জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আসুন পড়তে শিখি

আসুন পড়তে শিখি

মাহফুয আহমদ

জীবনে ভালো কোনো কাজ করতে চাইলে, আরও স্পষ্ট করে বলি, জীবনে কিছু হতে চাইলে ভালো বই অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। প্রচুর পড়তে হবে। তথ্যজ্ঞান সমৃদ্ধ করতে হবে। বিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সে কাজ সবসময় জারি রাখতে হবে। পড়তে হবে এবং বারবার পড়তে হবে। আসুন পড়া সংক্রান্ত বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য জেনে নিই:

মনে থাকে না?

হুজুর! কিতাব তো অনেক পড়ি, কিন্তু মনে কিছু থাকে না? আচ্ছা! এই নাও খেজুর। এটা চিবিয়ে খাও। এবার বলো তো! তুমি কি বড় হয়ে গেছ? না। কিন্তু খেজুরটি তোমার সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। বিক্ষিপ্ত হয়েছে প্রত্যক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। সম্পূরক শক্তি হিসেবে মিশে গেছে হাড়, রগ, নখ, চুল, চামড়া, গোশত প্রতিটির সাথে।

ঠিক তেমনি! তুমি যে কিতাব পড়ো তাও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সেটা তোমার ভাষাকে শক্তিশালী, তথ্যজ্ঞানকে সমৃদ্ধ, চরিত্রকে পরিমার্জিত, বলা ও লেখার ভঙ্গিকে উন্নত করে দেয়। যদিও তুমি তা না বুঝো। (উস্তাদ-শাগরেদের কথোপকথন)

যুবকের প্রতি উপদেশ

আরব বিশ্বের সাড়াজাগানো লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. আবদুল কারিম বাক্কার হাফিযাহুল্লাহ তাঁর এক নিবন্ধে বলেন, ‘আজ আমার নিকট সচেতন ও মেধাবী একজন যুবক আসলো। নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে আমার সামনে তার ব্যক্তিগত কার্যপ্রণালী তুলে ধরলো। সে বললো, তার এই কার্যপ্রণালী সাতটি গতিপথের সমষ্টি। আমি ওকে বললাম, এভাবে জ্ঞান বিষয়ক এত বেশি টুকিটাকি থেকে তুমি উপকৃত হতে পারবে না। বরং উত্তম হলো, তুমি তোমার নির্ধারিত পড়ার সময় (ওই যুবক প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা অধ্যয়ন করে, মাশাআল্লাহ!) তিনভাগে বিভক্ত করে নিবে। ৫০% নির্দিষ্ট ওই বিষয়ের জন্যে; যার দ্বারা তুমি নিজ রিজক উপার্জন করবে অথবা যে বিষয়ে তুমি দক্ষতা, ব্যুৎপত্তি ও বিশেষত্ব অর্জন করতে চাও। ২৫% ধর্মীয় পড়াশোনার জন্যে এবং ২৫% সাধারণ জ্ঞানের জন্যে।

একই উপদেশ আমি আমার সকল ছেলেমেয়েকে করছি। ভালোমন্দ সবকিছু পড়ে জীবন নষ্ট করো না। তোমাদের প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট বিষয় থাকা চাই; যাতে সে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে নিজের যোগ্যতার বিকাশ ঘটাবে। কোনো বিষয়ে যদি তুমি প্রত্যহ আধা ঘণ্টা করে পড়ো তবে পাঁচ বছরে তুমি ওই বিষয়ের পণ্ডিত হয়ে উঠবে। অতএব খুব ভালো করে চিন্তা করো। আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করুন।’

হেঁটে হেঁটে বই পড়া

নাহু শাস্ত্রের প্রাজ্ঞ পণ্ডিত, ইমাম আহমাদ ইবনে ইয়াহইয়া; সা’লাব উপাধিতে প্রসিদ্ধ (জন্ম: ২০০ হি.- মৃত্যু: ২৯১ হি.) ছিলেন বই পাঠে খুবই আসক্ত, আগ্রহী। সবসময় বই পড়তে থাকতেন। এমনকি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ও। ইতিহাসবেত্তাগণ তাঁর মৃত্যুর ঘটনা এভাবে লেখেছেন যে, জুমুআর দিন সালাতুল আসর আদায় করে বই পড়ে পড়ে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। শেষবয়সে তাঁর শ্রবণশক্তি কিছুটা লোপ পেয়েছিল; যার কারণে সবকিছু শোনতে পেতেন না। তো পথিমধ্যে একটি ঘোড়া ধাক্কা দিয়ে তাঁকে রাস্তার পাশের একটি গর্তে ফেলে দিল। সেখান থেকে বেহুঁশ অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করা হলো। এভাবে বেহুঁশই রইলেন। অবশেষে দ্বিতীয় দিন আপন মাওলার সান্নিধ্যে পাড়ি জমালেন।

আল্লাহ তাআলা যেন তাঁর ওপর অশেষ রহমত নাজিল করেন এবং তাঁর সকল সৎকর্ম কবুল করেন। আমিন। (দেখুন, ওফায়াতুল আয়ান; ইবনে খাল্লিকান, ১/১০৪, দারু সাদির, বৈরুত, ১৩৯৮ হি./১৯৭৮ খ্রি। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.)ও তাঁর সম্পর্কে তদীয় কিমাতুয যামান-এ আলোচনা করেছেন।)

ভালো বই

ড. আবদুল কারিম বাক্কার হাফিযাহুল্লাহ তাঁর বিনাউল আজইয়াল বইয়ে খুব সুন্দর একটি কথা বলেছেন। তিনি লেখেন, ‘ভালো লেখকগণ সবসময় ভালো লেখেন না।আর বইয়ের দোকানগুলোতে কখনও এমন ভালো বই পাওয়া যায়; যার লেখক প্রখ্যাত নন।’

এক হাদীস পাঁচশত বার!

হাদীস সংরক্ষণে এ উম্মাহর পূর্বসূরিগণ কী পরিমাণ শ্রম বিসর্জন দিয়েছেন, কেমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং কীভাবে এই মহান আমানত সংরক্ষণ এবং পরবর্তীদের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছাতে সচেষ্ট ও সক্ষম হয়েছিলেন- এসব বুঝতে নিম্নে উদ্ধৃত এই তিনটি বর্ণনা একবার পড়ে দেখুন!

১. হাফিয ইবনে হাজার (রহ.)-এর তাহযিবুত তাহযীব (১/৬৭) গ্রন্থে এসেছে, মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনুল ফুরাত ইবনে খালিদ আয-যাব্বী আবু মাসউদ আর-রাযী (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি প্রতিটা হাদীস পাঁচশত বার করে পুনঃপুন পাঠ করতেন।

২. হাফিয মিযযী (রহ.)-এর তাহযীবুল কামাল (১/৪২৪) গ্রন্থে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি আবু মাসউদ আহমাদ ইবনুল ফুরাত (রহ.)-কে বলল, আমি তো হাদীস ভুলে যাই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কে এমন আছে, যে এক একটি হাদীস পাঁচশত বার করে পাঠ করে? লোকটি বলল, এটা আবার কে পারবে? তিনি বললেন, এজন্যই তোমরা হাদীস মুখস্থ করতে পার না!

৩. হাফিয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহ.)-এর সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (১১/৮৪) গ্রন্থে এসেছে, আব্বাস আদ দুওরি বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রাহ. কে আমি বলতে শুনেছি যে, এক একটা হাদীস যদি আমরা পাঁচশত বার করে না লিখতাম, তবে আমরা হাদীসসমূহ বুঝতে এবং সংরক্ষণ করতে পারতাম না।

একটু চিন্তার খোরাক

ফিকহে শাফিঈর প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, ইমাম আবু ইসহাক আশ শিরাজী (রহ.) (মৃ. ৪৭৬ হি.) নিজের শিক্ষাজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমি প্রত্যেকটি কিয়াস বা ফিকহি মাসয়ালা এক হাজার বার রিপিট (তাকরার) করতাম। এক হাজার বার পূর্ণ করে ভিন্ন মাসয়ালার প্রতি একই পদ্ধতিতে মনোযোগী হতাম। অনুরূপভাবে আমি প্রতিটি দারস বা পাঠ এক হাজার বার রিপিট করতাম। মাসয়ালায় যদি এমন কোনো দীর্ঘ কবিতা থাকতো; যার মাত্র একটি শ্লোক এখানে প্রতিপাদ্য- তথাপি আমি পুরো লম্বা কবিতাটি মুখস্থ করে ফেলতাম। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা; যাহাবী, ১৮/৪৫৮) আমি-আপনি হয়তো এমন কঠোর পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত নই, আমাদের হয়তো এমন সাধ, সাধ্য ও সাহস নেই- তদুপরি আমাদের পূণ্যবান পূর্বসূরিদের জীবনচরিত থেকে এজাতীয় বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার। যাতে করে এই ইলম আমাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে সালাফে সালিহিন কী অসাধ্য সাধন করেছেন, কত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন, সেটা আমরা জানি এবং মনে রাখি। এসব জানার আরেকটি বড় ফায়দা এই যে, নিজেদের জ্ঞানের পরিধিকে তাঁদের জ্ঞানসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করার দুঃসাহস যেন আমরা না দেখাই।

লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ