জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদান

জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদান

জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদান

মির আহসান

বর্তমান যুগ জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ হিসেবে পরিচিত। আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় আজ সকলেই বিমোহিত। একদিনকার কল্পনার রাজ্য আজকে বাস্তবতায় ফুটে উঠেছে। মহারহস্যপুরী উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মহাভেদ উন্মোচনে মানুষ তথায় আঘাত হানছে বারে বারে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের সফলতা জগতের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। পাখির বীরত্বকে হার মানিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে উড়োজাহাজ। সমুদ্র সম্রাট দৈত্যাকৃতি নীল তিমির গর্বকে খর্ব করে সমুদ্রের উদর চিরে ধাবিত হচ্ছে সমুদ্রজাহাজ। দূরপ্রাচ্য থেকে পরিচিত কণ্ঠের সাথে ছবিও ভেসে আসছে অবাক করে। দিনে দিনে আমরা পাচ্ছি বিজ্ঞানীদের থেকে জ্ঞান-সাধনার অভাবিত উপহার। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজ মানব জীবনে এসেছে পরম সাচ্ছন্দ্য। এসেছে ডিজিটাল পদ্ধতি আর প্রগতি। বিজ্ঞান ছাড়া মানব সভ্যতাকে এখন আর কল্পনা করাই দুস্কর। বিশাল ভূমন্ডল আজ সংকীর্ণ রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। মুহূর্তের ব্যবধানে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ঘটনা আজকে আর অলীক নয়। ক্রমেই যেন কল্পনার বর্ণনাহীন সওয়ারী বাস্তবতায় পৌঁছতে বিজলির গতিতে এগিয়ে চলছে। কিন্তু বিজ্ঞানের এ অগ্রযাত্রার ইতিহাসকে মুসলমানদের অবদান নিয়ে পর্যলোচনা করলে মনে হয় মুসলমানদের অবদান একেবারে শূন্যের কৌটায়। আসলে কি বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান নেই? বিজ্ঞান মানেই কি ইউরোপ আর আমেরিকা? তাদের কাছ থেকে মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান শিখতে হয়েছে? অথচ আমাদের অনেকেই জানে না যে, মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসূতি। মুসলমানদের পূর্বপুরুষেরা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে। বিশ্ব সভ্যতা মুসলমানদের কাছে ঋণী। মুসলমানরাই বিশ্বসভ্যতাকে রক্ষা করেছে। এ ব্যাপারে মুসলিম ঐতিহাসিক মোহাইনির একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, In the seventh century, Western Europe was declining while the Byzantine and Persian empires were manifestly bent upon mutual destruction. Likewise, India was greatly divided. However, China was steadily expanding, the Turkish in central Asia were disposed to work in an accord with China. During this period, the world was saved by the rise of the Islamic civilization.[i]

অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের পতন ঘটছিল। অন্যদিকে বাইজান্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য একে অন্যের ধ্বংস সাধনে ছিল সুস্পষ্টরূপে বদ্ধপরিকর। একইভাবে ভারত ছিল মারাত্মকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। তবে দৃঢ়তার সঙ্গে চীনের সম্প্রসারণ ঘটছিল। মধ্য এশিয়ায় তুর্কিরা চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। এসময় ইসলামী সভ্যতার উত্থানে বিশ্ব রক্ষা পায়।

তাহলে বোঝা যায় মুসলমানদের অবস্থা আজকের মতো এত শোচনীয় ছিল না। তারা ছিল একসময় বিশ্বের প্রভু। তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিল বিশ্বসভ্যতা। মুসলমানদের ঘাড়ের ওপর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ। অথচ বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়ার জন্য একটি গভীর চক্রান্ত ইসলামী রেনেসাঁ যুগকে অন্ধকার ও বর্বর যুগ হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। একইসঙ্গে বিজ্ঞানময় ধর্ম ইসলামকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রগতির পথে একটি অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করে ইতিহাসে অন্ধকার ছড়িয়েছে। এবার দেখি মুসলমানরা বিজ্ঞানে কী কী অবদান রেখেছেন। এ সংখ্যায় আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান নিয়ে আলোচনা করব।

চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান

জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। শরীর সম্পর্কিত বিদ্যা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে খাদ্য সংগ্রহ ও রোগ-ব্যাধি মোকাবেলায় যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, তা থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূত্রপাত। আর তখনকার চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল তাদেরই আবিষ্কৃত ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি। রোগের সুস্থতার জন্য ঝাড়ফুঁক ছিল তাদের একমাত্র পথ্য।

এরপর মানুষের হাত ধরে আসে লতা-পাতা ও গাছগাছড়ার ব্যবহার। গাছের পাতা, গাছের মূল ও ফলে খুঁজে পায় সুস্থতার নিরাময়। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে বনজ বা গাছগাছালির সাহায্যে চিকিৎসাব্যবস্থা অব্যাহত আছে।

পৃথিবীতে চিকিৎসাশাস্ত্র একটি সুশৃঙ্খল অবকাঠামোর রূপ পায় হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর মাধ্যমে। ইতিহাসবিদ আল-কিফতী তাঁর তারিখুল হুকামাত-এ লিখেছেন, ‘ইদরীস (আ.) হলেন প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। এ বিষয়ে তাঁর কাছে ওহী আসে।’

মহা নবী মুহাম্মদ (সা.)ও চিকিৎসাশাস্ত্রে রেখে যান যুগান্তকারী অবদান। তাঁর হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে পূর্ণতা ও সজীবতা আসে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তাঁর ওপর নাযিলকৃত কুরআন চিকিৎসাশাস্ত্রের এক আকরগ্রন্থ। মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চার ধরন ও ধারণের কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে পবিত্র কুরআন। চিকিৎসাশাস্ত্রে কুরআনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে জার্মান পন্ডিত ড. কার্ল অপিতজি বলেছেন, In the Quran’s 114 Surahs, 97 verses of Surahs 355 are related to medical science. 355 verse has been given a complete solution to all aspects of the human body অর্থাৎ কুরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট। ৩৫৫টি আয়াতে মানবদেহের সব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া হয়েছে।

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক থিওরি দিয়েছেন। রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। নিজ হাতে চিকিৎসা করেছেন এবং নিজ আবিষ্কৃত পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন। হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ সহীহ আল-বুখারী শরীফে তিব্বুন নববী শীর্ষক অধ্যায়ে প্রায় ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে।  প্রতিটি পরিচ্ছেদের অধীনে একাধিক হাদিস রয়েছে। সব হাদিসই রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি, রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধ কার্যাবলি সংবলিত। আর তিনি নিজ হাতে শিক্ষা দিয়েছেন সঙ্গীদের। Prof. Brown বলেন, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। ’ রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে মহানবী (সা.) মোটামুটি ৫টি পদ্ধতি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন ১. হাজামাত বা রক্তমোক্ষণ পদ্ধতি। ২. লোলুদ বা মুখ দিয়ে ওষুধ ব্যবহার। ৩. সা’উত বা নাক দিয়ে ওষুধ ব্যবহার। ৪. মাসীয়ী বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধ ব্যবহার। ৫. কাওয়াই বা পেটের বিশোধনের ওষুধ ব্যবহার। আর ওষুধ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন মধু, কালজিরা, মেহেদী, খেজুর, জলপাই, কাকরোল, মান্না বা ব্যাঙের ছাতার মতো এক প্রকার উদ্ভিদ, উটের দুধ প্রভৃতি।

রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। এ বিষয়ে আলী (রাযি.)-এর নাম বিশেষভাবে পাওয়া যায়। ইসলামী খেলাফত আমলে মিসরের গভর্নর হজরত আমর ইবনুল আস (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা বিষয়ক উপদেষ্টা ইয়াহইয়া আন নাহবি চিকিৎসা বিষয়ক অমূল্য গ্রন্থাবলি রচনা করেন। তিনি প্রথম আরব চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি ইজিয়ান দ্বীপের কালজয়ী চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্রিটিস (৪৬০-৩৭৭ খ্রিস্টপূর্ব) এবং গ্যালেনের (২০০-১৩০ খ্রিস্টপূর্ব) গ্রন্থগুলোর ওপর গবেষণাধর্মী পুুস্তক প্রণয়ন করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগতির এ ধারা উমাইয়া শাসনামলেও অব্যাহত থাকে। খালিদ ইবনে ইয়াযীদের উদ্যোগে চিকিৎসাবিজ্ঞানসংক্রান্ত গ্রিক গ্রন্থগুলো আরবিতে অনূদিত হয়। অষ্টম শতাব্দীতে গ্রিক গ্রন্থগুলো আরবিতে অনুবাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে খলিফা আল মানসুর ও খলিফা আল মোতাওয়াক্কিল সরাসরি পৃষ্টপোষকতা করেন। জাবের ইবনে হাইয়ান ছিলেন এ যুগের একজন বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ। এ ছাড়াও অনুবাদের ক্ষেত্রে যারা অবদান রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জুরজিস, ইসহাক ইবনে হুনাইন, সাবেত আল নাফেল, আল-বাতরিক, আবদুল্লাহ ইবনে ইসহাকসহ আরও অনেকে।

অনুবাদ যুগের পরে শুরু হয় মৌলিক অনুবাদ যুগ। এ সময় মুসলমানরা চিাকৎসা শাস্ত্রে মৌলিক অবদান রাখতে শুরু করেন। সময়কালটি ছিল নবম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এ সময়কালকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ সময় বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিদ চিকিৎসা শাস্ত্রকে করে তুলেন পূর্ণাঙ্গ ও সমৃদ্ধশালী। তাদের মধ্যে অন্যতমরা হলেন,

১. ইবনে সিনা: সর্বকালের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক আবু আলী হুসাইন ইবনে সিনা। বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী বুখারার কাছে (৯৮০-১০৩৭) জন্মগ্রহণ করেন। ইউরোপে ‘আভিসিনা’ নামে পরিচিত। ইবনে সিনা ছোট বড় মোট ১২৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-কানুন ফিত তিব। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। ইউরোপের লোকেরা তাকে প্রাচ্যের গ্যালেন হিসেবে অভিহিত করতেন। কারণ তৎকালীন গ্রিক বিজ্ঞানী গ্যালেনই ছিলেন চিকিৎসায় ইবনে সিনার সমকক্ষ ব্যক্তি। G. Sarton ইবনে সিনা সম্পর্কে বলেন, The man that this world has ever seen. স্যার টমাস ক্লিফোর্ড বলেন, ইবনে সিনার আল-কানুন ফিত তিব হিপোক্র্যাটস ও গ্যালেনের কৃতিত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারণ ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। মানবসভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর চেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ এখনো পর্যন্ত আর দ্বিতীয়টি নেই।

২. আলী আত-তাবারী: চিকিৎসা শাস্ত্রের স্বর্ণযুগের সর্বপ্রথম উদ্যোক্তা হলেন, আলী আত তাবারি (৮৩৯-৯২০)। তিনি ছিলেন মুসলিম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের গৃহচিকিৎসক। তিনি খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরদৌসউল হিকমা নামে একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রই নয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কেও আলোচিত হয়েছে। এটি গ্রিক, ইরানি ও ভারতীয় শাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। পি কে হিট্রি তাঁকে One of the oldest Arabic compendiums of Medicine বলে আখ্যা দিয়েছেন।

৩. আল-কিন্দী: মুসলিম দার্শনিক আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি। ল্যাটিন নাম Alchendius| ইরাকের কুফায় (৮১৩-৮৭৩) খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরব জগতের দার্শনিক হিসেবে বিশ্ব ব্যাপি পরিচিত হলেও চিকিৎসা শাস্ত্রে তার অবদান অপরিসীম। তিনি ঔষুধের সাথে গণিতের সামঞ্জস্য করতে চেয়েছিলেন। Encyclopedia Britanicaগ্রন্থে বলা হয়েছে, তার ২৭০টি গ্রন্থের মধ্যে ২৭টি গ্রন্থ ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান সর্ম্পকিত। এর মধ্যে দুইটি বইয়ের নাম পাওয়া যায়। কিতাবুন ফি কিমিয়া ও আল-ইতর ওয়াত তাসিদাত। যাতে রয়েছে তেল, মলম ও আতর তৈরি সম্পর্কিত ও বিভিন্ন রোগ ও তার ব্যবস্থাপনাপত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা।

৪. আর-রাযী: মুসলিম চিকিৎসাবিদদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া আর-রাযী (৮৬২-৯২৫) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিদ। দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এর অর্ধেকই ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কীয়। প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন। মানুষের কিডনি ও গলব্লাডারে কেন পাথর হয়, সে সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন। লাশ কাটার বিষয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেন আল-জুদারি ওয়াল হাসবাহ। এটি ল্যাটিন ও ইউরোপের সব ভাষায় অনুবাদ করা হয়। শুধু ইংরেজি ভাষায় চল্লিশবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় বইটি। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে(Al-hawy) আল-হাবী। এতে সব ধরনের রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ বইয়ে ২০টি খ- আছে। আল হাবির নবম খ- ইউরোপের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ষোলো শতক পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। বইটিতে তিনি প্রতিটি রোগ সম্পর্কে প্রথমে গ্রিক, সিরীয়, আরবি, ইরানি ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালীর বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।

৫. আলী ইবনে আব্বাস: আলী ইবনে আব্বাস একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর রচিত কিতাবুল মালিকী তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসার বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে তিনি পূর্বেকার বিজ্ঞানীদের সমসাময়িক মতবাদ উল্লেখ করেন। তিনি ছিলেন সুদক্ষ শল্যবিদ, যিনি ব্যান্ডেজ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন।

৬. আলী ইবনে ঈসা: ইরাকের আলী ইবনে ঈসা (৯৪০-১০১০) ছিলেন একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি চক্ষুবিজ্ঞানের ওপর ‘চক্ষু বিশেষজ্ঞদের স্মারক’ এবং ‘চক্ষু চিকিৎসার চুম্বক’ নামে দুটি অতি উচ্চমানের গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থ দুটি তৎকালীন সময়ে এবং পরবর্তীকালেও চক্ষুবিজ্ঞানের পাথেয় হিসেবে কাজ করে।

৭. আবুল কাসেম আল-জাহরাবী: মুসলিম স্পেনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন আবুল কাসেম আল জাহরাবী (৯১৬-১৯১৩)। তিনিই প্রথম ইউরোপে সার্জিকেল বিদ্যার প্রচলন ঘটান। তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আত-তাসরীফ দুই খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে এনাটমি, ফিজিওলজি ও ডায়াবেটিকস সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। ২য় খন্ডে সার্জারী সক্রান্ত বিষদ বিবরণ রয়েছে। বিখ্যাত গবেষক G. Sarton তাঁর এই গ্রন্থকে Medical Encyclopadia আখ্যায়িত করেছেন।

৮. ইবনে রুশদ: ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) ছিলেন একজন বিশিষ্ট মুসলিম চিকিৎসাবিদ। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম কুল্লিয়াত ফিত তিব। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত। এতে তিনি রোগ, সাধারণ লক্ষণ ও ভেষজ সম্বন্ধে বিস্তৃত ও তথ্যপূর্ণ আলোচনা করেন। তিনি ভেষজ সম্পর্কে মোট ১৮ খানা বই রচনা করেন।

উল্লিখিত মুসলিম মনীষীগণ ছাড়াও আরো অনেক মুসলিম চিকিৎসাবিদ চিকিৎসা শাস্ত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। যেমনÑ ইবনে জুহর, আল বেরুনী, ইবনে হাইসাম, নাসির উদ্দিন তুসি, কুতুব উদ্দিন সিরাজী, সালাহ উদ্দিন ইবনে ইউসুফ, আলী মালকা, ফখরুদ্দীন রাজী, মুহাম্মদ আল মাহদীসহ আরো অনেক।

প্রিয় পাঠক! চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনই গৌরবময় ইতিহাস আছে মুসলমানদের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে চতুর্দশ শতকে মুসলমানদের ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সব কিছু থেকে আধিপত্য কমতে থাকে। চুরি হয়ে যায় অনেক থিওরি। ১৩০০ শতকে মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রগুলোতে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সেনারা ৩০ বছর ধরে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে অসংখ্য গ্রন্থাগার ও গবেষণালয় বিনষ্ট হয়ে যায়। আজ যদি মুসলমানদের আবিষ্কার, থিওরি ও লিখিত গ্রন্থাদি থাকত, তাহলে বিশ্ব পরিবার আজ চিকিৎসাবিজ্ঞনে এক নতুন দিগন্ত খুঁজে পেত। ইনশাআল্লাহ আগামীতে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় মুসলমানদের অবদান নিয়ে আলোকপাত করবো।

  মোহাইমিনি, গ্রেট মুসলিম ম্যাথমেটিশিয়ান পৃ. ৩

  আল-কিফতী, তারিখুল হুকামাত, পৃ. ৪৮

[1] Die Midizin In Koran, Dr. Karl Opteji page, 56

  সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুত তীব অধ্যায়

  বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, মুহাম্মদ রহুল আমীন, পৃ. ৬০

  প্রফেসর’স বিসিএস ইসলামিক স্টাডিজ, পৃ. ১৪৫

  দিকদর্শন গাইড সিরিজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ. ৩২৭

  মুসলিম দর্শন ও দার্শনিক , ড. মোঃ ইব্রাহীম খলীল, পৃ. ২২৯

  জি এম নিউজ, ০৬ নভেম্বর ২০১৭

  প্রফেসর’স বিসিএস ইসলামিক স্টাডিজ, পৃ. ১৪৮

  দিকদর্শন গাইড সিরিজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ. ৩২৮

  মুসলিম দর্শন ও দার্শনিক, ড. মোঃ ইব্রাহীম খলীল, পৃ. ৩৩১

  প্রফেসর’স বিসিএস ইসলামিক স্টাডিজ, পৃ. ১৪৮

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ