বই, ভাষা ও শিক্ষা: টুকরো কিছু ভাবনা
মাহফুয আহমদ
এক. আল-কুরআন:
কোরআন কোনো সাধারণ বই নয়। তেমনি কোরআন ফিকহ বা মাসয়ালা-মাসায়েলের প্রচলিত ধারার কোনো গ্রন্থও নয়। কোরআন চিন্তা করতে শিখায়। কোরআন হৃদয় ও আত্মাকে পবিত্র ও শাণিত করে। দেখুন, কোরআন ধারাবাহিকভাবে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত ইত্যাদি বিধি-বিধানের কোনো ব্যাখ্যা ও বর্ণনা পেশ করে নি। বরং কোরআন বিভিন্ন উপায়ে মানবাত্মাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করতে শিখিয়েছে। মনিবের দাসত্ব স্বীকার করে নিলে তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান পালনে আর কোনো কিছু প্রতিবন্ধক হতে পারবে না। এটাই কোরআনের মহান এক শিক্ষা।
দুই. বই পাঠের উপকারিতা:
সর্বশেষ কখন আপনি কোনো বই কিংবা সারগর্ভ কোনো প্রবন্ধ পড়েছিলেন? আপনার দৈনন্দিন পাঠাভ্যাস কি শুধু টুইটারের টুইট এবং ফেইসবুকের পোস্ট কেন্দ্রিক? আপনি যদি ওইসব অসংখ্য মানুষের একজন হয়ে থাকেন, যাদের নিয়মিত কোনো পাঠাভ্যাস নেই- তাহলে আপনি অনেককিছু হাতছাড়া করছেন! আপনি কি জানেন, নিয়মিত পাঠের রয়েছে বেশ কিছু উপকারী দিক। যেমনÑ
১. মানসিক উদ্দীপনা,
২. মানসিক চাপ লঘুকরণ,
৩. জ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়া,
৪. শব্দভাণ্ডার সম্প্রসারণ,
৫. স্মৃতিশক্তির উৎকর্ষসাধন,
৬. চিন্তাশক্তির উন্নতকরণ,
৭. মনোযোগ বৃদ্ধিকরণ,
৮. ভালো লেখালেখির যোগ্যতা অর্জন,
৯. প্রশান্তি লাভ ও
১০. ফ্রি বিনোদন।
তিন. অবসরে বই পড়ুন:
সবসময় ভালো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করুন। অবসর থাকা ভালো নয়। নির্ধারিত দায়িত্ব শেষ হলে পড়তে বসুন। ভালো বই পড়লে ভালো মানুষ হওয়ার প্রেরণা জাগবে। বই পড়তে মন চাচ্ছে না তো অন্য কোনো ভালো কাজ করুন। নতুন কোনো কাজ শিখতে চেষ্টা করুন। নতুন নতুন বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে সচেষ্ট হোন।
মোটকথা সময়টাকে কাজে লাগান। নিজের জন্য, পরিবার, দেশ ও জাতির জন্য কিছু রেখে যান। আপনার মৃত্যুর পর আপনার করে যাওয়া ভালো কাজগুলোই মানুষ স্মরণ করবে এবং সেগুলো আপনার পরকালে কাজে লাগবে।
চার. সব বই পড়া উচিত নয়:
সবার জন্য সব বই পড়া উচিত নয়। বিশেষত অপরিপক্ব লোকদের জন্য ভ্রান্তদের লেখা বই পড়া মোটেই সমীচীন নয়। ইসলামের প্রথম দিকে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট কিতাবধারীদের (ইহুদি ও খ্রিস্টানদের) বই পড়ার অনুমিত চাইলে নবীজি তাঁদের নিষেধ করলেন। কেননা তখন তাঁরা ছিলেন নওমুসলিম। অতঃপর যখন তাঁদের হৃদয় ও আত্মায় ঈমানের শক্ত অবস্থান গড়ে উঠলো এবং সত্য-মিথ্যার মাঝখানে পার্থক্য নিরূপণে যোগ্যতা অর্জিত হলো তখন নবীজি বলে দিলেন, এখন তোমরা ওদের বই পড়তে পারো; অসুবিধা নেই।
সুতরাং আমাদের নবীন, তরুণ ও উদীয়মানদের আপাতত শুধু হকপন্থীদের বইগুলো পড়া উচিত। ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের বই, চাই তা হোক ভুল শুধরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে পাঠ করা সুখকর হবে বলে মনে হয় না। পরিণত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পর সত্য প্রকাশ এবং ভ্রান্তি খণ্ডনের স্বার্থে পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে ওদের বইও দেখা যেতে পারে।
এখানে ভ্রান্তি শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। বই পড়া একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। বস্তুত ওদের বই পাঠ, বক্তব্য শোনা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওদের লেখা পড়া, ওদের সঙ্গে সখ্যতা (!) গড়ে তুলা সবগুলোই একই ক্যাটাগরিতে পড়ে বলে আমি মনে করি।
পাঁচ. বইপাঠ এবং
একটি নতুন চিন্তা:
পশ্চিমা দুনিয়ায় এমন বহু সংস্থা ও সংগঠন রয়েছে যেগুলো রকমারি পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে ছেলেমেয়েদের বই পাঠে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। তেমনি একটি সংস্থা হলো ‘রিডিং এহেড’। মূলত স্কুল-কলেজ ইত্যাদি শিক্ষপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরকে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করাই এর মূল টার্গেট। তারা একজন শিক্ষার্থীকে একটি রিডিং ডায়েরি প্রদান করবে। শিক্ষার্থী মোট ৬ বই নির্ধারিত মেয়াদের ভেতর পড়ে শেষ করবে। বই যেকোনো বিষয়ের এবং যেকোনো সাইজের হতে পারে। একেকটি বই পড়ে শেষ করার পর ডায়েরির নির্দিষ্ট পাতায় বইয়ের নাম, লেখকের নাম এবং বই সম্পর্কে শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়ন ও পাঠ অনুভূতি লেখতে হবে। প্রতি ২টি বই শেষ করার পর ওরা একটি প্রাইজ দিবে যেমন- কলম, নোটবুক, ব্যাগ ইত্যাদি। আর পুরো ৬টি বই শেষ করার পর ওরা শিক্ষার্থীকে একটি সার্টিফিকেট দেবে এবং সঙ্গে ভিন্ন একটি পুরস্কার প্রদান করবে। মোটামুটি এই হলো রিডিং এহেড সংস্থার কার্যক্রম।
আমরাও কি এভাবে নতুন কিছুর চিন্তা করতে পারি?
ইসলাম শিক্ষাকে যে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়েছে মানব ইতিহাসে অন্য কোনো ধর্ম ও মতবাদ সেই পরিমাণ গুরুত্ব দেয় নি। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ওহি নাজিলের ধারা শুরু হয় ‘পড়ো’ ঐশী নির্দেশের মাধ্যমে। নবীজি মুসলমান শিশুদের কিছু শেখাবেন- এই শর্তে মুক্তিপণ ছাড়াই যুদ্ধবন্দীদের জীবিত ছেড়ে দিয়ে ছিলেন। এছাড়াও আরও বহু নজির রয়েছে।
কিন্তু আজ আমরা শিক্ষার প্রতি কতটুকু মনোযোগী? ইসলামের দেখানো পথ ব্যবহার করে অন্যরা তাদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। বিভিন্ন উপায়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দিকে অনুপ্রাণিত করছে।
ছয়. স্ক্রিনে চোখ কম রাখুন:
পুরো ইউকের ফেইসবুকের বস যে ব্যক্তি তার বক্তব্য হলো, আমার ঘরে একটি ওল্ডফ্যাশনড এলার্ম ঘড়ি আছে। সন্তানদের বিছানায় যেতে মোবাইল সঙ্গে রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা বাহানা খোঁজে। বলে, আমরা সকালে উঠার জন্য এলার্ম দিতে হয়। মোবাইল ব্যবহারের সেই বাহানার পথ বন্ধ করতেই এই পুরাতন এলার্ম ঘড়িটি রেখেছি। কেননা বিছানায় যাওয়ার সময় স্ক্রিনে চোখ রাখা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমি চাই তারা স্ক্রিনে চোখ কম রাখুক এবং বেশি বই পড়ুক! ইউকে ফেইসবুকের বস নিকোলা মেনডেলসন গোটা ইউকের মধ্যে টেকনোলজির ক্ষেত্রে সবচেয়ে পাওয়ারফুল নারী। (সূত্র: ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, ১৩/১১/১৭)
সাত. শিশুদের পাঠ
মনস্ক করে তুলুন:
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু পড়তে ভালোবাসে এবং বই পড়ায় প্রচুর সময় ব্যয় করে, তাদের পড়া, লেখা, কথাবলা ও সাধারণ জ্ঞান- এসবের যোগ্যতা অন্যদের চেয়ে বেশি থাকে।
তো ঘরে শিশুদের কীভাবে পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে গড়ে তুলবেন এসংক্রান্ত কিছু পরামর্শ এখানে পেশ করা হলো:
১. প্রথমে এটা নিশ্চিত করুন যে, শিশুরা আপনাকেও পড়তে দেখে। আপনি কী পড়ছেন সেটা মুখ্য নয়, কী পরিমাণ পড়ছেন সেটাই দেখার বিষয়। আপনি চাই কোনো বই পড়ুন, না হয় কোনো দৈনিক বা মাসিক পত্রিকা অথবা ভিন্ন কিছু।
২. শিশুদের পড়ার সঙ্গে জড়িত করুন। সেটা হতে পারে বিভিন্ন উপায়ে। নিতান্ত আপনার বাজারখরচের লিস্টটি তাদের হাতে দিয়ে বলুন, এটি তুমি উচ্চস্বরে পড়ো অথবা অন্য কিছু।
৩. বিভিন্ন উপলক্ষে শিশুদের বই উপহার দিন। অন্য যারা আপনার শিশুদের উপহার দেয় তাদেরকেও বই উপহার দিতে বলুন।
৪. শিশুদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় লাইব্রেরিগুলো ঘুরতে যান। নতুন নতুন বই দেখার এবং পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহী করে তুলুন।
৫. সবসময় কোনো বই সঙ্গে রাখতে শিশুদের উৎসাহ দিন। দীর্ঘ ভ্রমণে তারা বই পড়ে সময় কাটাতে পারে এবং আপনিও তাই করুন।
৬. আপনার আশপাশে কোথাও বইমেলা হলে অথবা কোনো প্রসিদ্ধ লেখক আসলে আপনার শিশুদের তার সঙ্গে সাক্ষাত করিয়ে দিন। শিশুরা প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সান্নিধ্য পছন্দ করবে। ফলশ্রুতিতে বই পাঠের প্রতি তারা উদ্বুদ্ধ হবে।
৭. সর্বোপরি নিজ ঘরে একটি ঘরোয়া লাইব্রেরি গড়ে তুলুন।
আট. ভাষা শিখুন:
একাধিক ভাষা জানতে চেষ্টা করুন। ভাষা আল্লাহ তায়ালার এক বড় নেয়ামত। ভাষার ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য মহান আল্লাহর নিদর্শনাদির অন্যতম। মাতৃভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষা শেখার বিবিধ ফায়দা রয়েছে। একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে যেসব মানুষ বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করেন- তাদের ব্রেইন তুলনামূলক বেশি সুস্থ ও সচল থাকে। এ তো মাত্র একটি ফায়দা।
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘আর রাসূলুল মুয়াল্লিম ওয়া আসালিবুহু ফিত তালিম’ বইয়ে বহু ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা বিষয়ক শায়খ সফি উদ্দিন হিল্লি রাহিমাহুল্লাহর চমৎকার একটি আরবি শ্লোক উল্লেখ করেছেন:
بقدر لغات الـمرء يكثر نفعه
وتلك له عند الشدائد أعوان
فبادر إلى حفظ اللغات مسارعًا
فكل لسان بالـحقيقة إنسان
আরবি জানেন এমন ভাইয়েরা এটা পড়ে অনুপ্রাণিত না হয়ে পারবেন না। শ্লোকটির মোটামুটি ভাবার্থ হলো এই যে, মানুষ যত বেশি ভাষায় পারদর্শী হবে তার উপকারিতা তত বৃদ্ধি পাবে। সংকটপূর্ণ মুহূর্তে এইসব ভাষা তার সহযোগী সাব্যস্ত হবে। সুতরাং দ্রুত ভাষা শিখতে উদ্যোগী হোন। প্রকৃতার্থে একেকটি ভাষা আলাদা একজন মানুষের ন্যায় কাজে লাগে।
নয়. শিক্ষকতা:
শিক্ষকতা করতে ভালোবাসুন! ছাত্রদের পেছনে শ্রম দিয়ে ক্লান্তি বোধ করলেও দিনশেষে হৃদয়ে ভিন্নরকম প্রশান্তি অনুভব করবেন। অফিসে বসে সারাদিন নির্দিষ্ট কিছু সহকর্মীর মুখ দেখে দেখে আর কম্পিউটারের স্ক্রিন দেখে দেখে বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষকতা মানেই নতুন কিছু শিখা এবং নতুন কিছু শিখানো। কিছু মানুষের জীবন পরিবর্তনে, জীবনের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক হিসেবে আপনিও অসামান্য ভূমিকা রাখছেন এমন অনুভূতির স্বাদ ও শান্তি এককথায় তুলনাহীন। একজন আদর্শ শিক্ষক একটি আদর্শ সমাজ গড়ার কারিগর।
দশ. শিক্ষকদের বেশি পড়তে হয়:
ছাত্রদের থেকে শিক্ষকদের বেশি পড়াশোনা করতে হয়। কেননা ছাত্ররা প্রতিনিয়ত শিক্ষক থেকে নতুন কিছু শুনতে ও শিখতে থাকে। এখন শিক্ষক যদি নিয়মিত তাঁর জ্ঞানের পরিধি নবায়ন না করেন এবং তথ্যজ্ঞানের আপডেট না করে থাকেন তবে ছাত্ররা নতুন কিছু শুনতে ও জানতে পাবে না। ফলে বাধ্য হয়েই শিক্ষক একই কথা, একই তথ্য এবং একইরকম উপস্থাপনা বারবার পেশ করবেন। এতে করে ছাত্ররা ওই শিক্ষকের প্রতি, মানে তাঁর ক্লাসের প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ হারাতে বসবে।
এজন্য বলা হয়, ভালো ছাত্রদের কারণে একজন ভালো মানের সফল শিক্ষক গড়ে উঠেন। ইমাম তিরমিযি রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর শায়খ ইমাম বোখারি রাহিমাহুল্লাহর উক্তি; ‘তুমি আমার থেকে যে পরিমাণ উপকৃত হয়েছ, আমি তোমার থেকে এরচেয়ে অধিক উপকার লাভ করেছি’- এ বক্তব্যের একটি দৃষ্টান্ত। এজাতীয় দৃষ্টান্ত ইসলামী শিক্ষার ইতিহাসে প্রচুর পাওয়া যায়।