জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অস্তমিত সূর্যের ঝিলিক: আল্লামা মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী বারাকাতী (রহ.)

অস্তমিত সূর্যের ঝিলিক: আল্লামা মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী বারাকাতী (রহ.)

অস্তমিত সূর্যের ঝিলিক: আল্লামা মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী বারাকাতী (রহ.)

ড. মোহাম্মদ খলিলুর রহমান

১. প্রারম্ভিকা

আমাদের প্রাণপ্রিয় ধর্ম আল-ইসলাম একটি বিশ্বজনীন জীবন-দর্শন। অবস্থা, পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে উদ্ভুত যাবতীয় সমস্যার সুন্দর ও নিখুঁত সমাধান রয়েছে ইসলামে। জীবন প্রবাহের স্রোতধারায় ইসলামের অনুশাসনমালা এক কালজয়ী আদর্শরূপে স্বীকৃত। অভ্যুদয়ের যুগ থেকে অদ্যাবধি বহু মনীষী ও আল্লাহঅলার প্রচার ও সংরক্ষণে দিয়েছেন সীমাহীন কুরবানী। আমরা তাঁদের জীবনের কতটুকুইবা জানি?আমরা সমাজের মূল স্রোতধারা সংস্কারক শক্তির কথা বেমালুম ভুলে যাই। যে সব মানব হিতৈষীবর্গ তাঁদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও অভিজ্ঞতালদ্ব জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজের হিতসাধন করে গেছেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে দানকরেছেন এক সুষ্ঠু অবকাঠামো, মানবতার উত্তরণ ঘটিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সম্প্রীতির ডোরে আবদ্ধ করেছেন মানব সমাজকে তাঁরা রয়েছেন ইতিহাসের পাতায় অনুল্লেখ্য। পক্ষান্তরে ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো ভরে আছে রাজ-রাজড়াদের কাহিনীতে। আজ মানুষ সচেতন হয়েছে অনেকটা। রাজ-দণ্ডমুণ্ডের অধিকারীরা আজ দিশেহারা। জ্ঞানরাজ্যে বিচরণকারীদের সংস্পর্শে এসে সে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে চায়। যুগধর্ম ও পরিবেশের এই জরুরি মুহূর্তে সংস্কারক ব্যক্তিত্বসমূহকে স্থায়ী আসনে সমাসীন করার জন্য যে সব মনীষী ও চিন্তাবিদ তাঁদের ক্ষুরধার লেখনী নিয়ে কলমী জিহাদের বিস্তীর্ণ ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক, লেখক, শিক্ষাবিদ ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রোজ্জল নক্ষত্র আল্লামা মুফতী সাইয়েদ আমীমুল ইহসান আলমুজাদ্দেদী, বারাকাতী (রহ.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

২. বংশপরিচয়

মুফতী সাহেবের পিতার নাম সাইয়েদ আবদুল মান্নান, মাতার নাম সাইয়েদা সাজেদা। পিতামাতা উভয় সূত্রেই তিনি মহানবী (সা.)-এর অধঃস্তন পুরুষ। তিনি তাঁর রচিত বিবিধ গ্রন্থে নিজ বংশপরিচয় লিপিবদ্ধ করে যান।[1]

মূলত বংশলতিকা সংরক্ষণ সাইয়েদগণের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। মুফতী সাহেব পূর্বপুরুষগণের নিয়মানুযায়ী নিজের বংশলতিকা সংরক্ষণ করেন বলে মনে হয়। মুফতী সাহেব এ বংশলতিকায় নিজেকে মহানবী (সা.)-এর বংশধর বলে দাবী করেন। মহানবী (সা.)-এর সাথে তাঁর যোগসূত্র হলেন ইমাম যায়দ ইবনে যায়নুল আবেদীন (মৃ. ৭৩৯ খ্রি.)। তিনি হযরত হুসাইনের (রাযি.) পৌত্র ও রাসূলুল্লাহর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর অনুসারীগণ যায়দিয়া নামে অভিহিত। মুফতী সাহেব যায়দের বংশধর হলেও যায়দিয়া মতের অনুসারী ছিলেন না। তাঁর কর্ম ও চিন্তাধারা এ দাবির সত্যতা প্রমাণ করে। তিনি সত্যপন্থী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত হানাফী মাযহাব অনুসরণ করতেন। জীবনভর তিনি উক্ত মাযহাবসম্মত ধর্মীয় বিধানানুযায়ী ফাতওয়া চর্চা করেন।

মুফতী সাহেবের পূর্বপুরুষ আরব হতে ভারতে আগমন করেন। সুলতান তুঘলকের শাসনামলে (১২২৫-৫১ খ্রি.) তাঁরা জাজনীর (সিরিয়া ও হিজাজের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত) হতে দিল্লীতে হিজরত করেন।[2] ভারত প্রত্যাগত তাঁর পূর্বপুরুষের নাম সাইয়েদ আহমদ আল-জাজনীরী। তিনি একজন পুণ্যবান সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। সুলতান মুহাম্মদ তুঘলক ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁকে বিহার প্রদেশে প্রেরণ করেন। বিহারের রূহী নামক স্থানে তিনি বসতি স্থাপন করে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সুলতান তাঁর ন্যায়নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার কথা অবহিত হয়ে মুগ্ধ চিত্তে তাঁকে বিহারের মুঙ্গীর জিলার চৌদ্দটি বিশেষ সমৃদ্ধ গ্রাম জায়গীর হিসেবে দান করে পুর®কৃত করেন। বর্তমানে এ গ্রামগুলো বারাহগিঁয়া নামে পরিচিত। জায়গীর লাভের মত সম্মানের অধিকারী হয়ে সাইয়েদ আহমদ তাঁর প্রথম আবাসস্থল রূহী পরিত্যাগ করে নিজ জায়গীরভুক্ত নদীয়াওঁয়া গ্রামে পুনবসতি স্থাপন করেন। এ গ্রামে তাঁর জীবনের অবশিষ্ট সময় কাটে। তিনি এখানে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাহিত হন। প্রায় ১৪শ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগে। কালক্রমে বিয়েশাদী ও নানা প্রকার সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করে তাঁর উত্তরপুরুষগণ মুঙ্গীর জিলায় অধ্যুষিত হয়ে পড়েন। সাইয়েদ আহমদ আল-জাজনীরী পাঁচ পুত্রের জনক ছিলেন। তাঁরা সবাই পরবর্তী সময় একেকজন কামিল ইনসান ও সিদ্ধপুরুষ হিসেবে আভির্ভূত হন। সাইয়েদ আহমদের তৃতীয় পুত্রের নাম সাইয়েদ জামালউদ্দীন। তিনি বারাহ্গিঁয়ার অন্তর্ভুক্ত জাম্ওয়াড়া গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁর একজন অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন সাইয়িদ নূরুল হাফিয। তিনিও একজন উঁচুদরের সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। মুঙ্গীর জিলার রাঁকড় গ্রামে তিনি বসবাস করতেন। তিনি চার পুত্র ও এক কন্যার জনক ছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তানের নাম সাইয়েদ আবদুল মান্নান। তিনি একজন ইসলামী পণ্ডিত ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। তিনি চারপুত্র ও তিন কন্যার অধিকারী হন। তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের নাম সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহ্সান, তিনিই বক্ষমান প্রবন্ধের মূল চরিত্র।

৩. জন্মইতিহাস

১৩২৯ হিজরীর ২২ মুহাররম তথা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি সোমবার প্রত্যুষে সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহ্সান পাঁচনা গ্রামে তাঁর মাতামহের বাড়িতে ভূমিষ্ঠ হন। এ গ্রামে আবুল উলায়ী তরীকার প্রাণপুরুষ সাইয়েদ মুনইম-এ পাক (রহ.) (মৃ. ১৭৭৭ খ্রি.) এর বাড়ি অবস্থিত। সাইয়েদ আমীমুল ইহ্সানের সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। মুনইম-এ পাক যে কক্ষে ও যে আসনে ধরাধামে আসেন ঠিক একই কক্ষে ও একই স্থানে শিশু আমীমুল ইহ্সান ভূমিষ্ট হন বলে জানা যায়।[3]

৪. মহাত্মা পিতা

তাঁর পিতার নাম মাওলভী সাইয়েদ, আবদুল মান্নান। ১৮৮৪ খ্রি. মুঙ্গীর জেলার রাকড় গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন জগদ্বিখ্যাত ইসলামী গবেষক, পণ্ডিত ও সিদ্ধপুরুষ। ইসলামী শিক্ষার সাথে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি ইউনানানী হেকিম (আয়ূর্বেদিক) চিকিৎসায় সুগভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। জীবিকার সন্ধানে তিনি কলিকাতায় জালিয়াটুলীতে বসতিস্থাপন করেন। তিনি তথায় একটি ডিসপ্যানসারী ও মসজিদ স্থাপন করেন। মসজিদে দাঈ ইলাল্লাহর দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি ডিসপ্যানসারীতে খিদমাতুল খালকেরর অনন্য সেবায় রুগ্ণ-পীড়িত মানবতার সেবা করতেন। এভাবে দিনবদিন তিনি চিকিৎসা সেবায় পারদর্শীতা অর্জন করেন। জীবনের কোন এক সময়ে নকশাবন্দিয়া ত্বরীকার শায়খ আবু মুহাম্মদ বারাকাত আলী শাহ আল মুজাদ্দিদ্দীর হতে আধ্যাত্মিকতায় দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে তিনি প্রথিতযশা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শায়খ আবু মাহমুদ আশরাফ (রহ.)-এর হাতে চিশতীয়া তরীকার দীক্ষা অর্জন করেন।

৫. মহামতি মাতা

মাতার নাম সাইয়েদা সাজেদা। তিনি বারাগিয়ার সাইয়েদ আবদুল বারীর কন্যা। সাইয়েদ আহমদ জাজনীরী তাঁর ও পূর্বপুরুষ। তাঁর পিতা সাইয়েদ আবদুল বারী মুঙ্গীর জিলার পাঁচনা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী পুণ্যবান পুরুষ। নিজ কন্যা সাইয়েদা সাজেদাকে তিনি তাঁর মনের মত করে গড়ে তোলেন। তাই তিনি নিজ পিতার চরিত্রে বিভূষিতা ছিলেন। তিনি একজন সতী-সাধ্বী, উপসনাকারিনী, ধৈর্যশীলা এবং বিদূষী মহিলা হিসেবে গড়ে উঠেন। দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত (পাঠ) করতেন। সৎগুণাবলি ও উপাসনা-আরাধনায় তিনি এ উপমহাদেশের সমসাময়িক রমণীদের অন্যতমা ছিলেন। নম্রস্বভাবা ও মধুর ভাষিণী এই গুণবতী নারীর জুড়ি মেলা ছিল ভার। তাঁর সহনশীল মনোভাব ও স্নেহবাৎসল্য ছিল ঈর্ষণীয়। বড় বউ হিসেবে পারিবারিক সদস্যদের প্রতি তাঁর দায়িত্বানুভূতি ছিল প্রশংসনীয়। নিজের সন্তান-সন্ততিদের পাশাপাশি পরিবারের ছোটদেরকে তিনি মাতৃস্নেহে আচ্ছন্ন করে রাখতেন। প্রত্যেকটি শিশুই তাঁকে স্নেহময়ী ও অতি কাছের জন বলে জ্ঞান করত।

পরিণত বয়সেই তাঁর সাথে সাইয়িদ আবদুল মান্নানের পরিণয় হয়। দাম্পত্য জীবনের সূচনা হতেই তিনি স্বামী সংসারের প্রতি একাগ্রতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং সহনশীলতা প্রভৃতি গুণের পরিচয় দেন। সন্তান-সন্ততিদের পড়ালেখার প্রতি তিনি খুবই যত্নশীল ছিলেন। সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ও ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। এ শিক্ষানুরাগী রমণীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার ফলে তাঁর সন্তানগণ জীবনে সফলতা লাভে সক্ষম হন।

৬. পিতামহ

মুফতী আমীমুল ইহ্সানের পিতামহের নাম মাওলানা সাইয়েদ নূরুল হাফিয আল-কাদিরী। তিনি ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুঙ্গীর জিলার সালিমাবাদ পরগণার তারকুঞ্জী পল্লীতে পিতৃগহে ভূমিষ্ট হন। কুরআনের ওপর বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি মুজাদ্দিদিয়া ও কাদিরিয়া ত্বরিকায় দীক্ষিত হন। মাওলানা মুহাম্মদ আলী আল-মুঙ্গীরী আল-কানপুরীর (মৃ. ১৯৪০) ন্যায় প্রখ্যাত সাধক, শিক্ষা-সংস্কারক ও সংগ্রামী পুরুষের নিকট হতে খিলাফত প্রাপ্ত হন।[4]

তাঁর পূর্বপুরুষের গ্রাম চান্দিয়ারী অদূরবর্তী রাঁকড় পল্লীতে নিজস্ব আবাস স্থানান্তর করেন। এ গ্রামেই তিনি ১৩২৭ সালের যুলকাদা মাসের ১৯ তারিখে ইহধাম ত্যাগ করেন ও সমাহিত হন। তিনি একজন ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ ও পূণ্যবান ব্যক্তি ছিলেন। ফার্সী ভাষায় তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য।

৭. বাল্যকাল ও

বর্ণাঢ্যময় শিক্ষাজীবন

সাইয়েদ আমীমুল ইহ্সান শৈশবের কিছু সময় নিজ মাতামহের বাড়িতে মায়ের সাথে অতিবাহিত করেন। পঞ্চম বর্ষে উপনীত হওয়ার পর তিনি তাঁর পিতা-মাতার সাথে কলকাতা শহরে নীত হন এবং তথায় নিজ পিতৃপরিবারে প্রতিপালিত হতে থাকেন। শৈশব হতেই তাঁর আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রে ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। ধ্যান-ধারণা ও চাল-চলনে তিনি অন্যান্য সাধারণ শিশু অপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন। খেলা-ধূলায় লিপ্ত হয়ে অযথা সময় নষ্ট করা তাঁর পছন্দ হত না। তাঁর জন্মগত পরিবেশ ও পরিমণ্ডলের মনস্তাত্বিক প্রভাব তাঁর ব্যক্তিত্বের ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করতে থাকে। এ ধারা অবলম্বন করেই তাঁর বাল্য, কৈশোর শিক্ষাজীবন ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে।

ক. প্রাথমিক শিক্ষা

আমীমুল ইহ্সান সুপণ্ডিত বাবা ও চাচার নিকট প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। তার চাচা সাইয়েদ আবদুদ দাইয়ানের যত্নের অধীনে থেকে তিনি মাত্র তিন মাস সময়ের ব্যবধানে পূর্ণ ত্রিশ পারা কুর’আন শুরু হতে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াতের যোগ্যতা অর্জন করেন।[5]

এসময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর। এতদ্ব্যতীত তিনি তাঁর নিকট উর্দু ও ফার্সি ভাষায় প্রাথমিক পাঠও গ্রহণ করেন। আট বছর বয়সে তাঁর জীবনে এক শোকাবহ ঘটনা সংঘটিত হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সাইয়েদ আযীমুশ শান ১৯১৯ খ্রি. দুরারোগ্য এক ব্যধিতে মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তাঁর মেধা ছিল অসাধারণ। এ মৃত্যু তাঁর পরিবারে শোকের কালোছায়া নামিয়ে আনে। পুত্রশোকে কাতর পিতা এত ভেঙ্গে পড়েন যে, তিনি শিশু আমীমুল ইহ্সানের শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি উদাসীন হয়ে যান। এতে তাঁর পড়া লেখায় মারাত্মক বাধার সৃষ্টি হয়। শৈশব হতে পড়া-লেখার প্রতি তাঁর এতো ঝোঁক দেখা যায় যে, তিনি পথ হতে কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতেন এবং যত্নের সঙ্গে তা পড়ার চেষ্টা করতেন। পড়া-লেখার প্রতি তাঁর এ অদম্য আগ্রহ দেখে তাঁর মা খুবই মুগ্ধ হন। তাই তিনি তাঁর লেখা-পড়া বহাল রাখার জন্য নিজ স্বামীকে তাগাদা দিতে থাকেন। তাঁর উৎসাহে পিতা পুনরায় আমীমুল ইহ্সানের ভবিষ্যৎ শিক্ষাদানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে নিজ আধ্যাত্মিক মুরশিদ সাইয়েদ বারাকাত আলী শাহ (রহ.) (মৃ. ১৯২৬ খ্রি.)-এর দরবারে নিয়ে যান। শাহ্ সাহেব নিজ ভক্ত মুরীদের সাথে আসা শিশু আমীমুল ইহ্সানকে দেখে মুগ্ধ হন। নিজ দিব্যচোখে তিনি এ শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পান। তাই তিনি তাঁকে নিজ তত্ত্বাবধানে রেখে তারবিয়াত শিক্ষা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ আগ্রহের প্রতি শিশুর পিতা আনন্দচিত্তে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং তাঁকে শাহ সাহেবের দরবারে রেখে আসেন। তখন হতে শাহ সাহেবের দরবারে আমীমুল ইহ্সানের শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াত দানের কাজ চলতে থাকে। মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে তিনি আরবী ব্যাকরণের প্রাথমিক জ্ঞান রপ্ত করেন এবং পাশাপাশিভাবে উচ্চতর ফার্সি সাহিত্য ও তাজ্বীদের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন।

খ. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা

আমীমুল ইহ্সানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে। এ সময়ের পূর্বে তিনি সে সময়কার কিছু বিখ্যাত আলিম ও ইসলামী পণ্ডিত ব্যক্তি এবং নিকট আত্মীয়ের নিকট বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসার হেড মওলবী মাওলানা মাজেদ আলী জৌনপুরী (রহ.)-এর নিকট আরবী ব্যাকরণ, ফিকহ[6] ও যুক্তি বিদ্যার প্রাথমিক পাঠ[7] আবদুল মজিদ আল-মুরাদাবাদীর নিকট কিছু আরবী কিতাব[8] আবদুর রহমান আল-কাবুলীর নিকট যুক্তি বিদ্যা ও উসূল বিষয়ক গ্রন্থাবলি এবং আল্লামা কারামাত আলী শাহ পাঞ্জাবী (রহ.)-এর নিকট ফিকহ ও মানতিকের প্রাথমিক জ্ঞান হাসিল করেন। নিজ চাচার নিকট সুন্দর হস্তলিপি বিদ্যা অনুশীলন এবং সে সময়কার প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফার যথাক্রমে আবদুর রহমান খাঁ ও সাইয়েদ ফযলুর রহমানের যতেœ সুন্দর হস্তলিপি এবং পাথরের গায়ে লিখন শৈলী রপ্ত করেন। স্বনামধন্য কারী আবদুস সামী (মৃ. ১৯২৯ খ্রি.)’র নিকট ইল্ম-এ কিরআতে, নিজ পিতার যত্নে ইউনানী চিকৎসা শাস্ত্রে এবং নিকটাত্মীয় আবদুল করীমের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি ভাষায় প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন।[9]

গ. মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা

১৯২৬ সালে পনর বছর বয়সে সাইয়েদ আমীমুল ইহ্সান কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় আলিম (Lower Standard) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে তিনি বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত ও পূণ্যবান ব্যক্তিগণের নিকট দারস-এ-নিযামীর অনুমোদিত বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করেন। মাদরাসার আভ্যন্তরীণ প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথমস্থান এবং মাদরাসা বোর্ডের অধীনে গৃহীত কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে কৃতকার্য হন। তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আলিম (Lower Standard) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে তৃতীয়, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ফাযিল এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কামিল (হাদীস) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন।[10]

ঘ. অনানুষ্ঠানিক উচ্চতর শিক্ষা

কলকাতা মাদরাসা হতে শিক্ষা শেষ করে মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহ্সান তৎকালীন কতিপয় বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তির নিকট জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করেন। তিনি শামসুল উলামা ইয়াহইয়া সাহ্সারামী ও মুশতাক আহ্মদ আল-কানপুরীর নিকট জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তিগত জ্ঞানার্জন করেন। এতদ্ব্যতীত মুশতাক আহ্মদ আল-কানপুরীর নিকট ইলমুল মাওয়াকিত ও ইলমুল কিয়াফার উচ্চতর জ্ঞান এবং ফাতওয়া প্রদান কৌশল অনুশীলন করেন। তাঁর নিকট হতে তিনি ফাতওয়া প্রদানের ইজাযা (সনদ) লাভ করেন।[11]

ঙ. বিভিন্ন বিষয়ে সনদ লাভ

মুফতী সাহেব দেশ-বিদেশের বহু পণ্ডিত সুফিসাধক ও মুহাদ্দিসের নিকট হতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ সনদ অর্জন করেন। তিনি দামিশ্কের প্রখ্যাত মনীষী ইমাম মুহাম্মদ আল-জাযরীর মাসন দুআ বর্ণিত হাদীসের সংকলন হিসনু হাসীন’ (حصن حسين)-এর আমল করার সনদ লাভ করেন। এ সনদ খোদ সংকলকের নিকট হতে ব্যক্তি পরম্পরায় তিনি তাঁর শ্বশুর বারাকাত আলী শাহের মাধ্যমে লাভ করেন। শায়খ ওমর হামদুন ও হিজাযের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ আল-ইয়ামানী তাঁকে হাদীস পাঠদানের সনদ প্রদান করেন।[12] এতদ্ব্যতীত তাঁর আধ্যাত্মিক মুরশিদগণ তাঁকে খিলাফত দান করে অন্যকে আধ্যাত্মিক দীক্ষাদানের লিখিত অনুমতি দান করেন। এভাবে মুফতী সাহেব ইসলামী আধুনিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের সর্বপ্রকারের উপায় ও উপকরণ সদ্ব্যবহার করে নিজ জীবনকে কাজে লাগান। তাঁর জ্ঞান-অনুশীলন শিক্ষানুরাগ এক অনুপম আদর্শ।

৮. শিক্ষকমণ্ডলী

মুফতী সাহেব অভিজ্ঞ, দায়িত্ববান, কর্তব্যপরায়ণ ও স্বনামধ্য ইসলামী বিশেষজ্ঞ ওস্তাদগণের শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হন। তাঁর ওস্তাদগণ সবাই চারিত্রিক দৃঢ়তা, স্নেহবাৎসল্য ও নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন। মুফতী সাহেব আজীবন তাঁর ওস্তাগণের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। নিম্নে তাঁদের নামের বর্ণনাক্রমিকভাবে তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট ওস্তাদের পরিচিতি দেওয়া হল:[13]

১. আবুল হুফ্ফায মুহাম্মদ ফাসীহ (রহ.), মুরশিদাবাদ, ভারত।

২. মাওলানা আবদুস সাত্তার (রহ.), পাটনা, বিহার প্রদেশ, ভারত।

৩. মাওলানা সাইয়েদ ইসমাঈল বিহারী (রহ.), বিহার, ভারত।

৪. মুহাম্মদ ইসমাঈল সাম্ভুলী মুরাদাবাদী (রহ.), পাটনার মুরাদাবাদ, ভারত।

৫. ইয়াহইয়া সাহ্সারামী (রহ.), সাহসারাম, শাহবাদ, ভারত।

৬. মাওলানা সুফি ওসমান গনী (রহ.), চাঁদপুর, বাংলাদেশ।

৭. মাওলানা ওয়াসী উদ্দীন (রহ.), মুজাফফরপুর, ভারত।

৮. মাওলানা জামাল আনসারী (রহ.), বিহার, ভারত।

৯. মাওলানা মুহাম্মদ নাযিরুদ্দীন (রহ.), উড়িষ্যা, ভারত।

১০. মাওলানা আবুল আলী নুরুল্লাহ সন্ধীপী (রহ.), সন্ধীপ, বাংলাদেশ।

১১. বিলায়েত হুসাইন বীরভূমি (রহ.), বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

১২. মাওলানা মমতাজুদ্দীন আহমদ (রহ.), কেরানীগঞ্জ, নোয়াখালী, বাংলাদেশ।

১৩. শামসুল ওলামা মাওলানা মাজিদ আলী জৌনপুরী, (রহ.) জৌনপুর, ভারত।

১৪. শামসুল উলামা মাওলানা মুহাম্মদ মাযহার (রহ.), হুগলী, ভারত।

১৫. মুশতাক আহমদ কানপুরী (রহ.), কানপুর, ভারত।

৯. অনন্য কর্মজীবন

মুফতী সাহেবের ঘটনাবহুল কর্মজীবন কলকাতা ও ঢাকার ভিত্তিতে আবর্তিত:

৯.১. কলকাতাভিত্তিক

(১৯২৭-৪৭ খ্রি.):

১৯২৭ সালে মুফতী সাহেব পিতৃহীন হয়ে পড়েন। পিতার জীবিত সন্তানগণের মাঝে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর পিতা মৃত্যুর দু’মাস আগে তাঁকে নিজ জুব্বা পরিয়ে দেন এবং পূর্বপুরুষ পরস্পরায় প্রাপ্ত সব কল্যাণ ও বরকতময় বস্তু প্রদান করেন। এভাবে তিনি তাঁকে নিজ স্থলাভিষিক্ত করে যান।[14]

পিতা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর পর মুফতী সাহেবের কর্মধারা হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাঁকে পিতৃপরিত্যক্ত সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। মাত্র বছরখানেক আগে তিনি মাদরাসায় ভর্তি হন। নিয়মিত পড়ালেখা অব্যাহত রেখে বিধবা মায়ের সেবা-যত্ন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ভাই-বোনদের প্রতিপালন, পিতার ডিসপেনসারী সচল রাখা, মসজিদের তত্ত্বাবধান, ইমামতি, মক্তব পরিচালনা এবং পারিবারিক ছাপাখানা দেখাশোনা ইত্যাদি দায়িত্ব ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পালন করতে থাকেন। ১৯৩৩ খ্রি. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর উপরোক্ত দায়িত্ব সম্পাদনের পাশাপাশি নিজ বাসভবনে হাদীস, ফিকহ ও বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানে মনোনিবেশ করেন।[15] কালক্রমে তাঁর মেধা ও গভীর পাণ্ডিত্বের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ, পাক-ভারতের বিভিন্ন স্থানে আলিম ও জনসাধারণ ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাঁর পরামর্শ ও উপদেশ লাভের প্রতি আকৃষ্ট হন।

৯.২. নাখোদা মসজিদ-মাদরাসা ও দারুল ইফতা (১৯৩৪-৪৩ খ্রি.):

১৯২৬ সালের দাঙ্গার সময় কলকাতার চিৎপুরে অবস্থিত নাখোদা মসজিদ আবদুর রহিম ওসমান নামক জনৈক ধর্মপ্রাণ গুজরাটী কচ্চী (কচ্চ অঞ্চলের অধিবাসী) এ মসজিদটি তৈরি করেন।[16] মসজিদের সাথে একটি বেসরকারি মাদরাসা রয়েছে। মাদরাসার দারুল ইফতা (ফাতওয়া বিভাগ) খুবই সমৃদ্ধ। কালক্রমে এ মসজিদ ও এর দারুণ ইফতা সারা বাংলার ধর্মীয় যোগাযোগ কেন্দ্রে রূপান্তরিত ও স্বীকৃত হয়। প্রতিষ্ঠান অবিভক্ত বাংলার ইসলামী সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি রূপেও গড়ে ওঠে। ১৯৩৪ খ্রি. সালে মুফতি সাহেব উক্ত মসজিদের সহকারী ইমাম ও মাদরাসার প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৩৫ খ্রি. তাঁকে মাদরাসার দারুল ইফতার প্রধান মুফতীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তখন হতে তিনি জ্ঞান প্রসারের পাশাপাশি ব্যাপক ফাতওয়া দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মাদরাসায় তিনি হাদীস, ফিকহ ও সাহিত্যের পাঠদান করতেন। নাখোদা দারুল ইফতার প্রধান মুফতী হিসেবে মুফতী সাহেবের নাম ও যশ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা সমাধানকল্পে অসংখ্য ফাতওয়া প্রদান করেন। কারো মতে, এ সংখ্যা লক্ষ্যাধিক[17] এ প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে প্রদত্ত ফাতওয়া হতে তিনি ১২০০০ পৃষ্ঠা সংবলিত একটি বৃহৎ পাণ্ডুলিপি রেখে যান। এ পাণ্ডুলিপিতে প্রায় ৪০,০০০ ফাতওয়া রয়েছে। নাখোদা মসজিদ, মাদরাসা ও দারুল ইফতায় কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর প্রখ্যাত হাদীস সংকলন ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার সম্পাদনা করেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন ধর্ম হতে ইসলামে দীক্ষিত নওমুসলিমগণের পার্থিব ও ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্বসহ ইসলাম প্রচারের কাজে জড়িত থাকেন। তাঁর প্রচেষ্টায় চার সহস্রাধিক ধাঙ্গর নর-নারী ইসলামে দীক্ষিত হন।

১৯৩৭ খ্রি. ব্রিটিশ সরকার মুফতি সাহেবকে মধ্য কলকাতায় কাযী পদে নিয়োগ করেন। ১৯৩৮ খ্রি. বঙ্গীয় সরকারের উপদেষ্টা মনোনীত হন। ১৯৪০ সালে আ-মান-ই-কুররা-বাংগাল (নিখিলবঙ্গ কারী সমিতি)-এর সভাপতি নিযুক্ত হন। সরকার সময় সময় তাঁকে বিচার বিভাগীয় জুরীতে যোগদানের জন্য আহ্বান করতেন। এভাবে প্রায় এক যুগ ধরে সরকারি ও বেসরকারী পর্যায়ে ইসলামী ও জনহিতকর কার্যে আত্মনিয়োগ করে বাংলাদেশ-পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের সমূহ কল্যাণ সাধন করেন।

৯.৩. আলিয়া মাদরাসা (১৯৪৩-৪৭):

কলকাতা আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ খান বাহাদুর আলহাজ্ব যিয়াউল হকের (মৃ. ১৯৫৮) অনুরোধে সাড়া দিয়ে মুফতী সাহেব ১৯৪৩ খ্রি. উর্দু প্রভাষক পদে মাদরাসায় যোগদান করেন।[18]

এ পদে থেকেও অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্য এবং যোগ্যতা বলে তিনি কামিল শ্রেণিতে তাফসীরে বায়যাবী ও বুখারী শরীফ প্রথম খণ্ডের দারস এবং ফিকহ বিভাগে পাঠদানের অনুমতি লাভ করেন। ১৯৭৪ খ্রি. পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে যান। এ সময় তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর তৎকালীন রচনাবলি খুব সমাদর লাভ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর আলিয়া মাদরাসার এ্যাংলো আরবি বিভাগ ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। তখন তিনি কর্মরত অবস্থায় অপরাপর সহকর্মীর সাথে ঢাকায় চলে আসেন এবং স্থায়ী নিবাস স্থাপন করেন।

৯.৪. ঢাকাভিত্তিক (১৯৪৭-৭৪ খ্রি.):

মাদরাসা আলিয়া ঢাকায় মুফতী সাহেব একই পদে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বহাল থাকেন। অতঃপর মাওলানা জাফর আহমাদ ওসমানী হেড মওলবী পদ হতে অবসর গ্রহণ করার পর (১৯৫৫ খ্রি.) অস্থায়ীভাবে তিনি উক্ত পদে মনোনয়ন লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের ১লা জুলাই তাঁর পদ স্থায়ী হয়। তখন হতে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষাবিষয়ক দফতর পরিচালনার দায়িত্বও লাভ করেন। এসব দায়িত্ব তিনি কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। এ সময় তিনি তাঁর অবশিষ্ট রচনাকর্মের অধিকাংশই সমাপ্ত করেন। তাঁর কর্তব্য ও নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ নিয়মিত চাকরির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সরকার তাঁকে আরও অতিরিক্ত তিন বছর উক্ত পদে বহাল রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি এতে সম্মত হননি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ প্রণয়ন এবং ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে প্রচুর সময় দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি ১৯৬৯ সালের ১২ অক্টোবর সরকারি চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন।

৯.৫. বায়তুল মুকাররম ও জাতীয় ঈদগাহ (১৯৬৪-৭৪ খ্রি.):

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পুরানা পল্টন ময়দানে (বর্তমানে আউটার স্টেডিয়াম) অবস্থিত পূর্বপাকিস্তানের জাতীয় ঈদগাহের ইমামতির ভার মুফতী সাহেবের ওপর ন্যস্ত হন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম মসজিদ কমিটি সর্বসম্মতভাবে তাঁকে খতীব মনোনীত করেন। কালক্রমে এ মসজিদ পূর্বপাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ধর্মীয় মিলনকেন্দ্রে রূপলাভ করে। একে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার এবং বিভিন্নমুখী ইসলামী জ্ঞান-গবেষণায় সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যেই এ প্রতিষ্ঠান কায়েম করা হয়। কালক্রমে এ সংস্থা ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান বিতরণ ও গ্রন্থ প্রকাশের কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে। মুফতী সাহেব প্রতি জুমাবার ও ঈদের দিন বায়তুল মুকাররমে প্রাঞ্জল আরবি ভাষায় অতীব মান ও গুণগতসম্পন্ন হৃদয়-স্পর্শী খুতবা দিতেন। সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে তাঁর ভাষণগুলো রচিত হত। আত্মগঠন, চরিত্র শিক্ষা, সৎকর্মে উৎসাহ ও অসৎকাজ হতে বিরত রাখার আবেদনমূলক আয়াতে কারীমা ও হাদীসের বাণী দিয়ে এসব ভাষণ সাজানো ছিল। এ ভাষণগুলো শুনে সবাই মুগ্ধ হতেন। ব্যক্তিগত ডাক্তারের পরামর্শ এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ২২ অক্টোবর চার মাসের ছুটি নিয়ে বায়তুল মুকাররম ছেড়ে আসেন।[19] ছুটির নেয়ার ৫ দিন পর তিনি ইন্তিকাল করেন। তাই তাঁকে আর বায়তুল মুকাররমে ফিরে যেতে হয়নি।

৯.৬. মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা

মুফতী সাহেব ১৯৫৩ খিস্টাব্দে ঢাকার সূত্রাপুর থানার অন্তর্গত কলুটোলা মহল্লায় একটি বড় বাড়ি ক্রয় করেন। এ বাড়ির বিপরীত দিকে রাস্তার পাশে একটি মসজিদ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। এ মসজিদ ঘর নির্মিত হয় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মসজিদ এলাকায় হিন্দুদের প্রধান্য ছিল। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হিন্দু-মুসলিম সহিংস দাঙ্গার সময় হিন্দু সন্ত্রাসীরা মসজিদটির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে, এমনকি এটাকে তারা আস্তাকুঁড়ে পরিণত করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সে মহল্লার হিন্দু অধিবাসীগণ ব্যাপক আকারে ভারতে পাড়ি জমায়। ঢাকায় আসার পর মুফতী সাহেব ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এ জঞ্জালপূর্ণ মসজিদ ঘরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেন। সার্বিক সংস্কারকর্ম শেষ হওয়ার পর হতে সে মসজিদে রীতিমত জুমআ ও জামাআত জারি করা হয়। বর্তমানে মসজিদটি নকশেবন্দী মসজিদ নামে কালের কপোলতলে দাঁড়িয়ে আছে। মুফতি সাহেব এ নামকরণ করেন এবং এর মুতাওয়াল্লীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ও তাঁর নিকটাত্মীয় মাওলানা আবদুস সালাম আহমদ (নারিন্দার পীর মৃ. ১৯৬৭) নিয়মিত এ মসজিদের ইসলাম প্রচার ও প্রসারের তৎপরতা চালিয়ে যান। নকশেবন্দী মসজিদে প্রবেশ ফটকের বাঁ পাশে মিনারার নীচে একখানা কক্ষ নির্মাণ করা হয়। মাদরাসা আলিয়া হতে অবসর গ্রহণ করার পর শেষ জীবনে মুফতী সাহেব এ কক্ষটিতে ইসলামী বিষয় পাঠদান করতেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি মসজিদ ও মাদরাসার দায়িত্ব তাঁর কন্যার (সে সময় জীবিত একমাত্র সন্তান) ওপর ন্যস্ত করে যান। তাঁর সংস্কার করা মসজিদ ঘরখানা মুঘল ও আধুনিক স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।[20]

৯.৭. হজ্জ পালন

মুফতী সাহেব ১৯৫৪, ৬৮ ও ৭১ খ্রিস্টাব্দে তিন বার হজ্জ পালন করেন। তার মধ্যে প্রথম বার নারিন্দার পীর শাহ আবদুস সালাম আহমদের সাথে, দ্বিতীয়বার সস্ত্রীক এবং তৃতীয়বার একাকী। তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থবার হজ্জ গমনের জন্য বিমানের টিকেট সংগ্রহ করলেও মহান রাফীকে আলার সান্নিধ্যে পাড়ি জমান বিধায় হজ্পালন সম্ভব হয়নি। হজ পালন করার সময় তিনি মক্কা ও মদীনায় অবস্থিত ইসলামের স্মৃতিমাখা এবং মহানবী (সা.)-এর পবিত্র পদচিহ্নে ধন্য ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিদর্শন করেন তন্মধ্যে মহানবী (সা.)-এর জন্মস্থান, প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর মসজিদ, বিলালের মসজিদ, ফাতিমার জন্মস্থান, খাদিজার মাযার, হেরাগুহা, আরাফার ময়দান, মিনা ও মুযদালিফার ঐতিহাসিক ও এবং দর্শনীয় স্থানসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মদীনায় অবস্থিত স্থানসমূহের মাঝে তথাকার বিশেষ বিশেষ পাহাড়, কূপ, মসজিদ-এ নাবুবীর মাকসুরা ও মিহরাবের মধ্যবর্তী রিয়াযুলজান্নাত নামক স্থানে বিশেষ নামায আদায় এবং শ্রেষ্ঠ সাহাবী, আহল-এ বায়ত ও মহানবীর আত্মীয়-পরিজনের সমাধিস্থল বা জান্নাতুল বাকি যিয়ারত করেন। এছাড়া তিনি ইসলামের উক্ত দুটি পূণ্যময় স্থানে হাদীসের পাঠ দানও করেন। তাঁর পাঠে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীর ভিড় লেগে যেত। সে সময় তিনি মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আলিম, চিন্তাবিদ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুফতী, বাগ্মী, গ্রন্থকার এবং পুণ্যবান সুফিসাধকের সাক্ষাত লাভ করে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সুযোগ লাভ করেন। এর মধ্যে সিরিয়ার শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস ও মুফতী আল্লামা শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আল-গোদ্দা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁর সান্নিধ্যে এক সপ্তাহ অবস্থান করেন।[21]                            [চলবে]

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও উপাধ্যক্ষ, ফয়জুলবারী ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম

[1] ড. এএফএম আমীনুল হক কৃত মুফতী সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান: জীবন ও অবদান (ঢাকা: ইফাবা, প্রথম সংস্করণ, জুন ২০০২), পৃ. ১৮

[2] সাইয়েদ সালমান আল বারকাতী, মুখতাসার তারীখ-ই-সাইয়েদ আহমদ জাজনীরী ওয়া সাদাত-ই-বারাওগিঁয়া (কলকাতা: মাকতাবা-ই-নাকার ও ইশাআত, তা. বি.), পৃ. ৫৮

[3] ড. এএফএম আমীমুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১

[4] আবুল কাসেম ভূঁইয়া, একটি পূণ্যময় জীবন, (ঢাকা: তাওহীদ প্রকাশনী, প্রথম সংস্করণ ১৯৮৮ খ্রি.) পৃ. ২০৩

[5] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫

[6] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬

[7] মুফতী আমীমুল ইহসান, মিন্নাতুল বারী, (কলকাতা: হাজী সাঈদ, ১৯৪৪ খ্রি./১৩৮৪ হি.), পৃ. ১৪-১৫

[8] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬

[9] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত পৃ. ৬

[10] The Calcutta Gazette, June, 13,1929, PIB. P. 496, 26.06.1931, P. 543 and 22.06.1933, P. 939

[11] ক. মুফতী আমীমুল ইহসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫; খ. আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯

[12] মুফতী আমীমুল ইহসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬

[13] এএফএম আমীনুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১-৭৪

[14] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯

[15] মুফতী আমীনুল ইহসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫

[16] বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (কলকাতা : বাক সাহিত্য, তা. বি) পৃ. ৬৮১

[17] বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (কলকাতা : বাক সাহিত্য, তা. বি) পৃ. ৬৮১

[18] (রহ.)-এর ব্যক্তিগত ফাইল থেকে সংগৃহীত

[19] তাঁর যোগদান তারিখ, ২.৭.১৯৪৩ Letter to the princepal of Calcutta Madrasah, Diary No 718, File No 4A/5 Dated 03.7.1943

[20] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২১

[21] আবুল কাশেম ভূঁঞা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২১

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ