রুদাকি: ফার্সি সাহিত্যের জনক এক অন্ধ মহাকবি!
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, আরেফিন শিমন
জীবন আমাকে দিয়েছে ঢের শিক্ষা
শিক্ষার কাছে জীবন নেয় যে দীক্ষা
অপরের সুখে হয়ো না তুমি দুখি
তোমার সুখেও হবে না কেউ সুখি।
আমাদের মধ্যে অনেকেই মাঝেমাঝেই হতাশ হয়ে যাই। এটা নেই, সেটা নেই কত অভিযোগ আল্লাহ তাআলার কাছে। অথচ কিছু মানুষ এর অনেক কিছু না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ইতিহাসের পাতায় যায়গা করে নিয়েছেন সগৌরবে। এই ‘কিছু নাই’টা যদি হয় ‘চোখ’ তবে তো কথাই নেই। যেখানে হতাশায় ডুবে থাকার কথা, সেখানে তাঁরা পৌঁছে গেছেন সফলতার স্বর্ণ শিখরে। তেমনি একজন হলেন মহাকবি রুদাকি। যিনি ছিলেন জন্ম থেকেই অন্ধ।
ফার্সি সাহিত্যের একটি প্রবাদ আছে, ‘সাতজন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফার্সি সাহিত্য টিকে থাকবে।’ এই সাতজন কবির তালিকায় যেমন ফেরদৌসী, হাফিজ, নিযামী, রুমী, সাদী ও জামী আছেন, তেমনি অবশ্যম্ভাবীভাবে আছেন কবি রুদাকিও। যে ফার্সি কবিতার সুষম ধারা আজ পর্যন্ত চলে এসেছে এবং সারা বিশ্বের পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সেই ফার্সি কবিতার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল রুদাকির হাতে। বলতে গেলে তার হাত ধরে ফার্সি কবিতা শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে এখন সহস্রাব্দ পেরিয়েছে। রুদাকি যখন কবিতা লেখা শুরু করেন তখনও ফার্সি ভাষায় কাব্য রচনার চল ছিল না। রুদাকিই প্রথম আরবী বর্ণমালা ব্যবহার করে ফার্সি কবিতা লেখেন। এ জন্য তাকে ‘আদম-উল-শোয়ারা’ বলে অভিহিত করা হয়। তৎকালীন সময়ে কবিতাও সঙ্গীতের মতো সুর সহযোগে উপস্থাপিত হতো। রুদাকির উপস্থাপনশৈলীও ছিল দৃষ্টিনন্দন। উপস্থাপন ও রচনাশৈলীর কারণে তার কবিতা বা শ্লোকগুলো এতই প্রভাবশালী ছিল যে, অল্প ক’দিনেই তার খ্যাতি ইরান পেরিয়ে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ের সাহিত্যরসিক-শাসক নাসর সামানী রুদাকির কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে সভাকবি নিযুক্ত করেন। এটি ছিল কবি রুদাকির জন্য স্বর্ণসময়। এ সময় তিনি প্রচুর কবিতা রচনা করেন। একই সঙ্গে নাস্র ইবনে আহমাদ, আবুল ফাযল বালামি, দার্শনিক শাহিদ বালখি, আবুল হাসান মুরাদি, কবি আবু ইসহাক জুয়িবারী, কেসাঈ, দাকিকী প্রমুখ বরেণ্যদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রুদাকি সেই সব সৌভাগ্যবান প্রাচীন কবিদের একজন যিনি জীবিতাবস্থায় কবিতার জন্য তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এবং একই সঙ্গে অঢেল প্রতিপত্তির অধিকারী হন।
রুদাকি প্রচণ্ড পরিশ্রমী ছিলেন। কবিতার প্রতি তার তৃষ্ণা ছিল আজন্ম। তিনি প্রচুর লিখতে পছন্দ করতেন। গজল, কাসিদা, মর্সিয়া, মাসনাভী ও প্রশংসাগীতি এই শাখাগুলোতে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশেষত, তার হাত ধরেই এই শাখাগুলো গতিশীলতার সন্ধান পেয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি রাশিদি সামারকান্দি মনে করেন, রুদাকি ১৩ লাখ দ্বিপদী পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। তবে সময়ের আবর্তনে ও সংরক্ষণের অভাবে এখন স্বল্পসংখ্যক কিছু পঙ্ক্তি টিকে আছে। ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রুদাকি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কালিলা ও দিমনা’ রচনা করেন। এ বইটি ভারতীয় ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থের ফার্সি কাব্যরূপ। অনুবাদ হলেও রুদাকি ‘কালিলা ও দিমনা’ গ্রন্থে ফার্সি ভাব, পরিবেশ ও ভাষার অপূর্ব সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কাব্যে রুদাকির কবিত্বশক্তির সক্রিয়তা ও প্রতিপত্তি প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। তার পরবর্তী কবিগণও তাদের রচনায় ‘কালিলা ও দিমনা’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। ধারণা করা হয়, এই গ্রন্থটি ছাড়াও তিনি আরও চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রখ্যাত কবি জালালুদ্দিন রুমি ও ওমর খৈয়ামের রচনায়ও রুদাকির প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
রুদাকি যখন ফার্সি ভাষায় কাব্য রচনা করেন তখন ফার্সি সাহিত্য ভাণ্ডার ছিল প্রায় শূন্য। ফলে তিনি লেখার শুরুতে কাউকে ভিত্তি হিসেবে পাননি। যুগ অনুযায়ী তার লেখা সংস্কারাচ্ছন্ন, দর্শনের সঙ্গে বিরোধ ও অনাধুনিক মানসম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে রুদাকি ছিলেন বিরল প্রতিভার। রুদাকি প্রাচীন হয়েও ছিলেন আধুনিক, ধর্মীয় গণ্ডিতে থেকেও তার ছিল ব্যাপৃত অভিজ্ঞান। তার কবিতায় দার্শনিকতাও নানা মাত্রায় ও সারল্যে উদ্ভাসিত। কবি মাত্রই যে তার সময় থেকে এগিয়ে থাকেন, বর্তমানে থেকে অনুভব করেন ভবিষ্যতকে রুদাকি তার প্রমাণ। তার কবিতায় সমাজ, রাষ্ট্র, চিত্রকল্প, দার্শনিকতা চিত্রিত হয়েছে নানা ভাবে। ফার্সি জগতের প্রবহমান দার্শনিক ভাবধারা রুদাকির মধ্যে মহীরুহরূপে ছিল। তাই তো তাকে বলতে শুনি, সেই সহস্র বছর আগে থেকে তিনি বলছেন ‘যে নেয় নি শিক্ষা কখনও ফেলে আসা সময় থেকে/সে তো শেখেনি কিছুই এমনকি কোন শিক্ষক থেকে।’ অর্থাৎ সময় থেকে শিক্ষা নিলেই ভাল কিছু করা সম্ভব। রুদাকি অসংখ্য প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন। বিশেষ করে স্র্রষ্টাপ্রেম তার কবিতায় বার বার এসেছে। একই সঙ্গে তিনি ইসলামিক মিথগুলোকে প্রেমের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। ইউসুফকে নিয়ে তার পঙ্ক্তি: ‘ইউসুফের ফুল্ল-চাঁদ চেহারায় মন হলো প্রেমার্ত/মিসরী যুবতীর সম হৃদয় মম ভেঙ্গে চৌচির…।’ রুদাকি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখেছেন। মানুষের ওপর তিনি অতিমাত্রায় আরোপে বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রাচীনকালে কবিরা যেসব প্রশংসাগীতি রচনা করতেন, তাতে ভুল প্রশংসা (তিলকে তাল) করার মানসিকতা ছিল। কিন্তু রুদাকির প্রশংসাগীতি ছিল বাহুল্যবর্জিত। তিনি বিশ্বাস থেকে প্রশংসাগীতিগুলো রচনা করতেন। তৎকালে কবিতার শব্দে শব্দে তিনি যে চিত্রকল্প গেঁথে দিয়েছেন তা আজও গবেষকদের জন্য বিস্ময়ের বিষয়। তার কবিতায় চিত্রকল্প:
‘আমি সরখ শহরের কাছে একটি পাখি দেখেছি
মেঘের কাছে সে গান গাইছিল
আমি দেখলাম তার গায়ে একটি রঙিন চাদর
এই চাদরে ছিল অনেক রং।’
রুদাকির কবিতাগুলোর প্রকাশ ছিল সরল। শিল্পগুণকে সঙ্গে নিয়েই তার এই সরলতা উদ্ভাসিত। শব্দ ও অলঙ্কারের যথার্থ প্রয়োগের কারণে তার কবিতা এক শতাব্দী থেকে অন্য শতাব্দী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তার কবিতা সম্পর্কে ব্রিটিশ লেখক ও মধ্যপ্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড ব্রাউন মন্তব্য: ‘রুদাকির বক্তব্য বর্তমানের পাঠকের কাছেও সহজবোধ্য হওয়ার ব্যাপারটি শেক্সপিয়ারের মতো, তার ভাষাও ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে সহজবোধ্য। …তেমনি ফার্সি ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে রুদাকির ভাষা আজও দুর্বোধ্য নয়।’
রুদাকির পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ জাফর ইবন মোহাম্মদ রুদাকি। তার জন্ম তাজিকিস্তানের পাঞ্জেকান্টের রুদাকে, ৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে। অল্প বয়স থেকেই রুদাকির প্রতিভা তার স্বজনদের নজরে পড়ে। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি মর্যাদা ও প্রতিপত্তির মালিক হলেও শেষ জীবন তার অর্থদৈন্যে কেটেছে। অনেকে মনে করেন এই মহাকবি শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। চরম দুর্দশার মধ্যে তার জীবন কেটেছে।
রুদাকি শুধু ভালো কবি নন, ভালো গায়কও ছিলেন। তিনি নিজের লেখা গজল এমন সুন্দর করে গাইতেন যে, সবাই তন্ময় হয়ে শুনতো। রুদাকি আরবি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন। তিনিই প্রথম বিখ্যাত শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘কালিমা ওয়া দিমনা’ ও ‘আলিফ লায়লা’ ফার্সিতে অনুবাদ করেন। এছাড়া লায়লী-মজনু নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ফারসি কবি রুদাকির খণ্ড কবিতাতে।
একজন অন্ধ হয়ে এতো কিছু করা কীভাবে সম্ভব এই প্রশ্নের উত্তরে রুদাকি বলেছিলেন, ‘জীবনযুদ্ধে জয়লাভের জন্য যেসব হাতিয়ারের প্রয়োজন, অন্ধত্ব হচ্ছে সেসবের একটি। অন্য সব হাতিয়ার ধারালো থাকলে একটির অভাব আসলে কোনো অভাব নয়।’
অন্ধত্বকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করা এই মহাকবি ৯৪০ সালে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি চলে গেছেন অনেক শত বছর আগে। তবু রেখে গেছেন সমগ্র সাহিত্য জগতে তাঁর অবদান। আর তাই তো ইতিহাসের পাতায় ফার্সি সাহিত্যের জনক মহাকবি রুদাকির নাম জ্বলজ্বল করেছে।
শূন্য থেকে সহস্রাব্দ পেরোনো এই মহান কবির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।