পবিত্র কুরআন শিক্ষা এবং এ খাতে ব্যয় প্রসঙ্গে
আলী হাসান তৈয়ব
আধুনিক বিশ্বে অমুসলিম গবেষকরা যখন জ্ঞানের সমুদ্র পবিত্র কুরআনের ভেতর থেকে মণি-মুক্তো আহরণ করে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়, তখন কুরআনের জাতি মুসলিমরা একে গুরুত্ব না দিয়ে, এর শিক্ষায় মনোনিবেশ না করে এবং এর শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংস ও পতন নামক খাদের কিনারায়। পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করি, আজ তাওহীদের কালেমা পাঠকারী অনেক ভাই-বোন সারা পৃথিবীর সকল ভালো-মন্দ জ্ঞানের পেছনে ছুটছেন, জাগতিক জ্ঞান প্রচার ও উন্নতির পেছনে জীবনের বসন্তগুলোকে উৎসর্গ করছেন, অথচ তারা তাদের ইহ ও পরকালীন সার্বিক সাফল্যের নিশ্চয়তা দানকারী পবিত্র কুরআনটাই কেবল পড়ছেন না। কুরআনের ছাঁচে নিজেকে, নিজের সমাজ ও রাষ্ট্রকে গড়ছেন না। এমনকি কুরআনুল কারীম নিয়ে তারা আর দশটি জ্ঞানগ্রন্থের মতো গবেষণাও করছেন না। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ (44)
‘এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে। আর যাতে তারা চিন্তা করে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
‘এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে। আর যাতে তারা চিন্তা করে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا (24) إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى ۙ الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ (25) ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ ۖ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ (26)
‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে? নিশ্চয় যারা হিদায়াতের পথ সুস্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পৃষ্ঠপ্রদর্শনপূর্বক মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান তাদের কাজকে চমৎকৃত করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দিয়ে থাকে। এটি এ জন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা যারা অপছন্দ করে। তাদের উদ্দেশ্যে তারা বলে, অচিরেই আমরা কতিপয় বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব’। আল্লাহ তাদের গোপনীয়তা সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন।’
হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ».
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে কুরআন শেখে এবং (অপরকে) শেখায়।’
আমরা জানি কুরআন শেখা ও মুখস্থ করা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। কারণ এ কুরআন হলো মহান রবের অলৌকিক বাণী। সরল পথের পাথেয়। আল্লাহর মজবুত রশি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (153)
‘আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।’
যাকে এই কুরআন শেখার তওফীক দেওয়া হবে সে বিশাল মর্যাদা ও ফযীলতের অধিকারী হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالْـحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِـهَا، لَا أَقُولُ [الٓمّٓۚ۰۰۱] {البقرة: 1} حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيْمٌ حَرْفٌ».
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত পড়বে, তার জন্য একটি নেকী লেখা হবে। আর নেকীটিকে করা হবে দশগুণ। আমি বলছি না الٓمّٓۚ۰۰۱ একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ এবং ‘মীম’ একটি হরফ’।’ সুবহানাল্লাহ!
আবু হুরায়রা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ، يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُوْنَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْـمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ، وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ، لَـمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ».
‘যখন কোনো দল আল্লাহর ঘরসমূহের কোনোটিতে সমবেত হয় কুরআন তিলাওয়াতের জন্য এবং পরস্পরে তা শেখার জন্য, তখন তাদের ওপর সকীনা নাযিল হয়, তাদেরকে রহমত ঢেকে ফেলে, তাদের ফেরেশতারা বেষ্টন করেন এবং আল্লাহ তাদের আলোচনা করেন তার কাছে যারা রয়েছে তাদের কাছে। আর যে ব্যক্তিকে তার আমল পিছিয়ে দেয় তার বংশ তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না।’
সন্তানদের আল্লাহর কিতাব মুখস্ত করায় উদ্বুদ্ধকরণ এবং কুরআন বিষয়ে তাদের আগ্রহী করায় বিশাল ফযীলত রয়েছে। সন্তান ও পিতামাতার জন্য প্রচুর নেকী রয়েছে। সন্তানদের কল্যাণ এবং তাদের কল্যাণ যদ্বারা পিতামাতা উপকৃত হতে পারেন তার অন্যতম হলো সন্তানকে কুরআন শেখানো। যেমন হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: صَدَقَةٌ جَارِيَةٌ، وَعِلْمٌ يُنْتَفَعُ بِهِ، وَوَلَدٌ صَالِحٌ يَدْعُوْ لَهُ».
‘মানুষ যখন মরে যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি (উৎস) থেকে (তার নেকীপ্রাপ্তির রাস্তা খোলা থাকে): সাদাকায়ে জারিয়া, এমন ইলম যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দুআ করে।’
তার জন্য এও কল্যাণবাহী যে সে আল্লাহর কিতাব মুখস্থ করবে এবং তা পড়ার চেষ্টা করবে। অতএব পিতামাতাদের কর্তব্য হবে, আপন সন্তানদের আল্লাহর কিতাব শিক্ষা দেওয়া, তা মুখস্থ ও চর্চায় অনুপ্রাণিত করা। যাতে করে সবাই এর নেকী লাভ করতে পারে এবং ভ্রান্তি ও পদস্খলন থেকে বাঁচতে পারে। কেননা কুরআনে কারীম হলো আল্লাহর কাছে পৌঁছার জন্য মজবুত রশি এবং এর সরল পথ স্বরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا۪ ۰۰۱۰۳
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।’
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَمَنْ يَّعْتَصِمْ بِاللّٰهِ فَقَدْ هُدِيَ اِلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍؒ۰۰۱۰۱
‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে দৃচভাবে ধারণ করবে তাকে অবশ্যই সরল পথের দিশা দেয়া হবে।’
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ».
‘আমি তোমাদের মধ্যে এমন জিনিস রেখে গেলাম আমার পরে যা তোমরা দৃচভাবে আঁকড়ে থাকলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তার রাসূলের সুন্নাহ।’
আল-হামদুলিল্লাহ, আমাদের দেশে আল্লাহর কিতাব নিখুঁতভাবে পঠন-পাঠন ও মুখস্থ করণের খেদমতে নানা উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। দেশের লাখ লাখ মসজিদে, সব এলাকার মক্তবগুলোয় দিনরাত কুরআন শিক্ষার মতো মহৎ উদ্যোগ পূর্ব থেকেই চলে আসছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগের চাহিদা পূরণে নানা উপায়ে মুসলিমকে কুরআনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করতে আল্লাহর অসংখ্য বান্দা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সহজে কুরআন শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়েছে। নূরানী পদ্ধতিতে মাত্র কয়েক দিনে মাতৃভাষা নয় এমন এক ভাষা আরবীর অক্ষর জ্ঞান দিয়ে পবিত্র কুরআন পড়ায় অভ্যস্ত করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে নিজে কিংবা নিজের সন্তানকে প্রাইভেট শিক্ষক রেখে কুরআন শেখার ব্যবস্থা করছেন। ইসলামের সেবায় নিয়োজিত, মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানরত সকল জামায়াত ও গোষ্ঠীই মানুষকে কুরআনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করার কাজ কম-বেশি করে আসছেন। দেশের প্রতিটি প্রান্তে ইসলামী শিক্ষার বিশেষ প্রতিষ্ঠান সরকারি (আলিয়া) ও বেসরকারি (কওমী) ধারার মাদরাসাগুলোতেও যতেœর সঙ্গে কুরআন শিক্ষার এই ফযীলতপূর্ণ কাজ চলছে।
তবে এসব উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। এদিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কুরআন ও কুরআনের শিক্ষা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি মুসলিমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে যাতে তাদের কোনো সন্তান কুরআনের শিক্ষা ছাড়া গঙে না ওঠে। কুরআনের আলোয় আলোকিত এবং কুরআনের চরিত্রে চরিত্রবান হিসেবে তাদের মানুষ করতে হবে। তাদের জন্য শুধু এ শিক্ষার ব্যবস্থা করেই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না, বরং নিয়মিত তদারক করতে হবে তারা ঠিক মতো পড়ছে কি-না, প্রত্যহ মক্তব-মসজিদ বা মাদরাসায় যাচ্ছে কি-না। তারা সালাত আদায়ে মসজিদে যাচ্ছে কি-না। আরও তদারক করতে হবে যাতে তারা নিজেদের মূল্যবান সময় খারাপ কিছু তো দূরের কথা অনর্থক কিছুতেও ব্যয় না করে। এমন খেলাধূলায় যাতে না জড়ায় যা তার শরীর-মনকে কলুষিত করতে পারে। তার মধ্যে বদ স্বভাব কিংবা খারাপ চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারে।
প্রত্যেক অভিভাবকেরই দায়িত্ব নিতে হবে নিজের অধীন সন্তানদের। কারণ সন্তানরা হলো কলিজার টুকরো, আমাদের কাঁধে সন্তানরা আল্লাহর আমানত স্বরূপ। অতএব তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। এ বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এসবের শিক্ষক-পরিচালকদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এটিকে নিজের দায়িত্ব মনে করে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। বলাবাহুল্য এ কাজটির জন্য অব্যহতভাবে অর্থের প্রয়োজন। এ জন্য আমরা মাসিক বা বার্ষিক অল্প করে হলেও অনুদান দেব। আল্লাহ যাকে সামর্থ্য দিয়েছেন তিনি এককালীন বড় অনুদানও দিতে পারেন। প্রতিষ্ঠানের জন্য জায়গা বা নির্মাণ সামগ্রীও দান করতে পারেন। দীন প্রচারের কাজটি সাধারণত ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুদানেই পরিচালিত হয় তাই এর স্থায়ী সম্পদের ব্যবস্থা করাও জরুরী। এতে করে শিক্ষকদের বেতন, ছাত্রদের খরচাদি যোগানোসহ অন্যান্য প্রয়োজন সহজেই পূরণ করা সম্ভব হয়।
এই পুণ্যকর্মে, লাভজনক ব্যবসায় প্রতিযোগিতামূলক আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে করে আমাদের প্রভুত নেকী অর্জিত হবে। আল্লাহ অল্পের বিনিময়ে বেশি দান করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اِنَّ الَّذِيْنَ يَتْلُوْنَ كِتٰبَ اللّٰهِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِيَةً يَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَۙ۰۰۲۹ لِيُوَفِّيَهُمْ اُجُوْرَهُمْ وَ يَزِيْدَهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖ١ؕ اِنَّهٗ غَفُوْرٌ شَكُوْرٌ۰۰۳۰
‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহ যে রিয্ক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না। যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী।’
এতে করে আমাদের কাক্সিক্ষত ফায়দা হাসিল হবে। উন্নত ফল বেরিয়ে আসবে। আমাদের পরবর্তীতে এমন এক প্রজন্ম গড়ে ওঠবে যারা আখলাক-চরিত্রে হবে অনন্য। যারা আল্লাহর কিতাব হিফজকারী হবে। নিজের পিতামাতা ও সমাজের জন্য কল্যাণের বার্তাবাহী হবে। সবার নিয়ত সঠিক হলে, কাজ নিখুঁত হলে এবং সার্বিক সহযোগিতা দিলে এ কাজ বেশি কঠিন নয়।
অতএব আমাদের সবার কর্তব্য হলো নিজের ব্যাপারে, নিজেদের সন্তান ও পরিবার সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا وَّقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلٰٓىِٕكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُوْنَ اللّٰهَ مَاۤ اَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ۰۰۶
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, যারা আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সে ব্যাপারে অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়।’
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন,
«أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا، وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ».
‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম তথা জননেতা একজন দায়িত্বশীল; তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন তার দায়িত্ব সম্পর্কে। স্ত্রী দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানের; তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মানুষের (দাস) ভৃত্য দায়িত্বশীল মুনিবের সম্পদের, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। অতএব সতর্ক থেকো, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে।’
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘দায়িত্বশীল’ তিনিই, যিনি হবেন রক্ষণাবেক্ষণকারী, বিশ্বস্ত, নিজ দায়িত্ব ও নজরাধীন বিষয়ের কল্যাণ ও স্বার্থ সম্পর্কে সজাগ। এ থেকেই বুঝা যায় যা কিছু তার নজরাধীন রয়েছে, তাতে তার ইনসাফ কাম্য। তার দুনিয়া ও আখিরাত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কল্যাণ কাম্য। আজকাল অনেক বাবা-মাই মনে করেন সন্তানের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব সীমিত। কখনো খেলাধুলা ও বস্তুগত আরও কিছুকে এর সঙ্গে যোগ করা হয়। অথচ তারা তাদের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারেন না। কারণ তাদের গুরুত্বের সবটুকু জুড়ে থাকে শারীরিক প্রতিপালন, কখনো বৃদ্ধিবৃত্তিক লালনকেও এর সঙ্গে যোগ করা হয়। তবে রূহ তথা আত্মার খোরাক সম্পর্কে উদাসীনতা দেখানো হয়। অথচ বাস্তবে মানুষ প্রথমে রূহ তারপর বুদ্ধি অতঃপর দেহ।
সাহাবীদের বাণী হিসেবে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, কিয়ামতের দিন সন্তানরা পিতামাতার পেছনে লেগে থাকবে। তারা চিৎকার করে বলবে, হে পিতা, আপনি আমাকে ধ্বংস করেছেন কেন?!!
তারপরও কিভাবে পিতা-মাতারা কলিজার টুকরা সন্তানদের জাহান্নামের জ্বালানি হিসেবে বেঙে উঠতে দেন?!! বরং তারা জাহান্নামে পৌঁছার সব সামগ্রী তাদের জন্য ক্রয় করেন। এমনটি হবার কারণ সাধারণ পিতা-মাতার ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। আর যারা ইসলাম সম্পর্কে জানেন, তাদের ইসলামের নির্দেশনা মতো সন্তানের লালন-পালন পদ্ধতি না জানা। এর সিংহভাগই সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে। এ কারণেই পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দায়িত্ব, যা সীমাহীন যতেœর দাবি রাখে। তাই মুসলিম নর-নারীকে এ দায়িত্বের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। মুসলিম বিদ্যালয়গুলোর কর্তব্য আগামী প্রজন্মকে এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্তভাবে গড়ে তোলা। তাদেরকে এ দায়িত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে পরিচিত করা।
আসুন আমরা নিজেদের সময় ও সম্পদ আল্লাহর কাজে ব্যবহার করি। সময় থাকতেই নিজের উভয় জগতের কল্যাণে কাজে লাগাই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আল্লাহ আমাদেরকে নিজেদের সন্তানদের তাঁর নির্দেশ মতো গঙে তোলার তওফীক দিন। আমীন।
আল-কুরআন, সূরা আন-নাহল, ১৬:৪৪
আল-কুরআন, সূরা মুহাম্মদ, ৪৭:২৪Ñ২৬
আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৬, পৃ. ১৯২, হাদীস: ৫০২৭
আল-কুরআন, সূরা আল-আনআম, ৬:১৫৩
আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৫, পৃ. ১৭৫, হাদীস: ২৯১০
মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ.