আরবি কবিতায় রুচিবোধ ও রূপমাধুরী
রাফিক হারিরি
ঠিক কখন থেকে আরবি কবিতার সূচনা হয়েছে এবং সূত্রপাত ঘটেছে, এর শুরুর ইতিহাস কী, তা ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক-গবেষকদের কাছে আজও অজানা। পঞ্চম শতাব্দীকেই আরবি কবিতার সূচনাকাল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। কারণ এ শতাব্দীর পূর্বের কোনো আরবি কবিতার নির্দশন তাঁরা পাননি।
আরবি ভাষার ইতিহাসবিদ ও সমালোচকেরা মনে করেন, আরবি সাজা বা ছন্দবদ্ধ গদ্য হতে আরবি কবিতার উদ্ভব হয়েছিল। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এ সাজা বা ছন্দবদ্ধ গদ্য রাজাজ বা অন্ত্যমিলের পঙ্ক্তিতে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে আরবি কবিতায় রূপ নেয়।
জাহেলি যুগ বা প্রাক আরব কবিতা ছিল বেদুইন-জীবনের সুখ-দুঃখের প্রতিচ্ছবি। সকালের মৃদু হাওয়ার মতো বেদুইনেরা ভেসে বেড়াত মরুভূমির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কবি তাব্বাত শারার কয়েকটি লাইনে তার চিত্র ফুটে উঠেছে,
আসুক যত বিপদ ঝঞ্ঝা অভিযোগ নেই তার,
বাসনার ঝোলাগুলো পূর্ণ করতেই হবে
সঙ্গীহীন জীবনমরুর এক প্রান্তে কাটে সকালে
সন্ধ্যায় চলে যায় অন্য কোথাও
বায়ুর গতির চেয়ে গতি বেশ তার
ছুটে চলে নিজের গন্তব্যে…।
মরুবাসী, যাযাবর, বেদুইনদের মনে আনন্দের ভাব তৈরি হলে বা কোনো উতসবের সূচনা ঘটলে তারা মনের সুখে এসব ছন্দবদ্ধ বাক্য আবৃত্তি করত। বেদুইনরা বিভিন্ন মরুভূমিতে উট চরাত। উট চরাতে চরাতে যখন উটের গতি থেমে আসত, তখন উটকে দ্রুত চালনার জন্য চালকেরা মধুর সুরে গান ধরত। মরুভূমিতে উটের চলার তালে তালে চালকেরা যে গান গাইত, সেটা আল-হিদা নামে পরিচিত ছিল। আল-হিদা গান হতেই আরবি ছন্দের উতপত্তি ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।
আরবদের মধ্যে কবিতার প্রতি অনুরাগ ছিল খুব বেশি। তারা কবিদের আল্লাহর রহমত ও বিশেষ উপহার হিসেবে মনে করত। অনেকেই আবার কবিকে অতিপ্রাকৃতিক শয়তানি ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করে তাকে বিশেষ ভাবে সম্মান করত। কোনো গোত্রে কবি জন্মগ্রহণ করলে সেই গোত্রকে ভিন্নরকম সন্মান দেওয়া হতো। কারণ তারা মনে করত, কবিরা হলো গোত্রীয় মর্যাদার রক্ষা কবচ। কবিরা বিভিন্ন মজলিশে ছন্দোবদ্ধ কবিতা আবৃতি করে যেভাবে লোকজনকে আমোদ দিত একই ভাবে যুদ্ধের ময়দানে শব্দের ঝংকার দিয়ে যোদ্ধাদের সাহস জোগাত। আরবরা কবিদের কথাকে খুব ভয় পেত। কারণ, তাঁদের কাছে তরবারির আঘাতে তৈরি ক্ষতের চেয়ে মুখের কথা দিয়ে তৈরি ক্ষত বেশি বেদনাদায়ক ছিল।
আরবি ভাষায় সর্বপ্রথম কে কবিতা রচনা করেছিলেন, তাঁর সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আরবি সাহিত্যের ভান্ডারে জাহেলি যুগের যে বিশাল কাব্যসম্ভার সংরক্ষিত আছে, সেগুলো উন্নত ও মার্জিত। কবিতা শুরুর দিকের কোনো ছাপ তাতে নেই। ফলে সেগুলো প্রথম কবিতা হওয়ার সুযোগ কম। এই কবিতাগুলো বেশিরভাগই রচিত হয়েছিল ষষ্ঠ শতাব্দীতে। এর পূর্বের আরবদের কবিতাসংখ্যা খুব কম।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ইমরুল কায়েসই আরবি ভাষায় প্রথম কবি। অনেকে অবশ্য এই মতের বিরোধিতা করেছেন। অনেকে প্রথম দিকের কবি হিসেবে ইমরুল কায়েস, জুহায়ের ইবনে আবি সুলমা ও আনতারার নাম উল্লেখ করেছেন।
প্রাক আরব বা জাহেলি যুগের আরবি কবিতা ছিল মূলত গীতিকবিতা বা লিরিক ধরনের, আরবিতে যাকে বলে ‘শিরুল গিনাই। সে যুগের কবিরা বীরত্বগাথা, গর্ব, প্রশংসা, ব্যঙ্গ, প্রেম-প্রকৃতির বর্ণনা, ক্ষমা প্রার্থনা, তিরস্কার, শোকগাথা প্রভৃতি বীণা নামের বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলে গাইতেন। এই কবিতাগুলো জাহেলি যুগে গীতিকাব্য হিসেবে পরিচিত ছিল। আরবি গীতিকাব্যের সাথে যেসব বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে মিজহার, দাফ, সনজ, বারবাত ইত্যাদি।
প্রাচীন এই আরবি গীতিকাব্যগুলো দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। প্রথমত, কিতআ বা খণ্ডকবিতা এবং দ্বিতীয়ত, কাসিদা বা দীর্ঘকবিতা।
কিতআ বা খণ্ডকবিতায় কবিগণ একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে ধারণ করে নাতিদীর্ঘ কবিতা রচনা করতেন। এ ধরনের কবিতার বয়াত বা পঙ্ক্তি কখনোই ২৫ পঙ্ক্তির বেশি হতো না। নিজের অথবা নিজ গোত্রের বীরত্ব, বদান্যতা, আতিথেয়তা, মৃত ব্যক্তির শৌর্য-বীর্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির বর্ণনা, কারও বিরুদ্ধে কুতসা করা ইত্যাদি বিষয়ের নির্দিষ্ট কোনো একটিকে উপজীব্য করে এ সকল কিতআ বা খণ্ডকবিতা রচনা করা হতো।
কাসিদা বা দীর্ঘকবিতাগুলো ছিল বেশ দীর্ঘ। এই ধরনের কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধরনের ছন্দ সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হতো। কবির নিজস্ব ভাবধারা, ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য এ জাতীয় কবিতায় অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করা হতো। এই সকল দীর্ঘ কবিতায় সাধারণত ২৫ থেকে ১০০ পর্যন্ত বায়াত বা শ্লোক থাকে। ২৫টির কম হলে সেটাকে বলা হতো কিতআ বা খণ্ডকবিতা।
জাহেলি বা প্রাক আরব যুগে আরবদের মধ্যে কবিতার প্রতিযোগিতা নিয়ে বাহাস হতো। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানে কবিরা তাঁদের কবিতা নিয়ে একত্র হতেন। সেখানে বিচারকেরা থাকতেন। তাঁরা শ্রেষ্ঠ কবিতা বাছাই করার কাজটা করতেন। এই ধরনের কবিতা-প্রতিযোগিতার জন্য সেরা জায়গা ছিল উকাজের মেলা। উকাজের মেলাতেই সবচেয়ে বড় সাহিত্যসন্মেলন ঘটত। সেই সাহিত্যসভায় কবিতা-প্রতিযোগিতায় যাঁর কবিতা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো, তাঁর কবিতাগুলোকে বহুলপ্রচারের জন্য কাবাঘরের গিলাফের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো। উকাজ মেলার এই সাহিত্যসভায় কবিতা-প্রতিযোগিতায় মূল বিচারকের ভূমিকায় থাকতেন কবি নাবিগা জুবিয়ানি। কথিত আছে, উকাজ মেলার কাব্যপ্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে দামি মিসরীয় কাপড়ে সোনালি অক্ষরে লিখে কাবাঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এই কবিতাগুলোকে তাই মুয়াল্লাকাত বা ঝুলন্ত কবিতা বলা হতো। এ মুয়াল্লাকাত বা ঝুলন্ত কবিতার মধ্যে কবি ইমরুল কায়েসের কবিতা, জুহায়ের ইবনে আবু সুলমা, আনতারা ইবনে শাদ্দাদসহ আরও বিখ্যাত কবিদের কবিতা ছিল।
জাহেলি যুগের এসব কবিতায় খুব সাবলীলভাবেই নারীপ্রেম, নগ্নতা, বীরত্বগাথা, আত্ম-অহংবোধ, গোত্রপ্রীতি প্রকাশ পেয়েছে। কবি ইমরুল কায়েস তাঁর কবিতায় বলেছেন,
(তুমি শুনলে না। এ তো তোমার অহংকার! তুমি তো জানো না)
তোমার মতো অনেক কুমারী, গর্ভবতী, দুগ্ধবতী সুন্দরীদের আমি
ভোগ করেছি রাতের আঁধারে।
আমার ছোঁয়ায় সে
ভুলে গিয়েছিল তার কোলের শিশুর কথা
কোলের শিশু কেঁদে উঠলে আধেক বুক তার পেতে দিত শিশুর কাছে
বাকিটা থাকত আমার নিচে থরহরি কম্পমান।
আরেক বীর কবি আন্তারা ইবনে শাদ্দাদ নিজের বীরত্বের কথা বলেছেন এভাবে,
তুমি যদি আমার থেকে
পর্দার আড়ালেই থাকো, তাতে কী
জেনে রাখো, বর্ম পরা যোদ্ধাদের হত্যা করতে আমার চেয়ে
দক্ষ তুমি আর কাউকেই পাবে না।
আমার বিষয়ে যা জেনেছ বলে যাও
আমাকে যখন কেউ না ঘাটায় তখন আমি সুবোধ বালক
অথচ কেউ যদি আমাকে বিরক্ত করে
তখন আমার প্রতিবাদ আলকাম ফলের মতো তিতা আর কাঁটাযুক্ত।
৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের আবির্ভাবের পর আরবি কবিতায় বেশ ভালো একটা ধাক্কা টের পাওয়া গেল। বিষয়-প্রকারে, শব্দব্যবহারে আরবি কবিতার নতুন বিপ্লবের শুরু হলো ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে। কবিতার নগ্নতার বিষয়টা সামগ্রিকভাবে কিছুটা হালকা হয়ে এল। ইসলামের প্রভাবে কবিতায় রাসুলের স্বস্তিকা কিংবা খোদার প্রশংসায় কবিতায় রচনা হলো। তাই বলে প্রেম, গাথা কিংবা বীরত্বগাথা নিয়ে কবিতারচনা মোটেও বন্ধ ছিল না। বরং ইসলামের আবির্ভাবের পর আরবি কবিতায় এমন সব নতুন নতুন শব্দ আর পরিভাষা ব্যবহূত হতে লাগল, যা ইতিপূর্বে আরবি কবিতায় একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। এই সময়ের কবিতায় কোরআনের প্রাঞ্জল ভাষার প্রভাব ছিল খুব বেশি। এই সময়ের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে হাসসান বিন সাবিত, কাব বিন জুহায়ের, আমর ইবনে মাদি কারিবের নাম উল্লেখযোগ্য।
৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়টাকে ধরা হয় উমাইয়া যুগ হিসেবে। এ যুগেও আরবি কবিতার গতি থেমে ছিল না। অসংখ্য কবির আর্বিভাব ঘটেছিল এই সময়ে। তবে এই সময়ের কবিরাও তাদের পূর্বসূরিদের কবিতার বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেননি। তার পরও এ সময়ের আরবি কবিতায় নাকাইদ বা প্যারোডি কবিতা ও খামারিয়াত বা শরাবের বর্ণনামূলক কবিতার মতো কিছুটা নতুন ধারার কবিতা দেখা যায়। কবি দ্বিতীয় ওয়ালিদ, যিনি সবসময় মদের পাত্র হাতে নিয়ে থাকতেন, তিনি মদের প্রশংসায় লিখেছেন,
‘এক গ্রাম্য মহিলা একদিন আমাদেরকে শরাব উপহার দিয়েছিল
খুব ভালো ছিল
শরাবপাত্রের মুখ ছিল ছিপি দিয়ে আঁটা
মদপাত্র হাতে নেওয়ার পর যে সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল
সর্দির রোগীও অনায়াসে শরাবের সেই ঘ্রাণ পেয়ে যাবে।
নাকাইদ বা প্যারোডি কবিতা ছিল দুজন কবির মধ্যে কবিতার যুদ্ধ, একই ছন্দে একজন কবি আরেকজন কবিকে তীব্র কিন্তু শালীন ভাষায় গালমন্দ করে কুপোকাত করা। এই কবিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল লোকজনকে বিনোদন দেওয়া। এই জাতীয় কবিতায় কবি জারির আর ফারজদাকের কবি জুটি সবচেয়ে আলোচিত। উমাইয়া যুগের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে উমর ইবনে আবি রাবিআ, আখতাল, ফারাজদাক ও জারির উল্লেখযোগ্য।
৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় আব্বাসি যুগ। এই যুগকে মনে করা হয় আরবি কবিতার স্বর্ণযুগ। এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের হাতে বাগদাদের পতন পর্যন্ত।
আব্বাসি আমলে এসে আরবি কবিতার পরিবেশ ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটল। বিদেশি সভ্যতা, সংস্কৃতির স্পর্শে কবিদের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটে। আগের তিনটি আমলের কবিতায় বেদুইনজীবনের একঘেয়ে চিত্রকে কবিরা পাশ কেটে দরবারমুখী হলেন। কবিতায় আরব জাতীয়তা তথা বেদুইন জীবনবোধের চেয়ে আন্তর্জাতিক অনুভব আর বিলাসিতাই প্রাধান্য পেল। কবিতার উপস্থাপনে দেখা দিল নতুনত্ব। কাব্য সমালোচকেরাও কবিতার নতুন এই রূপকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করলেন। কবিতায় ইসলামি জীবনদর্শনের সাথে সাথে বস্তুবাদী দর্শনেরও ঠাঁই হলো। জীবন ও জগত সম্পর্কে বিচিত্র ধ্যান-ধারণা কাব্যের বিষয় ও পরিধিকে বৈচিত্রপূর্ণ করে তুলল।
অন্ধ কবি আবুল আলা মাআরীর কবিতায় এমনটা দেখা যায়,
কান্নার বিচিত্র সুর অথবা পাখির সুমধুর কলতান
আমার বুকের শক্ত পাথরকে পারে না সরাতে
মৃত্যুদূতের শীতল আহ্বান কিংবা হাস্যোজ্জ্বল মানুষের কণ্ঠস্বর
দুটোতে কোনো তফাত নেই
গাছের উঁচু ডালে যখন একজোড়া পায়রা বসে
আনন্দের হিল্লোল তোলে কিংবা করুণ স্বরে গান গায়
দুটোই কেন আমার কাছে এক মনে হয়?
এই সময়ের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে ছিলেন আবু নুওয়াস, আবুল আতাহিয়া, মুতানব্বি, আবুল আলা মাআরি বাশশার ইবনে বুরদ, আবুল আতাহিয়া প্রমুখ।
আব্বাসি আমলের পর বাগদাদ পতন পর্যন্ত সময়টাকে আরবি কবিতার ইতিহাসে বলা হয় অন্ধকার যুগ। এ সময়টাতে আরবি কবিতায়, গদ্যে কোনো ধরনের নতুন কিছুরই নির্দশন দেখা যায় না। প্রাচীন ধারা অনুসরণ করেই কবিগণ শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছিলেন এ সময়ে।
আরবি কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে চমকপ্রদ আর ঐতিহাসিক বিপ্লব শুরু হয় ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বীর নেপোলিয়ান বেনাপোর্টের মিসর আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরবি সাহিত্যের ইতিহাসকে ধরা হয় আধুনিক আরবি সাহিত্যের যুগ হিসেবে। রাষ্ট্রীয় বিপ্লব যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আধুনিক আরবি সাহিত্যে। আরবি কাব্যের প্রাচীন যুগ থেকে যে গতানুগতিক ধারা চলে আসছিল, তার আকস্মিক পরিবর্তন দেখা যায় ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ানের মিসর অভিযানের ফলে। মিসর অভিযানের সময় নেপোলিয়ান যে সমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে এসেছিলেন, তাদের প্রভাব আরবি সাহিত্যে উন্নয়নের গতি বইয়ে দিয়েছিল।
সেই গতির পরিপূর্ণতা লাভ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে। এই সময়টাকে আরবি সাহিত্যের আন নাহদা বা রেনেসাঁ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কবিরা আরবি কবিতায় নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। বিষয়বস্তুতে নিয়ে আসেন নতুন নতুন সব বিষয়। এই সময়ের কবিদের মধ্যে মারুফ আর-রুসাফী (১৮৭৫-১৯৪৫) হাফিজ ইবরাহীম (১৮৭১-১৯৩২) মিখাইল নুআইমা ও জিবরান খালিল জিবরান উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক আরবি কবিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তাঁরা প্রকৃতির বর্ননা দিতে গিয়ে নিজেদেরকে প্রকৃতির সাথে একাÍ করে ফেলেছিলেন। কবিমনের এই ভাব নতুন এক পৃথিবীর জানালা খুলে দিয়েছিল।
কবি মাহমুদ সামি আল বারুদি তাঁর কবিতায় বলেছেন,
কোথায় আমার যৌবনভরা দিনগুলো
হারিয়ে গেল কোথায়?
কী মনে হয় তোমার সে কি ফিরে আসবে আবার
কত দূর চলে গেছে সে
আমাদের এ দূরত্ব কে আর পারবে ঘোঁচাতে, বলো
কে পারবে সমান করে দিতে এই সব একই সরল রেখায়।
প্রকৃতির সৌন্দর্য আর আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণে অদ্ভুত কবিতা লিখেছেন কবি খালিল জিবরান,
আমি এক হূদয় ভোলানো শব্দ উচ্চারিত হই প্রকৃতির কণ্ঠে
নীল তাঁবু থেকে খসে পড়া এক নক্ষত্র আমি সবুজ কার্পেটে
সমতলভূমি সজ্জিত হয় আমার অপরূপ সাজে
আমি দৃষ্টি মেলে দিই উঁচুতে শুধুই আলোর দিকে
কখনো আমার ছায়ার দিকে তাকাই না
এই হলো প্রজ্ঞা যা শিখতেই হবে মানুষকে।
এসব ছাড়াও নর-নারীর যৌবনসম্পর্কিত বেদনার উচ্ছ্বাসও আধুনিক আরবি কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসব কবিতায় যৌবনের হা-হুতাশ থাকলেও সেগুলো ছিল অশ্লীলতা ও দুর্বোধ্যতার দোষ থেকে মুক্ত।
আরবি সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত। আইয়ামে জাহেলিয়া বা জাহেলি যুগ থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর সর্বকনিষ্ঠ কবিদের কাব্যধারার পর্যালোচনায় এই কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এর মূলে কাজ করছে আধুনিক আরবি কবিদের আন্তরিকতা ও কাব্যাদর্শ।