শুক্রবার-১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৬ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলা ভাষার বিকাশধারায় আলিমদের ভূমিকা

বাংলা ভাষার বিকাশধারায় আলিমদের ভূমিকা

মুফতি আমজাদ হোসাইন

এদেশের আলেম সমাজ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধশালী ভাষায় পরিণত করার ক্ষেত্রে অসামান্য মেহনত করেছেন।

বাংলায় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে শিক্ষিত সমাজ ও জনসাধারণের ভাষা অনেকটা আরবি ও ফারসির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কারণ রাজকার্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা সংস্কৃতি ইত্যাকার জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগী অসংখ্য আরবি, ফারসি শব্দ এমনভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে যা বাংলা ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে পরিণত হয়। এ আরবি ফারসি ভাবধারা বুকে ধারণ করেই সে যুগে ইসলামী কাব্য সাহিত্য রচনা করে অমর হয়ে আছেন কবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির, বাহরাম খান। এ ছাড়াও ইসলামী আদর্শ নিয়ে রচিত আবদুল করিম খোন্দকারের ‘দুল্লা মসজিদ’ গ্রন্থটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ১৬৯৮ খ্রি. তিনি এ কাব্যটি রচনা করেন। কাব্যটি ফারসি গ্রন্থের ভাবানুবাদ। এতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও অপর কয়েকজন মহাতদার কথা বর্ণিত হয়েছে। নামায-রোযা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদির বর্ণনাও এতে রয়েছে। ‘হাজার মাসাইল’ ও ‘নূরনামা’ নামে তিনি আরও দুটি কাব্য রচনা করেন।

মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম লেখতে হয় মুনশী গরীবুল্লাহর। পুঁথি সাহিত্যের জনকরূপে যিনি অমর হয়ে আছেন। তার পরে কবি সৈয়দ হামযা ইসলামী ভাবধারায় সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ ছাড়াও এই ধারায় কবি হিসেবে আবদুর রহিম, মনিরুদ্দিন, আয়েজুদ্দিন, মুন্সী তাজুদ্দিন, মুহাম্মদ দানেশ, আরিফ রেজাউল্লাহ, সাদ আলী আবদুল ওয়াহাব প্রমুখ কবি ইসলামী সাহিত্য সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুহাম্মদ দানেশ ‘চাহার দরবেশ’ নামক কাব্য রচনা করেন। প্রথমে ফারসি ভাষায় কাব্যটি রচিত হলেও পরে তিনি তা বাংলায় রূপান্তরিত করেন। এ ছাড়াও তিনি নুরুল ঈমান, হাতেম তাই ইত্যাদি কাব্য রচনা করেন। এ দুই যুগের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই এ যুগ ছিল কাব্য ও পুঁঁথি সাহিত্যের যুগ। আর এ দুই যুগে যারা বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন তারা প্রকৃত পক্ষে আলেম সমাজই। এরপর থেকে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের সর্বমুখী পদচারণা। বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয় এক নব অধ্যায়-রেনেসাঁ যুগ। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে, লেখা-লেখনী শক্তির মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেন। এরই ফলশ্রুতিতে সিপাহি বিপ্লবের মাত্র ২০ বছর পরেই ১৮৭৭ সালে বাংলা ভাষায় ‘আখবারে মুহাম্মদী’ নামক একটি উন্নত ধরনের বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার সঙ্গেই জড়িত রয়েছে বাঙালি আলেম সমাজের মাতৃভাষা চর্চা ও সাংবাদিকতার এক গৌরবময় ইতিহাস। আর এ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা স¤পাদক ছিলেন একজন মাওলানা। আল্লামা জামালুদ্দিন তার বিপ্লবী চিন্তাধারার ব্যাপক প্রসার এবং ঐক্য ও সংহতির আহ্বান সারা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেসব পন্থা অবলম্বন করেন তার মধ্যে সংবাদপত্র প্রকাশনা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তিনি আল-উরওয়াতুল-উসকা, শামসুন্নাহার প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশ করে যে বিপ্লবের সৃষ্টি করেন উপমহাদেশের আলেম সমাজ তা দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকেন। বিশেষভাবে বাংলার আলেম সমাজ। আর এটা হয়েছিল এ মাওলানার কিছুদিন কলকাতা অবস্থানের ফলে। তার সোহবতে থেকে বাংলার আলেম সমাজ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আল্লামা জামালুদ্দীনের সংস্পর্শে যেসব বাঙালি আলেম সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন, পত্রপত্রিকা প্রকাশ করেন তাদের মাঝে পণ্ডিত রেয়াজুদ্দিন মাশহাদীসহ অন্য পণ্ডিতরা। মুন্সী শেখ আবদুর রহিম ও মৌলভী মেরাজুদ্দিন আহমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৯ খ্রি. আশ্বিন মাসে। পত্রিকাটি নানা বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে বেশ কিছুদিন চালু ছিল। এই পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় মুসলমানরা তাদের ধর্মের মহিমা, তত্ত্ব, তথ্য, জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরব সম্বন্ধে কিছুটা ওয়াকিবহাল হয়েছিল।

এ ছাড়াও একজন বিখ্যাত বাঙালি বুজুর্গ ফুরফুরা শরিফের পীর সাহেব হযরত আবু বকর সিদ্দীক (র.)। এর পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সাহায্যে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় ‘মোসলেম হিতৈষী’ ইসলাম দর্শন, হানাফি শরীয়ত, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত, হেদায়েত প্রভৃতি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাগুলো। এসব পত্রপত্রিকা প্রকাশের জন্য তার কতিপয় খলিফাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার হাজার হাজার খলিফার মধ্যে থেকে মাও. রুহুল আমিন, মাও. মুয়েজুদ্দীন হামিদী, মাও. নেছারুদ্দীন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাও. রুহুল আমীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা স¤পাদনা ছাড়াও প্রায় দেড়শ ইসলামী পুস্তক রচনা করেন। মাও. রুহুল আমীন ছাড়াও যারা ওই সময় পত্রপত্রিকা পরিচালনা এবং বই-পুস্তক রচনা করে বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মাও. আহমদ আলী (নবযুগ), মাও. আহমদ আলী এনায়েতপুরী (শরীয়তে ইসলাম), মাও. মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (সাপ্তাহিক ছোলতান, দৈনিক হাবলুল মাতীন, দৈনিক আমির, মাসিক আল-ইসলাম প্রভৃতি), মাও. মুস্তাফিজুর রহমান (আজাদ ও মোহাম্মদী পত্রিকাদ্বয়ের নিয়মিত লেখক), মাও. আজিজুর রহমান (তাবলিগ) মাও. নূর মোহাম্মদ আজমী (মোহাম্মদী ও আজাদ), মাও. মুস্তাফিজুর রহমান (আজাদ ও মোহাম্মদী পত্রিকাদ্বয়ের নিয়মিত লেখক), মাও. শেখ আ. রহিম (তরজুমানুল হাদিস ও আরাফাত), মাও. শামছুল হক ফরিদপুরী (বহু ইসলামী গ্রন্থ প্রণেতা)। পরবর্তী যুগে যেসব ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পরিচালনা ও বই পুস্তক রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের নবযুগ সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে মাও. মুহিউদ্দীন খান (মাসিক মদিনা, সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম, দৈনিক নাজাত, ত্রৈমাসিক মীনার), মাও. আমিনুল ইসলাম (মাসিক আল বালাগ), মাও. রুহুল আমিন খান (ইনকিলাব), মাও. মুহিউদ্দিন শামী (মাসিক তাহযীব), মাও. রেজাউল করিম (তমদ্দুন), মাও. হাকীম আবদুল মান্নান (মাসিক হামদর্দ, পূর্বদেশ), মাও. মাহমুদুল হাসান (মাসিক আল জামিয়া)।

এ ছাড়াও আরও অনেক ওলামায়ে কেরাম রয়েছেন যারা পত্রপত্রিকা প্রকাশনা ও বই পুস্তক রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। যাদের নামের তালিকা দিয়েই স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করা সম্ভব।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ