জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কওমী মাদরাসা ও তার অবদান

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭

কওমী মাদরাসা ও তার অবদান

মাওলানা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন (দা. বা.)

অধ্যাপক, ওমরগনি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশের প্রাচীনতম দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক বার্ষিক ইসলামী সম্মেলনে উপস্থিত হযরাতে ওলামায়ে কেরাম ও দীনদার মুসলিম ভাইরা! আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করি যে, আজকের এ মোবারক মাহফিলে উপস্থিত হতে পারলাম, আল্লাহ তায়ালা তওফীক দিলেন আল-হামদু লিল্লাহ।

আল্লাহ তায়ালার বাণী:  اِنَّمَا يَخْشَى اللّٰهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُاؕ ۰۰۲۸ অর্থাৎ ওলামায়ে কেরাম আল্লাহকে সবচে বেশি ভয় করেন।  নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ অর্থাৎ আলেমগণ নবীগণের উত্তরসূরি।  তারাই আমাদের হালাল-হারাম পার্থক্য করার শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَاَحَلَّ اللّٰهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبٰواؕ ۰۰۲۷۵ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।  হালাল টাকা রোজগার করাও ইবাদত। রাসূল (সা.) বলেন, طَلَبُ كَسْبِ الْـحَلَالِ فَرِيْضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ অর্থাৎ হালাল উপার্জন করা অন্যান্য ফরায়েযের পর একটি ফরয। একথাগুলো আমরা আলেমদের মাধ্যমেই জানতে পারি।

মসজিদ যেমন দামী, মাদরাসাও তেমনি দামী। কারণ মসজিদে যিনি ইমামতি করেন, এই ইমাম তৈরি করেন মাদরাসাঅলাগণ। মসজিদে আমরা যারা ركوع سجود قعود قيام করি এবং যে যে তাসবীহাত আদায় করি এই তালীম আমরা মাদরাসাঅলাগণ থেকে পেয়েছি। তাই মাদরাসার প্রয়োজন বুঝে জীবনের প্রথম দিন থেকে কেয়ামতের দিন সকাল বেলা পর্যন্ত এক মুর্হূতের জন্যও আমরা বসে থাকতে পারি না। আর এ সমস্ত মাদরাসা আছে বলেই আমাদের দীন, ধর্ম ও আকীদা সুস্থ আছে।

আমাদের মুখে দাঁড়ি আছে, মাথায় টুপি আছে, আযান দিলে আমরা মসজিদে যাই, আলেম-ওলামাদেরকে দাওয়াতে তাবলীগ, তালীম, তাযকিয়ায়ে নাফস এর মেহনতের মাধ্যমে চালু রাখুক। আমীন।

মাদরাসা আর প্রচলিত স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির শিক্ষাক্রম ও ধারা এক নয়। দীনী মাদরাসার পেছনে আল্লাহঅলাদের চোখের পানি আছে।

প্রতিটি মাদরাসার পেছনে রয়েছে এক একটি সোনালি ইতিহাস। দারুল উলুম দেওবন্দ হল কওমি মাদ্রাসাগুলোর প্রাণকেন্দ্র। পটিয়া মাদরাসা হল তার শাখা, ১৮৫৭ সনে ভারতে জাতীয় বিপ্লব শুরু হয়, ৫৮ লক্ষ মাদরাসা ছিল হিন্দুস্থানে ও বাংলাদেশে। ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করার পর মাদরাসাগুলো প্রায়ই বিলুপ্ত করে দেয়। তৎকালে মাদরাসার নামে, খানকার নামে, মসজিদের নামে কোন আল্লাহঅলার নামে ১০ বিঘা করে জমি বরাদ্দ ছিল। ইংরেজরা ক্ষমতায় আসার পর তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৭৮০ সালে ভারতবর্ষে হৈ চৈ পড়ে গেল। ইংরেজরা ইংরেজী মিশনারি স্কুল চালু করে ভারতবর্ষকে খ্রিস্টান বানানোর চক্রান্ত শুরু করে দেয়। এই চক্রান্ত একেবারেই নিষ্ফল হয়নি। ভারতের চারটি অঙ্গরাজ্য এখন খ্রিস্টান রাজ্য পরিণত হয়েছে।

ভারতবর্ষের মর্দে মুজাহিদ হাজী আবেদ হোসাইন ও কাসেম নানুতবী (রহ.) ভাবলেন, আমাদের মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিতে হবে। কে টাকা দেবে, কে জান কুরবান দেবে, কিছু না ভেবে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমাদের দীনী মাদরাসা চালু রাখতে হবে।

১৮৬৬ সনে দেওবন্দ নামক এলাকায় ডালিম গাছের ছায়ায় একজন ছাত্র ও একজন ওস্তাদের মাধ্যমে মাদরাসার তালীম শুরু হয়ে গেল। ওস্তাদের নাম মোল্লা মাহমুদ আর ছাত্রের নাম মাহমুদুল হাসান। ওস্তাদের বেতন নেই ও ছাত্রেরও ফিস নেই।

আমি ওমরগনী এম.ই.এস. কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক। অত্র প্রতিষ্ঠানে আমার শিক্ষকতার বয়স  ২৬ বছর, আমি New Pay Scale-এ উচ্চতর বেতন পাই, এমনকি প্রতি বছর ইনক্রিমেন্টও আছে।

বাংলাদেশের যত কওমী মাদরাসা আছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত কোন ওস্তাদের বেতন নেই। বাংলাদেশে সরকারের  নূন্যতম বেতন স্কেল হলো ৮,৩০০ টাকা। এটার নাম বেতন আর কওমী মাদরাসার মুহতামিম থেকে নিয়ে দারওয়ান পর্যন্ত কোন বেতন নেই, সামান্য ভাতা আছে। যারা বিনা বেতনে হাজার বছর ধরে আল্লাহর দীনকে, কুরআন-হাদীসকে এবং ইসলামকে দুনিয়ার বুকে প্রতিস্থাপন ও চালু রাখার জন্য মেহনত করে যাচ্ছেন তাদের এ মেহনত সোনালি অক্ষরে লিখে রাখা প্রয়োজন।

১৮৬৬ সনে ডালিম গাছ তলায় যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয় (আমি ওই গাছ তলায় গিয়েছিলাম) একজন ছাত্র ও একজন শিক্ষকের মাধ্যমেই মাদরাসা চালু হয়, উভয়ে বেতন ছাড়া। ধীরে ধীরে ছাত্র ও মাদরাসা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বর্তমানে এটি আন্তর্জাতিক মাদরাসায় পরিণত হয়েছে। ১৮৬৬ সনে দারুল উলুম দেওবন্দে ১ পয়সাও বার্ষিক বাজেট ছিল না। বর্তমান ২০১৬ সনে বার্ষিক বাজেট হল ১৬ কোটি রুপি। হাজার হাজার طلباء حكماء رقباء দারুল উলুম দেওবন্দ তৈরি করেছে। মুফতি, মুহাদ্দিস, মুনাযির, তৈরি হয়েছেন অসংখ্য। ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে দারুল উলুম দেওবন্দের ওলামায়ে কেরাম খেদমত করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে দেওবন্দী ধারার দীনী মাদরাসাসমূহ বিশেষভাবে পটিয়া, হাটহাজারী, জিরি, নানুপুর, বাবুনগর, ঢাকার লালবাগ, বরিশালের চরমোনাই, ফরিদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, ফরিদপুরের গওহরডাঙ্গা, সিলেটের রেঙ্গা, দরগাহ হরিপুর, বগুড়ার জামিল, রংপুরের দারুল উলুম করিমিয়া দারুল উলুম দেওবন্দের শাখা। দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানে দারুল উলুম দেওবন্দের অবদান অবিস্মরণীয়। দারুল উলুম দেওবন্দের মাধ্যমেই তৈরি হয় তাবলীগ জামায়াত। হিন্দুস্তানের জনৈক সাংবাদিক বলেন যেদিকে তাকাই শুধু মাওলানা ইলিয়াছের গড়া তাবলীগ জামায়াতের ঢল দেখতে পাই। আজ সারা বিশ্বব্যাপী আমলের দাওয়াত, ঈমানের দাওয়াতের এই মহান দায়িত্ব তাবলীগ জামায়াতের ভাইয়েরা পরিচালনা করে আসছেন, তারা দারুল উলুম দেওবন্দের লোক।

এই দীনী মাদরাসার ওপর চক্রান্ত কেবল আজ নয়, বহুকাল আগের। ইনশাআল্লাহুল আযীয এই পৃথিবীতে যতদিন সূর্য উদয় হবে এবং অস্ত যাবে ততদিন কওমী মাদরাসার অস্তিত্ব টিকে থাকবে। কেউ চক্রান্ত করে এর যাত্রাপথ বাধাগ্রস্থ করতে পারবে না।

দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক শিক্ষা সচিব আল্লামা আরশাদ মাদানী সাহেব (দা. বা.) তার সফর নামায় লিখেন, তিনি একবার দক্ষিণ আফ্রিকার জামবিয়া সফরে গেছেন, তিনি বলেন, আমার সাথে তিনটা গাড়ি ছিল। পথিমধ্যে আসর নামাযের সময় হয়ে যায়, রাস্তার কিনারায় রুমাল বিছিয়ে নামায শুরু করে দেই, নামায আদায় শেষে পাশের   বাড়ি থেকে একজন ৮০/৯০ বছরের বয়স্ক মহিলা বলল, তোমরা এসব কী করছো? অর্থাৎ তোমরা বুকে হাত বাধা, হাটুতে হাত রাখা, মাঠিতে লুটিয়ে পড়া এস কী করছো? আরশাদ মাদানী সাহেব বলেন, আমরা প্রভুর উপাসনা করলাম, তিনি বলেন, তোমরা ঠিক বলেছ, আমার দাদা নানা তোমাদের মত উপাসনা করত, এতোদিন তোমরা কেন আসনি? আর তোমাদের না আসার কারণে আজ মসজিদের মিনারাগুলো মন্দিরের মিনারায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। জামবিয়ায় মাদরাসা ও পীর সাহেবদের খানকাগুলোর সেই অলোকচ্ছটা আগের মত নেই। Genaration gap গেলে এমন হয়। আমি প্রথম Genaration, আমার ছেলের দ্বিতীয় Genaration, আমার নাতি তৃতীয় Genaration। তিন Genaration পর্যন্ত যদি পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে ইলমে দ্বীনের চর্চা না হয়, ঈমানী দাওয়াতের কাজ না থাকে امر بالمعروف نهي عن المنكر না থাকে সে দেশের জনগোষ্ঠী ঈমান হারা হয়ে যায়, এভাবে জামবিয়ার সকল মানুষ ঈমান হারা হয়ে গেছে। অর্থাৎ খ্রিস্টান ও অন্যন্য ধর্মালম্বী হয়ে গেছে।

প্রতিটি মাদরাসার পেছনে রয়েছে বুযুর্গদের চোখের পানি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়ার বর্তমান বয়স ১১০-১১৫ বছর, জামিয়া ইউনুছিয়ার ইউনুছ কে? কোন ইউনুছ? সেই ইউনুছ হল ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফ্ফর নগরের এক দরবেশ আলিম।

তৎকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক স্কুলের Head Master প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন, ভালো মানের বক্তাও ছিলেন, তিনি মহকুমার কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব ছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রথভ্রষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি ছিলেন কাদিয়ানি মতবাদের অনুসারী, তাঁর প্রভাবের কারণে সেখানকার মানুষ গোলাম আহমদ কাদিয়ানির অনুসরণ করতে শুরু করে। তখনকার ওলামায়ে কেরাম তাঁর সাথে মোনাজারা করে পেরে উঠতে পারেননি।

সেই শায়খ ইউনুছ রাসূল (সা.)-কে একরাতে স্বপ্নে দেখেন, রাসূল (সা.) তাঁকে বলেন, হে ইউনুছ! তুমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাও, সেখানে খতমে নবুওয়াত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষ এতবড় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিভাবে খুঁজে পাবেন? তখন এদেশের নাম ছিল পূবর্বঙ্গ, তিনি অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারেন, কুমিল্লা জেলার এক মহকুমার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া, তারপর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন, সেই স্কুল মাস্টারের সাথে মোনাজারা করে তার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেন । স্থানীয় জনগণ তাঁর নামে মাদরাসা দিলেন জামিয়া ইউনুছিয়া।

এরকম প্রতিটি মাদরাসার পেছনে রয়েছে এক বা একাধিক ব্যক্তির চোখের পানি আর আহাজারি, আর এই মেহনত ইন শা আল্লাহ ব্যর্থ হবে না।

আল্লামা আরশাদ মাদানী সাহেব বলেন, দারুল উলুম দেওবন্দের সবচে বড় অবদান রেখেছেন। একজন নাপিতের ছেলেকে মুফতীয়ে আজম বারিয়েছে। তাঁর নাম আল্লামা মুফতি কেফায়াতুল্লাহ (রহ.)।

হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে চারটি বর্ণ আছে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈষ্য, শূদ্র। প্রত্যেক বর্ণের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে, শূদ্র সমাজের একেবারে নিম্নপর্যায়ের বর্ণ।

এই শূদ্রের ছেলেকে মুসলমান বানিয়ে দীনী তালীম দিয়ে The Great Mufti of India বানিয়ে জাতিকে উপহার দিয়েছেন। এইসব মাদরাসার পেছনে অদ্যবাদী গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে এই কওমী মাদরাসার কোন ছাত্র, শিক্ষক, কোন জঙ্গী বা কোন সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত নয়। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত মাদরাসায়ে কওমিয়া আছে ৪০ হাজার, ছাত্র ৫০ লক্ষ। কোন মাদরাসার ছাত্র ৭০ বছরের ইতিহাসে জঙ্গী বা সন্ত্রাসের সাথে জড়িত নেই।

পত্রিকার পাতা খুললে আমরা দেখতে পাই এ দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীগণ অস্ত্র নিয়ে দৌঁড়া দৌঁড়ি করে। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডগুলো করে কারা? বিগত ১০ বছরের পত্রিকা খুললে দেখা যাবে এই কর্মকাণ্ডের সাথে মাদরাসা ছাত্রের কোন সম্পর্ক নেই।

প্রতিটি থানায় ওসি সাহেবের কামরায় ডাকাত, চোর, বাটপার, দালালের লিস্ট আছে। সেই লিস্টে কোন মাদরাসার মোহতামিম, নায়েবে মোহতামিম, নাযেমে তালিমাত (শিক্ষা পরিচালক) কোন মুফতি, মুহাদ্দিস, কোন হাফেজে কুরআন, ছাত্র এবং কোন দাওরায়ে হাদীস পাশ ছাত্রের নাম নেই।

বিগত ৭০ বছর ধরে এই সমস্ত মাদরাসায়ে কওমিয়া আরাবিয়াহ দেওবন্দীয়া জাতিকে সুশৃঙ্খল চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক নাগরিক উপহার দিয়ে আসছে। আর এ দেশের ওলামায়ে কেরাম এক প্রচন্ড শক্তির নাম, এই শক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাও নেই, কেবল আমরা যদি وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا۪ ۰۰۱۰۳ হয়ে কালেমায়ে তাইয়িবার পতাকা তলে জমায়েত হতে পারি। তাহলে এদেশ চলবে ওলামায়ে কেরামের কথা মতে। শাসকবর্গ ওলামা মাশায়েখদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করতে সাহস করবে না।

বেশি দূর যেতে হবে না, জামিয়া মালিবাগের মোহতামিম, হযরত আল্লামা আশরাফ আলী বলেন বাংলাদেশের বড় বড় ওলামায়ে কেরামগণের একটি জামাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে কতিপয় পরামর্শ প্রদান করেন, কিছু পরামর্শ তিনি মেনে নেন বাকীগুলো বিবেচনার আশ্বাস প্রদান করেন।  হাক্কানী আলিমদের রাজনৈতিক কোন উচ্চভিলাষ নেই, কোন অর্থনৈতিক স্বার্থ নেই,  এমপি হতে চায় না, মন্ত্রী হতে চায় নাই। তাঁরা রাষ্ট্রদূত হতে চান না, কোন মাদরাসার জন্য অনুদান চান না। মানুষ নেতাদের সাথে সাক্ষাত করে কিছু পাওয়ার আশায়, কিন্তু হাক্কানী রাব্বানী ওলামায়ে কেরাম জীবনে কোন দিন কোন সরকারের দালালী করেন নি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন, কুমিল্লার হযরত আল্লামা আশরাফ আলী সাহেব বলেন, ওলামায়ে কেরামগণ কওমী মাদরাসার ইতিহাস ও খেদমত প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন। ভারতের স্বাধীনতার পেছনে আলিমদের অবদান সবচেয়ে বেশী, তাঁরাই জেল নির্যাতন, ফাসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন, আন্দামানের মাটি খনন করলে এখনো সংগ্রামী আলেমদের হাড় পাওয়া যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, একথাগুলো তো সাধারণ পাবলিক জানে না, একথাগুলো পত্রিকার মাধ্যমে, বইয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের জানিয়ে দিতে হবে। ওলামায়ে কেরামগণ আরো বলেন, কওমী মাদরাসা আপনার মাধ্যমে কোন ক্ষতি হোক এটা আমরা কামনা করি না, বরং আপনার মাধ্যমে মাদরাসার আরো বিকাশ ঘটুক এটাই আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী বলেন, কওমী মাদরাসার ব্যাপারে আমার ওপর বিভিন্ন দিক হতে চাপ আছে, আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি কওমী মাদরাসার ওপর হাত দিতে পারব না।

ক্লাস ওয়ান হতে টেন পর্যন্ত বাংলাদেশের যে শিক্ষাব্যবস্থা আছে সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে এদেশের বুদ্ধিজীবী যারা দীন ধর্ম বুঝেন না ও পছন্দ করেন না; পরিবর্তন করে ফেলেছেন, যেমন কাজী নজরুলের, ওমর ফারুক ও মরু ভাস্কর, তাওহীদের মর্মকথা, বন্দনা, প্রার্থনা, বিদায় হজ এই প্রবন্ধ ও কবিতাগুলোকে গোপনে বাদ দেয়া হয়েছে।

আল্লামা আশরাফ আলী আরো বলেন, এই বইয়ের এই পৃষ্ঠায় এই পাতায় কিছু বুদ্ধিজীবী পরিবর্তন করে দিয়েছেন, যদি এই শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয় তাহলে এদেশের স্কুলের ছাত্ররা কিভাবে তাদের তাওহীদ-রেসালাত, তাদের নবী মুহাম¥দ (সা.), আবু বকর (রাযি.) ও ওমর ফারুক (রাযি.)-কে জানবে? তারা প্রবন্ধ হিসেবে যুক্ত করেছে লাল গরুটা, গরু মায়ের মত, গরু বিক্রয় করা অধর্ম, গোহত্যা মহাপাপ, আরও অনেক ভ্রান্ত ও আজগুবী কল্পকাহিনী যুক্ত করেছে। এদেশের ওলামায়ে কেরামদের কাছে গরু মায়ের মত নয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কাছে এর আগেও এমন কিছু রিপোর্ট জমা আছে, আমি এ আবেদন রাখলাম, বিবেচনা করে দেখবো।

আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, ১লা জানুয়ারি হতে স্কুলের ছাত্রদের হাতে যে বই এসেছে তা সংশোধনকৃত। আর হুমায়ুন আজাদের ‘যে বই আমার ডর লাগায়’ সহ অনেক প্রবন্ধ ও কবিতা যেগুলো এদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী সংযোজন করেছিল তা বাদ পড়ে গেছে। যা বাদ পড়েছিল তা আবার সংযোজন করা হয়েছে। মরু ভাস্কর, বিদায় হজ, বন্দনা, আবু বকর, ওমর ফারুক, তওহীদ রেসালাত।

গরম কথার চেয়ে নরম কথায় কাজ বেশি হয়, গরম কথায় কাজ হয় না, বরং বিদ্ধেষ বাড়ে। ওলামায়ে কেরামগণ নরম কথা বলার কারণে আজ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এরপরও কিছু বুদ্ধিজীবী আজেবাজে কথা বলছে, ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের বর্তমান যে শিক্ষাব্যবস্থা আছে তাকে নাস্তিক্যবাদী করার সব চক্রান্ত রুখে দিতে হবে।

আলিম ওলামাগণ সবসময় ময়দানে। আর যারা সরকারি চাকুরী করেন তারা সরকারি বেতন পান, তারা সরকারের পক্ষে বিপক্ষে কথা বলেন না। আর কওমী ওলামায়ে কেরামগণ সরকারি চাকুরী করেন না। আল্লাহর রহমতে দীনের খেদমত করে যান, তাই তারা হক কথা বলদে দ্বিধা করেন না। বর্তমানেও হিন্দুস্তানে ইসলাম বিরোধী কোন ফেতনা এবং নাস্তিক্যবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তখনই ওলামায়ে দেওবন্দ তাজা বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত আছেন।

আমি ভারতে শাহ ওয়ালিওল্লাহ দেহলভী (রহ.)-এর মাযারে গিয়েছিলাম, তার মাযারের পাশে মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া সাহেবের মাযার, তার কবরে লেখা আছে, ‘আমি জীবিত থাকতে তো আজীবন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছি, এখন তো আমি পৃথিবীতে নেই, কিন্তু যখন ভারতের বুকে কোন বাতিল শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তখন আমার কবরের মাটি আমাকে ফিতনার কথা জানিয়ে দেয়।’

এ সমস্ত মাদরাসাকে আমাদের ঈমানের জন্য, আকীদার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করা একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশে ৮৭% মুসলমান, আর অন্যন্য ধর্মের বাকিগুলো বর্তমানে ১% লোক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে, এই ১% লোক এদেশের মুসলিম জনতার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এদেশের   জনগণ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যেও রয়েছে ইসলামী চেতনা, আর এ চেতনা বলে তারা সামনে অস্ত্র রেখে ওয়াক্ত হলে সালাত আদায় করে, তাই ইনশাআল্লাহ এই দীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কেউ আনতে পারবে না। আল্লাহ সবাইকে ইসলামী চেতনামুখী করার তওফীক দান করুন। আমীন।

অনুলিখন:

মুহাম্মদ আবদুল আউওয়াল

আদব বিভাগ, জামেয়া পটিয়া ২০১৭

সূত্র:

আল-কুরআন আল-করীম, সুরা আল-ফাতির, ৩৫:২৮

  ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৮১, হাদীস: ২২৩

  আল-কুরআন আল-করীম, সুরা আল-বাকারা, ২:২৭৫

  আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রাশাদ, রিয়াদ, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ১১, পৃ. ১৭৫, হাদীস: ৮৩৬৭

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ