হিজাব : টিনএজারদের সামাজিক নিরাপত্তার অনুষঙ্গ
বাংলাদেশে হিজাব পরার প্রবণতা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বাড়ছে। স্কুল থেকে অফিস আদালত, সবখানে দেখা যাচ্ছে এমন হিজাব-পরা নারীদের। সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি কিংবা পশ্চিমা পোশাক সব পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে হিজাব পরছে নারীরা। শুধু ধর্মীয় কারণ নয়, সামাজিক নিরাপত্তা ও ধুলোবালি থেকে নিজেকে সুরক্ষার জন্য অনেকেই বেছে নিচ্ছেন এই হিজাব। কিছু কিছু টিনএজারের কাছে হিজাব এখন ফ্যাশনের একটি অনুষঙ্গ। অন্যদিকে বিশেজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় রীতি, সামাজিক চাপ, সুরক্ষা, নিরাপত্তার স্বার্থেই হিজাবের ব্যবহার বাড়ছে। নগরীর মার্কেটসমূহে বিভিন্ন ডিজাইনের হিজাব বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশে হিজাব পরা নিয়ে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। মুসলিমদের ওপর জোর করে হিজাব পরা যাবে না বলে আইন পাসের বিরুদ্ধে নারীরা প্রতিবাদ করছেন। ফ্রান্সে হিজাববিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ইউরোপের মানবাধিকার আদালতে মামলা করেছেন এক মুসলিম নারী। ওই নারী বলেন, বোরকা ও হিজাব পরার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে তার ওপর কোনও ধরনের চাপ নেই। তিনি নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কারণে হিজাব পরেন।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের নারীরা হিজাবের দিকে ঝুঁকছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, আমার পরিবারের পক্ষ থেকে হিজাব পরাটা বাধ্যতামূলক নয় আমার জন্য। আর সবসময় আমি হিজাব ব্যবহার করি না। মাঝে মাঝে এটা ব্যবহার করে থাকি। অনেকে বলেন, আব্রু মেনে চললে অফিস আর যাতায়াতের পথে অনেক সেইফলি চলাফেরা করা যায়। আমি বলতে চাই সেটা শালীন যেকোনো পোশাকের মাধ্যমেই সম্ভব। তবে অনেকক্ষেত্রে এটাও দেখেছি হিজাব বা বোরকা পরে বের হলে অনেকক্ষেত্রে সুযোগও পাওয়া যায়। তাই আমি মনে করি, যাদের পছন্দ তারা হিজাব বা পর্দা করতেই পারে। এই বিষয়গুলোতে জোরাজুরি না করাই শ্রেয়। চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী নাঈম ইসলাম। তিনি জানান, বর্তমানে হিজাব পরার বিষয়টি ফ্যাশনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে। একদিকে পর্দা করাও হয়, পাশাপাশি ফ্যাশনের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে হিজাব ফ্যাশনের অঙ্গ এটা অনেকেই মানতে নারাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাঈমুনা ইসলাম। তিনি বলেন, হিজাব ফ্যাশনের অংশ হয়েছে বলে সবাইকে এটি গ্রহণ করতে হবে বিষয়টি এভাবে ভাবতে আমি পছন্দ করি না। যার ইচ্ছে করবে সে অবশ্যই হিজাব পরবে, এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা বিষয়। তবে ছোটবেলা থেকেই জেনেছি ধর্মীয় কারণেই এই হিজাব কিংবা বোরকা ব্যবহার করা হয়।
অনেকে আবার সুরক্ষা ও প্রয়োজনেই বেছে নিচ্ছেন হিজাব। তেমনি একজন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবাইদা ইসলাম। নিয়মিত হিজাব ব্যবহার করেন তিনি। তিনি জানান, গত দু’বছর ধরে হিজাব পরা শুরু করেছি। কারণ দূষণজনিত কারণে আমার চুলপড়া শুরু হয়। তখন ধুলোবালি থেকে রক্ষা পেতেই এই হিজাব ব্যবহার শুরু করি। তবে নিজের প্রয়োজনে হিজাব পরা শুরু করলেও চলতি পথে নানা সুযোগ-সুবিধা পাই। যেহেতু বাসেই চলাচল করতে হয়, সেক্ষেত্রে নিজেকে কিছুটা প্রোটেক্ট করা যায়।
অনেকে নিজেদের মধ্যে আভিজাত্যে আনতেও বেছে নিচ্ছেন হিজাব। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গৃহবধূ জানান, আমাদের সার্কেলে অনেকেই আছেন, যাদের দেখেছি সম্প্রতি হিজাব পরা শুরু করেছে। কারণ এতে এলিগেন্ট একটা লুক আসে। তাই নিজেদের সুরক্ষাও হয় এবং ফ্যাশনও করা হয়। চট্টগ্রাম কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী সোনিকা সায়াম। তিনি বলেন, ধর্মীয় কারণেই আমি হিজাব পরি এবং আমার পরিবারের নারী সদস্যদের সকলেই এই হিজাব পরে। এটা পরে কাজ করতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি কখনো। তবে উপরের সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই হিজাব পরিধানের প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হারে বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে ফ্যাশন, পরিবারের চাপ, ধর্মপরায়ণতা, সুরক্ষার বিষয়গুলোকেই গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ও লেখিকা ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘অনেক কারণে হিজাবের ব্যবহার বেড়েছে গত কয়েকবছর ধরে। ধর্মীয় রাজনীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ, সুরক্ষা, নিরাপত্তার স্বার্থে, সুযোগসন্ধানী এ বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।’
‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৪) পড়ছি, তখনো হিজাব পরতে দেখা যায়নি মেয়েদের। এমনকি স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও না। তবে বোরকার প্রচলন ছিল। অনেকে আবার চোখ ঢেকে রাখা এক ধরণের পর্দা ব্যবহার করতেন। যা খুব অল্পসংখ্যক। তবে বর্তমানে যারা হিজাব পরে তাদের অধিকাংশই জানে না কেন হিজাব পরে। শুধুমাত্র আভিজাত্য প্রকাশ করতেও বর্তমানে হিজাবের ব্যবহার শুরু হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, তবে কিছু কিছু মেয়ে নিজেদের প্রয়োজনে এই বোরকা, হিজাবকে বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে লড়াকু শ্রেণির পেশার মহিলারা। আবার অনেকে মনে করেন বোরকা, হিজাব ব্যবহার করলে যাতায়াতেও অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষ করে যৌনহয়রানির মতো ঘটনাগুলো এড়ানো যায়। অনেকে আবার পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে এই হিজাবটাকে গ্রহণ করেন। বিশেষ করে টিনএজার বয়সীরা। ধর্মীয় বিধি-বিধানও এর সঙ্গে যুক্ত। অনেক পরিবার ভাবে ছোটবেলা থেকে অভ্যাস না করলে বড় হয়ে আর পরবে না। তবে বর্তমানে সুযোগসন্ধানী অনেকেই এই হিজাব ব্যবহার করছেন। উদ্দেশ্যমূলককারণে মুখ লুকিয়ে খারাপ কাজের সুবিধার্থে এমন পোশাকগুলো ব্যবহার করছেন তারা।
ঊর্মি বড়ুয়া
চট্টগ্রাম