জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সারাওয়াক: ধনেশ পাখির দেশে

সারাওয়াক: ধনেশ পাখির দেশে

সারাওয়াক: ধনেশ পাখির দেশে

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

কুয়ালালামপুর থেকে ২ ঘণ্টার এয়ার এশিয়ার ফ্লাইটে দক্ষিণ চীন সাগর পাড়ি দিয়ে সারওয়াক প্রদেশের রাজধানী কুচিংয়ে এসে পৌঁছলাম ১২ মে’১৮ দুপুরে। নাগরিক সব সুবিধা সম্বলিত বিশাল আয়তনের ছিমছাম বিমানবন্দর। সাথে আছে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়নরত আমার ছোট ছেলে নাঈম তালহা। সারাওয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ে(UNIMAS) অধ্যয়নরত নাঈম উল্লাহ ইয়াসির ও সাকিব আমাদের বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত ছিলেন।  স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ হওয়ার কারণে ঐতিহ্যগতভাবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেসনের আনুষ্ঠানিকতা সারতে হয়। এতদঞ্চলের মানুষগুলো সহজ, ভদ্র ও বন্ধুবৎসল। পর্যটকদের সম্মান ও আতিথ্য প্রদর্শনে তারা কার্পণ্য করে না।

সারাওয়াকে আমাদের তিনদিন হোটেলে অবস্থান, সার্বক্ষণিক দেখভাল, খাবার দাবার, গাড়ি নিয়ে দর্শণীয় স্থান পরিভ্রমণ সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ইয়াসির ভাই। তিনি বর্তমানে সারাওয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ে(UNIMAS) বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স করছেন। এর পূর্বে তিনি অস্ট্রেলিয়ার Swinburneপ্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের সারাওয়াক ক্যাম্পাস থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। ইয়াসির ভাই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ার প্রাক্তন প্রধান পরিচালক হযরত শাহ মাওলানা হাজী ইউনুছ (রহ.)-এর তিনি দৌহিত্র। বান্দরবান ইসলামী সেন্টারের প্রধান পরিচালক মাওলানা হোছাইন আহমদ সাহেব (দা. বা.)-এর ছেলে। সদাচরণ, মানুষের সেবা ও অতিথিপরায়ণতা তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য। তিনি বারবার আমাকে বলেন এত কম সময় নিয়ে আসলেন কেন? সাকিব একজন সচিবের ছেলে। সারাওয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ে(UNIMAS) আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামের ছাত্র। তিনব্যাপী তিনি আমাদের সাথে ছিলেন ও ড্রাইভিংয়ের দায়িত্ব পালন করেন। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে কুচিং বিমানবন্দরে তাঁদের বিদায় জানাতে গিয়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।

ধনেশ পাখি

সারাওয়াক ধনেশ পাখির দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রদেশের সর্বত্র এ পাখি দৃষ্টিগোচর হয়। ধনেশ শক্ত ও লম্বা বাঁকানো ঠোঁটঅলা Bucerotidaeপরিবারভুক্ত পাখি। ঠোঁটের উপরে অধিকাংশ সময়ে শিঙয়ের মতো একটি গঠন দেখা যায়। এরা আকৃতিতে শকুনের চেয়েও অনেক বড়। ওজন প্রায় ৩-৬ কেজি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে অধিকাংশ ধনেশের প্রধান আবাস। অসাধু কিছু চক্র ধনেশ পাখি শিকার করে ‘ধনেশের তেল’ বিক্রি করে। এছাড়া পাহাড়িরা মাংস হিসেবে ধনেশ ধরে খায়। সারাওয়াকে ধনেশ পাখি শিকারীদের ২৫ হাজার রিংগিত জরিমানা ও ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ৫৪ প্রজাতির মধ্যে ৮ প্রজাতির ধনেশ সারাওয়াকের গহীন বনে বসবাস করে। স্থানীয় জনগণ ধনেশকে সম্মানের চোখে দেখে থাকে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও সৌভাগ্যের প্রতীক বিবেচনা করে। ধনেশ পাখি যদি কারো বাসা বাড়ির ওপর উড়ে যায় তাহলে সে ঘরে সৌভাগ্য ধরা দেবে এমন একটি বিশ্বাস এতদঞ্চলের মানুষরা পোষণ করে। তাই এখনো মহাসড়কের পাশে ধনেশ পাখির পাথরের ভাস্কর্য চোখে পড়ে।

কাছে থেকে দেখা

পূর্ব মালয়েশিয়ার বর্নিও দ্বীপে অবস্থিত সারাওয়াক প্রদেশ। দক্ষিণ চীন সাগর পূর্ব মালয়েশিয়াকে পশ্চিম মালয়েশিয়া থেকে পৃথক করে রেখেছে। মালয়েশিয়ার ১৩টি প্রদেশের মধ্যে আয়তনে বৃহত্তর সারাওয়াক প্রদেশ তেল, গ্যাস, বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। মালয়েশিযার ৬৫% ট্রপিক্যাল হার্ডউড টিম্বার এ প্রদেশ থেকে রফতানি হয়। সারাওয়াকের উত্তরে ব্রুনাই দারুস সালাম ও দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়া অবস্থিত। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান মতে সারাওয়াকের জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ ৭০ হাজার। আয়তন প্রায় ১লাখ ২৪হাজার ৪৫১ কিলোমিটার। সরকারী ভাষা ইংরাজী ও মালয়। সারাওয়াকে ৪০টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে, এর মধ্যে ৬টি প্রধান। প্রত্যেকের রয়েছে আবার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারা। অপরাপর অঞ্চল থেকে সারাওয়াকের এটাই স্বতন্ত্রতা।

 ১৫ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত সারাওয়াক ছিল ব্রুনাই সালতানাতের অধীনে। রাজা Jame Brookeআগমনের পর ১৮৪১ সালে এটি পৃথক রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ব্রিটিশ  আমল থেকে সারাওয়াক স্বায়িত্বশাসিত অঞ্চল। ১৯৬৩ সাল থেকে মালয়েশিয়া ফেডারেশনের সদস্য। প্রদেশের প্রধান হচ্ছেন গভর্নর এবং সরকার প্রধান হচ্ছেন মূখ্যমন্ত্রী। সারাওয়াক বহু বছর জাপান ও বৃটিশের শাসনাধীন ছিল। ফলে অধিকাংশ মানুষ খ্রিস্টান। পুরো জনসংখ্যার ৪২% খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ২য় বৃহত্তম ধর্ম হল ইসলাম। ৩২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি সুন্দর পরিবেশে এখানে বিরাজিত।

১২ মে বিকেলে ইয়াসির ও সাকিব দামাই রিসোর্টের অদূরে দক্ষিণ চীন সাগর দেখাতে নিয়ে যান আমাদের। সাগরের তীরে মুক্ত হাওয়া অবগাহন করে সন্ধ্যায় কুচিংয়ের হোটেলে ফিরে আসি। মালয়েশিয়ার বাস, ট্রেন, বিমানবন্দর, বিনোদন পার্ক, মার্কেট, শপিং মল, খেলার মাঠ সব জায়গায় নামাযের ব্যবস্থা আছে। এ ব্যবস্থাপনা প্রশাসনিকভাবে বাধ্যতামূলক।

কুচিং শহরের খোলামেলা স্থানে বহু রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে সন্ধ্যাবেলা গ্রাহকের ভীড় লেগে থাকে সব সময়। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেকে এখানে সান্ধ্যখাবার বা নৈশভোজ সারতে আসে। আমরা পার্লামেন্ট ভবনের অনতিদূরে এমনি একটি খোলা রেস্টুরেন্টে স্যামন(Salmon) মাছের ফ্রাইড কাটলেট দিয়ে নৈশভোজ সারি। স্যামন মাছ বেশ উপাদেয় ও স্বাস্থ্যবান্ধব। জীবনে এই প্রথম স্যামন মাছের স্বাদ উপভোগ করি। সাধারণত উত্তর আটলান্টিক সাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও তার শাখা নদীতে স্যামন মাছ পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ  ৬১ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়ে থাকে। স্যামন মাছে রয়েছে উচ্চমাত্রার ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড ও ভিটামিন ডি।

সারাওয়াকে প্রাকৃতিকভাবে অনেক গুহা সুড়ঙ্গ রয়েছে। মাথার উপরে বিশাল পাহাড়, প্রকান্ড বৃক্ষ, লতাগুল্ম, নিচে গুহা ও সুড়ঙ্গ। সরকার পর্যটকদের সুবিধে নিশ্চিত করে গুহা অভ্যন্তরে চলাচলের জন্য সেতু তৈরি করে দেন। গুহার মুখে প্রাকৃতিক পরিবেশে নিবিড় সময় কাটানোর জন্য বসার ও বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় হাঁফিয়ে উঠা মানুষ কিছু সময়ের জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসে। Niahগুহা ৪০ হাজার বছরের পুরণো। আমরা Wind I Fairyগুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করি। বেশ শান্ত ও সমাহিত পরিবেশ।

ইসলামের আগমন

সারাওয়াকে ইসলামের আগমনের সঠিক দিন তারিখ লিপিবদ্ধ নেই। তবে প্রাচীন কাল থেকে আরব বণিকদের এ অঞ্চলে আসা যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এতগুলো মানুষকে মুসলমান বানানোর পেছনে নিঃসন্দেহে সুফী দরবেশ ও ধর্মপ্রচারকদের মেহনত আছে। কুচিং শহরে দুটি প্রাচীন সমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে। সমাধিগাত্রে লিখিত আছে ১২৪২ সাল। এতে প্রতীয়মান হয় ত্রয়োদশ শতকে সারওয়াকে ইসলামের বিকাশ ঘটে। এমনও হতে পারে যে, অনেক মুবাল্লিগ দাওয়াতি কাজ শেষে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। ফলে তাঁদের সমাধি এ দেশে নেই। ১৮৪১-১৯১১ এ সময়ে ইসলামের প্রচার প্রসার ব্যাপকতা লাভ করে। ১৮৫২ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কুচিংয়ে মসজিদ স্থাপিত হয়। সে সময় বেশ ক’জন ধর্মীয় নেতার আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে দাতুক হাকিম আবদুর রহমান, শায়খ ওসমান আবদুল ওয়াহাব, মুরশিদী আবাং হাজী নূরুদ্দিন, আবাং মুয়াসিলী আবদুর রহমান অন্যতম। তাঁরা পবিত্র মক্কায় গিয়ে দীনী ইলম হাসিল করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে এ অঞ্চলে ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের প্রচেষ্ঠায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পবিত্র কুরআন শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে উঠে। এখন পুরো প্রদেশ জুড়ে অসংখ্য মসজিদ ও মাদরাসায় ধর্মচর্চা অব্যাহত রয়েছে।

পেত্রা জায়ায় অবস্থিত সারাওয়াক স্টেট মসজিদ পরিদর্শন করি। এটি সারওয়াকের প্রথম ও প্রাচীন মসজিদ। পুননির্মাণের পর এটি ১৯৯০ সালে নামাযের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বর্ণিল কারুকার্য শোভিত, পবিত্র কুরআনের আয়াত ও আল্লাহ তায়ালার ৯৯ নাম উৎকীর্ণ অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশন অনন্য ও দৃষ্টিকাড়া। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদকে ভেঙ্গে নতুনভাবে আধুনিক স্থাপত্য রীতি ও তুরস্কের ইস্তাম্বুলের মসজিদের আদলে তৈরি করা হয়। মিনারার উচ্চতা ৯৯ মিটার। সবুজ বর্ণের আয়াতাকার গম্বুজ মসজিদের শোভা অনেকাংশে বর্দ্ধন করে। ১০ হাজার মুসল্লি একসাথে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করার মত স্পেস রয়েছে। ঈদের নামায আদায়ের জন্য মসজিদের রয়েছে বিশাল ও প্রশস্ত সাহান। কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে গ্রন্থাগার ও কনফারেন্স হল।

হোটেলকক্ষে বাইবেল

কুচিং শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি ত্রিস্টার হোটেলে ৩দিন ছিলাম। ইয়াসির ভাই আগেভাগে বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। টেবিলের ড্রয়ার টানতেই দেখি ইংরেজি ভাষায় লিখিত পবিত্র বাইবেল(The Holy Bible)। এটি বাইবেল প্রচারকদের দাওয়াতের অংশ। তাঁরা মনে করেন যে, পর্যটক যখন হোটেলে বিশ্রাম নেবেন এবং কোন অবসর মুহূর্তে পবিত্র বাইবেল একটু উল্টিয়ে দেখবেন। হতে পারে বাইবেল সম্পর্কে তার কৌতুহল বৃদ্ধি পাবে এবং এক পর্যায়ে বাইবেলের অনুসারী হয়ে পড়বেন। এ রকম থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের ৪ তারকা হোটেলেও দেখেছি।

বর্নিও হাইল্যান্ড: ঘনবর্ষণের বনাঞ্চলে প্রকৃতির মিতালী

সকালে প্রাইভেট কার নিয়ে রওনা হই বর্নিও হাইল্যান্ডের উদ্দেশ্য। সাথে ছিল ইয়াসির, সাকিব ও তালহা। স্বল্প সময় ৬০ কিলোমিটার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই বর্নিও হাইল্যান্ডের প্রবেশদ্বারে। সকড়ের দু’পাশের শোভা হৃদয় মনকে রাঙিয়ে দেয়। দীর্ঘ এ পাহাড়ি পথ সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রবেশদ্বার থেকে হাইল্যান্ড রিসোর্টের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। অত্যন্ত বন্ধুর এ পথে দক্ষ চালক নাহলে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বিপদ হতে পারে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩২৮১ ফিট এবং তাপমাত্রা ১৮-২৮ডিগ্রী। উল্লেখ্য যে, মালয়েশিয়ার সাধারণ তাপমাত্রা ৩১-৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। চারিদিকে গহীন বন, পাখ-পাখালির কিচির মিচির, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘের দলের আনাগোনা, মৃদুমন্দ হাওয়া ও জীববৈচিত্র্য মন ও হৃদয়কে চাঙা করে তুলে।

নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে মানুষ ছুটে আসে ক্ষণিকের স্বস্তির প্রত্যাশায়। এখানের কফিশপ, ক্যাফে, আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, বর্ণিল ফুলের বাগান, হর্টিকালচার নার্সারি, অর্গানিক ফার্ম, ঝর্ণাধারা, ঘোড়াশালা ও চায়নিজ টি হাউজ বর্নিও হাইল্যান্ডের বাড়তি আকর্ষণ। সর্বোচ্চ চূড়া থেকে ইন্দোনেশিয়ার কালিমান্তান প্রভিন্স দেখা যায়।

ইসলামী ঐতিহ্য যাদুঘর

ইয়াসির ও সাকিব আমাদের নিয়ে গেল কুচিং শহরে অবস্থিত ইসলামী ঐতিহ্য যাদুঘরে। মালয়-ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের আগমন, বিকাশ, ধর্ম প্রচারকদের অবদান বিশেষত সারওয়াক অঞ্চলে মুসলিম কমিউনিটির সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের একটি সঠিক চিত্র উপস্থাপন করে এ যাদুঘর। অনেকে এখানে আসেন শেকড়ের সন্ধানে। যাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন স্মারকগুলো মুসলিম দুনিয়ার সাথে এ অঞ্চলের সম্পর্ক নির্দেশ করে।

আমরা ঘুরে ফিরে ৭টি গ্যালারিতে রক্ষিত আরবী ক্যালিগ্রাফি, আরবী অক্ষরে উৎকীর্ণ তৈজষপত্র, কুরআনের আয়াত লিখিত গিলাফ, সারওয়াক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নামকরা মসজিদের ছবি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, নানা সাইজের দফ, বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, মুসলিম নারী পুরুষের পরিচ্ছদ, খোদাইকৃত কাঠের আসবাবপত্র দেখি এবং মুগ্ধ হই। ১৯৯২ সালে সারওয়াক প্রদেশের তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী দাতুক হাজী আবদুত তালিব বিন মুহাম্মদ এ যাদুঘরের উদ্বোধন করেন।

ঐতিহ্যের সন্ধানে মানুষ এখন নেই। এখানে দর্শক নেই থাকলেও কম। অথচ প্রতিটি গ্যালারিতে এয়ার কুলার চলছে। অপর দিকে বিড়ালের যাদুঘরে লোকে জমজমাট। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ছোঁয়া। পুরনো ইসলামের ঐতিহ্যের যাদুঘরে ব্যবস্থাপনাও পুরনো।

সারাওয়াক বিশ্ববিদ্যালয়(UNIMAS) পরিদর্শন

মালয়েশিয়ার অষ্টম বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া সারাওয়াক(UNIMAS)  পরিদর্শন করি। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এটি প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইয়াসির ও সাকিব দু’জনই এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। কয়েক হাজার একর জুড়ে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি, আবাসিক হল, ক্লাশরুম, প্রশাসনিক ভবন, অডিটোরিয়াম, ক্যাফেটেরিয়া ঘুরেঘুরে দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সালাহুদ্দিন মসজিদে যোহরের নামায আদায় করি। মসজিদের স্থাপত্য শৈলী ও নির্মাণকৌশল সত্যিকার অর্থে দৃষ্টিনন্দন। হ্রদ ও  সবুজ বনরাজি পরিবেষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মনমাতানো ও শিক্ষাবান্ধব। UNIMAS– এর অধীন ৫০টি অনুষদ, ৬০টি রিসার্চ সেন্টার, ৪২টি আন্ডার গ্রাজুয়েট ও ৪০টি পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। ৫২টি দেশের ১৬ হাজার ছাত্র ছাত্রী এখানে শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। কলা, সমাজ বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল, অর্থনীতি, বিজনেস স্টাডিজ, তথ্য প্রযুক্তি, মানব উন্নয়ন, কগনিটিভ বিজ্ঞান, এপ্লাইড ও ক্রিয়েটিভ আর্টস, ভাষা ও যোগাযোগ UNIMAS-এর বৈশিষ্ট্য।

নবপ্রতিষ্ঠিত হিফযখানা পরিদর্শন

১৫ মে’১৮ সন্ধ্যায় গুমবাক এলাকার পাদাং বালাং এ অবস্থিত মাআহাদ তাহফিয দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া পরিদর্শন করি। মাত্র ৪ মাস আগে হাফেয উসামা সাহেবের তত্ত্বাবধানে এ প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। ২৫ জন মালয় ছাত্র নিয়ে এ মাদরাসার যাত্রা শুরু।

হেফযখানার জন্য ক্লাশ রুম ও আবাসনের ব্যবস্থা করেন হাজী ইউশা ইবন ইয়াহয়া নামক ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভূত এক শিক্ষানুরাগী। মাদরাসায় পৌঁছলে তিনি আমাকে স্বাগত জানান। কচিকাঁচাদের পবিত্র কুরআন শিক্ষার সুব্যবস্থার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। পরে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নসীহতমূলক বক্তব্য রাখি এবং আল্লাহ তায়ালার রহমত কামনা করে মুনাজাত পরিচালনা করি।

কুয়ালালামপুরে আলিম ও ইসলামী  চিন্তাবিদদের পরিচালিত রেডিও এফএম ৯১.৫০

মালয়েশিয়ার আলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ ২০০১ সাল থেকে একটি রেডিও প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছেন কুয়ালালামপুর স্টেশন থেকে। এটি IKIM FM 91.50 কিলোহার্টজে শোনা যায়। ডা. মাহাথির মুহাম্মদ আগে ক্ষমতায় থাকতে এটির অনুমোদন দেন। Institute of Islamic Understanding, Malaysia নামক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ২৪ ঘন্টার এ রেডিও প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। ৯৫ শতাংশ প্রোগ্রাম মালয় ভাষায় এবং ৫ শতাংশ ইংরেজি ও আরবি ভাষায় সম্প্রচারিত হয়।

তাফসীরুল কুরআন, হাদীসের বাণী, সংবাদ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজ, বিনোদন, তথ্য কণিকা, খবর পর্যালোচনা, মুসলিম বিশ্ব, স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে প্রোগ্রাম সম্প্রচারিত হয়।

মালয়েশিয়ার আ. ই. বিশ্ববিদ্যালয়ে জুমার খুতবা প্রদান ও ইমামতির দায়িত্ব পালন

 ১৮ মে’১৮ শুক্রবার মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে ‘মুসলিম ঐক্য ও আমাদের দায়িত্ব’ শীর্ষক বিষয়ে ইংরাজী ভাষায় বক্তব্য রাখি এবং কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করি। পরে জুমার খুতবা ও ইমামতির দায়িত্ব পালন করি। মালয়েশিয়ার প্রতিটি প্রদেশে সুলতানের জন্য খুতবায় দু’আ করা বাধ্যতামূলক। আমিও সেলেঙ্গারের সুলতান শারাফুদ্দীন ইদরীসের জন্য দুআ করি।

নামায শেষে মসজিদের ভেতরে বিদেশী এক ব্যক্তির জানাযার নামাযেও ইমামতি করি। বিপুল সংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ মুসল্লি নামাযে অংশ নেন। প্রজেক্টরের মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠান বিভিন্ন কক্ষে রিলে করা হয়। পৃথক এনক্লোজারে ছাত্রী ও মহিলা শিক্ষিকাবৃন্দ পর্দার সাথে নামায আদায় করেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১৭টি দেশের ৩০,৬৪৯ জন ছাত্র-ছাত্রী ১৪টি ফ্যাকাল্টি ও ৩টি ইনিস্টিটিউটের অধীনে ভাষা, অনার্স ও মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়ন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ১৯৮০ জন শিক্ষক রয়েছেন। এখানে ১৯টি ছাত্রাবাস রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি মেয়েদের। মেয়েদের হলে পুরুষ ছাত্রদের আর ছেলেদের হলে মেয়েদের আনাগোনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সব দয়া, প্রশংসা ও মেহেরবানি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। আল-হামদুলিল্লাহ।

যে সব বিদেশী মেহমান মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে লেকচার ও খুতবা প্রদান এবং ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। পরিদর্শন বইতে তাঁদের মন্তব্য লিখতে হয়। আমিও যথারীতি সম্মানসূচক মন্তব্য লিখি।

আ. ই. বিশ্ববিদ্যালয়ে রামাযানের তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা

১১ মে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস কমপ্লেক্সে মাহাল্লা বেলাল মসজিদ মিলনায়তনে ছাত্রদের ব্যবস্থাপনায় ‘রামাযানের তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আমি ১ ঘণ্টা বক্তব্য রাখি এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর প্রদান করি। অন্ষ্ঠুান শেষে মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীবৃন্দ কিছু উপহার সামগ্রী আমার হাত তুলে দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নরত গবেষক ভাই মুহাম্মদ মুহিব। সঞ্চালনায় ছিলেন ভাই হাসিবুর রহমান সিয়াম।

ছাত্রগণ বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে কিয়ামুল লাইল ও রোযা পালন করেন।

সততার শিক্ষা

মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি আবাসিক হলে DESA নামক ১৫০০ মিলি. বোতলজাত পানি নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। Angenet Sdn. Bhd নামের একটি মিনারেল ওয়াটার উৎপাদনকারী কোম্পানি এ দায়িত্ব পালন করে থাকে। সাইন বোর্ডে লেখা আছে সৎ হতে পছন্দ করুন (Choose to be honest) এ পানি ফ্রি নয়। ২ রিংগিত দিয়ে কিনুন। লব্ধ অর্থ মুহাব্বত প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীগণ নির্ধারিত বক্সে ২ রিংগিত জমা দিয়ে বোতল নিয়ে যাচ্ছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম কিছু বক্স রিংগিতে ভর্তি হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীগণ রিংগিত বক্সের ওপর রেখে গেছে। যারা অসৎ তারা টাকা না দিয়ে পানি নিয়ে যেতে পারবে। কারণ এখানে কোন প্রহরী নেই। একমাত্র বিবেকই পাহারাদার। সততার চর্চা ও মানবিকতার উজ্জীবনে এ প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাকওয়া বা আল্লাহ তায়ালার ভয় মানুষকে সৎ ও মানবিক বানায়।

সাহাবায়ে কেরামের নামে আবাসিক হল

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি হলে ১৬ হাজার দেশী বিদেশী শিক্ষার্থী অবস্থান করে। ৭টি পুরুষের ও ৯টি মেয়েদের হল রয়েছে। ৪তলাবিশিষ্ট হলগুলো ‘মাহাল্লা’ নামে পরিচিত। পুণ্যাত্মা সাহাবাদের নামে হলের নামকরণ বেশ তাৎপর্যবহ। হলগুলো হলো আস সিদ্দিক, আল-ফারুক, উসমান, আলী, বিলাল, যুবায়ের আওয়াম, আমিনাহ, আছিয়া, রুকাইয়া, আসমা, হাফছা, হালিমাতুস সাদীয়া, মরিয়ম, নুসাইবা, সফিয়্যাহ ও সুমাইয়া।

পুত্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী প্রফেসরের সাথে সাক্ষাৎ

মালয়েশিয়ার পুত্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আবু হেনা এম কামালের সাথে ১৯ মে’১৮ কুয়ালালামপুরের Seri Petalingতাবলীগ মারকাযে সাক্ষাত ঘটে। তিনি এর পূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

সমুদ্রের জীববিজ্ঞানের ওপর তাঁর পাণ্ডিত্য স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক মানের বহু প্রবন্ধের তিনি রচয়িতা। তাঁর মতে মালয়েশীয় অঞ্চলের দক্ষিণ চীন সাগরে ১০০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে প্রচুর শৈবালের কারণে। বাংলাদেশে আছে এর অর্ধেক।

মালয়েশিয়ার তাবলীগ মারকায পরিদর্শন

১৯ মে১৮ কুয়ালালামপুরের Seri Petaling-এ অবস্থিত তাবলীগ মারকায কমপ্লেক্স পরিদর্শন করি। বেশ বড়সড় জায়গায় নিয়ে এর কার্যক্রম বিস্তৃত। কমপ্লেক্সের আওতায় বিরাট মসজিদ, বালক-বালিকা মাদরাসা ও ছাত্রাবাস রয়েছে। পুরো মালয়েশিয়া জুড়ে ইসলামী শিক্ষার বিকাশ, দীনী পরিবেশ সৃষ্টি ও দাওয়াতের কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ মারকাযের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

আ. ই. বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট স্টাডি কার্যালয় পরিদর্শন

১৮ মে’১৮ মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট স্টাডি(PGSS) কার্যালয় পরিদর্শন করি। PGSS– এর সেক্রেটারি অর্থনীতি বিযয়ে পিএইচডি কোর্সে গবেষণারত ভাই মুহাম্মদ মুহিব আমাকে স্বাগত জানান। বিশ্বের ১১৭ টি দেশের যেসব শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়ন করছে তাদের সংগঠন PGSS । বিকেলে আন্ডার গ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রদের আয়োজিত ইফতার মাহফিলে ‘পবিত্র কুরআন চর্চার প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক বিষয়ে বক্তব্য রাখি।

মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি

জাতীয় নির্বাচনের আগে পরে কয়েকদিন মালয়েশিয়া থাকায় সে দেশের জাতীয় নির্বাচন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ লাভ করি। ৯ মে’১৮ মালয়েশিয়ায় জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। সাথে সাথে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন কোন পক্ষ অপর পক্ষকে চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও স্বাধীনতা বিরোধী এসব অভিধায় গালাগাল করেননি। নাজিব রাজ্জাকের ক্ষমতাসীন পক্ষ সন্ত্রাস, দলীয় ক্যাডার, দলভূক্ত সরকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ইলেকশন ইনজিনিয়ারিং করে ক্ষমতা পুনর্দখলের মহড়া চালাননি। অপরদিকে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন বিরোধীজোটও বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা না করে সংযত রাজনৈতিক সহনশীলতার পরিচয় দেন। পেট্রোল বোমা, হরতাল, গাড়ি ভাংচুর করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেননি।

এখানে কারচুপির অভিযোগ নেই, রাস্তাঘাট বন্ধ করে নেই মিছিল মিটিং। ১৩টি প্রদেশের ২২২ টি আসনের মধ্যে ১২২টি আসনে বিজয়ী মাহাথির ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন সরকার গঠনের পর তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের বিরুদ্ধে কোন প্রতিশোধ নেবেন না। তিনি দলীয় কর্মীদের উচ্ছাস প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে বলেন।

মালয়েশিয়া থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এখানে মনে রাখতে হবে যুলুম ও বাড়াবাড়ি আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। তিনি যাকে ইচ্ছে করেন ক্ষমতায় বসান। তিনি যেকোন মানুষকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেন। অতএব আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করি।

হযরত নকশবন্দিব দা. বা.-এর গ্রন্থাবলির অনুবাদ ও সম্পাদনার জন্য কমিটি গঠিত

মালয়েশিয়ার হুলু লাংগাতে অবস্থিত মিফতাহুল উলুম মাদরাসায় অনুষ্ঠিত ৪দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক উলামা সম্মেলনে হযরত শাহ সুফি যুলফিকার আহমদ নকশবন্দি দা. বা. লিখিত কিতাবাদি বাংলা ভাষায় অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রকাশনায় গতি সঞ্চারের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটিতে আছেন মাওলানা মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া দা. বা., মাওলানা মুফতি মিজান সাঈদ দা. বা., মাওলানা উবায়দুর রহমান নদভী দা. বা., মাওলানা মুহাম্মদ দা. বা. ও ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।

হযরতের গ্রন্থাবলি যে কেউ ভাষান্তর করতে এবং যেকোন প্রকাশনা মুদ্রণ ও বাজারজাত করতে পারবেন। এগুলোর কোন গ্রন্থস্বত্ব নেই। কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে পর্যায়ক্রমে সব গ্রন্থ অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করা এবং বাজারে প্রকাশিত হযরতের গ্রন্থাবলির অনুবাদের মান যাচাই করা।উল্লেখ্য হযরতের লিখিত গ্রন্থাবলির সংখ্যা প্রায় ২’শ।

সৌভাগ্য

৭ মে’১৮ রাতে মালয়েশিয়ার হুলু লাংগত, সেলাঙ্গরে অবস্থিত মাদরাসা মিফতাহুল উলুমে বিশ্ববরেণ্য বুযুর্গ, লেখক, সুফি, পীর হযরত মাওলানা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দি, মুজাদ্দিদি দা. বা.-এর সান্নিধ্যে কিছু সময় অতিবাহিত করার সুযোগ হয়েছে। তিনি আমার বক্ষদেশ স্পর্শ করে বিশেষ দোয়া দেন। মুহূর্তে আমি পুলক শিহরণ অনুভব করি।

হযরতের পদপার্শ্বে বসে কদম মুবারক টিপে খিদমতের সুযোগ লাভে ধন্য হয়েছি। হে আল্লাহ, হে রহিম, আমাকে ইসলাহ করো। আমাকে ক্ষমা করো।

আন্তর্জাতিক উলামা সম্মেলন

৭ থেকে ১০ মে’১৮ পর্যন্ত ৪ দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক উলামা সম্মেলনে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাই থেকে প্রায় ৫শ’ প্রতিনিধি অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০জন আলিম শরীক হন। হুলু লাংগতে অবস্থিত মাদরাসা মিফতাহুল উলুমে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৭ মে মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী দাতু সেরি ড. আহমদ জাহিদ হামেদী হযরতজি মাওলানা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দি, মুজাদ্দিদি দা. বা.-কে তাঁর গ্রামের বাড়ীতে দাওয়াত প্রদান করেন। উদ্দেশ্য দোয়া নেওয়া ও খাবার পরিবেশন। ৫টি এসি ভলবো বাস নিয়ে ভক্তরা তাঁর সফরসঙ্গী হন। আসা-যাওয়া, দোয়া-খাবার ও মুনাজাত সব মিলিয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টার সফর। শারীরিক ক্লান্তির কারণে আমি অপারগতা প্রকাশ করি।

সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন মাদরাসায় কর্মরত আলিমগণ রান্নাবান্না ও খাবার পরিবেশনায় স্বতস্ফুর্ত সেবা প্রদান করেন। পুরো ৪দিনের কর্মসূচি ছিল ছকবাঁধা। শেষরাতে তাহাজ্জুদ নামায, ফজরের নামাযের পর মসজিদে বয়ান, ৮.৩০ মিনিটে প্রাতঃরাশ ও ব্যক্তিগত কাজের বিরতি। যোহরের জামায়াতের পর খতমে খাজেগান। দুপুরের খাবারের বিরতি ও বিশ্রাম। আসরের জামায়াতের পর বয়ান ও চা পানের বিরতি। মাগরিবের জামায়াতের পর বয়ান, মুরাকাবা ও মুনাজাত। মুনাজাতে আল্লাহ তায়ালার দরবারে কান্নার দৃশ্য মনকে বিগলিত করে দেয়। ৪দিনব্যাপী মাগরিবের নামাযের পর হযরতজি মাওলানা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দি, মুজাদ্দিদি দা. বা. দেড় ঘণ্টার মতো বয়ান করেন। ইশকে ইলাহীর আলোচ্ছটায় পুরো জমায়েত হয়ে উঠতো বর্ণিল ও জীবন্ত। তিনি একটি নোট হাতে নিয়ে নির্ধারিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। মনে হয় পরবর্তী সময়ে এটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ হয়ে যাবে। এরপর মুরাকাবা ও মুনাজাত। এশার জামায়াতের পর নৈশভোজ ও নিদ্রার বিরতি। যেসব ভারতীয় আলিম বয়ান করেন তাঁরা ছিলেন বাগ্মি, পন্ডিত ও বিদগ্ধ। তাঁদের মধ্যে দু’তিন জন ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস। বক্তাদের নির্ধারিত বিষয়ের বাইরে যেতে দেখা যায়নি। হযরতজির দু’ছেলেও বয়ান ও মুনাজাত পরিচালনা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল চিত্তাকর্ষক ও আবেগময়। শেষের দিন ফজরের নামাযের পর হযরতজির অন্যতম খলিফা বরেণ্য আলিমে দীন, পটিয়া আল-জামিয়া আল ইসলামিয়ার শিক্ষা পরিচালক আল্লামা মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া দা. বা. উর্দু ভাষায় বয়ান রাখেন। তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, ইলমি, দালিলিক ও যুক্তিগ্রাহ্য। আহলে ইলমদের কাছে তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বয়ান প্রশংসিত হয়েছে। পুরো ৪দিনব্যাপী উলামা সম্মেলনের সার্বিক তদারকীতে যে সব দায়িত্বশীল রাতদিন ব্যাপৃত ছিলেন তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশি হযরত মাওলানা মুহাম্মদ দা. বা. ছিলেন অন্যতম। তিনি হযরতজির বিশিষ্ট খলিফা। বার্ষিক এ ইসলাহী জমায়েতের বরকতে মানুষের দিলের হালত বদলে যায়, ইশকে ইলাহী জাগ্রত হয়, সুন্নাতের পাবন্দি দৃঢ় হয়, ঈমান-আমলে পরির্তন আসে, আমি সেটা উপলব্ধি করেছি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ