আল্লামা শাহ ছোলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) : মরণে হাসিলে তুমি, কেঁদেছে ভুবন
মাওলানা শাহ মুহাম্মদ বেদারুল আলম (রহ.)
১১ রবিউস সানী ১৪১৮ হিজরী মুতাবিক ১৬ আগস্ট ১৯৯৭ ঈসায়ী, শনিবার সকালবেলা বাসা শাহ মানযিলে নাস্তা সেরে আমার কর্মস্থল দারুল উলূম হাটহাজারী (হাটহাজারী মাদরাসা)-এ আমার কক্ষে প্রবেশ করেছি। উদ্দেশ্য দিবসের নির্ধারিত দরসসমূহের প্রস্তুতির নিমিত্তে রুটিনমাফিক অধ্যয়ন করা। সবেমাত্র মনোনিবেশ করেছি ফিকহশাস্ত্রের অন্যতম প্রামাণ্য গ্রন্থ কুদূরীতে। এমন সময় শুনতে পেলাম হৃদয়বিদারক সেই দুঃখ সংবাদটি। ঐতিহ্যবাহী চট্টলার রতœপ্রসবিনী ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুরের শতাব্দীর সেই মহীরুহ আর নেই। নেই ইলমে ইলাহীর পুষ্প কাননের সমকালের শ্রেষ্ঠ গোলাপটি। ইলমে তাসাওওফের তাত্ত্বিক মহান সাধক আল্লামা শাহ ছোলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) প্রভুর প্রেমাহ্বানে সাড়া দিয়ে ভক্তকুলকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন স্রষ্টার সান্নিধ্যে। কি এক অব্যক্ত বেদনায় হৃদয় মুচড়ে ওঠে! জবান দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন।
নানুপুরী হুযূর (রহ.) চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি মাতৃহারা হন। ইয়াতীম এই অসহায় বালকের যখন চক্ষু উন্মীলিত হয়, তখন সমগ্র বিশ্ব তাঁর সম্মুখে বিস্ময়াকারে উপনীত হয়। চারদিকে ছিল শিরক-বিদয়াতের মহামারী।
তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পান। তাই তাঁর অভিভাবকগণের ইচ্ছা ছিল সাধারণ শিক্ষায় তিনি আরো উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন। কিন্তু, মহান রব্বুল আলামীন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। তাঁর পিতার ইচ্ছায় মরহুমের সৎ মা তাঁকে দ্বীনী শিক্ষা অর্জনার্থে দ্বীনী মাদরাসায় পাঠিয়ে দেন। দরসে নিযামীর প্রাথমিক কিতাবসমূহ তিনি অধ্যয়ন করেন মাওলানা মোজাহেরুল ইসলাম (রহ.)-এর পিতা মাওলানা উবাইদুল হক ওরফে মাওলানা লাল মিয়া (রহ.)-এর নিকট। অতঃপর তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারতে গমন করেন। তথায় শায়খুল আরব ওয়াল আজাম মাওলানা সাইয়িদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে তিনি ইলমে হাদীসের বড় বড় কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। ইলমে যাহিরীর সমাপ্তির পর তিনি মাওলানা সাইয়িদ মাদানী (রহ.)-এর নিকট ইলমে তাসাওওফের সবক গ্রহণ করেন।
অতঃপর দেশে প্রত্যাবর্তন করে হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস আল্লামা শাহ আবদুল আযীয (রহ.)-এর সাথে ফটিকছড়ির নাজিরহাটস্থ আল-জামিয়াতুল আরবিয়া নছিরুল ইসলাম (প্রকাশ- নাজিরহাট বড় মাদরাসা)-এ শিক্ষকতা শুরূ করেন। পরবর্তীতে ফটিকছড়ির বাবুনগর গ্রামে অবস্থিত আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আযীযুল উলূম (প্রকাশÑ বাবুনগর মাদরাসা)-এ শিক্ষক পদে নিয়োগ লাভ করে শিক্ষা পরিচালক হিসাবেও নিয়োজিত হন।
এরপর তাঁর শায়খ, তথা আধ্যাত্মিক মুরব্বী, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া (জমিরিয়া কাছেমুল উলূম মাদরাসা), পটিয়া, চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম আল্লামা মুফতী আযীযুল হক (রহ.)-এর ইশারায় তিনি নানুপুর নিবাসী মাওলানা আমীর উদ্দীন (রহ.)-এর সাথে আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আল-উবাইদিয়াকে গড়ে তুলতে কাজ শুরূ করেন। সে প্রতিষ্ঠানের আজীবন মহাপরিচালক ও মুরব্বী হিসাবে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের মহান দায়িত্ব পালন করেন। লক্ষ লক্ষ জনতা আত্মশুদ্ধির নিমিত্তে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁর শাগরেদগণ ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান, হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহতামিম (মহাপরিচালক), হাকীমুল উম্মত আল্লামা শাহ আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলীফা আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহহাব (রহ.)-এর সাথে মাওলানা শাহ ছোলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.)-এর ছিল বিশেষ সম্পর্ক। সেই সুবাদে আমার প্রতি তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। অত্যধিক স্নেহ করতেন আমাকে। তাঁর দরবারে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার বেশ কয়েকবার।
আমরা মরহুমের মাগফিরাত কামনা করি এবং দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা তাঁকে যেন জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করেন। আমীন।
লেখক : সাবেক উস্তায, দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।