প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পদ নয় জ্ঞানই সম্পদ
ড. শফিক-উজ-জামান
কোন দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাফল্য নির্ভল করে সে দেশের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের উপরে। সম্পদ বলতে এখানে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে খনিজ পদার্থ কিংবা উর্বর মাটি সম্পদ নয়। মরুভূমির বালু, ধুসর পর্বতমালা কিংবা জলরাশি সবকিছু প্রাকৃতিক সম্পদ যা প্রযুক্তির সংস্পর্শে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত করা যায়। আসলে সম্পদহীন বলে কোন দেশ নেই। সব সম্পদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো মানব সম্পদ। একটি দেশে অন্য কোন সম্পদ পর্যাপ্ত না থাকলেও মানব সম্পদ তো থাকবেই সেই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের ওপর নির্ভর করবে সে দেশের অগ্রগতি।
এক সময় মনে করা হতো প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ খনিজ সম্পদই দেশের উন্নতির চাবিকাঠি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েক দশকের উন্নয়ন এই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এটা ঠিক, প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশের উন্নযনকে ত্বররান্বিত করে,কিন্তু এই সম্পদকে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন গবেষণা আর এই গবেষণার জন্য প্রয়োজন গবেষক, বিজ্ঞানী এবং কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদ। এই সম্পদের অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী হয়েও একটি দেশ দরিদ্র হতে পারে। আসলে প্রকৃতিক সম্পদ অভিশাপ না আর্শিবাদ তা নির্ভর করবে সে দেশের জনগণ এবং সরকারের সাথে এই সম্পদের সম্পর্কের ধরনের ওপর। তাইতো প্রাকৃতিক সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েও নাইজেরিয়া ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, আফগান, চাদ, সুদান, মিযানমার, বলিভিয়া, ও ইন্দোনেশিযা পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। অপরদিকে জাপান, সুইজারল্যান্ড, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে কোন খনিজ সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও তারা পৃথিবীর উন্নত দেশ। তাছাড়া অনেক দেশেই খনিজ সম্পদ উল্টো দেশের মানুষের জন্য করুণ পরিণতি বয়ে নিয়ে এসেছে। এ সমস্ত দেশের পর্যাপ্ত খনিজ সম্পদ জনগণের কল্যাণার্থে ব্যবহার না করে দুর্নীতিপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী বিদেশী লুণ্ঠনকারী।
বহুজাতিক কোম্পানীর সহযোগিতায় ভাগাভাগী করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মকলহে লিপ্ত হয়েছে। এমন কি কোন কোন দেশ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পরিণতিতে প্রাকৃতিক সম্পদ কল্যাণের পরিবর্তে আরও দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়ায় খনিজ সম্পদের ভাগ বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিন ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। ফলে জনগণ খনিজ সম্পদ থেকে উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো গৃহযুদ্ধের খোরাক হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে অর্থনীতি। আফ্রিকার নাইজেরিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম তৈল উৎপাদনকারী দেশ। আশির দশকের শুরুতেও ১২০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের হিসাবে মধ্যম আয়ের দেশ ছিল। দুর্নীতিপরায়ণ সামরিক শাসকের সহযোগিতায় বহুজাতিক কোম্পানির লুণ্ঠনে এ দেশটি আজ পৃথিবীর নিম্ন আয়ের দেশসমূহের একটি। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সর্বত্রই এমন উদাহরণ বিরল নয়।
আবার অনেক দেশ খনিজ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আর্থে আর্থিক দৈন্যতা ঘুচিয়ে ঠিকই কিন্তু শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আত্মনির্ভলশীল অর্থনীতি তথা আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে আজও অনেক অনুন্নত দেশের চাইতেও পশ্চাদপদ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশসমূহে অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র নির্ভর গণবিচ্ছিন্ন শাসন ব্যবস্থায় তেল রপ্তানী থেকে প্রাপ্ত বিপুল আয় রাজতন্ত্রের সদস্য ও তাদের সহযোগীদের অপরিনামদর্শী ভোগ-বিলাসী জীবন যাপনে ব্যয় হয়েছে। অপরদিকে দেশের আশি ভাগ মানুষকে আধুনিক শিক্ষা তথা সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন যাপনে বাধ্য করেছে। শুধু তাই নয় খনিজ তেল থেকে প্রাপ্ত বিপুল আয় সত্ত্বেও অর্থনীতির ভিত্তি আজও নিম্ন প্রবৃদ্ধির ফাঁক থেকে বের হতে পারেনি। প্রায ৩০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি আরব মুসলিম দেশে বিশ্বের ৫০০টি উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিও নেই। কিন্তু মাত্র ৫০ লক্ষ মানুষের দেশ ইসরাইলে ৫টি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশই ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার তীর্থভূমি। বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার গড়ে উঠেছিল এই মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশই ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার তীর্থভূমি। বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার গড়ে উঠেছিল এই মধ্য প্রাচ্যেরই মিসর ও মরক্কোতে। আজ সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা নির্বাসিত। অনায়াসলব্ধ খনিজ তেল থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে আজ একদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের আশির্বাদে ও অনুগ্রহে বিলাসী আর কদর্যপূর্ণ জীবন যাপনের পিছনে যে ভাবে ব্যয় করা হচ্ছে তার সিকি ভাগও যদি উচ্চতর শিক্ষা, জ্ঞানাহরন ও জ্ঞান সৃষ্টির জন্য ব্যয় করা হতো তা হলে পাশ্চাত্যের সেবাদাস না হয়ে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিকশিত হয়ে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবেই তারা মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী সচেতন ভাবেই মানুষকে এসব থেকে দূরে রেখেছে, কেননা নিরক্ষর, ধর্মান্ধ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে শাসন-শোষণ করা সহজ।
প্রাকৃতিক সম্পদ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকারের তত্ত্বাবধানে জনগণের কল্যাণে লাগলেও তা স্থায়ী উন্নয়নের ভিত্তি সৃষ্টি করতে পারে না। কেননা প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমান অপরিসীম কিংবা চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি বৈষয়িক সম্পদের অতিব্যবহারে যেমন একদিন তা নিঃশেষ হয়ে যায়, প্রাকৃতিক সম্পদও তেমনি। তাই শুধুমাত্র কোন বিশেষ খনিজ সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কিন্তু জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্র জাপান, জার্মান ও কোরিয়া প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং মানব সম্পদকে ব্যবহারের মাধ্যমে মাত্র কয়েক দশকেই অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলছে। নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন মিলিয়ন, যা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেরার জনসংখ্যার সমান। অথচ তাদের জিডিপি-এর পরিমান বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণের সমান। অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের চাইতে ৪০ গুণেরও বেশি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের জিডিপির পরিমান সিঙ্গাপুরের অর্ধেক। আয়তনে এবং জনসংখ্যায় পৃথিবীর মানচিত্রে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র হয়েও সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আজ পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্যই অগ্রগতির মূল কারণ। অবশ্য প্রাকৃতিক সম্পদও অনায়াসে একটি দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে যদি তাতে মানুষের প্রজ্ঞা আর প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কাজে লাগানো যায়। নরওয়ে, সুইডেন, অষ্ট্রিইয়া, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সাহায্যে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ রেডিমেইড (Readymade) পণ্য হিসেবে মাটির নীচে বা উপরে এমনভাবে সাজানো থাকে না যা মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাপ্তি কোন অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে না যদি তা ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলা না হয় এবং এর জন্য প্রয়োজন তাদের প্রযুক্তিবিদ ও দক্ষ জনশক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ যে সমস্ত দেশ প্রযুক্তিগত জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়েছে তাদের আর্থ সামাজিক অগ্রগতি দ্রুততর হয়েছে। অপরদিকে একটি দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারে, প্রচুর অর্থের মালিক হতে পারে, প্রচুর জনসংখ্যা অধ্যুষিত হতে পারে কিন্তু প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষ জনশক্তির অভাবে দেশটি পশ্চাদপদ হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত বৈষয়িক সম্পদের ভান্ডারও অফুরন্ত নয় এবং অতি ব্যবহারে তা নিঃশেষ হয়। শুধু প্রাকৃতিক নয় যে কোন বৈষয়িক সম্পদের ক্ষেত্রেই একই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু মানুষের জ্ঞানের কোন ক্ষয় নেই। জ্ঞানের চর্চা যত বেশি হবে তত বেশি জ্ঞান আহরিত হবে। এবং নতুন নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হবে। তাই জ্ঞানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমাজের ভিত্তি শুধু দৃঢ় হয়না বরং তা সকল প্রতিবন্ধকতা সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করে অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখে। বিশেষ করে বর্তমানের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে জ্ঞানই হবে টিকে থাকার একমাত্র মাধ্যম। কম খরচে যে যত উন্নত মানের বৈচিত্রময় পণ্য উৎপাদন করতে পারবে। সেই বাজারে টিকতে পারবে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বৈচিত্র্যময় এবং মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনে আধুনিক প্রযুক্তি। তবে সকল প্রযুক্তিই নিজ নিজ দেশে তৈরি করতে হবে এমন নয়। প্রযুক্তির প্রায়োগিক সাফল্য দেশ কাল ভেদে এক রকম নয়। কেননা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা শুরু হয় কোন সমস্যা উত্তরনকে কেন্দ্র করে । সেই সমস্যা সার্বজনীন নাও হতে পারে আর হলেও তার ধরন আর্থ সামাজিক বা ভৌগলিক অবস্থার কারণে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না এনে প্রযুক্তির ঢালাও প্রয়োগ করলে কাঙ্খিত ফল না দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই আমদানীকৃত প্রযুক্তি নিজ নিজ পরিবেশের উপযোগী করার লক্ষ্যে অভিযোজনের প্রয়োজন আছে। তার জন্য প্রয়োজন দেশের নিজস্ব প্রযুক্তির নূন্যতম বিকাশ। কেবলমাত্র প্রযুক্তিবিদ ও দক্ষ জনশক্তিই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও আত্মস্থ করতে পারে। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ কেবল উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটায় না, আমদানিকৃত প্রযুক্তির প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতা দূর করে অভিযোজনের মাধ্যমে তার কার্যকারীতা বৃদ্ধি করে। আজকের প্রযুক্তিতে শীর্ষ থাকা জাপানও একদিন এভাবেই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামও একই পথে এগিয়ে চলছে। চীনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি শুধুমাত্র সস্তা শ্রমের কারণে হয়নি। চীনের চেয়ে বাংলাদেশ, ভারত এবং ভিয়েতনামে শ্রম সস্তা। কিন্তু চীনের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের দ্বিগুণ, ভারত ও ভিয়েতনামের দেড়গুণ বেশি। উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমশক্তি, সর্বোপরি নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিদেশি প্রযুক্তি আত্মস্থ করে দেশি বাস্তবতায় সঠিক প্রয়োগের ফলেই চীন সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এহেন কৌশলের প্রয়োজন আরও বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। এমনিতেই এদেশ মাথাপিছু আবাদী জমির পরিমান পৃথিবীর সর্বনিম্ন দেশগুলোর অন্যতম। তার ওপর প্রতি বছরই প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কারণে জমির পরিমাণ কমছে। তাই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিকল্প কিছুই নেই। স্বাধীনতার চার দশকে খাদ্য উৎপাদন তিনগুণ বাড়লেও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়। এখনও দেশে হেক্টর প্রতি উৎপাদন জাপান ও চীনের অর্ধেক, এমন কই ভারত ও ভিয়েতনামেরও কম। অথচ বাংলাদেশের মাটি এসব দেশের তুলনায় উর্বর এবং আবহাওয়া অনুকূল, আর এ উর্বর মাটি ও অনুকুল আবহাওয়াই বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু এই সম্পদের আমরা প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে পারিনি। আর পারিনি বললেই আজও আমরা কৃষিতে পশ্চাদপদ। অপরদিকে চীন, জাপান ও ভিয়েতনাম আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের তুলনায় অনুর্বর মাটিতেও দ্বিগুণের বেশি ফসল উৎপাদন করছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ভূমির দুষ্প্রাপ্যতা হেতু কৃষি উৎপাদন বৃ্িদ্ধর জন্য অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারনের ওপর নির্ভর করতে হবে। এর জন্য কৃষি গবেষণা এবং কৃষকের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। কিন্তু এখানেও কৃষি উন্নয়নে অপরিহার্য উদ্যোগ নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে আজও কৃষি প্রকৃতি নির্ভরতা কাটিয়ে প্রযুক্তিভিত্তিক হয়ে উঠতে পারেনি। শুধু কৃষিই নয়, গত আড়াই দশকে সর্বাধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পোষাক শিল্পই বা কতটুকু জ্ঞানভিত্তিক?
বিশ্বায়নের চাপে পড়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী সকল শিল্পই আজ ধ্বংস। একমাত্র পোষাক শিল্পও আজ তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে। শুধুমাত্র সস্তা শ্রম আর পোষাক শিল্প টিকে থাকার গ্যারান্টি নয়। উচ্চমূল্য সংযোগকারী, বৈচিত্র্যময়, উচ্চ মান এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের পণ্যই বাজারে টিকে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি, প্রযুক্তিবিদ ও দক্ষ শ্রমশক্তি। কিন্তু বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য কতজন প্রযুক্তিবিদ, পেশাজীবী ও দক্ষ কর্মী সৃষ্টি হয়েছে? প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আত্মস্থকরনের জন্য কয়টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে? কয়টি টেক্সটাইল ডিজাইন ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিযারিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে? কিংবা সেই মান্ধাতার আমলে প্রতিষ্ঠিত টেক্সটাইল কলেজগুলো কি আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও পণ্যের চাহিদা মেটাতে সক্ষম? এসব প্রশ্নের জবাব হতাশাব্যঞ্জক। এই অবস্থা শুধু শিল্প বা কৃষিতে নয়, অর্থনীতির অপরাপর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ সর্বক্ষেত্রেই সমভাবে বিরাজমান। অথচ প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিকাশের প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়লে স্থবিরতা আক্রান্ত সমাজ আরও স্থবির হয়ে পড়বে। যত দ্রুত এটা উপলব্ধি করা হবে ততই তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে।