জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাম্যের দাওয়াত

সাম্যের দাওয়াত

সাম্যের দাওয়াত
মোরশেদ জাহান

আসরের নামায শেষে মসজিদের আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করছে মাহিন। বিকেলের সময়টা কোথায় কাটানো যায়! ভাবছে একলা মনে। গ্রামে আসা হয়নি বহুদিন। গেলো রাতে ছুটে এসেছে তাই মা-মাটির টানে। গ্রামীন সবুজ প্রকৃতি বরাবরই তাকে কাছে টানে। হাতছানি দেয় অবারিত সবুজ মেঠোপথ। খালপাড়টাতে বসার কথা ভাবছে একবার, আবার অন্য কোথাও ঘুরে দেখার ইচ্ছে জাগছে তার মনে। সংশয়ের দোলাচলে পায়চারি করছে এদিক-ওদিক।
গাঁয়ে মাহিনের ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গী হাতেগোনা দু-চারজন। দশ বছর বয়স হতেই বাড়ির বাইরে সে। প্রাইমারি শেষ করে মাদরাসায় পড়াশুনো শুরু। পাড়ায় বন্ধুবান্ধব বলতে তেমন কেউ নেই। গ্রামে এলে পাশের পাড়ার এক খৃস্টান বন্ধুর সঙ্গে গ্রামটা ঘুরে দেখে। বন্ধুটা তার বেজায় ভদ্র। বেশ ভালো মনের অধিকারী। মেধাবীও তুখোড়। শারিরীক অসুস্থতা ও পারিবারিক টানাপড়েনে লেখাপড়ায় এগোয়নি বেশিদূর। তবে গণিতে বেশ পারদর্শী। এলাকায় গণিতে তার যথেষ্ট নামডাক। প্রাইভেট পড়তে স্টুডেন্টরা যথারীতি তার কাছে ভীড় করে। মাহিনের সমবয়সী হওয়ায় দুজনের বোঝাপড়াটাও ভালো। আজ সে ভীষণ ব্যস্ত। ব্যক্তিগত কিছু কাজের অজুহাত দিয়েছে বন্ধুকে। ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবে তাই তার দেখা মিলছে না। মাহিনের সময় কাটানোর অন্য সঙ্গী হলেন মহল্লার মসজিদের ইমাম হাফেজ মাহবুব।
‘মাহিন ভাই! চলেন। হাটে যাবো। কিছু কেনাকাটা আছে।’ হুট করে তার ভাবনায় ফাটল ধরলো। ইমাম হাফেজ মাহবুব কোত্থেকে এসে হাজিরা দিলো। সালাম বিনিময় সেরে প্রস্তাবটি করলো।
‘আপনি এসেছেন! ভালোই হলো। বিকেলটা কীভাবে কাটাবো, ভাবছিলাম।’ মাহিন পেছন ফিরে মৃদু হেসে জানালো।
মসজিদের আঙিনা ছেড়ে জোর কদমে এগিয়ে চললো তারা। হাটের দূরত্ব কিলো দেড়েক হবে। চলতে চলতে মাহবুব মাহিনকে তার কলেজজীবনের নানা দিক নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘নতুন পরিবেশ, ভিন্ন পরিবেশ, দাড়ি-টুপি নিয়ে ক্লাস করতে কেমন বোধ করছেন কলেজে?’
মাহিনও তার প্রশ্নগুলির জবাব দিতে লাগলো। বহুদিনের সখ্য তাদের মাঝে। জীবনের কতো কী গল্প জুড়ে গেছে, যাচ্ছেও বা নিজেদের অজান্তে। আলাপে আলাপে একটা সময় হাটে পা পড়লো তাদের। হাটটা বেশ জমেছে আজ। উপচেপড়া ভীড় চারদিকে।
‘মাহবুব ভাই! হাতে কিন্তু সময় নেই তেমন।’ তাড়া দিলো মাহিন।
সূর্যটা প্রায় ঢলে পড়েছে। মাগরিব ধরতে হবে। তড়িঘড়ি তাই কেনাকাটা শেষ করে নিলো তারা। এবার বাড়ির পথ ধরার পালা। হাট থেকে বেরোবার নাম করতেই দেখা জয়দেবের সঙ্গে। জয়দেব পাশের এলাকার হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। ইয়া বড় সাইজের দুটো ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছে সে। ব্যাগভর্তি সদাইপাতি। বাড়ি ফেরার পথটি বেশ অকেজো। ভ্যান-গাড়ি চলাচলের উপযোগী নয় একদমই। পথ চলতে হয় তাই পায়ে হেঁটেই। একসঙ্গে দুটো ব্যাগ বহন করা! তাও আবার এতোটা পথ! অসম্ভব প্রায় জয়দেবের জন্য। ওর অবস্থা দেখে মাহবুব এগিয়ে গেলো। একটি ব্যাগ ওর হাত ফসকে নিজের হাতে নিতে চাইলো। জয়দেব অবশ্যি খুব জোরাজুরি করলো না দেবার জন্য। তবু মাহবুব ব্যাগটি ওর হাত থেকে কেড়ে নিলো। এরপর পথ চললো সামনের। মাহিনও হা করে দাঁড়িয়ে থাকেনি। এগিয়ে এসে বললো, ‘জয়দেব কাকা! আপনার ব্যাগের একটা হাতল আমার হাতে দিন।’ ওদের ঠিক পেছনেই হাঁটছিলেন এলাকার প্রভাবশালী রহমত সাহেব। অনেকটা কাঠখোট্টা প্রকৃতির তিনি। মাহবুবের একজন নিয়মিত মুসল্লিও। তিনজনের ব্যাগ টানাটানি দেখছিলেন পেছন থেকে। সামনেই এলাকার ত্রি-মাথা-গোছের একটা বাঁক। তিনজনেই দাঁড়িয়ে গেলো সেখানে। জয়দেবের বাড়ি ডানদিকে, মাহিন ও মাহবুবের পথ বাঁ-দিকে।
‘কাকা! আমাদের তো অন্যদিকে যেতে হবে। তাছাড়া আজানের সময়টাও বেশ কাছাকাছি। নইলে আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতাম।’ ভদ্রতা দেখালো মাহিন।
এতোটুকুতেই জয়দেবের চোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। মৃদু হেসে দুজনের হাত ধরে বললো, ‘থাক থাক, সমস্যা নাই। আর আগাইয়া দিতে অবে না। যট্টুক করেছো, তাতেই তোমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নাই। আইজ তোমরা আমারে অনেক কিছু শিখাইলা। মানুষে মানুষে বিভেদ নাই, বুঝাইলা। আশীর্বাদ করি, ভগবান তোমাদেরকে অনেক বড় করুক।’
‘ঠিকাছে, আবার দেখা হবে।’ বলে মাহিন ও মাহবুব আপন গন্তব্যের পথ বেছে নিলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে ডাক শোনা গেলো রহমত সাহেবের। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লো তার সম্মানে।
‘ইমাম সাব! একজন হিন্দুর ব্যাগ টাইনা আনলেন? তাও আবার সামান্য একজন কাঠমিস্ত্রির?’ কুশলাদি ছাড়াই মাহবুবকে কথাটি বললেন তিনি। মাহবুবের মাথাটা নিচু হয়ে গেলো। এবার মাহিনের পালা। তাকেও বেশি কথা বলতে ছাড়লেন না রহমত সাহেব। জোর গলায় বললেনÑ‘তুমি তো মাদরাসায় পড়েছো একটা সময়। মুসলিম হিসেবে এলাকায় তোমার বাবার বেশ সুনামও আছে। তুমিও চাকরের মতো হিন্দু লোকটার ব্যাগ টাইনা আনলা?’
মুখ খুললো মাহবুব ‘কাকা! রাগ করবেন না। অনুমতি দিলে একটা কথা বলি? আজকের এই আচরণ আমার ধর্ম আমায় শিখিয়েছে। আমার মাদরাসা আমায় তালিম দিয়েছে।’ মাহিনও ওর সঙ্গে জুড়লো নিজের অভিব্যক্তি ‘কাকা! এই মানবতা, উদারতা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকেই আমরা শিখেছি। মাদরাসা, পরিবার থেকে হাসিল করেছি। এটা কোনো গোলামি নয়।’
অগত্যা রহমত সাহেব দু’জনের পিঠে মৃদু হাত চাপড়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ