের ঘটনা। এটা কেবল তুরস্কের যুদ্ধ নয়। আপনি কেবলমাত্র তুরস্ককে বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতিকে অনুধাবন করতে পারবেন না।
আমেরিকা হলো এই যুদ্ধে হেরে যাবার পক্ষ। মানবতা, বিশ্বের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের প্রতিশোধ নিবে। এখন এক সর্বাত্মক যুদ্ধের সময়। আপনার সমস্ত সময়সূচী এখন একপাশে রাখুন, এসব স্থগিত রাখুন এবং তা বন্ধ করুন। এটা স্বাধীনতার জন্য একটি অনন্য অর্থনৈতিক যুদ্ধের সময়।
অনুবাদ: মাসুমুর রহমান খলিলী