উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রেক্ষাপট : যুগ চাহিদায় করণীয়
মিযানুর রহমান জামীল
সময়ের স্রোত অনেক দূর এগিয়ে যায়। কালের আয়নায় লেগে যায় কতো যুদ্ধ বিগ্রহের দাগ। সূর্যের উদয় অস্তের মধ্যে উল্টে যেতে থাকে কালের পৃষ্ঠা। ১৭৫৬ সাল। ভারত উপমহাদেশে মুসলমানরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। দীর্ঘ আট শত বছর মুসলিম শাসনের ফলে ভারত উপমহাদেশ ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন উন্নতি ও সমৃদ্ধির একটি ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে যায়। সংখ্যালঘু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের নীতি নৈতিকতা ও উন্নত আদর্শের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে ছিল মাথার তাজ। তাই মুসলমানদের শাসক হিসেবে গ্রহণ করতে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। এরই মধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে যায়।
১৭৫৭ সাল। শুরু হলো বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। আর তখনই শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহদ্দিসে দেহলভীর শিষ্য ও সন্তান শাহ আব্দুল আজীজ দেহলভী (রহ.) ভারতবর্ষকে ‚দারুল হরব“ ঘোষণা করেন। ১৮৩১ সালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রামের সূচনা করেন ইসলামী খেলাফত প্রত্যাশী অবিসংবাদিত প্রাণ পুরুষ শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.)। আর এই ১৮৩১ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রেরণা (বালাকোট যুদ্ধ) ইংরেজদের রোষানলে পড়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেন। কেউ মাল্টা বা আন্দামান দীপে নির্বাসিত হন। কেউ কারাগারে তিলে তিলে ক্ষয় হন। শেষ পর্যন্ত আলেমদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের (বালাকোট ফেরত) অন্যতম মুজাহিদ নেতা মাওলানা ইয়াহইয়া আলীর পরোক্ষ নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে গণঅভ্যূত্থানের রূপ নেয়। হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে আন্দোলনের কাজ বণ্টন করে দেন। নিজেও সশরীরে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৮৫৭ সালের আযাদী বিপ্লবের সময় থানাভবন ফ্রন্টে তার সঙ্গে যে সব মর্দে মুসলমান ও সংগ্রামী আলেম জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের সংখ্যা ছিল হাজর হাজার। এর মধ্যে হাজ এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর সহকর্মী শিষ্য হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.), হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.)-এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর ওলীরা থানা ভবনে এসে সমবেত হন। তারা সেখানে ইংরেজদের হটিয়ে অনেক এলাকা জয় করেন। এমনকি ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটিও দখল করতে সক্ষম হন। কিন্তু বালাকোটের ন্যায় এবারও বিশ্বাসঘাতকদের ঘড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়। ফাঁসির কাষ্ঠে ২৮ হাজার মুসলমান ও সাত শত আলেম শাহাদাত বরণ করেন।
মোটকথা ঊনবিংশ শতাব্দীটা ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য ছিল অত্যন্ত ক্রান্তিকাল। নানামুখী আগ্রাসনে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইসলামী শৌর্য-বীর্যের প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঘোষণা করছিল। দিল্লির রাজ সিংহাসন থেকে মোগল শাসন বিদায় নিয়েছিল। সেখানে ব্রিটিশ শাসন জেঁকে বসেছিল। ইংরেজ শাসন গোটা ভারতবর্ষকে গ্রাস করে ফেলেছিল। ইসলামী সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনৈসলামী কৃষ্টি-কালচার, ধ্যান-ধারণা ও শেরেকী আকীদা-বিশ্বাস এমনভাবে শেকড় গেড়ে চলেছিল যে, ইসলামের আসল পরিচয়ই হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। ইসলামী সমাজ বিভিন্ন সভ্যতা ও ধর্মের আগ্রাসনে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তার আসল রূপই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
ইসলামী সমাজের ওপর একই সাথে দ্বিমুখী হামলা চলছিল। একদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে নির্মূল করার জন্য দলে দলে খ্রিস্টান পাদ্রিদের প্রেরণ করতে লাগল। এসব পাদ্রি নানারূপ চক্রান্ত করে ভারতের মানুষকে খ্রিস্টান বানানোর চেষ্টা করতে লাগল এবং মুসলমানদের মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। দিল্লির জামে মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। পাদ্রিদের দুঃসাহস এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তারা মুসলমানদের সাথে শুধু বিতর্কই নয়, সংঘর্ষেও লিপ্ত হতো। বিভিন্ন বাজারে গলিতে গলিতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাদরিরা দলে দলে ঘুরে বেড়াত এবং মুসলমানদের ঈমান আকিদা-নষ্ট করার চেষ্টা করত। সারা ভারতবর্ষে খুব কমই শহর ও জনবসতি ছিল যেখানে পাদ্রিরা তাদের অপচেষ্টা চালায়নি। এমন স্থান খুব কমই ছিল, যেখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়ে মুসলমানদের অন্তর ক্ষত-বিক্ষত করেনি। তারা জোরপূর্বক সর্বত্র নিজেদের প্রচার কার্য চালাত এবং মুসলমানদের মোকাবিলা করার জন্য চ্যালেঞ্জ দিত। ঝঞ্ঝা বায়ুর ন্যায় তাদের প্রচার তৎপরতা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্রের সাথে অপরদিকে তারা অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামের নামে এমন একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়ে মুসলমানদের শেকড় কর্তনের এমনি এক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করল যে, খ্রিস্টান মিশনারীরা সারা জীবন চেষ্টা করেও তা করতে সক্ষম হতো না। আর সে আন্দোলনটি ছিল কাদিয়ানী আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট হলো, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি ইংরেজদের সর্বাপেক্ষা অস্থির করে তুলেছিল তা হলো, ‚ইসলামের জিহাদ নীতি“।
ইসলামের যে জিহাদী তরবারি ইংরেজদের মাথার ওপর সদা ঝুলছিল, তা চিরকালের জন্য চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে ইংরেজরা ছিল বদ্ধপরিকর। যদিও প্রাচ্যবিদদের একটি দল জিহাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, তবুও এ বিষয়ে সফলকাম হওয়ার জন্য তাদের নিকট মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী অপেক্ষা আর কেউ উপযুক্ত ছিল না। তাই তারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইসলামের জিহাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিল। যাতে মুসলমানদের ভেতর থেকে সেই জিহাদের আগুন জ্বলে না উঠতে পারে, যার ভয়ে তারা সব সময় তটস্ত থাকত। এই অভিশপ্ত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইংরেজ সরকারের সহযোগিতায় ইসলামের জিহাদ নীতির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। পরবর্তীতে সে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় প্রথমে ঈসা মাসীহ তারপর শেষ নবী পর্যন্ত দাবি করেছিল। এর মাধ্যমে সে লাখ লাখ মুসলমানের ঈমানী দুর্গে দিন-দুপুরে হামলা চালিয়েছিল।
কাদিয়ানী ফিতনার পাশাপাশি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে শেকড় গেড়ে বসা শিয়া সম্পদ্রায়ও তাদের অসংখ্য শেরেকী আকীদা-বিশ্বাস ও প্রথা-প্রচলন মুসলিম সমাজে প্রসার ঘটিয়েছিল, যা ধীরে ধীরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের স্বীকৃত আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে শামিল হয়ে যাচ্ছিল। শিয়া ফিতনা ছাড়াও কিছু দুনিয়াদার, স্বার্থপর পীর ও ওলামায়ে ছূর প্রচেষ্টায় নির্ভেজাল তাওহীদ ও সুন্নাতের পরিবর্তে আশ্চর্য ধরনের বিদআত, রসম-রেওয়াজ ও প্রথা-প্রচলন এবং শেরেকী কর্মকা- সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। এসব ওলামায়ে ছূ হুব্বে রাসূল-এর আড়ালে রাসূল ও পীর-আওলিয়াদেরকে ‚প্রভুত্বের“ মর্যাদায় আসীন করেছিল।
ভারতবর্ষে হাজার হাজার কবরকে তারা কাবা শরীফের মর্যাদা দিয়েছিল। কবরের সামনে তারা আনুগত্যের মাথা অবনত করত। এসব কবরীদের মধ্যে বিশেষভাবে ব্রেরেলীর রেজভী সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, ভারতবর্ষে ইসলামের চেরাগ নিভে যাওয়ার উপক্রম করছিল। পরিস্থিতির যাঁতাকলে মুসলমানরা নিষ্পেষিত হচ্ছিল। কিন্তু কখনো এই ভূখ-কে তাওহীদ ও সুন্নাতের ঝরণাধারা থেকে বঞ্চিত করার ইচ্ছা আল্লাহ পাকের ছিল না। তাই এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যর্থবিদ্রোহের পর উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরাম সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খালেস ইলমে দীন শিক্ষা, দাওয়াতী মিশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলার ইলহামী নির্দেশে একটি ইসলামী ছাউনী প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করলেন। সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে আপাতত ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে এ কাজটি হাতে নেন। ফলে শুরু হয় একাডেমিক পন্থায় ভারত উপমহাদেশের নতুন জিহাদী কার্যক্রম।
দারুল উলুম দেওবন্দ সেই কার্যক্রমের নতুন অধ্যায়। যা আজ বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত নাম। নতুন করে এর কোন পরিচয় পেশ করার প্রয়োজন নেই। তবুও প্রসঙ্গক্রমে সংক্ষিপ্ত কিছু ইতিহাস তুলে ধরছি। দারুল উলূম দেওবন্দ উপমহাদেশে ইসলামী চেতনার পীঠস্থান, বিশ্বব্যাপী ইসলামী রেনেসাঁ ও পুনর্জাগণের সবচেয়ে বড় দুর্গ এবং ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সবচেয়ে বড় ঝরণাধারা। দারুল উলূম দেওবন্দের মহান দীনি, ইলমী ও ইসলাহী কার্যক্রম শুধু উপমহাদেশেই নয়, বরং গোটা বিশ্বে এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে, তা কেবল কোন হতভাগা ও দুর্ভাগা ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারে, নতুবা যে কোন সচেতন মানুষ দারুল উলূম দেওবন্দের গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক দীনি কর্মকা-কে স্বীকৃতি দিতে ও তার প্রশংসা করতে বাধ্য। আজ উপমহাদেশে তথা বিশ্বব্যাপী যেসব সক্রিয় জামাআত, সংগঠন, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান মহান দীনের প্রচার-প্রসারে নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকেরই পেছনে কোন না কোনভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের চেতনা ক্রিয়াশীল রয়েছে।
দারুল উলূমের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এখানকার শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হওয়া তালিবে ইলম বাইরের দুনিয়ায় যেন অপরিচিত ও অপাংক্তেয় না হয়। তাকে যেন সময় ও সমাজের সাথে খাপ না খাওয়া ভিন্ন যুগের, ভিন্ন জগতের মানুষ ভাবা না হয়। এমন যেন না হয় যে, দারুল উলূমের ইলমী পরিবেশে কয়েক বছর জীবন ও জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সময় ও সমাজ থেকে বেখবর থেকে হঠাৎ কর্মের ময়দানে হাজির হলো, আর দিশেহারা অবস্থায় পড়ে গেল, বরং এমন যেন হয় যে, এখানে থাকা অবস্থায়ও নিয়মিতভাবে (এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে) বাইরের আলো-বাতাস সে গ্রহণ করতে পারে এবং উন্মুক্ত বাতায়ন পথে ভিতর থেকে বাইরের জগত অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
দারুল উলূমের যখন প্রতিষ্ঠা, তখন আমাদের দীনী মাদারেসে পঠন-পাঠনের একটি বিশেষ ভাষা ও পরিভাষা প্রচলিত ছিল এবং চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের জন্যও ছিল আলাদা রীতি ও শৈলী। এটা ছিল আমাদের প্রাচীন শিক্ষা-ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল। তার ভাষা ও বাক-ধারা এবং চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের রীতি ও পদ্ধতি, সবকিছু সে যুগের প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থা দ্বারা প্র্ভাবিত ছিল। তখন মাদরাসায় পত্র-পত্রিকার তেমন প্রচলন ছিল না বরং দোষণীয় বিষয় ছিল। সেই সময়ে সেই পরিবেশে দারুল উলূমের ছাত্রদের এমন একটি সংগঠনের ভিত্তি স্থাপন করা, যার আলাদা পাঠাগার থাকবে, পত্র-পত্রিকার বিভাগ থাকবে, সাপ্তাহিক বক্তৃতা ও রচনা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান থাকবে এবং এর যাবতীয় আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা, এমনকি সংগঠনের পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব ছাত্রদের হাতে থাকবে এটা ছিল অত্যন্ত বাস্তববাদী চিন্তা এবং সময়ের সাহসী পদক্ষেপ।
এখন তো এই সাংস্কৃতিক চিন্তা আমাদের মাদরাসা জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে যে তাতে অভিনবত্ব কিছুই নেই। কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগে আঠারো শতকের একেবারে শেষ দিকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূমের বিচক্ষণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জমিয়াতুল ইসলাহ প্রতিষ্ঠার এই সাহসী পদক্ষেপ আহলে মাদারেসের জন্য ছিল চমকে উঠার মত ঘটনা। সে যুগ যারা দেখেছেন এবং ইলমী মহলের মন-মানস ও চিন্তা-চেতনার সাথে যাদের পরিচয় ছিল তারাই শুধু এর গুরুত্ব ও গভীরতা অনুধাবন করতে পারবেন।
সে যুগের সে পরিবেশের বিচারে এটা ছিলো অত্যন্ত কল্যাণপ্রসূত একটি পদক্ষেপ এবং কোন সন্দেহ নেই যে, আল-ইসলাহ যুগ ও সময়ের জন্য তখন দিশারীর ভূমিকা পালন করেছে, এখনো করে চলেছে। এখানে যারা শিক্ষা লাভ করেছেন, অনুশীলন করেছেন এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। সমাজের কর্মক্ষেত্রে নেমে তারা তা বেশ কাজে লাগিয়েছেন। এখানে তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভার এমন পরিচর্যা হয়েছে যে, পরবর্তীতে সময় ও সমাজের সামনে দাঁড়াতে তাদের কোন রকম দ্বিধা-সংকোচের সম্মুখীন হতে হয়নি। সুতরাং আল-ইছলাহ যারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, দারুল উলূমের সেই সুসন্তানদের কীর্তি ও অবদানের যত উচ্চ প্রশংসাই করা হোক এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যত কৃতজ্ঞতাই নিবেদন করা হোক, তা সামান্য।
যে কোন কাজের এবং যে কোন পদক্ষেপের মূল্যায়ন হয় সমকালের চাহিদা ও প্রয়োজনের মানদণ্ডে। আল-ইসলাহের প্রতিষ্ঠা যে সময়ের ঘটনা তখনকার জন্য সেটা ছিলো আলিম সমাজের প্রাগ্রসর চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং নিঃসন্দেহে দারুল উলূম ছিল এই চিন্তার দিশারী ও পথিকৃত। কিন্তু সামনে এগিয়ে চলাই হলো সময়ের ধর্ম। সময় সদা গতিশীল, মুহূর্তের জন্য তার যাত্রা বিরতি নেই। তাই সময়ের ব্যবধানে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন হয় এবং চাহিদা ও প্রয়োজনের রূপবদল হয়। সামনে আসে নতুন নতুন সমস্যা ও জিজ্ঞাসা। তৈরি হয় কর্ম ও পরীক্ষার নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং উলামায়ে উম্মতকে দাঁড়াতে হয় অন্য রকম কিছু চ্যালেঞ্জের সামনে, যার সফল মোকাবেলার উপর নির্ভর করে ইলম ও আহলে ইলমের অস্তিত্ব।
এখন তো সাধারণ মাদরাসায় লেখালেখির চর্চা এবং বক্তৃতা-বিতর্কের অনুশীলন হয়, দেয়ালিকা, এমনকি নিয়মিত পত্র-পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বন্ধুরা! সময় এখন অনেক এগিয়ে গেছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। এখন শুধু পত্র-পত্রিকার পাতায় বিচরণ, বক্তৃতা-বিতর্কে অংশগ্রহণ এবং মুখে বা কলমে চিন্তার সুবিন্যস্ত ও পরিমার্জিত উপস্থাপন যোগ্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো এখন বৈশিষ্ট্যের বিষয় নয়, বরং বিগত যুগের স্মৃতিচিহ্নমাত্র। যা শুধু এজন্য বহাল রাখা হয়েছে যে, হয়ত তা চিন্তার প্রসার এবং যুগের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। নচেৎ বাস্তবতা এই যে, পরিবর্তিত সময়ের বিচারে এসবে কোন চমক বা ঝলক নেই, কীর্তি বা কৃতিত্ব নেই। সময় এখন আরো কিছু চায়, সমাজ এখন অন্য কিছু চায়।
বর্তমান মুসলিম সমাজের চিন্তা-জগতে এক ব্যাপক নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। এই উম্মাহ এবং এই দীনের মাঝে যে চিরন্তন যোগ্যতা গচ্ছিত রাখা হয়েছে সেই যোগ্যতা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে যুব সমাজ এবং আধুনিক শিক্ষিত মহলে ভয়ানক অনাস্থা-অনিশ্চয়তা দানা বেঁধে উঠছে, সর্বোপরি দীনের ধারক-বাহক আলিমদের নতুন প্রজন্মে মারাত্মক হতাশা ও হীনমন্যতা শিকড় গেড়ে বসেছে। এগুলো দূর করে যুগ ও সমাজের লাগাম টেনে ধরার জন্য এবং দীন ও শরীয়তকে নয়া জামানার নয়া তুফান থেকে রক্ষা করার জন্য এখন অনেক বেশি প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন। অনেক বড় ইলমী জিহাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় অর্জনের প্রয়োজন।
এখন প্রয়োজন আরও বেশি আত্মনিবেদনের, আত্মবিসর্জনের এবং আরো ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নের।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের পূর্বসূরিগণ অনেক কালজয়ী কীর্তি ও অবদান রেখে গেছেন। বিশেষত নাদওয়াতুল উলামার প্রথম কাতারের লেখক-গবেষক ও চিন্তাবিদগণ তাদের সময় ও সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছেন এবং নতুন প্রজন্মকে ইসলাম ও ইসলামী উম্মাহর ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে যথেষ্ট আশ্বস্ত করতে পেরেছেন। যে সব সমস্যা ও জিজ্ঞাসা তখন জ্বলন্ত ছিল সেগুলোর উপর চিন্তা-গবেষণার যে ফসল এবং যে বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তারা রেখে গেছেন তা সে যুগের জন্য খুবই কার্যকর ও যুগান্তকর ছিল, কিন্তু সেগুলোর চর্বিত চর্বণ এখন বিশেষ কোন কৃতিত্ব বলে গণ্য হবে না এবং তাতে যুগ ও সমাজের হতাশা দূর হবে না।
জ্ঞান ও গবেষণার ক্ষেত্র এখন অনেক ব্যাপক ও বি¯তৃত হয়ে পড়েছে। ইলমের যে প্রাচীন ভাণ্ডার ও গুপ্ত সম্পদ পূর্ববর্তী আলিমদের কল্পনায়ও ছিল না, আধুনিক প্রকাশনা বিপ্লবের কল্যাণে এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলোর নিরলস প্রচেষ্টায় তা এখন দিনের আলোতে চলে এসেছে। আগে যে সব কিতাবের শুধু নাম শুনেছি এখন তা গ্রন্থাগারের তাকে তাকে শোভা পায়। তাছাড়া চিন্তার পথ ও পন্থা এবং অস্থির চিত্তকে আশ্বস্ত করার উপায়-উপকরণে এত পরিবর্তন ঘটেছে যে, পুরোনো ধারার অনুকরণ এখন কিছুতেই সম্ভব নয়। সে যুগের বহু আলোচনা এখন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। একটা সময় ছিলো যখন আল্লামা শিবলীর আল-জিযয়া ফিল ইসলামকে মনে করা হতো মহাআলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব।
এক নজরে আওরঙ্গজেব তো ছিল ইসলামের রীতিমত বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয়। একইভাবে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব। কিন্তু এখন তা এতই গুরুত্বহীন যে, এ সম্পর্কে বলার বা লেখার নতুন কিছু নেই এবং যুগ ও সমাজের তাতে তেমন আগ্রহ নেই। এ যুগে কোন কীর্তি ও কর্ম রেখে যেতে হলে এবং প্রতিভা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি পেতে হলে আরো ব্যাপক ও বি¯তৃত জ্ঞান-গবেষণা ও ইলমী সাধনার প্রয়োজন। কেননা সময়ের কাফেলা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেছে অনেক সামনে। পূর্ববর্তীদের রেখে যাওয়া জ্ঞান-সম্পদ অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। এর সাথে জড়িয়ে আছে মূল্যবান স্মৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য। এগুলো এখন আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ। কিন্তু সময় বড় নির্দয়। যামানা বড় বে-রহম। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যত বিশাল হোক, প্রতিভার প্রভা যত সমুজ্জ্বল হোক এবং জামাত ও সম্প্রদায় যত ঐতিহ্যবাহী হোক সময় কারো সামনেই মাথা নোয়াতে রাজি নয়। যুগের স্বভাবধর্ম এই যে, যোগ্যতার দাবিতে স্বীকৃতি আদায় না করলে আগে বেড়ে সে কাউকে স্বীকার করে না।
কোন কিছুর ধারাবাহিকতা বা প্রাচীনতা সময়ের শ্রদ্ধা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সময় এমনই বাস্তববাদী, এমনই শীতল ও নিরপেক্ষ যে, তার হাতে নতুন কিছু তুলে না দিলে এবং তার ঘাড়ে ভারী কোন বোঝা চাপিয়ে না দিলে সে মাথা নোয়াতে চায় না। সময়ের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি লাভ করা এত সহজ নয় এবং শুধু ঐতিহ্যের দোহাই যথেষ্ট নয়। সুতরাং সময়ের স্বীকৃতি পেতে হলে, ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিস্তার করতে হলে এবং আত্মগর্বী সমাজের মন-মগজে যথাযোগ্য স্থান পেতে হলে প্রতিভা ও যোগ্যতার আরো বড় প্রমাণ দিতে হবে এবং ব্যক্তিত্বের উচ্চতা আরো বাড়াতে হবে, যে উচ্চতা ছাড়িয়ে যাবে হিমালয়ের শৃঙ্গকে।
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে সমান গুরুত্বের সাথে। তা এই যে, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি এখন যদিও উৎকর্ষের চরমে পৌঁছে গেছে এবং চিন্তা-গবেষণার বহু নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে, সর্বোপরি তার গুরুত্ব ও ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মানবজাতির জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে বেশ কিছু সমস্যা ও জটিলতারও সৃষ্টি হয়েছে। সময় এখন এমন নতুন মোড় পরিবর্তন করেছে এবং এমন সব উলট-পালট ও বিপ্লব দেখা দিয়েছে যে, শুধু জ্ঞানের ব্যাপ্তি, চিন্তার উচ্চতা, মতবাদের অভিনবত্ব এবং লেখার যাদু এখন সময়ের আশির্বাদ ও যামানার নেক নজর লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে এখন প্রয়োজন উন্নত চরিত্রের, দরদি হৃদয়ের এবং অশ্রুভেজা চোখের। হয়ত এ কথা আপনাদের কাছে মনে হবে অবাস্তব। হয়ত বলা হবে যে, এ বক্তব্যে সময়ের চরিত্রের সঠিক চিত্র নেই। কেননা সাদা চোখে দেখা যায়, এককালে যে সকল আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের প্রাণপ্রিয় ছিল এবং যে সকল নীতি ও বিধান শরীয়তের প্রাপ্য ছিল আধুনিক যুগ সে সবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আওয়াজ তুলেছে। সুতরাং মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, হৃদয়ের ও চরিত্রের এবং দরদের ও অশ্রুজলের এখন আর তেমন মূল্য নেই।
কিন্তু এ ধারণা ভুল। কেননা সব কিছুর পরও একথা সত্য যে, মহৎ ব্যক্তিত্বের প্রতি, উন্নত চরিত্রের প্রতি এবং কর্মের শুভ্রতার প্রতি সমাজ ও মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে। যে কোন সংস্কার ও বিপ্লবের পিছনে প্রাণপুরুষ রূপে আপনি এমন কোন কোন ব্যক্তিকে অবশ্যই দেখতে পাবেন যিনি তার বিপুলসংখ্যক সাথী ও অনুগামীকে আপন ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত করেছেন, তাদের চিন্তায়, চেতনায় এবং ভাব ও ভাবনায় পরিবর্তন এনেছেন এবং তাদের মাঝে এক নতুন চিন্তাধারা সৃষ্টি করেছেন। মোটকথা গুণসমৃদ্ধ কোন ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করেই নতুন আদর্শের এবং নতুন বিপ্লবের আবির্ভাব ঘটেছে।
যে কোন বিপ্লবের গোড়ায়, যেখান থেকে বিপ্লবের নতুন স্রোতধারা উৎসারিত হয় এবং দেশ ও সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে অবশ্যই আপনি একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব দেখতে পাবেন, বিশ্বাসের শিকড় যার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত এবং বিপ্লবের চেতনায় মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন। বিশ্বাসের এই গভীরতা এবং চেতনার এই আচ্ছন্নতা তার ব্যক্তিত্বে চৌম্বুক শক্তি ও বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দূর থেকে আকৃষ্ট করে কাছে টেনে আনে। শুধু বক্তৃতা ও বাগ্মিতা, শুধু কলমের ধার ও ভার, শুধু চিন্তার চমক ও গবেষণার চটক এবং শুধু মনীষা ও জ্ঞানবৈদগ্ধ দ্বারা যুগ ও সমাজের বুকে নতুন বিপ্লব সৃষ্টি করা যায় না। বিপ্লব তো বড় কথা, সাদামাটা পরিবর্তনও আনা যায় না। সুতরাং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এ যুগে আরো বেশি প্রয়োজন উন্নত চরিত্রের, হৃদয় ও আত্মার সুতীব্র দহনের এবং এমন তাপ ও উত্তাপের যা ভিতরে ভিতরে জন্ম দেয় প্রবল এক আগ্নেয়গিরির, যার লাভা উদ্গীরণ সমাজের বিদ্যমান সব জঞ্জাল মুহূর্তে ভস্মীভূত করে এবং লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয় একইভাবে উত্তপ্ত করে। আজ দরকার সেই রকম কিছু মানুষের, কিছু জীবন্ত হৃদয়ের এবং কিছু অশ্রুসিক্ত চোখের। আর সেজন্য সময় ও সমাজ তাকিয়ে আছে আপনাদের পানে ব্যাকুল দৃষ্টিতে। কারণ মখমলের গালিচার অভাব নেই, অভাব খেজুর পাতার ছিন্ন চাটাইয়ের।