জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্রোধ ও হিংসা মানুষের সৎকর্ম নষ্ট করে দেয়

ক্রোধ ও হিংসা মানুষের সৎকর্ম নষ্ট করে দেয়

ক্রোধ ও হিংসা মানুষের সৎকর্ম নষ্ট করে দেয়

মুফতি এহসানুল হক জিলানী

রোগব্যাধি দুই প্রকার, এক. শারীরিক রোগ। দুই. আধ্যাত্মিক রোগ। শারীরিক রোগ মানুষকে হাসপাতালে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু আধ্যাত্মিক রোগ মানুষকে জাহান্নামে পৌঁছায়। আমরা শারীরিক ব্যাধির জন্য অনেক চেষ্টা করলেও সে তুলনায় আধ্যাত্মিক ব্যাধির জন্য কোনো চেষ্টাই করি না। এমনকি এ রোগের চিকিৎসা করার প্রয়োজনও মনে করি না। আজ এ রোগগুলোর মধ্যে দুটি রোগের বিষয় নিয়ে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। রোগ দুটি হচ্ছে ক্রোধ ও হিংসা। আমরা প্রথমে জেনে নিই ক্রোধ ও হিংসা কাকে বলে।

ক্রোধ

ক্রোধ বা রাগ। অনেক সময় এত ক্রোধ হয় যে, মানুষ না জানোয়ার, তা বোঝা মুশকিল। অহেতুক রাগ করা অত্যন্ত খারাপ একটি আত্মিক ব্যাধি। রাগ দোজখের আগুনের একটি টুকরা, এ জন্য রাগান্বিত ব্যক্তির চেহারা লাল হয়ে যায়। এ কারণে মারামারি ঝগড়াঝাটি, গালাগালি, খুনাখুনি পর্যন্ত সংঘটিত হয়। এমনকি অনেকে বৃদ্ধ বয়সে এসে তুচ্ছ ঘটনায় বিবিকে তিন তালাক দিয়ে পস্তাতে থাকে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন,

«لَيْسَ الشَّدِيْدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيْدُ الَّذِيْ يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ».

‘ওই ব্যক্তি বাহাদুর নয় যে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনকে নিচে ফেলে দেয় বরং ওই ব্যক্তি বাহাদুর যে রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।’

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ h، أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ ﷺ: أَوْصِنِي، قَالَ: «لَا تَغْضَبْ»، فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ: «لَا تَغْضَبْ».

‘হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, এক সাহাবী রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন, আল্লাহর রসুল। আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘গোসসা করবা না।’ সে আবারও বলল, আল্লাহর রসুল! আমাকে আরেকটি নসিহত করুন। রসুল (সা.) আবারও বললেন, ‘গোসসা ত্যাগ কর।’ সাহাবী তৃতীয়বার অনুরোধ করার পরও একই জবাব দিলেন। তো যতবারই সাহাবী নসিহতের কথা বলেছেন, রসুল (সা.) একই কথা বলেছেন, ‘গোসসা ছাড়, গোসসা ছাড়।’  এ ক্রোধ একটি মহা বড় ব্যাধি। আসুন আমরা জেনে নিই ব্যাধি থেকে বাঁচার উপায় কী।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু নির্দেশই দেননি, বরং তা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। জামিউত তিরমিযী ও মুসনদে আহমদ হযরত আবু যর আল-গিফারী (রাযি.) থেকে একটি হাদীস নকল করা হয়েছে। যে হাদীসটিতে মহানবী (সা.) ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি  বলেছেন,

«إِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ قَائِمٌ فَلْيَجْلِسْ، فَإِنْ ذَهَبَ عَنْهُ الْغَضَبُ وَإِلَّا فَلْيَضْطَجِعْ».

‘যদি ক্রোধের সময় তুমি দাঁড়িয়ে থাক তাহলে বসে যাবে, এতেও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে না এলে শুয়ে পড়বে।’

দু’ভাবে গোসসার চিকিৎসা করা হয়। ১. ইলমি বা জ্ঞানগত পদ্ধতিতে ২. আমলি বা কার্যগত পদ্ধতিতে।

ইলমি চিকিৎসা হচ্ছে গোসসার সময় চিন্তা করতে হবে গোসসা কেন আসে? গোসসা আসার কারণ তো এটাই যে, যে কাজটি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে সে কাজটি আমার মনের মোতাবেক কেন হয়নি? কেন এটা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হলো? তার মানে আমি আল্লাহর ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছার অনুগত বানাতে চাই? নাউযু বিল্লাহ! এভাবে চিন্তা করলে গোসসার বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে।

আসুন আমরা জেনে নিই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে ইসলামের আমলি শিক্ষা কী?

গোসসা আসলে ১. أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়বে, ২. নিজ অবস্থা পরিবর্তন করবে। অর্থাৎ দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়বে, বসে থাকলে শুয়ে পড়বে। ৩. যার প্রতি গোসসার উদ্রেক হয় তার সামনে থেকে সরে পড়বে। ৪. তারপরও গোসসা ঠাণ্ডা না হলে অযু করবে, নিজ গালকে মাটিতে লাগিয়ে দেবে। এভাবে আমল করলে গোসসা দূর হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

আবু দাউদ শরীফের একটি হাদীসে রসুল (সা.) ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি প্রসঙ্গে বলেছেন,

«فَإِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَوَضَّأْ».

‘কেউ ক্রোধান্বিত হলে অযু করে নেবে। এতে ক্রোধ থেমে যাবে, ক্রোধ প্রশমিত হবে।’

এসব পদ্ধতি অবলম্বন করে যারা নিজেদের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের ক্ষেত্রেও হাদীসে ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। মুসনদে আহমদের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

«مَا تَجَرَّعَ عَبْدٌ جَرْعَةً أَفْضَلَ عِنْدَ اللهِ b مِنْ جَرْعَةِ غَيْظٍ، يَكْظِمُهَا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ تَعَالَىٰ».

‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে বান্দা এক ঢোক ক্রোধ হজম করল, আল্লাহর কাছে বান্দার এ ঢোকের চেয়ে উত্তম কোনো ঢোক হতে পারে না।’

একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

«مَنْ كَفَّ غَضَبِهِ كَفَّ اللهُ عَنْهُ عَذَابَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ».

‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রোধ হজম করতে থাকবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার ওপর থেকেও নিজের আযাব তুলে নেবেন।’

হিংসা-বিদ্বেষ একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। মানুষের হীন মন-মানসিকতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের সৎ কর্ম ও পুণ্যকে তার অজান্তে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে।

হিংসার সংজ্ঞা

কোনো ব্যক্তিকে আরাম আয়েশ বা প্রাচুর্যপূর্ণ অবস্থায় দেখে তার সে নেয়ামত দূরীভূত হয়ে নিজের জন্য হাসিল হওয়ার আকাক্সক্ষা করা। হিংসা অত্যন্ত জঘন্য একটি ব্যাধি।

আল্লাহ তায়ালা হাদীসে কুদসীতে বলেন,

«الْـحَاسِدُ عَدُوٌّ لِنِعْمَتِيْ رَادٌّ لِقَضَائِيْ سَاخِطٌ لِقِسْمَتِي الَّتِيْ قَسَمْتُ بَيْنَ عِبَادِيْ».

‘আমার বান্দার ওপর নেয়ামত দেখে হিংসাকারী কেমন যেন আমার ওই বণ্টনের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট যা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে করেছি।’  নাউযু বিল্লাহ।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,

«إِنَّ الْـحَسَدَ يَأْكُلُ الْـحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْـحَطَبَ».

‘হিংসা নেকিসমূহকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দেয় যেমন আগুন শুকনো লাকড়িসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়।’

হিংসা নামের এ ভয়াবহ আধ্যাত্মিক ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে। এ জন্য হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্যে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য পবিত্র কুরআনে দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে,

وَ مِنْ شَرِّ حَاسِدٍ اِذَا حَسَدَؒ۰۰۵

‘আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই, যখন সে হিংসা করে।’

আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্রোধ ও হিংসাসহ সব আত্মিক ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকার তওফীক দান করুন।  আমিন।

  আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি খ. ৮, পৃ. ২৮, হাদীস: ৬১১৪, হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত

  আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৮, পৃ. ২৮, হাদীস: ৬১১৬

  আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩৫, পৃ. ২৭৮, হাদীস: ২১৩৪৮

  আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২৪৯, হাদীস: ৪৭৮৪

  আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, খ. ১০, পৃ. ২৭০, হাদীস: ৬১১৪

  আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রাশাদ, রিয়াদ, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ১০, পৃ. ৫৪২, হাদীস: ৭৯৫৮, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত

  (ক) আল-গাযালী, ইয়াহইয়াউ উলূমিদ্দীন, দারুল মারিফা, বয়রুত, লেবনান, খ. ৩, পৃ. ১৮৮; (খ) আবু নুআইম আল-আসবাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, আস-সাআদা, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৩৯৪ হি. = ১৯৭৪ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ২৬৬

  আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ২৭৬, হাদীস: ৪৯০৩

  আল-কুরআনুল করীম, সুরা আল-ফালাকা, ১১৩:৫

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ