তুরস্কে এরদোগানের বিজয়
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ফের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২৪ জুন ২০১৮ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী কামাল আতাতুর্কের দল সিএইচপির প্রার্থী মুহাররেম ইনজে পেয়েছেন প্রায় ৩১ শতাংশ ভোট।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে পার্লামেন্ট নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে তুরস্কে। পার্লামেন্ট নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে এরদোগানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট পিপলস অ্যালায়েন্স। ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে এরদোগানের জোট। সিএইচপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স পেয়েছে ৩৪ শতাংশ ভোট।
৬০০ আসনের পার্লামেন্টে এরদোগানের দল একেপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ২৯৩ জন এমপি। জোট শরিক এমএইচপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ৫০ জন। কামাল আতাতুর্কের দল সিএইচপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ১৪৬ জন এমপি। তাদের জোট শরিক ইজি পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ৪৪ জন।
এছাড়া এইচডিপির সালাদিন ডেমিরেটাস পেয়েছেন ৮.৪ শতাংশ, গুড পার্টির মেরেল আকসেনার পেয়েছেন ৭.৩ শতাংশ এবং সাদাত পার্টির টেমেল কারামোলাগ্লু পেয়েছেন ০.৯ শতাংশ ভোট। জোটবহির্ভূত কুর্দি দল এইচডিপি পেয়েছে ১১.৬ শতাংশ ভোট (আসন ৬৭)।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এরদোগান বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতির মাধ্যমে তুরস্ক দুনিয়াকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দিয়েছে। এ নির্বাচনে তুরস্কের জনগণ, এ অঞ্চল এবং দুনিয়ার সব নিপীড়িত মানুষের বিজয় অর্জিত হয়েছে।
এদিকে এরদোগানের বিজয়ের খবরে রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করেছেন তার সমর্থকরা। দেশ-বিদেশ থেকে আসতে শুরু করে একের পর এক অভিনন্দন বার্তা। এরই মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানী, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, তার্কিশ রিপাবলিক অব নর্দান সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা আকিঞ্চি, বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বয়কো বরিসোভ প্রমুখ এরদোগানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এরদোগান ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন। তার প্রধান সমর্থক রক্ষণশীল এবং ধার্মিক তুর্কিরা। তিনি তুরস্কের এতকাল ধরে চলে আসা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামি মূল্যবোধকে শক্তিশালী করেছেন এবং তার সময় দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামোয় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
২০১৬ সালে এরদোগানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এরদোগানের আহ্বানে জনগণ রাস্তায় নেমে পড়ায় সে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। এই অভ্যুত্থানের পেছনে ফতুল্লাহ গুলেনের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ধর্মীয় নেতা যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত।
এরপর ২০১৭ সালে এক গণভোটে সামান্য ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করেন এরদোগান। এতে তিনি দেশটিকে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার জনরায় পান। পশ্চিমা জগৎ অভ্যুত্থানপরবর্তী তুরস্কে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ করে আসছিল। এ নিয়ে মানসিক টানাপড়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে। এসব কারণে এবারের নির্বাচনে জয়লাভ তুরস্ক ও বাইরের দুনিয়ার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তুরস্কের জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে আর তুরস্কের অতীত ঐতিহ্য মনে করিয়ে দিতে ভালোবাসেন এরদোগান। সমর্থকদের তিনি ‘অটোমান সুলতানদের উত্তর পুরুষ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০১৭ সালে সরকারি স্কুলগুলোর এক অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে তুরস্ক এমন ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী হবে, যেমন ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ছিল অটোমান সাম্রাজ্য।
ভৌগোলিক কারণে নিজ দেশের বাইরেও তুরস্কের নির্বাচন বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির বৈশ্বিক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ দেশটির একদিকে ইউরোপ; অন্যদিকে ইরান, ইরাক আর সিরিয়ার সীমান্ত। মুসলিমবিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ তুরস্ক পশ্চিমা ন্যাটো জোটের সদস্য। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য পদপ্রার্থী হলেও বহুদিন ধরে তুরস্ককে সদস্যপদ দিতে পশ্চিমা জগৎ রাজি হচ্ছে না। এরদোগানের মনোভাব হলো, তুরস্ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আর লালায়িত নয়। তুরস্কের সেনাবাহিনী ন্যাটো জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাহিনী হলেও কৌশলগত কারণে এরদোগান এতদিনকার প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিয়েছেন, যা পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
বায়তুল মুকাদ্দাসে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞের মতো মুসলিম বিশ্বের স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোয় বরাবরই আওয়াজ তুলেছেন এরদোগান। সৌদি জোটের কাতারবিরোধী অবরোধ প্রায় ব্যর্থ করে দেওয়ার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ওই অবরোধকে ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ বলে মনে করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। মূলত এরদোগান প্রশাসনের এমন নীতিগত অবস্থানের কারণেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির নির্বাচনকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
রবিবার (২৪ জুন) নির্বাচিত হওয়ার পরপরই এরদোগান ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রা থেকে পিছু হটবে না। একই সঙ্গে তুরস্কসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার সরকারের নীতির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন এই ঝানু রাজনীতিক।
তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের কেউ ন্যূনতম পঞ্চাশ শতাংশ ভোট না পেলে নির্বাচন গড়াবে দ্বিতীয় দফায়। সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন দ্বিতীয় দফায়। প্রথম দফা নির্বাচনের পনেরো দিন পর অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন এরদোগান। তাই দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন হবে না।
এবারের নির্বাচনে জয়লাভ করায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বর্ধিত নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের ম্যান্ডেট পেলেন।
সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি, আলজাজিরা, বিবিসি, তুর্কি রেডিও টিভির অনলাইন ভার্সন