জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রসঙ্গ: থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন

প্রসঙ্গ: থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন

সাইফুল্লাহ মনসুর

থার্টি ফার্স্ট নাইট ও ১ জানুয়ারি (নববর্ষ) পালন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নয়। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

اِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللّٰهِ الْاِسْلَامُ۫ ۰۰۱۹

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পাকের নিকট একমাত্র মনোনীত দীন হচ্ছে ইসলাম।’

বাংলাদেশের ৯৭ ভাগ মানুষের দীন হচ্ছে ইসলাম, তাই সংবিধানের ২ নম্বর ধারায় বর্ণিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের স্বীকারের পরিপ্রেক্ষিতে বিজাতীয় সংস্কৃতি থার্টিফার্স্ট নাইটসহ কোনো ইসলাম বিরোধী কাজ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না ৯৭ ভাগ মুসলমানের দেশের সরকারের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে- সরকারিভাবে থার্টিফার্স্ট নাইটসহ সকল ইসলাম বিরোধী কাজ বন্ধ করে দেয়া এবং সরকারিভাবে থার্টিফার্স্ট নাইটসহ সকল ইসলাম বিরোধী কাজ থেকে মুসলমানদের বিরত রাখা।

ইসলামের দৃষ্টিতে থার্টি ফার্স্ট নাইট ও ১ জানুয়ারি (নববর্ষ) পালন

ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক (সা.)-এর প্রতি ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত, একমাত্র পরিপূর্ণ, সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত, নিয়ামতপূর্ণ, অপরিবর্তনীয় ও মনোনীত দীন। যা কিয়ামত পর্যন্ত বলবত থাকবে। যে প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক সূরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াত শরীফে বলেন,

اِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللّٰهِ الْاِسْلَامُ۫ ۰۰۱۹

‘নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহ পাকের কাছে একমাত্র দীন।’

আল্লাহ পাক সূরা আল-মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত শরীফে আরও ইরশাদ করেন,

اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِيْنًاؕ ۰۰۳

‘আজ আমি তোমাদের দীনকে (দীন ইসলামকে) কামিল বা পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত তামাম বা পূর্ণ করে দিলাম এবং আমি তোমাদের দীন ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট রইলাম।’

আল্লাহ পাক দীন ইসলামকে শুধুমাত্র পরিপূর্ণ সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ও নিয়ামতপূর্ণ করেই নাযিল করেননি সাথে সাথে দীন ইসলামকে মনোনীতও করেছেন। তাই দীন ইসলাম ব্যতীত অন্য সমস্ত ধর্ম যা ওহী দ্বারা নাযিল করা হয়েছিল যেমন, তাওরাত শরীফ, যাবূর শরীফ, ইনজীল শরীফ ও ১০০ খানা সহীফা এবং মানবরচিত মতবাদ যা পূর্বে ছিল এবং বর্তমানে যা রয়েছে ও ভবিষ্যতে যা হবে সেগুলোকে তিনি বাতিল ঘোষণা করেছেন।

হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ، أَنَّ عُمَرَ أَتَاهُ فَقَالَ: إِنَّا نَسْمَعُ أَحَادِيْثَ مِنَ الْيَهُوْدِ تُعْجِبُنَا أَفَتَرَىٰ أَنْ نَكْتُبَ بَعْضَهَا؟ فَقَالَ: ্রأَمُتَهَوِّكُوْنَ أَنْتُمْ كَمَا تَهَوَّكَتِ الْيَهُوْدُ والنَّصَارَىٰ؟ لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً، وَلَوْ كَانَ مُوْسَىٰ حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا اتِّبَاعِيْ

হযরত জাবির (রাযি.) হুযূর পাক (সা.)-এর হতে বর্ণনা করেন যে, একদিন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) হুযূর পাক (সা.)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (সা.)! আমরা ইহুদীদের থেকে তাদের কিছু ধর্মীয় কথা শুনে থাকি যাতে আমরা আশ্চর্যবোধ করি, এর কিছু আমরা লিখে রাখবো কি? হুযূর পাক (সা.) তিনি বললেন, ‘তোমরাও কি দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছ? যে রকম ইহুদী-নাসারারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে? অবশ্যই আমি তোমাদের নিকট পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিষ্কার দীন নিয়ে এসেছি। হযরত মুসা (আ.)ও যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তাহলে তাঁকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।’

থার্টি ফার্স্ট নাইট ও ১ জানুয়ারি পালনের ইতিহাস

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করে। ১ জানুয়ারি পালনের ইতিহাস ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার [খ্রিস্টানদের তথাকথিত ধর্মযাজক, দুশ্চরিত্র (যার বিয়েবহির্ভূত একটি সন্তান ছিল] পোপ গ্রেগরির নামানুসারে যে ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে। ইরানে নববর্ষ বা নওরোজ শুরু হয় পুরনো বছরের শেষ বুধবার এবং উৎসব চলতে থাকে নতুন বছরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত।

সাধারণভাবে প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জামশিদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে এ নওরোজের প্রবর্তন করেছিলেন এবং এ ধারাবাহিকতা এখনো পারস্য তথা ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব পালিত হয়। ইরান হতেই একটি সাধারণ সংস্কৃতির ধারা বহন করে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ এবং ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। মেসোপটেমিয়ায় এ নববর্ষ শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষূবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বর। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রিকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১ জানুয়ারিতে। ইহুদিদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথম দিন গোঁড়া ইহুদিদের মতে সেই মাসের দ্বিতীয় দিন। মোটামুটিভাবে তিসরি মাস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ, তারা ধারণা করতো, এদিন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশু খ্রিস্টের জন্মবার্তা জ্ঞাপন করে। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে।

বাদশাহ আকবরের ফরমান অনুযায়ী আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল চালু হয় ১০ মার্চ ১৫৬৩ সালে। ইংরেজ আমলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হলেও রাজস্ব আদায়ে ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা সাল তথা ফসলী সন বেশি ব্যবহার করা হতো।

বর্ষবরণের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুভূতি যোগটা সে শুরু থেকেই ছিলো বা বর্ষবরণকারীরা ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকেই তা করতো। অথবা বর্ষবরণকে তাদের বিশেষ ধর্মীয় আচার বলে বিশ্বাস করতো। মজুসি বা অগ্নিউপাসকরা এখনো বর্ষবরণকে সরকারিভাবেও ব্যাপক জাঁকজমকভাবে পালন করে থাকে। একে তারা তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে করে এবং একে নওরোজ বা নতুন দিন বলে অভিহিত করে।

ফসলী সনের নববর্ষ হিন্দুদের খাছ ধর্মীয় উৎসবের দিন। এর আগের দিন তাদের চৈত্র সংক্রান্তি। আর পহেলা বৈশাখ হলো ঘটপূজার দিন।

ইতিহাস পর্যালোচনায়

শরীয়তের ফায়সালা

হযরত ইমাম আবু হাফস কবীর (রহ.) বলেন, নওরোজ বা নববর্ষ উপলক্ষ্যে যদি কেউ একটা ডিমও দান করে তার ৫০ বছরের আমল থাকলে তা বরবাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ নওরোজ পালনের কারণে তার জিন্দেগির সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে।

আজকে অনেক মুসলমান থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করছে। ইংরেজি নববর্ষ, পালন করছে। আর এতে করে তারা বিজাতি ও বিধর্মীদের সাথেই মিল মিশ রাখছে। তাদেরই অনুসরণ অনুকরণ করছে।

কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

اِنَّ شَرَّ الدَّوَآبِّ عِنْدَ اللّٰهِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُوْنَۖۚ۰۰۵۵

‘নিশ্চয়ই সমস্ত প্রাণীর মাঝে আল্লাহর নিকট কাফিররাই নিকৃষ্ট, যারা ঈমান আনেনি।’

আর ইংরেজি নববর্ষ পালনের দ্বারা সে কাফিরদেরই অনুসরণ-অনুকরণ করা হয়।

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: ্রمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহ পাকের হাবীব হুযুর পাক (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।’

ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, সব নববর্ষের প্রবর্তকই বিধর্মীরা। তাই ইসলাম নববর্ষ পালনকে কখনোই উৎসাহিত করে না।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী থার্টি ফার্স্ট নাইট ও ১লা জানুয়ারি (নববর্ষ) পালনের বৈধতা

সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সে পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ইংরেজি ভাষাসহ বিভিন্ন উপজাতীয় ভাষার ঊর্ধ্বে যেমন রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা ও প্রাধান্য তেমনি সংবিধানের ২ নম্বর ধারায় বর্ণিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা স্বীকারের প্রেক্ষিতে অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীর উপরে ইসলাম ও মুসলমানের মর্যাদা ও প্রাধান্য স্বীকৃত হওয়া আবশ্যক এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও অনেক বেশি হওয়া কর্তব্য। যা মূলত প্রচলিত সংবিধানেরই ব্যাখ্যা।

মূলকথা হলো সংবিধানের ২ নম্বর ধারায় বর্ণিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর স্বীকারের প্রেক্ষিতে বিজাতীয় সংস্কৃতি থার্টি ফাস্ট নাইটসহ কোন ইসলাম বিরোধী কাজ গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশের সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে, সরকারিভাবে থার্টি ফাস্ট নাইটসহ সকল ইসলাম বিরোধী কাজ বন্ধ করে দেয়া এবং সরকারিভাবে থার্টি ফাস্ট নাইটসহ সকল ইসলাম বিরোধী কাজ থেকে মুসলমানদের বিরত রাখা অর্থাৎ মুসলমানদেরকে ইসলাম পালনে বা ইসলামের উপর ইস্তিকামত থাকার ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা।


সূত্র:

আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯

আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯

আল-কুরআন, সূরা আল-মায়িদা, ৫:৩

আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রাশাদ, রিয়াদ, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৩৪৭, হাদীস: ১৭৪

আল-কুরআন, সূরা আল-আনফাল, ৮:৫৫

আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ৪৪, হাদীস: ৪০৩১

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ