বৃহস্পতিবার-২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সীরাতে রাসূল (সা.): বিশ্বমানবতার মুক্তি সনদ

সীরাতে রাসূল (সা.): বিশ্বমানবতার মুক্তি সনদ

আরিফুর রহমান

মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সুষ্টি করেছেন তাঁর বান্দা ও খলিফা হিসেবে। এ জন্য মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। এখানেই মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির পার্থক্য, আর এই পার্থক্য বাস্তবে কার্যকর করার জন্য রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল এবং আসমানি কিতাব ও সহিফা নাযিল করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল আকায়ে নামদার তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমাদ মুস্তফা (সা.) কে বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তিসনদ, মানব জাতির হেদায়াতের জন্য সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ আসমানি কিতাব আল-কুরআন দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।

এরপর পৃথিবীতে আর কোনো নবী-রাসূল এবং আসমানি কিতাব বা সহিফা আসার কোনো রকম অবকাশ নেই। এটি আমাদের ঈমানের অঙ্গ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেন,

اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِيْنًاؕ ۰۰۳

‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের দীন বা জীবনবিধান মনোনীত করে আমি সন্তুষ্ট হলাম।’ (৫:৩)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, আল-কুরআনের মাধ্যমে প্রদত্ত আল্লাহ তায়ালার বিধান এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে গঠিত রাসূলে করীম (সা.)-এর সিরাত তথা জীবনচরিত। এ দুটোর সমন্বিত নামই হচ্ছে দীন ইসলাম বা ইসলামি জীবনব্যবস্থা। প্রতিটি মানবজীবনে এর যথাযথ বাস্তবায়নই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দা ও তাঁর খলিফা হওয়ার একমাত্র পথ।

রাসূলে করীম (সা.)-এর সিরাত হচ্ছে আল-কুরআনের সব বিধিনিষেধের সফল বাস্তবায়ন। তাই উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাযি.)-কে যখন নবীজীর আখলাক তথা সিরাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কি কুরআন পড়নি? সেই কুরআনই তো তার আখলাক বা সিরাত।’

নবী করীম (সা.)-এর সিরাত বা জীবনচরিত হচ্ছে একটি জীবন্ত কুরআন। কেননা কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া

তায়ালা মানব জাতিকে যত রকম বিধিনিষেধ প্রদান করেছেন, তার প্রত্যেকটি বিধিনিষেধ নবী করিম (সা.) অক্ষরে অক্ষরে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে আমাদের গোটা জীবনের জন্য তিনি আদর্শ নমুনা হয়ে রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনাদর্শের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সারা জীবন আল্লাহ তায়ালার হুকুম আহকাম পালনে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তাঁর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল,

قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَ نُسُكِيْ وَ مَحْيَايَ وَ مَمَاتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَۙ۰۰۱۶۲

‘হে নবী বলুন, আমার সালাত আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে নিবেদিত।’ (৬:১৬২)

আল্লাহ তাআলার হুকুম আহকাম পালনে তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি তা প্রথমে নিজে আমল করতেন এরপর অন্যকে তা আমল করার নির্দেশ দিতেন। তাঁর গোটা জীবন ও চরিত খোঁজ করলে এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না যে, তিনি নিজে আমল না করে অন্যকে তা আমল করতে বলেছেন।

নবী করীম (সা.)-এর সিরাত বা জীবনচরিত ছিল খুবই ভারসাম্যপূর্ণ। তাঁর জীবনে ধর্মীয় বিষয়াদির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা সত্ত্বেও তিনি ‘রাহবানিয়্যাত’ বা বৈরাগ্যবাদের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘ইসলামে কোনো বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদের স্থান নেই।’ প্রতিটি মানুষ যেমন আল্লাহর দেয়া বিধান মোতাবেক ঐকান্তিকতার সঙ্গে ইবাদত বন্দেগি তথা নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি আদায় করবে, তেমনিভাবে আল্লাহর দেয়া বিধিনিষেধ পালনের মাধ্যমে তাঁর ওপর অর্পিত সাংসারিক যাবতীয় দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, এতে যেন কোনো রকম ভারসাম্য নষ্ট না হয়, যেমন কোনো ব্যক্তি নফল ইবাদতে এত বেশি মশগুল হয়ে যায় যে, সে সংসার জীবনের প্রতি কোনো রকম দায়দায়িত্বই পালন করে না। ফলে তার পরিবারের সদস্যদের ইসলামের প্রতি এমন একটা বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয় যে, তারা নফল ইবাদত তো দূরে থাক, ফরজ ইবাদতের প্রতিও তাদের অনীহা দেখা দিতে শুরু করে।

নবী করীম (সা.)-এর জীবনচরিত ছিল কঠোর সঙ্কল্প ও দৃঢ়চিত্ততার উজ্জ্বল নিদর্শন। এ কারণেই আল-কুরআনে তাঁকে উলুল আযম বা স্থির প্রতিজ্ঞ বলা হয়েছে। (৪৬:৩৫)

কেননা নুবুওয়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রাক্কালে তাঁর তেমন কোনো সহযোগী ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়চিত্তে স্বীয় গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েননি। একবার মক্কার কাফির মুশরিকদের প্রবল বিরোধিতার মুখে তার চাচা আবু তালিব কিছু দিন ইসলাম প্রচার থেকে তাকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। উত্তরে তিনি তাঁর দৃঢ়চিত্তের পরিচয় দিয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ! এরা যদি আমার এক হাতে চন্দ্র এবং অন্য হাতে সূর্যও এনে দেয়, তবুও এ মহান দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে পারব না। একবার কোনো এক বেদুইন নবী করীম (সা.)-কে একাকী একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করতে দেখে তাঁর তলোয়ার দেখিয়ে বলল, ওহে মুহাম্মদ! এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন, আমার আল্লাহ। একথা শুনে লোকটি এত ভয় পেল যে, তাঁর হাত থেকে তলোয়ারটি মাটিতে পড়ে গেল। এমন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিশোধ না নিয়ে লোকটিকে ক্ষমা করে দিলেন। (সহীহ আল-বুখারী)

সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল নবী করীম (সা.)-এর সিরাতের একটি বিশেষ অলঙ্কার। এ ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহ তায়ালার অমূল্য নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তা আমাদের জন্য পালনীয় করে রেখে গেছেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,

اِنَّ اللّٰهَ يَاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْاِحْسَانِ ۚ ۰۰۹۰

‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সুবিচার ও সদাচরণের নির্দেশ দিচ্ছেন।’ (১৬:৯০)

তিনি সারা জীবন অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং সমাজে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। (সহীহ আল-বুখারী)

নবী করীম (সা.)-এর সিরাতে তাইয়্যেবার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল আড়ম্বরহীনতা। তিনি পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদসহ কোনো কিছুতেই আড়ম্বর করা কখনো পছন্দ করতেন না। তাই তিনি সহজ-সরল জীবনযাপনেই অভ্যস্ত ছিলেন। যখন যে খাদ্য মিলত তিনি তাই খেতেন, যখন যা পেতেন তাই পরিধান করতেন। তবে তিনি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সদাসর্বদা অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবনযাপন করার জন্য তিনি তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) এর ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন।

হযরত আলী (রা.) এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো সুসজ্জিত ঘরে প্রবেশ করা নবী-রাসূলের জন্য শোভনীয় নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ)

যুহদ ও কানাআত তথা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও অল্পে তুষ্টি ছিল নবী করীম (সা.)-এর সিরাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হযরত আবদুল্লাহ (রাযি.) বর্ণনা করেন, একদিন তিনি খেজুরপাতার চাটাইয়ে শুয়েছিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে আমি একটু নরম বিছানা করে দিই। তিনি বললেন, ওহে! এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে ক্ষণিকের আরামের কী মূল্য আছে। আমার উদাহরণ তো ওই মুসাফিরের মতো, যে দুপুরের খরতাপে একটি গাছের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে পরক্ষণেই তার গন্তব্যে চলে যায়। (ইবনুল জাওযী, আল-ওয়াফা)

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে দশ বছর অতিবাহিত করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ কোনো দিন পেট ভরে আহার করেননি।

নিজের কাজ নিজের হাতে করা নবী করিম (সা.) এর সিরাত তথা জীবনচরিতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর অসংখ্য সাহাবি সদাসর্বদা তাঁর একটু খিদমত করার সুযোগ লাভে ধন্য হওয়ার লক্ষ্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। কিন্তু তিনি বিনা ওজরে ব্যক্তিগত কাজে সাধারণত কারো সাহায্য গ্রহণ করতেন না। তিনি কাবাঘর পুনর্নির্মাণে মসজিদে নববী ও মসজিদে কুবার নির্মাণ এবং খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননে সাহাবিদের সাথে মিলে সমানভাবে কাজ করেন। (আল-ওয়াকিদি, আল-মাগাযী)

তিনি গৃহস্থালির কাজে উন্মুল মুমিনীনদের সাহায্য করতেন, কাপড়ে তালি লাগাতেন, ঝাড়– দিতেন, দুধ দোহন করতেন, বাজার থেকে সওদা বহন করে আনতেন, বালতি মেরামত করতেন, নিজে উট বাঁধতেন, খাদিমদের সাথে আটার খামির তৈরি করতেন। (সহীহ আল-বুখারী)

বিনয় ও নম্র স্বভাব ছিল নবী করিম (সা.) এর সিরাতে পাকের অন্যতম ভূষণ। তাঁর কথায় ও কাজে কখনো এমন কিছু প্রকাশ পায়নি, যা দ্বারা অহঙ্কার বা আত্মম্ভরিতার লেশমাত্র অনুভূত হয়। একবার তাঁর ও মূসা (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জনৈক মুসলিম ও ইহুদির মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি তাঁর কর্ণগোচর হলে তিনি বললেন, তোমরা হযরত মূসা (আ.)-এর ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ো না। কেননা কিয়ামতের দিন মানুষ যখন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বে, তখন সর্বপ্রথম আমিই সংজ্ঞা ফিরে পাবো এবং দেখব হযরত মূসা (আ.) আরশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি না, তিনি কি আমার আগে সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হবেন, না কি তিনি আদৌ সংজ্ঞা হারাবেন না। (সহীহ আল-বুখারী)

একবার একটি প্রতিনিধিদল নবী করীম (সা.)-কে বলল, ‘আপনি আমাদের নেতা।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘তোমাদের প্রকৃত নেতা আল্লাহ তাআলাই।’ প্রতিনিধিদল তখন বলল, ‘আপনি আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, সর্বাপেক্ষা সম্মানী।’ তিনি বললেন, ‘সংযত হয়ে কথা বলো। শয়তান তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে না বসে।’ (সুনানে আবু দাউদ)

অন্য এক রেওয়াতে বলা হয়েছে, তিনি আরও বললেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা থেকে আমাকে কেউ আরো ওপরে তুলুক তা আমি পছন্দ করি না।’ (মুসনাদে আহমাদ)

ওপরে বর্ণিত আলোচনা থেকে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নবী করীম (সা.)-এর সিরাত তথা তিনি তাঁর মিলাদ বা জন্ম থেকে নিয়ে ওফাত পর্যন্ত যা কিছু করেছেন, বলেছেন এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুমোদন দিয়েছেন তা সুন্নাহ হিসেবে আমাদের মানবজীবনে অনুসরণ, অনুকরণ ও বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য কর্তব্য। এর মাধ্যমেই আমাদেরকে হতে হবে আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দা ও খলিফা এবং সফলকাম হতে হবে ইহকালে আর নাজাত লাভ করতে হবে পরকালে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ