রমজান মাসে বদরপ্রান্তরে মহানবী (সা.)
মাওলানা দৌলত আলী খান
মদিনায় মহানবী (সা.)-এর প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারে ঈর্ষান্বিত হয়ে কুরাইশরা ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে লাগলো। তারা বুঝতে পারলো, নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামকে ধ্বংস করতে না পারলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আর এ অবস্থাকে কেন্দ্র করে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ১৭ রমজান বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এটাই ইসলামের ইতিহাসে বদরযুদ্ধ নামে পরিচিত। মূলত এযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে ষড়যন্ত্র করেছিল মুনাফেক আবদুল্লাহ বিন উবাই। কারণ সে নিজে মদিনার শাসক হওয়ার আশা পোষণ করেছিল, কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন করলে তার সেই আকাক্সক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়। শুধু তা নয়, সুবিধাবাদী কিছু ইহুদিও মুনাফেকদের সাথে মিশে মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দেয়।
মক্কার কুরাইশরা মনে করে, মদিনায় মুসলমানদের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হলে মদিনার মধ্য দিয়ে তাদের একমাত্র বাণিজ্যপথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে মক্কার কুরাইশরা মদিনার সীমান্তে আক্রমণ চালিয়ে ভয়ভীতি সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের এ অত্যাচার বন্ধের জন্য মদিনার মুসলমানরা আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
অতঃপর মহানবী (সা.) কুরাইশদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে মক্কার উপকণ্ঠে একটি গোয়েন্দা দল প্রেরণ করেন। তবে কোনো কাফেলার ওপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেননি। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ভুলক্রমে মক্কার নিকটবর্তী নাখলা নামক স্থানে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করে এবং একজনকে হত্যা করে। ফলে উভয় দলের মধ্যে শত্রুতা প্রকট আকার ধারণ করে। এরপর আবদুল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মদিনায় ফিরলে মহানবী (সা.) তাঁর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। কারণ, তখন ছিল পবিত্র রজব মাস। এ মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। এ ঘটনায় মহানবী (সা.) দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। কিন্তু এ সময়ে কুরআনের একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা জায়েয কি না। বলো, পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা গুরুতর অন্যায়। কিন্তু আল্লাহকে অস্বীকার করা, আল্লাহর ভক্তদেরকে তাঁর পথে চলতে ও পবিত্র মসজিদে যেতে বাধা দেয়া এবং মোমিনদেরকে সেখান হতে তাড়িয়ে দেয়া আল্লাহর চোখে অধিকতর অন্যায় এবং হত্যা অপেক্ষা অত্যাচার বেশি ভয়াবহ। (সূরা বাকারা: ২১৭)
এ আয়াতে আবদুল্লাহর কাজের সমর্থন মিললো। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মন শান্ত হলো। তবে এ খ-যুদ্ধের ফলে মক্কার কুরাইশদের ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি পেল। তারা অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য বাণিজ্যের নামে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি দল সিরিয়া গমন করে। কিন্তু মিথ্যা খবর আসে, কুরাইশ কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে মদিনার মুসলমানদের আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। এ সংবাদে আবু জেহেল প্রায় এক হাজার সৈন্যসহ মদিনা আক্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করে।
মক্কাবাসীদের যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদে মহানবী (সা.) চিন্তিত হয়ে পড়েন। রক্তপাত তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু যুদ্ধ প্রতিহত করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। এমতাবস্থায় আল্লাত তাআলা তাঁর নিকট ওহী পাঠিয়ে যুদ্ধের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায়। ওহীতে বলা হয়, ‘আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো যারা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করে। তবে সীমা লঙ্ঘন করো না। কারণ, আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৯০)
এরপর মহানবী (সা.) যুদ্ধসংক্রান্ত পরামর্শ সভা আহবান করলেন। এতে সিদ্ধান্ত হলো, মুসলমানরা কুরাইশদের মোকাবেলা করবে। মন্ত্রণা সভার পরামর্শক্রমে ৬২৪ সালের ১৩ মার্চ (১৭ রমজান, ২য় হিজরী) তারিখে ২৫৩ জন আনসার এবং ৬০ জন মোহাজেরিন নিয়ে গঠিত একটি মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রেরিত হয়। তবে এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই।
মদিনা হতে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর উপত্যকায় মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে কুরাইশী কাফেরদের নংঘর্ষ হয়। রাসুল (সা.) স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করে অনুপ্রেরণা দান করেন। প্রথমে প্রাচীন আরব রীতি অনুসারে মল্লযুদ্ধ হয়। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে হযরত আমীর হামজা, হযরত আলী ও আবু উবাইদা কুরাইশ পক্ষের নেতা উতবা, শায়বা এবং ওয়ালিদ বিন উতবার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে শত্রুপক্ষের নেতৃবৃন্দ পরাজিত ও নিহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে আবু জেহেল তার বাহিনীসহ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মুসলমানদের প্রচন্ড আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। অসামান্য রণ-নৈপুণ্য ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলিমগণ বদরের যুদ্ধে মক্কার কুরাইশী কাফেরদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এ যুদ্ধে আবু জেহেলসহ ৭০ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয় এবং ৭০ জন সৈন্য বন্দী হয়। অপরদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন। বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ যুদ্ধে ইসলাম ও পৌত্তলিকার চরম পরিক্ষা হয়ে গেল। মিথ্যার ওপর সত্যের জয় হলো। বদর যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলমানরা ঈমানি চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। (সূত্র: বিশ্বনবী (সা.): গোলাম মোস্তফা; সীরাতে মোস্তফা: মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী)
বদর যুদ্ধের বিজয় সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, নিশ্চয়ই দুটো দলের মোকাবেলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে। আর অপর দল ছিল কাফেরদের, এরা স্বচক্ষে তাদেরকে দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। এরই মধ্যে শিক্ষণীয় রয়েছে দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য। (সূরা আলে ইমরান: ১৩)
বদর যুদ্ধের ফযীলত সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এবং তাঁর সাহাবাগণ মদিনা হতে যাত্রা শুরু করে মুশরিকদের পূর্বেই বদর নামক স্থানে পৌঁছে গেলেন। তারপর মুশরিকরা সেই স্থানে আসলো। অতঃপর রাসুল (সা.) মুসলিম মুজাহিদদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা এমন এক জান্নাতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাও, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের ন্যায়। এমন সময় ওমাইর ইবনে হুমাম আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, বাহবাহ! বাহবাহ!! তখন রাসুল (সা.) তাকে লক্ষ করে বললেন, তোমার বাহবাহ বাহবাহ বলার কারণ কি? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে আল্লাহর রাসুল! এর দ্বারা আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। বরং আমি শুধু এই আশায় বলছি যে, আমিও যেন এর অধিবাসী হয়। হুযুর (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই তুমি অধিবাসী। আনাস (রাযি.) বলেন, তখন ওমাইর তার থলে হতে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। অতঃপর বলে ওঠলেন, আমি যদি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে তা হবে বড়ই দীর্ঘ জীবন। এ কথা বলে তিনি অবশিষ্ট সমস্ত খেজুর ফেলে দিলেন এবং মুশরিকদের মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, অবশেষে শহীদ হয়ে গেলেন। (মুসলিম: ৫০২৪)
লেখক: শিক্ষক, নাজিরহাট বড় মাদরাসা, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম