ইয়াবার মরণথাবায় বিপর্যস্ত যুবসমাজ
ভয়ংকর নেশা উদ্রেককারী মাদক ‘ইয়াবা’ ও ‘আইস পিল’ তাদের সর্বশক্তি নিয়ে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে; তান্ডবের প্রলয় নৃত্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বিত্তের প্রাচুর্যে লালিত ধনীর দুলালদের সামাজিক মর্যাদা ও আভিজাত্যের দর্প। কিছু দিন পূর্বে ঢাকায় আবিস্কৃত হয়েছিল চার কোটি টাকা মূল্যের এক লাখ ৩০ হাজার ‘ইয়াবা’ ট্যাবলেট। আদিকাল হতে এ ভূখন্ডে মাদকের উৎপাদন, বিপনন ও প্রচলন লক্ষণীয়, তবে তা সীমিত মাত্রায়। একশ্রেণির লোক যুগে যুগে মাদক ব্যবহার করে আসছে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক চোরাচালানীদের স্বর্গরাজ্যে। ১২ টি চক্র মিয়ানমার হতে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার করে।
ভোক্তাদের ব্যাপক চাহিদার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিরাট মার্কেট গড়ে উঠেছে। সারা দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭৩ লাখ। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ যুবক এবং ৪৩ শতাংশ বেকার। ঢাকায় রয়েছে ১০ লাখ মাদকসেবী। কেবল মাত্র কক্সবাজার জেলায় মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে অন্তত চার হাজার ‘ইয়াবা’ আসক্ত। এক দিনে গোটা বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্রান্ডের মাদক বেচা কেনা হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) মতে, বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা দাম হিসেবে)। এই টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে। হিসাব করে দেখা গেছে, ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ (২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিজিবির বাজেট ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা)।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারীদের নিরাপদ ট্রানজিট রুট। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল হতে আনা কোটি কোটি টাকার মাদক টেকনাফ হতে ঢাকা বিমান বন্দর পর্যন্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোসাজশে ইউরোপ বা দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত হয় নিয়মিত। মাঝে মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যা ধরা পড়ে তা শতভাগের একভাগ মাত্র। মাদক বহনকারী হয়তো গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু আসল নায়ক থেকে যায় পর্দার অন্তরালে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা এসব ‘মাদক সম্রাট’ অত্যন্ত শক্তিধর ও বিপুল কালো টাকার মালিক। ইয়াবা চক্রকে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রয়াসকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
পিল-এর ব্যবহার বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। ধর্মবিবর্জিত শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধানুকরণই এ দেশের উঁচুতলার সম্ভাবনাময়ী শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। কথা সাহিত্যিক হাসানাত আবদুল হাই এর পর্যবেক্ষণ প্রনিধানযোগ্য: ‘…নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা প্রচলিত জীবনযাপনের বিরুদ্ধে দ্রোহ যখন কাউন্টার কালচার তৈরি করেছে, তখন মাদক সেবন সেই ব্যতিক্রমী জীবন যাপনের একটি অনুষঙ্গ হয়েছে।’
ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ভাষ্য মতে কতিপয় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠে এসেছে। গত ১০ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি আখড়া থেকে ৪০জন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে র্যাব গ্রেফতার করে এবং বিপুল গাজা উদ্ধার করে।
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর অধিকার রয়েছে তার নিজের ধর্ম, কৃষ্টি ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার। ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার অধিকার হতে তাদের বঞ্চিত করলে মাদকের ছোবলে নবপ্রজন্ম অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাবে। উদ্ভ্রান্তি অশুভ উপসর্গ ইতোমধ্যে সমাজদেহে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। মাদকের নেশায় একবার আসক্ত হয়ে গেলে কোন মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন। ‘মাদক সরবরাহকারী চক্র’ এতই শক্তিশালী যে, জড়িত ব্যক্তিবর্গ তাদের খপ্পর হতে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। তাই আগে থেকে প্রতিরোধক ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় একান্ত দরকার।
এখানে সঙ্গত কারণে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা ধর্ম-নির্ভর হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্রের মান অতি উচ্চ। গোটা বাংলাদেশে কওমি ও আলিয়া মাদরাসা ক্যা¤পাসে একজনও মাদকসেবী নেই, এ কথা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায়। মহান আল্লাহর দরবারে পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতি তাদের নৈতিক শক্তির ভিত্তি।
সুস্থ সমাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে মাদকের ভয়াবহতা হতে যুব সমাজকে বাঁচাতে হবে। মাদকের নেশা হতে বিরত রাখার কার্যকর উপায় হচ্ছে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি। মাদক উৎপাদন, বিপনন, আমদানি, চোরাচালান ও সেবনের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ও সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা অত্যন্ত জরুরি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে থাইল্যান্ডে তিন হাজার মাদক উৎপাদক ও চোরাচালানীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে অভিযুক্ত ও মাদকসহ হাতে নাতে গ্রেপ্তারকৃতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিলে অন্যরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন