জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঈদুল আযহা ও হজ দিবস:  তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য

ঈদুল আযহা হজ দিবস:  তাৎপর্য মাহাত্ম্য

আরবী পঞ্জিকা অনুযায়ী যিলহজ মাসের ৯ তারিখ পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং পরদিন ১০ তারিখ ঈদুল আযহা। মুসলমানদের কাছে এ দু’টো দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী। যিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফাহ দিবস নামেও পরিচিত। এর বিশেষ ফযিলত ও বিশেষত্ব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতে ‘আরাফাহ দিবসের রোযা দু’বছরের (বিগত ও অনাগত) গোনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আরাফার দিন আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের গর্ব করে বলেন, আমার এ সব বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ! তারা এলোমেলো কেশ ও ধুলোয় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে’ (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩, ১৩৪৮)। স্মর্তব্য যে, আরাফার দিন তারাই রোযা রাখবেন যারা হজ পালনরত নন। যারা হজ পালনোপলক্ষে আরাফাতে অবস্থান করবেন তাদের ওপর রোযা নেই। তবে আরাফাতে অবস্থানকালীন হাজীগণ অধিক হারে যিকির ও দোয়াসহ অন্যান্য নেক আমলে তৎপর থাকবেন (সুনানে তিরমিযী: ২৮৩৭, ইমাম খাত্তাবী, শান আদ দুআ, পৃ. ২০৬)। আরাফার দিন (৯ যিলহজ) হতে মিনার শেষ দিন (১৩ যিলহজ) পর্যন্ত হজ পালনরত এবং দেশে-প্রবাসে অবস্থানরত প্রত্যেক মুসলমান নারী পুরুষকে তাকবীর পাঠ করতে হবে (ফাতহুল বারী, খ. , পৃ. ৫৩৫)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যিলহজের প্রথম ১০ দিন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠদিনগুলোর অন্যতম। এ ১০ দিন নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবর) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে পাঠ কর (সহীহ আল-বুখারী: ৯৬৯ সুনানে তিরমিযী: ৭৫৭)। যিলহজ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে হজ ও কুরবানির দিন।

শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ এ তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবেহ করাই হল কুরবানী। নেক আমলসমূহের মধ্যে কুরবানী একটি বিশেষ আমল। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় কুরবানী করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের পাশাপাশি মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন, চিন্তার স্বচ্ছতা, ত্যাগের মহিমা, হৃদয়ের উদারতা সবকিছু মিলে কুরবানী এক স্মরণীয় অধ্যায়। ঈদুল আযহার দিন (১০ যিলহজ) পশু কুরবানী সর্বোচ্চ ইবাদত। ঈদুল ফিতরের চাইতেও কুরবানীর দিনের মর্যাদা বেশি। ওই দিন গোসল, পরিচ্ছন্নতা অর্জন, সুগন্ধি ব্যবহার, উত্তম পোষাক পরিধান, দু’রাকাআত জামাআতের সাথে নামায আদায়, গোশত পরিবেশন ও বিতরণ ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত।

মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে ঈদ পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। তাই ঈদ শুধু আনন্দ ও ফুর্তির উৎস নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে ইবাদত, কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যবহ। এলাকার লোকেরা ঈদের নামাযের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সকলের মধ্যে একাত্মতা ও সমপ্রীতি ফুটে ওঠে-ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী গরীবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী গরীব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদুল আযহার যে কুরবানী দেওয়া হয় তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কুরবানীর রক্ত-মাংস কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়কে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন।

খাঁটি নিয়ত সহকারে কুরবানী করা এবং নিজেদের আনন্দে অন্যদের শরীক করা ঈদুল আযহার শিক্ষা। কুরবানীকৃত পশুর গোশত তিন অংশে ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ, দ্বিতীয় অংশ আত্মীয়-স্বজনকে প্রদান এবং তৃতীয় অংশ সমাজের অভাবগ্রস্থ ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া ইসলামের বিধান। কুরবানীকৃত পশুর চামড়া অনাথ আশ্রম, এতিমখানা ও মাদরাসায় পড়ুয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের জন্য প্রদান করলে দ্বিবিধ সওয়াব হাসিল হয়। এক দুঃখী মানুষের সাহায্য এবং দ্বিতীয় দীনী শিক্ষার বিকাশ। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীদাতা কেবল পশুর গলায় চুরি চালায় না বরং সে তো চুরি চালায় সকল প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে। এটিই কুরবানীর মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তি। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয় তা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-এর সুন্নাত নয়, এটা এক রসম তথা প্রথা মাত্র। এতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে কিন্তু সেই তাকওয়া হাসিল হয় না যা কুরবানীর প্রাণশক্তি। পশু কুরবানীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশু শক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কুরবানী দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কুরবানীর মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়।

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ