কওমি সনদ আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন: ইতিহাসের মাইলফলক
গত ১৩ আগস্ট’১৮ কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান দেয়া সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আমরা এ অনুমোদনকে স্বাগত জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব, প্রস্তাবিত খসড়া আইন নিরীক্ষণের জন্য গঠিত সরকারি কমিটির প্রতিনিধিগণ, কওমি শিক্ষা কমিশনের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই। এতদিন দেশে শিক্ষা বিস্তার ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিশাল অংশ এই স্বীকৃতি থেকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত ছিল।
কওমি ধারার নীতিনির্ধারক আলিমগণ আশাবাদী সরকার তার বর্তমান মেয়াদেই আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন এবং সংসদের অনুমোদন গ্রহণ করবেন। এর মাধ্যমে ১৫ লাখ কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের দাবী পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। দেশের ভেতরে বাইরে উচ্চতর জ্ঞান আহরণ ও বিতরণে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন। সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ফলে কওমি শিক্ষার্থীদের খিদমতের পরিধি আরো বিস্তৃতি লাভ করলো এবং তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্র বিপুলসংখ্যক মেধাবী মানুষের সেবা লাভ করবে। ১৪ হাজার কওমি মাদরাসা সরকার থেকে কোনো ধরণের বেতন, ভাতা, অনুদান ও অবকাঠামোগত ফ্যাসিলিটিজ নেবে না এবং যে কোনো ধরনের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকবে। সিলেবাসে কোনো ধরণের পরিবর্তন আনতে হলে সরকার পরামর্শ দিতে পারেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়ার অংশিদার ৬ শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধিগণ। আমাদের মনে রাখতে হবে এটি একটি বিশেষায়িত শিক্ষা এবং দক্ষ-যোগ্য-দেশপ্রেমিক আলিম তৈরিই এর লক্ষ্য।
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গণভবনে কওমি মাদরাসার আলিম-ওলামাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোকে ভিত্তি ধরে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান করে। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে আদেশ জারি করা হয়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনাব আলী ইমাম মজুমদারের মন্তব্য এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। ‘প্রত্যেককে একটি স্তর যেমন অষ্টম বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত আসতে হয় একই সিলেবাসের মধ্য দিয়ে। এতে তারা ভাষা, গণিতসহ মৌলিক কিছু বিষয়ে ধারণা পেয়ে যায়। জানা যায়, কোনো কোনো কওমি মাদরাসায়ও ইংরেজি ও গণিত পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। তবে এই সংখ্যা খুবই সীমিত। ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবনাচারে অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে আছে। অবশ্য অনেক স্কুল, কলেজ ও আলিয়া মাদরাসায় এটা শেখানোর ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তবে হতে হবে। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরও এসব বিষয়ে একটি স্তর পর্যন্ত জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা তাদের পরিচালকেরা নিজ থেকেই করতে পারেন। সনদের সমতাকরণ চাকরির নিশ্চয়তা দেবে না। প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে এর বিকল্প কিছু নেই, এটা নিশ্চয়ই তাঁরা অনুধাবন করেন। তাঁরা বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ। সমাজে সম্মানিত অবস্থানে আছেন। তাঁরা কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন চলার পথকে সহজ করতে ডিগ্রির সমতাকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘকাল। সরকার তা মেনেও নিয়েছে। তবে সে সমতাকরণই একমাত্র সমাধান নয়, এটা সবাই বুঝতে পারেন।’
‘বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী| জন্ম থেকে মৃত্যু, বিয়ে সব ক্ষেত্রেই তাদের প্রয়োজন আলেমদের। তাঁদের প্রতি সবাই যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। সেই আলেমদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হবে। কোরআন, হাদিস, ফিকহসহ এসব বিষয়েই তাঁদের পারদর্শী হতে হয়। এ নিয়ে কেউ জীবনাবধি গবেষণাও করেন। তবে মাদরাসায় যাঁরা পড়েন, তাঁদের সবারই পেশা হিসেবে ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাদরাসার শিক্ষক বা স্কুলের ধর্ম শিক্ষক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আলিয়া মাদরাসার ছাত্রদের জন্য পথ খোলা আছে। কওমি মাদরাসার জন্যও খোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে সে পথে চলার পাথেয় তাদের সংগ্রহ করে আনতে হবে শিক্ষাঙ্গন থেকেই। আর দাবিটির নেতৃত্ব যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের তা উপলব্ধি করার মতো বিচক্ষণতাও রয়েছে।’
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন