জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অসহাবস্থানে সপারগ:‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ আর কতদূর?

অসহাবস্থানে সপারগ:‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ আর কতদূর?

অসহাবস্থানে সপারগ:‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ আর কতদূর?

খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ

বাংলাদেশি মানুষের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে স্বভাবসুলভ বৈপরিত্য বেশ পুরনো ও চিরায়ত একটি ‘গুণ’! পৃথিবীর অন্যান্য জনপদের লোকজন আমাদের কাছে অতিশয় কৃতজ্ঞ। কারণ তাদের জন্য দয়া করে আমরা বাহারি বিনোদনের পাশাপাশি নিয়ত বিস্ময় উৎপাদনে নিরলস ও অবিশ্রান্ত। এ ক্ষেত্রে আমাদের কা-কারখানা তাদেরকে কখনও কাঁদায়, কখনও হাসায় আবার কখনও বিস্ময়ের অতলে নিক্ষেপ করে। কেউ কেউ আমাদেরকে বাঙালি কেউ বাংলাদেশি—যার যেই নামে খুশি ডাকুক—আসল কথা হলো আমরা পারি, আমরা অনন্য; আমরা অসাধারণ। আমাদের চিত্র-চরিত্রের ফিরিস্তি লিখতে গেলে যেকোনো লেখকের কয়েশ’ বছর আয়ুষ্কাল দরকার পড়বে। সেই লেখকের যদি অপরসিীম ধৈর্য, বিপুল সময়, অপরাজেয় উদ্যম আর পুনঃপুনঃ উৎপাদনশীল উদ্দীপনা থাকে তাহলে কয়েক অভিসন্ধর্ভে এই মহাআয়োজন সম্পন্ন হলে হতেও পারে।

এই লেখক উপরিউক্তি ‘সৌভাগ্য’ আর গুণাগুণের ধারেকাছেও নাই। বরং এসব যোগ্যতার দারিদ্র্যসীমারও বহু নীচে কোনো রকম বেঁচে-বর্তে আছেন। কাজেই লম্বা আলোচনার মহাসমুদ্রের সাতরানোর দুঃসাহস না করে সংক্ষিপ্ত ও সাদামাটা আলোচনা সেরে উপসংহারের পেরেকটা টুকে দেওয়ার চেষ্টা করবো। বৈপরিত্যের কথাটা তোলার কারণ হলো, আমরা মুখে সকলেই ঐক্যের মহিমা গেয়ে বেড়াই কিন্তু নিজেরাই অনৈক্যের চাষাবাদ করি।

আমাদের একটি বড় গুণ হলো আমরা তর্কপ্রিয় ও বিতণ্ডবাজ। আজকের আলোচনা কেবল বাকযুদ্ধ, পরমত অসহিষ্ণুতা, বিভাজন লড়াই, অন্তর্কোন্দল, বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীদের মাঝে অসহাবস্থানে সপারগতা বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। আমরা জাতীয় ঐক্য, সামাজিক ঐক্য, রাজনৈতিক ঐক্য ও ধর্মীয়সহ আরও বহুবিধ ঐক্যের বিস্তর কথা, বক্তৃতা, আলোচনা ও উপদেশ অহরহ দিয়েই চলেছি। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, বাস্তবে আমরা অনেকেই বোধ হয় এটা মন থেকে চাই না। ঐক্য তো এভাবে হয় না যে, অন্যরা আমার মতের অনুসারী হয়ে যাক; তাতেই তো ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়!

লেখার গোড়াতেই আমরা আলোচনার চেহারাটা একটু পরিষ্কারভাবে পাঠকের সামনে নিয়ে আসতে চাই। বাংলাদেশি মুসলমানদের মাঝে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ঐক্যটা তা হলো ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’। সব বিষয়ে সকল মানুষ একমত হওয়া সম্ভব নয় এমনকি মৌলিক ও প্রধান বিষয়গুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে খোদ মুসলমানদের মাঝেও সর্বাঙ্গীন ঐক্য সম্ভব নয়; এর প্রয়োজনও নেই। আজকে আমরা কেবলই ধর্মীয় বিভেদ-বিভাজনসম্পর্কিত প্রসঙ্গে তুলতে চাইছি। সমকালীন ইহুদি-খ্রিস্টানদের উদ্দেশে কুরআন বলেছে,

‘আপনি বলে দিন! হে আহলে কিতাব! তোমরা সেই বিষয়ের দিকে (অভিন্ন অবস্থা গ্রহণে) এগিয়ে এসো যার ব্যাপারে আমরা আর তোমরা একমত; যে আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবো না।’ [আলে ইমরান: ৬৪]

বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে ওয়াহাবি-সুন্নী মতবিরোধকেন্দ্রিক ঝগড়া-বিবাদের বয়স এক শতকের কম নয়। আহলে হাদিস আর মাযহাব অনুসারীদের মাঝে মতপার্থক্য কয়েকদশক আগেও এখানে-ওখানে অল্পস্বল্প ছিলো কিন্তু তা পুরো দেশে ততটা দৃষ্টিগ্রাহ্য বা আলোচিত বিষয় হবার মতো ছিলো না। গত ছয়-সাত বছরে আহলে হাদিস আর হানাফী মতানৈক্য শরীয়তের শাখাগত বিধান ও ব্যক্তিগত আমলের সীমারেখা ছাড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখন সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমাবেশ-শোডাউনও করতে দেখা যাচ্ছে।

আমরা আলোচনার সুবিধার্থে সমস্যাকে কয়েকটি প্রশ্নের আকারে ভাগ করে নিতে চাই,

এক. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ-এর ভিত্তিতে মাযহাব অনুসারী আর আহলে হাদিস বা সালাফীদের মাঝে ঐক্য হতে পারে না?

দুই. মৌলিক বিশ্বাস, ঈমান-আকিদা ও ফরয বিষয়ে বিবদমান দুই পক্ষের মাঝে কোনো মত পার্থক্য আছে?

তিন. ‘আমিন’ শব্দটি নিম্নস্বরে বা উচ্চৈঃস্বরে বলা, রুক-সিজদায় যাওয়ার আগে হাত তোলা আর না তোলার সঙ্গে কি নামায শুদ্ধ হওয়া না হওয়ার প্রশ্ন জড়িত? নাকি এগুলো সুন্নাত-মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল?

চার. ‘আমিন’ উচ্চস্বরে বললে, হাত তুললে (রাফয়ে ইয়াদাইন) তাকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া বা ঝগড়া করার মধ্যে মুসলিম উম্মাহর কী উপকার নিহিত?

পাঁচ. কুরআন-হাদিস, ইসলামি আইনশাস্ত্রের মূলনীতি, শরীয়াহ তথা ফিকহশাস্ত্র ও আরবি ভাষা-সাহিত্য-ব্যাকরণ সম্পর্কে সাধারণ মুসলমান—তিনি সাধারণ শিক্ষায় যতই উচ্চশিক্ষিত হোন—প্রত্যক্ষ উপায়ে ‘সহীহ হাদিস’ বাছাই করতে কীভাবে সক্ষম হবেন?

ছয়. টিভি চ্যানেল ও ইউটিউবে পাল্টাপাল্টি বয়ানের ঝড় তোলা এবং হানাফীদেরকে বিদআতী এমনকি মুশরিক আখ্যায়িত করার অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো উগ্রপন্থী কথিত সালাফী আলেমের বিরুদ্ধে। এতে কি মুসলমানদের শত্রুরাই বেশি লাভবান হচ্ছে না? একইভাবে হানাফী মাযহাব অনুসারী আমরা কতিপয় অতি উৎসাহী আলেম ‘আহলে হাদিস ঠেকানো’র নামে ইসলামকে ঠেকিয়ে দিচ্ছি কিনা তাও ভেবে দেখার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

এই ছয়টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা মাযহাব অনুসরণ বিষয়ে এমন একজনের উদ্ধৃতি পেশ করতে চাই যাকে আহলে হাদিস মতাবলম্বী মুসলমানরাও অনেকক্ষেত্রে অনুসরণ করেন আবার মাযহাব অনুসারী মুসলমানরাও বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ করেন। তিনি যুগশ্রেষ্ঠ ধর্মতত্ত্ববিদ শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রাহ.)। মাহফুয আহমদের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি,

‘শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ছিলেন হিজরি সপ্তম শতাব্দীর একজন ‘মুজাদ্দিদ’। অসাধারণ মেধা, আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, সূক্ষ্ম বিচারশক্তি এবং তার্কিকতায় পারদর্শী একজন মহান আলেম ছিলেন তিনি। তার গবেষণাকৃত ফতওয়াগুলো এবং রচিত গ্রন্থাদি পর্যালোচনা করে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ফিকহি মাসায়েলের ক্ষেত্রে তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর মাজহাব সামনে রাখতেন। শুধু তাই নয়, অনুসৃত অপরাপর ইমামদেরও তিনি শ্রদ্ধা করতেন এবং সসম্মানে তাদের আলোচনা পেশ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত আজকাল তার কিছু বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে মুসলিম উম্মাহর বিরাট অংশ; যারা কোনো না কোনো মাজহাবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করে যাচ্ছেন- তাদের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক। মাযহাবের ব্যাখ্যা অনুসারে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা সম্বন্ধে ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর ভারসাম্যপূর্ণ মন্তব্যগুলো স্বয়ং তার রচিত গ্রন্থাদি থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লেখেন, ‘ফিকহ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমামরা যেমন- আবু হানিফা, সাওরী, মালিক, আওযায়ী, লায়স বিন সা’দ, শাফিয়ি ও আহমদ প্রমুখের ফতোয়ার স্বপক্ষে কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা দলিল পেশ করা যাবে। তাদের কারও তাকলিদ করা হারাম হবে না। পক্ষান্তরে যে ইলম ছাড়াই ফতওয়াবাজি করে তার তাকলিদ সম্পূর্ণরূপে হারাম।’ (আল-ফুরকান বাইনা আউলিয়াইর রাহমান ও আউলিয়াইশ শায়তান, পৃ. ৭৭)

দৃষ্টান্ত পেশ করত ইবনে তাইমিয়া (রহ.) স্পষ্ট করে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য, তাঁরা যা হালাল করেছেন তা হালাল আর যা হারাম করেছেন তা হারাম জ্ঞান করা, তাঁরা যা ওয়াজিব করেছেন তা অবশ্য পালনীয় মনে করা প্রত্যেক মানুষ ও জিনের ওপর অপরিহার্য। সবার ওপর গোপনে-প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় তা ওয়াজিব। কিন্তু শরয়ি বিধি-বিধানের মধ্যে যেহেতু এমন কিছু বিধান রয়েছে যেগুলো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না; এ জন্য তারা এসব ক্ষেত্রে আলেমদের শরণাপন্ন হয়। কেননা আলেমরা হাদিস ও হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন। অতএব, মুসলিম উম্মাহর অনুসরণীয় ইমামরা প্রকৃত অর্থে সাধারণ মুসলমান এবং রাসুল (সা.)-এর মাঝে বাহক হিসেবে পরিগণিত হবেন। তাঁরা হাদিসের প্রচার-প্রসার করেন এবং সাধ্যানুযায়ী ইজতিহাদের ভিত্তিতে লোকজনকে তা বুঝিয়ে দেন।’ [মাজমুউল ফাতাওয়া, ২/২৩৯] (তথ্যসূত্র: মাহফুয আহমদ, প্রবন্ধ, দৈনিক কালের কণ্ঠ)

প্রিয় পাঠক! উদ্ধৃতি খানিকটা দীর্ঘ হলেও বিষয়টি অনুধাবনের তাগিদে এটা উল্লেখ করতে হলো।

প্রবন্ধের একেবারে শুরুতেই বিভক্তি, বিভাজন, অনৈক্য ও অসহিষ্ণুতার এই সমস্যাকে বাংলাদেশকেন্দ্রিক বলে দাবি করেছি। শুধুই বাংলাদেশকেন্দ্রিক বলা কতটুকু বাস্তব সে প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে এটুকু বলি, অন্তত আহলে হাদিস আর হানাফী ‘বিরোধ’টা যে যুদ্ধংদেহী রূপ নিয়েছে তা আরব-অনারব আর কোনো দেশেই এতো প্রকট আকার ধারণ করে নি। মোটাদাগে শিয়া-সুন্নী বিভাজনের কথাটা ব্যতিক্রম ধরে নিয়ে যদি দেখেন শরীয়াহর বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাব অনুসারী আর নির্দিষ্ট কোনো মাযহাব অনুসরণ করেন না এমন নানা মত-পথের মুসলমানদের মাঝে এতো ব্যাপক ও তুমুল দ্বন্ধ কোথাও তো দৃষ্টিগোচর হয় না! তাই বাংলাদেশের কথা বিশেষভাবে বলা।

চলুন এবার প্রথম সমস্যার পর্যালোচনায় প্রবেশ করি,

মুসলমানদের মধ্যে যারা মাযহাব অনুসারী তাদের মধ্যে জ্ঞানী, দূরদর্শী, চিন্তাশীল অংশ (সংখ্যাগরিষ্ঠ) স্বীকার করে যে, কুরআন-হাদিস ও ইসলামি আইনশাস্ত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী লোকেরা মাযহাব অনুসরণ না করলেও ক্ষতি নাই আর যারা তেমনটি নন তারা বিভ্রান্ত হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকলেও তাদেরকে ইসলাম থেকে খারিজ মনে করেন না। অন্যদিকে যারা কোনো নির্দিষ্ট মুজতাহিদ ইমামের মাযহাব অনুসরণ না করার পক্ষে তাদের ভাষায় : ‘সহীহ হাদিস’ দেখে ইসলামি বিধিবিধানের ওপর আমল করার পক্ষে তাদের মধ্যে জ্ঞানী, বিচক্ষণ, চিন্তাশীল ও উদার অংশটি (আমার পর্যবেক্ষণে অন্তত বাংলাদেশে সংখ্যালঘিষ্ট) মাযহাব অনুসরণ করলে কারও ঈমান-আমল বরবাদ হয়ে যায় না। বড়জোর উত্তম-অনুত্তমের তর্ক চলতে পারে। তাহলে উভয়পক্ষের মাঝে ঈমান ও ইসলামের বিজয় প্রশ্নে ঐক্য গড়তে কোনো বাধা নাই।

দ্বিতীয় পয়েন্টের সুরাহাও প্রায় কাছাকাছি উপায়ে হতে পারে যে, বিবদমান উভয়পক্ষের মাঝে ঈমান ও ফরজ বিধানের বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নাই। মতের ভিন্নতা কেবল অমৌলিক, শাখাগত বিষয় ও সুন্নাত-নফল আমলে ক্ষেত্রে। তাহলে এটা নিয়ে পরস্পরের প্রতি মারমুখী অবস্থানের কোনো প্রয়োজন নেই এতে কেবল ইসলামের শত্রুরাই তো লাভবান হবে। নাকি?

তিন নম্বর সমস্যাটির সমাধানের উপায় একেবারে সহজ; উত্তরও সংক্ষিপ্ত। ফরয নামাযে ইমাম সাহেবকর্তৃক উচ্চৈঃস্বরে তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহার শেষে মুক্তাদিরা ‘আমিন’ শব্দটি নিচু স্বরে বলা আর উচুঁ স্বরে বলা সুন্নাত-মুস্তাবের বিষয় এটা ফরজ-ওয়াজিব নয়; কাজেই এর সঙ্গে নামায শুদ্ধ হওয়া শুদ্ধ না হওয়ার সম্পর্ক নেই। তাহলে আমরা এতো কঠোর কেন? বোঝা গেলো যেকোনো পক্ষের শক্ত অবস্থান এখানে বাড়াবাড়ির শামিল। এতে শয়তান আগুনে ঘি ঢালছে!

চার নম্বরে আমরা বলেছিলাম রুকু-সিজদায় যাওয়ার সময় ‘রফয়ে ইয়াদাইন’ বা হাত তোলা না তোলার বিতর্ক। এটাও তিন নম্বরের অনুরূপ। পুনরাবৃত্তির দরকার নাই।

পাঁচ নম্বর পয়েন্টে কথা ছিলোÑ কুরআন-হাদিস, ইসলামি আইনশাস্ত্রের মূলনীতি, শরীয়াহ তথা ফিকহশাস্ত্র ও আরবি ভাষা-সাহিত্য-ব্যাকরণ সম্পর্কে সাধারণ মুসলমান Ñতিনি সাধারণ শিক্ষায় যতই উচ্চশিক্ষিত হোনÑ প্রত্যক্ষ উপায়ে ‘সহীহ হাদিস’ জয়ীফ হাদিস, জাল হাদিস, দুর্বল সূত্র, সবল সূত্র, হাদিস ও সনদের মান বাছাই করতে কীভাবে সক্ষম হবেন? এরূপ দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে চাপানোর মধ্যে দিয়ে ‘দুঃসাধ্য কর্মভার অর্পন’ হয়ে গেলো না? এতে করে তারা ইবাদতবিমুখ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ষষ্ঠ পয়েন্টের আলোচনা ওপরেই খানিকটা সেরে নিয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক ইউটিউব ইত্যাদি জায়গায় বর্তমানে বিশ্ববিস্তৃত একটি ঐন্দ্রজালিক সমাজ। এখানেও আমরা উভয়পক্ষ ইখতিলাফের নামে শত্রুদের হাসাচ্ছি এবং নিজেদের দুর্বল করছি। তারা আমোদভরে প্রত্যক্ষ করছে আমরা কীভাবে অমৌলিক, শাখাগত, খুঁটিনাটি, নফল-মুস্তাহাব আর উত্তম-অনুত্তমের ঝগড়ায় মেধা ও সময় ক্ষয় করার পাশাপাশি নিজেদের বিভাজন ফাটলটা ক্রমে বড় করছি।

এ প্রসঙ্গে আলোচনার শেষপ্রান্তে এসে আমরা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয় খোলাসা করার সুবিধার্থে দুয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করবো।

একটি বিষয় হলো আমাদের অনেক ভাই সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মাঝে এ ধরনের একটি ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন যে, ফিকহশাস্ত্রের ইমামগণ বিশেষত ইমাম আবু হানিফা নুমান ইবনে সাবিত (রহ.) সহীহ হাদিসের আলোকে নয় কিয়াস তথা যুক্তিভিত্তিক তুলনার মানদ-ে মাসআলা বর্ণনা করেছেন। এতবছর যাবত আমরা ‘সহীহ হাদিস’-এর সন্ধান না পেয়ে মাযহাব অনুসরণ করেছিলাম এখন মাযহাব বাতিল। তাদের চমকপ্রদ যুক্তি হলো, কুরআন-হাদিস সামনে থাকতে কীসের মাযহাব। এই বক্তব্য অপনোদনে আমরা এখানে নতুন কোনো আলোচনায় যাবো না কারণ এর আংশিক উত্তর দিয়েছি। শুধু এতটুকু বলি, কুরআন-হাদিসও আজকের নতুন জিনিস নয়, শরীয়তের বিধান সম্পর্কিত গবেষণা ও আইয়াম্মায়ে ফিকহগণের মাযহাবও নতুন নয় কিছু নয় এমনকি আহলে হাদিস মতালম্বীদের মত ও পথও নতুন নয়। এগুলো বহু আগের মিমাংসিত বিষয়। কাজেই দলভারী করার জন্য আমরা কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে আল্লাহর কাছে কঠোর জবাবদিহি করতে হবে।

হাদিস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসীন অথবা হাদিসের ইমামগণ আর ফিকহশাস্ত্রের ইমামদের কর্মক্ষেত্র এবং উভয়ের মিলিত পরিশ্রমের ফসল যে, ইসলামি শরীয়াহ এ প্রসঙ্গে একজন লেখকের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি বেশ যুৎসই মনে করছি,

রবী বলেন, আমি ইমাম শাফেয়ীকে কিছু হাদিস বিশারদকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুনেছি, ‘আমরা হলাম ডাক্তার, আর তোমরা হলে ওষুধ বিক্রেতা।’ [সিয়ার আ’লামিন নুবালা, ১০/২৪]

আ’মাশ ইমাম আবু হানীফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে ফকীহগণ, আপনারা হলেন ডাক্তার, আর আমরা হলাম ফার্মাসিস্ট।’ [ইবনে হিব্বান ৮/৪৬৭]

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, ‘ফুকাহাগণ হচ্ছেন ডাক্তার। আর মুহাদ্দিসীনরা হলেন ওষুধ বিশেষজ্ঞ।’ [তারীখে দামেস্ক ৫১/৩৩৪]

সহীহ হাদিস প্রসঙ্গ

সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই মনে করেন সহীহ হাদিস মানে সঠিক ও বিশুদ্ধ হাদিস আর যয়ীফ হাদিস মানে জাল হাদিস। অথচ বাস্তবতা এমন নয়। বিশিষ্ট আলেম ও লেখক ডা. গাজী নজরুল ইসলাম তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন,

‘হাদীসশাস্ত্রে জাল আর যয়ীফ শব্দ দুটি কখনোই একই অর্থে প্রয়োগ করা হয়নি। জাল হল রাসূলুল্লাহ (সা.) নামে মিথ্যা বা বানোয়াট বর্ণনা, যার পরিণতি হল জাহান্নাম। যয়ীফ হল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে প্রদত্ত বর্ণনাটি মিথ্যা বা বানোয়াট সাব্যস্ত করা যায়নি, তবে সনদ-সূত্র মজবুত নয়। জাল হাদীসের উপর কখনোই আমল করা যায় না, পক্ষান্তরে কোন সহীহ হাদীস বিপক্ষে না থাকলে বা কোনো সহীহ হাদীসের দূরতম সমর্থন থাকলেও জয়ীফ হাদীসের ওপর আমল করা যায়। ইসলামি আইনশাস্ত্রেও হাদীসের জাল আর যয়ীফকে কখনোই একই মানদণ্ডে মাপা হয়নি, যেমন বর্তমান যামানায় কতিপয় উলামা মেপে থাকেন।’

বাংলাদেশে সালাফিজম

একজন ফেসবুক-বন্ধু চমৎকার লিখেছেন, তার কথাগুলো চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে,

‘বাংলাদেশে সালাফিজম (আহলে হাদীস) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা হলো, ইসলামের যেকোনো বিষয় জানার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহতে এর দলীল আছে কিনা তা যাচাই করে দেখার মানসিকতা তৈরি করেছে। কারণ একটা সময় ছিল যখন মানুষ আলিম, পীর, সুফি-দরবেশদের কথাকে যাচাই না করেই মেনে নিতো। এখন সেই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশে সালাফিজম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক যে প্রভাব ফেলেছে তা হলো, তারা ফিকহী মতভেদকে বিভেদের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। হানাফী-সালাফী বিরোধকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। এমন অবস্থা অন্য কোন দেশে আছে বলে আমার জানা নেই।’

উপসংহার

হানাফী বা অন্যান্য মাযহাব অনুসারী এবং আহলে হাদিস দাবিদার (এই পরিচিতির বদলে তারা যদি সালাফী বা অন্য কোনো নাম ব্যবহারে করেন তো লেখকের দৃষ্টিতে সেটা ভালো) মুসলমান ভাইবোনদের কাছে এই নিবন্ধকারের বিনয়-বিগলিত আবেদন, আসুন! আমরা অন্তত শরীয়তের বিষয়ে হলেও ‘ইত্তেফাক মাআল ইখতেলাফ’ অর্থাৎ বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য গড়ে তুলি। আমরা মনে করি, এমন আকুতি আজ কেবল এক-দুইজনের নয়; হাজারো-লাখো ভারসাম্যপ্রিয়, দূরদর্শী ও গভীর জ্ঞান সম্পন্ন দরদী মুসলমানের। এই মতপার্থক্য আর স্রেফ আমলের বৈচিত্র্যকে আমরা যদি সহনশীলতা, সম্প্রীতি ও সদ্ভাবপূর্ণ সহাবস্থানের সীমানায় সংযত না রাখি, আমরা যদি হানাফী-সালাফী সহাবস্থানে অপরাগ হয়ে অসহাবস্থানে সপারগ হতে থাকি তবে এদেশের মুসলমানদের কপালে বড় দুঃখ নেমে আসতে পারে। এটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়, একটা গড়পড়তা আশঙ্কা। আল্লাহ আমাদের জন্য নিরাপত্তা, শান্তি, সাফল্য ও বিজয়ের ফয়সালা করুন! আমিন!

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ