আল্লামা ইকবাল: বিশ্বনন্দিত এক দার্শনিক কবি
আম্মার সাদিক
পাঞ্জাবের সিয়ালকোট শহরে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর ইকবালের জন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। প্রায় তিনশ বছর আগে তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন। শিয়ালকোটে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন শেষে ইকবাল ১৮৯৫ সালে লাহোরে যান।
শৈশব থেকেই ইকবাল কবিতা লেখা শুরু করেন। তার শিক্ষক শামসুল ওলামা মীর হাসান তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাকে উৎসাহিত করতে থাকেন। সিয়ালকোট ত্যাগ করার সময় ইকবাল যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষায় মাত্র উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তবুও প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানে ততক্ষণে তিনি গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।
লাহোরে তিনি বিভিন্ন কবি-সম্মেলনে যোগ দিয়ে কবিতা পাঠ করতে থাকেন। ক্রমে তাঁর কবিখ্যাতি দিগি¦দিক ছড়াতে থাকে। লাহোরের আঞ্জুমানে হিমায়েতে ইসলামের বার্ষিক সভায় ১৮৯৯ এবং ১৯০০ সালে পঠিত তার ‘অনাথের বিলাপ’ ও ‘ঈদের চাঁদের প্রতি ইয়াতীমের সম্বােধন’ কবিতাদ্বয় (তাঁর প্রকাশিত কাব্য-সংগ্রহে এগুলির স্থান দেওয়া হয়নি) শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
ইকবাল মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনেক বিদেশি কবিতার সরল কাব্যানুবাদও করেছেন। এ শ্রেণির কিছুসংখ্যক কবিতা তার প্রকাশিত বইগুলোতে দেখা যায়। তিনি কিছু কিছু রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন, যদিও এদিকে তার ঝোঁক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
লাহোরে ইকবাল বিখ্যাত মনীষী টমাস আরনল্ডের সংস্পর্শে আসেন এবং পাশ্চাত্য কৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় লাভের সুযোগ পান।
বিশেষত আধুনিক সমালােচনা ও গবেষণা-পদ্ধতির পাঠ তিনি আরনল্ডের কাছেই পান। এ সময় ইকবালের প্রথম বই প্রকাশিত হয়, যা উর্দু ভাষায় ধনবিজ্ঞানের সর্বপ্রথম বইও বটে । তার এ সময়কার কবিতা বেশ উচ্চমার্গীয় হলেও এতে পরবর্তী রচনায় পরিলক্ষিত দৃষ্টির প্রসারতা, উদারতা, গভীরতা ও চিন্তার পরিপক্বতা দেখা যায় না।
আরনল্ডের পরামর্শে ইকবাল উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯০৫ সালে ইউরোপ যান। তিন বছর তিনি সেখানে অবস্থান করেন। তাঁর চিন্তাধারা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রবাসের এই তিন বছর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে, কর্মের চেয়ে প্রস্তুতিতেই এর অধিকাংশ ব্যয় হয়েছে।
কেমব্রিজ, লন্ডন ও বার্লিনের বিশাল গ্রন্থাগারগুলো ছিল সহজলভ্য। গভীর অধ্যয়ন ও ইউরোপীয় মনীষীদের সঙ্গে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলাপ-আলােচনায় ইকবাল তার প্রবাসকালের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।
তাঁর চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এ সময়। সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদই ইউরোপীয় সঙ্কটের মূল কারণ তার উদার মন এমন জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
অপরদিকে অবিরাম সংগ্রাম ও সক্রিয় গতিশীল জীবনকেই তিনি স্বকীয় আদশরূপে গ্রহণ করেন। তার অসংখ্য কবিতায় এর পরিচয় পাওয়া যায়। আবার এসময়েই তিনি উর্দুর পরিবর্তে ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা শুরু করেন।
কবি ইকবালের ইউরোপ প্রবাস ছিল গভীর প্রস্তুতির। তিনি কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি ও মিউনিখ থেকে ডক্টরেট লাভ করেন। ছয় মাস তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবির অধ্যাপক ছিলেন। তখন লন্ডনে অনেকগুলি মূল্যবান বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
ইকবাল ১৯০৮ সালে লাহোরে ফিরে আসেন। কিছুদিনের জন্য আংশিক সময় তিনি লাহোর সরকারি কলেজে দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনায় ব্যয় করেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে আইন ব্যবসাও শুরু করেন। পরে অধ্যাপনা ছেড়ে আইন ব্যবসায় পূর্ণ মনােযোগ দেন।
১৯১৫ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ প্রকাশ ইকবালের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গতানুগতিক নিষ্ক্রিয় মরমীবাদের ভক্তদের মনে এ সংকলন প্রবল ধাক্কা দেয়। প্রথমদিকে তাকে প্রবল বিরুদ্ধ সমালােচনা সহ্য করতে হয়েছিল।
সুখের বিষয়, ইকবালের জীবনকালেই তার এ বই বিশ্বব্যাপী সমাদর লাভে সমর্থ হয়েছিল। আসরার-ই-খুদীর পরিপূরক রুমুয-ই-বেখুদি প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সনে। ফলে কবি ও দার্শনিকরূপে ইকবালের খ্যাতি বিশ্বের সুধী সমাজে স্থায়ীভাবে প্রসার লাভ করে।
ইকবালের কাব্যকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় : এক. শুরু থেকে রুমুয-ই-বেখুদি পর্যন্ত রচিত কবিতা। দুই. রুমুয-ই-বেখুদি পরবর্তী কবিতা।
বিলাতে যাবার আগে ইকবাল উর্দু ভাষায় যেসব কবিতা লিখেছিলেন তাতে যথেষ্ট সৌন্দর্য ছিল বটে, কিন্তু তাঁর প্রতিভা তখনাে স্থৈর্য ও পূর্ণতা পায়নি। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরে উর্দুতে ‘শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া’, ‘শামা আওর শাইর’ ইত্যাদি কয়েকটি অপূর্ব রকমের বই প্রকাশ করেন।
কিন্তু মানব সমাজের জন্য যে অভিনব বাণী তিনি প্রদান করবেন, তার আভাস এতে নেই। সে বাণী প্রথম মূর্ত হয়ে ওঠে ফারসী ভাষায় লিখিত ‘আসরার’ ও ‘রমূ’ কাব্যদ্বয়ে, পূর্ণ বিকশিত প্রতিভার প্রথম অবদান। বিশ্ব সাহিত্যে এর সমকক্ষ কাব্য বিরল।
১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘খিজর-ই-রাহ’ এবং পরের বছর ‘তুল-ই-ইসলাম’। দুটি কবিতাই উর্দু ভাষায় রচিত এবং ‘বাঙ্গ-ই-দারা’ নামক কবিতাটি এ সংকলনে স্থান পেয়েছে।
এরপরে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় লিখিত ‘পয়ামই-মাশরিক’ বা প্রাচ্যের বাণী। এর কবিতাগুলি বিখ্যাত জার্মান কবি গ্যেটের কয়েকটি কবিতার প্রত্যুত্তরে লিখিত।
দু’বৎসর পর প্রকাশিত হয় ‘যবুর-ই-আজম’ (ফারসী) এবং তার পরে ‘জাবিদনামা’ (ফারসী)।কেউ কেউ জাবিদনামাকে ইকবালের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৩৪ সালে তাঁর ফারসি কবিতা ‘মুসাফির’ এবং ১৯৩৬ সালে অন্য একটি ফারসি কবিতা ‘পাসূচে বায়াদ কদ’ (কিংকর্তব্য) প্রকাশিত হয়। এ সময় আবার তিনি উর্দু ভাষাতেও কবিতা লেখা শুরু করেন।
উর্দু কবিতা সংগ্রহ ‘বাল-ই-জিবরাঈল’ ১৯৩৫ সালে এবং ‘যুব-ই-কলীম’ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়।
ফারসি ও উর্দু ভাষায় তাঁর শেষ কবিতা সংকলন ‘আরমুগান-ই-হিজায’ (হিজাযের অভিনব উপহার) প্রকাশিত হয় ইকবালের ইনতিকালের পরে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ইকবালকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তিনি মাদ্রাজ, হায়দরাবাদ ও আলীগড়ে কয়েকটি সুচিন্তিত বক্তৃতা প্রদান করেন। সেগুলি The Reconstruction of Religious Thought in Islamনামে পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৩১-৩২ সালে তিনি আবার ইউরোপ ভ্রমণে গেলে বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক হেনরি বার্গসের সঙ্গে প্যারিসে সাক্ষাত করেন। কথা প্রসংগে ইকবাল ‘কালকে ভর্ৎসনা করো না’ হাদীসের উল্লেখ করেন, শোমাত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হুইল চেয়ারে বসা দার্শনিক লাফিয়ে ওঠেন।
ফিরার পথে ইকবাল স্পেন ভ্রমণ করেন এবং মুসলিম যুগের প্রাচীন সৌধসমূহ দর্শন করেন। একটি ইসলামি সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে তিনি জেরুজালেমেও গমন করেছিলেন।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের শিক্ষা সংস্কার বিশেষ করে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সম্বন্ধে পরামর্শ দেবার জন্য আফগান সরকার ইকবালকে কাবুলে দাওয়াত করে নিয়ে যান। তার প্রদত্ত অধিকাংশ সুপারিশই আফগান সরকার কার্যে পরিণত করেছিলেন।
ইকবাল ১৯০৮ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত আইন ব্যবসা করেন। পরে অসুস্থতার জন্য তাকে এ ব্যবসা ছাড়তে হয়। তার আইনের জ্ঞান ছিল গভীর। কিন্তু অত্যধিক ধনােপার্জন কখনই তার উদ্দেশ্য ছিল না।জীবন ধারণের জন্য যতটা অর্থের দরকার, তার যোগাড় হলেই তিনি আর মােকদ্দমা নিতেন না।
আল্লমা ইকবাল ১৯২৭ সালে পাঞ্জাব আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে তিনি সাইমন কমিশনের সমক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। সে বছরের মুসলিম লীগের বার্ষিক সভার তিনি সভাপতিও নির্বাচিত হন। তাঁর সুচিন্তিত অভিভাষণে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির আবশ্যকতা সম্বন্ধে আভাস ছিল।
১৯৩৭ সনের ২১ জুন কায়েদ-ই-আযমকে লিখিত এক পত্রে তখনকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার কথা উল্লেখ করে ইকবাল লেখেন, এ অবস্থায় এটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, ভারতে শান্তি রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে বংশগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংযোগের ভিত্তিতে দেশকে পুনর্বন্টন করা’।
ভারতীয় সমস্যার বাস্তব সমাধান-রূপে দেশ বিভাগের পরিকল্পনা তিনিই প্রথম পেশ করেন।
১৯৩১ এবং ১৯৩২ সালে তিনি বিলাতে গােল টেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। ১৯৩২ সালে তিনি মুসলিম সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতির অভিভাষণে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সুচিন্তিত মতবাদ প্রকাশ করেন।
১৯৩৫ সালে রোডস(Rhodes) বক্তা হিসেবে তাকে অক্সফোর্ডে আমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু অসুস্থতার দরুন তাকে এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হয়। ১৯৩৭ সালে তার চোখে ছানি পড়ে। যদিও মাঝে মধ্যে তিনি কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন, তবুও তার শেষ দিনগুলি দৈহিক অসুস্থতার মধ্যেই অতিবাহিত হয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাঁর সৃজনী কর্মতৎপরতা এ সময় ছিল সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ। আমৃত্যু তার শেষ কবিতাটি বলে বলে লিখিয়ে নেন। যারা তার সেবা-শুশ্রুষা করতেন তাদের মত, শারীরিক শক্তি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনীষা অধিকতর শক্তিশালী ও প্রখর হতে থাকে ।
১৯৩৮ সালের ২৫ মার্চ তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। সুচিকিৎসা ও সেবাশুশ্রƒষা সত্ত্বেও তিনি ২১ এপ্রিল প্রত্যুষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আধঘণ্টা আগে তিনি নিচের শ্লোকটি আবৃত্তি করেন,
نمیمے از حجاز آید کہ ناید
ر دانای راز آید کہ ناید
سرود رفتہ ما أید کہ ناید
سر أمد روزگار ابن فقیر
বিগত দিনের সুর-মূর্ছনা ফিরবে অথবা ফিরবে না
হিজাযের মধুমন্দ বাতাস বইবে অথবা বইবে না,
দীন ফকিরের জীবনের দিন ফুরালে হায় আজ
অন্য মনীষী সুধীরা ফের আসবে অথবা আসবে না।
অন্তিম সময়ে আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করে তিনি ধীরে ধীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ঠোঁটে একটি ক্ষীণ হাসির রেখা খেলছিল এবং স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল তারই একটি পঙ্ক্তি:
বীর মুমিনের নিশান তােমায় বলছি এবার,
মৃত্যু এলে হাস্য খেলে ঠোঁটেতে তার।