জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অমুসলিম হৃদয়ে সালাতের ছোঁয়া

অমুসলিম হৃদয়ে সালাতের ছোঁয়া

অমুসলিম হৃদয়ে সালাতের ছোঁয়া

মাহমুদুল হাসান


একাডেমিক একটি বইয়ের শিরোনাম ও লেখকের নাম দেখে হঠাৎ আমার মধ্যে একটি কৌতুহল জেগে উঠলো। আমি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে বইটি অনলাইনে অর্ডার করলাম। A fresh look at Islam in a Multi-faith world: A philosophy for success through education ২৭৮ পৃষ্ঠার বইটি আমার হাতে আসার সাথে সাথে আমি পড়তে শুরু করলাম। নতুন টাটকা বই পড়ার আনন্দই অদ্ভুত। অনলাইনপ্রজন্ম হয়তো কাগজে মুদ্রিত বইপড়ার মজা অনুভব করতে পারবে না। তরতাজা প্রিন্টিংয়ের ঘ্রাণ তাদের হয়তো আর আকর্ষণ করবে না। বইটির বাংলা অনুবাদ হল: ‚বহু ধর্মমতের এ বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে নতুন ভাবনা: শিক্ষার মাধ্যমে সাফল্যের দর্শন।” লেখকের নাম: Matthew L. N. Wilkinson

আমার কৌতুহলোদ্দীপনার কারণ হল এ ইংরেজ লেখক ইসলাম সম্পর্কে কি নতুন ভাবনা পেশ করতে চান তা জানা। তা ছাড়া ইংরেজ অমুসলিম (!) হয়েও তিনি কেন ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করছেন তা উদ্ঘাটন করা! আমার মতো পাঠকদের মনে এমন জিজ্ঞাসা জাগতে পারে লেখক তা অনুধাবন করে পূর্বেই তার জবাব লিখেছেন বইয়ের ভূমিকায়। The author’s story (লেখকের গল্প) অংশে তিনি বলেন, ‚আপনি হয়তো বিস্মিত হয়ে বলবেন, একজন শেতাঙ্গ ব্রিটিশ লেখক যার নাম মিথিউ উইলকিন্সন তিনি আবার ইসলাম সম্পর্কে কি বলতে চান! এ বিষয়ে তার বাস্তব কিবা অভিজ্ঞতা আছে? একটি ইঙ্গ-খ্রিস্টান উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। বিখ্যাত এলিট প্রতিষ্ঠান ইটন কলেজে আমি অধ্যয়ন করেছি, সেখানে আমার —হেড-বয়’ হওয়ার গৌরব ও ছিল। পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপসহ অধ্যয়ন করার সুযোগ হয়। সেখানে ১৯৯১ সনে আমি ডিগ্রি সমাপ্ত করি।“

তারপর তিনি বলেন, Having been impressed by the spiritual depth and seriousness of the Muslim prayer, I converted to Islam. (p. 7)

“মুসলমানদের সালাতে যে আধ্যাত্মিক গভীরতা ও গাম্ভীর্য আছে তা দেখে আমি অসম্ভব অভিভূত হই এবং ইসলাম গ্রহণ করি।”

উইলকিন্সনের এই বক্তব্য পড়ে আমি খুবই শিহরিত হই। আমি স্তব্ধ হয়ে ভাবি মহান রব সালাতের মতো কত মূল্যবান শান্তির পাথেয় আমাদের দিয়েছেন। জগতের সকল ঝঞ্ঝা হতে আমরা সহজে সালাতের মাধ্যমে পরিত্রাণ পেতেপারি। আধ্যাত্মচর্চার এ মহাদামি উপায়ের কথা তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা এ উপহার হতে বঞ্চিত। বহু অমুসলিম সালাতের অনুপম বহুমাত্রিক প্রশান্তি ও সুশৃঙ্খল-পদ্ধতি দেখে যুগে-যুগে ইসলামের সম্মোহন পেয়েছেন। তেমনি একজন হলেন ফ্রেঞ্চরাপ শিল্পী ডিয়াম। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে এবং একটি ডকুমেন্টারির সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ‚তাঁর জীবনের বিশাল পরিবর্তনের কথা। সঙ্গীতশিল্পের জৌলুসপূর্ণ বাহারী খ্যাতি হতে ইসলামের নিরিবিলি জগতে পদার্পণের বৈপ্লবিক ঘটনাপ্রবাহ সত্যই মুগ্ধ করার মতো। হাজারো গুণগ্রাহী ও ভক্তকুলের প্রাণোচ্ছ্বাসের পরও তাঁর মনটা কেমন খাঁ খাঁ করত। নিজেকে বড্ড অসহায় ও একাকী মনে হত। তাঁর এক মুসলিম বান্ধবী একদিন তাঁকে বললো, তুমি অপেক্ষা কর, আমি আমার প্রার্থনা সেরে আসি। তিনি বললেন, আমি কি তোমার সাথে প্রার্থনা করতে পারি? অবশ্যই মুসলিম বান্ধবী উত্তরে বলল। তিনি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সালাত অনুকরণ করলেন। সেজদাবনত হলেন। জীবনের প্রথম সিজদা, মাটিতে কপাল ঠেকানোর প্রথম অভিজ্ঞতা। যা জীবনকে আমূল পাল্টে দিল। তার কাছে মনে হল সকল কষ্ট, একাকিত্ব, অসহায়ত্ত যেন তার সেজদা চুষে নিয়েছে। বিনিময়ে তাকে দিয়েছে অনাবিল শান্তি, পূর্ণতা ও স্নিগ্ধতা। তার ভাষায়:

Medicine was not able to heal my soul so I turned toward religion.

“চিকিৎসা ও ওষুধ আমার আত্মাকে নিরাময় দিতে পারেনি, তাই আমি ধর্মে ঝুঁকে পড়লাম।”

তাঁর এ আধ্যাত্মিক বিপ্লবের পর দীর্ঘদিন তিনি পর্দার অন্তরালে চলে যান। তাঁর ভক্তরা কোথাও তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। নাটিভিস্ক্রিনেনা স্টেজ পারফরমেন্সে। তিন বছর পর এক টিভি রিপোর্টার তাঁকে আবিষ্কার করল হিজাব পরিহিতা এক মুসলিম নারী হিসেবে কোনো এক মসজিদের আঙিনায়। ছড়িয়ে পড়ল সংবাদটি মিডিয়াজগতে। তারপর তিনি তাঁর নীরবতা ভঙ্গ করে সকলকে জানালেন ভিন্ন এক ডিয়ামের গল্প। ২০১৩ সনে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর আত্মজীবনী।

উপরের দুটি গল্পপ্রমাণ করে —সালাত’ নিতান্ত একটি আচার অনুষ্ঠান নয়, এটি সৃষ্টিও স্রষ্টার সংযোগের একটি মহাসড়ক। আধ্যাত্মচর্চার এক অপূর্ব ব্যবস্থা। অস্থির মনকে সালাত করে তুলতে পারে স্থির, অতৃপ্ত ব্যক্তিকে করে তুলে তৃপ্ত। সালাত আত্মার ময়লা পরিচছনন করার এক কার্যকর পদার্থ। মহানবীর (সা.) ভাষায়: —পাঁচবার সালাত মানে প্রবহমান সচ্ছনদীতে পাঁচবার অবগাহন। সকল জঞ্জাল,ম য়লা ও পন্কিলতাকে সালাত তাড়িয়ে দেয়।’

এজন্য ইসলামে সালাতের গুরুত্ব শুধু অপরিসীম নয়, ঈমান ও কুফরী, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের পার্থক্য-রেখা হল সালাত। সর্বোপরি সালাত হল মুসলিম উম্মাহর পরিচয়। সিজদার চিহ্ন হল আমাদের গৌরব, আমাদের মর্যাদার প্রতীক। তাওরাতে ও আমাদের এ পরিচয়ের বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে (সূরা আল-ফাতহ)। কুরআন তাই সালাতের কথা বলেছে বারবার। সালাত পড়ার কথা বলেনি কুরআন, বলেছে সালাত প্রতিষ্ঠার কথা (اَقِيْمُوا ؕ ۰۰۷۲), সালাতের যত্নের কথা (حٰفِظُوْا ۗ ۰۰۲۳۸), বিনম্র সালাতের কথা (خٰشِعُوْنَۙ۰۰۲)।

আজকাল সালাতের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে প্রচুর। সালাত আদায়কারীর সংখ্যাও বেড়েছে ঢের। কিন্তু সালাতের প্রাণ ও আধ্যাত্ম নিয়ে নেই তেমন কোনো আলোকপাত। মনোযোগ ও বিনম্র সালাতত আয়ত্তের জন্য নেই কোনো কর্মশালা, নেই মাথাব্যথা। যেমন আছে হাত বাঁধার পদ্ধতি নিয়ে খিস্তি খেউড়। অথচ সালাফ বিজ্ঞজনেরা বেশি মনোযোগ দিয়েছেন —খুশূ’ নিয়ে। যেমন- ইবনে রাজাব হাম্বলী (রহ.) লিখেছেনالذل والانكسار للعزيز الجبار শীর্ষক বই এবং ইবনুল কাইয়িম (রহ.) রচনা করেছেন أسرار الصلاة

পরিশেষে আমাদের সালাত হোক প্রাণবন্ত, রবের সাথে সংযোগ সৃষ্টিকারী। সালাত উম্মাহর জন্য বিভেদের কারণ না হোক, বরং হোক শক্তি, সম্মান, সমৃদ্ধি, ঐক্য ও বলিষ্ঠ ভ্রাতৃত্ব অর্জনের অনুশীলন।

লেখক: পিএইচডি রিসার্চ ফেলো, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ