রোহিঙ্গা নারীদের একটা বড় অংশ বর্মী সেনাবাহিনীর হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী রোহিঙ্গা নারীদের একটা বড় অংশ বর্মী সেনাবাহিনীর হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। অনেকে যৌন নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হয়েছেন বলে পালিয়ে আসা পরিবারগুলো বলছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে এসব নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না বলে বলছেন স্থানীয় চিকিৎসকরা।
হাজেরা বেগম উখিয়াতে পালিয়ে এসেছেন তিন দিন হলো। তিনি বলছিলেন, সেনাবাহিনী তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। আর যারা পালাতে পারেননি তারা হয় নিহত হয়েছে নয়ত তার মতই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, নির্যাতনের পর আমার মত অনেক নারীই চিকিৎসা নিতে চেয়েছে। বিশেষ করে যাতে করে গর্ভধারণের ঝুঁকি মুক্ত থাকা যায় সেজন্য ওষুধ পর্যন্ত চেয়েছে। কিন্তু পায়নি। আমি নির্যাতনের পরেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু অনেক মেয়ে আছে যাদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২৫ অগাস্টের পর যত মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তার একটা বড় অংশ নারী এবং শিশু। তারা বলছেন, পুরুষরা যেমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তেমনি নারীরা হয়েছে যৌন নির্যাতনের শিকার। আরেকজন নারী তার এক শিশু সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু তার ১৫ বছরের মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছেন।
তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে সে ধরা পড়েছে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমি এখনো তার কোন খোঁজ পাইনি। নারীদের ওপর কী নৃশংসভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মুহাম্মদ ইলিয়াস।
তিনি বলেন, তারা যখন পালিয়ে আসেন তখন একজন নারীকে তিনি ধর্ষিত হতে দেখেছেন। কোলে তার শিশু সন্তান ছিল। পরে ওই নারীর অর্ধপোড়া মরদেহ তারা দেখতে পান আরো পাঁচটি মরদেহের সাথে।
এদিকে, কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় যেসব নারী ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসকরা।
রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন সম্পর্কে ডাক্তারের বক্তব্য
তারা বলেন, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের বিষয়ে নারীরা মুখ খুলছেন না। তাই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা দেয়ার কাজটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
উখিয়ার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত তারা ১৮টি ঘটনার কথা জানতে পেরেছেন। তবে তিনি বলেন এ সংখ্যা আরও বেশি।
আমি ছয়জন মায়ের সাথে কথা বলেছি, তাদের কোলে সন্তান ছিল। তারা বলছেন, তারা বার্মার মিলিটারির হাতে জুলুমের শিকার’ হয়েছে। তাদের চেহারায় বেদনা,কষ্ট, আর আতেঙ্কর ছাপ রয়েছে।
মেজবাহ উদ্দিন বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ের যে তথ্য পাচ্ছি তাতে সংখ্যাটা কম নয়, যেটাতে আমাদের শঙ্কার-আশঙ্কার জায়গা তৈরি হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন যাতে করে তাদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়।
যৌন নির্যাতনের শিকার যেসব নারীদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তাদের কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, তাদের যদি সনাক্ত না করা যায় তাহলে বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পরতে পারেন তারা।
অনেক শরণার্থী রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে পুরুষ সদস্যরা নেই কেন?
সপ্তাহখানেক আগে টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে এসেছেন আলমাস খাতুন। ক্যাম্পে এক পরিচিতজনের সাথে আছেন। আলমাস খাতুন বলেন তার স্বামী এবং একমাত্র ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে। তিনি জানেন না আদৌ তারা বেঁচে আছেন কিনা।
আলমাস খাতুনের মতো অনেক নারী ও শিশু বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তাদের সাথে আসেনি। তাহলে তাদের পরিণতি কি হয়েছে?
রাখাইন রাজ্য থেকে আসা আরেক জন নারী শরণার্থীর সাথে কথা হচ্ছিল। আমার সাথে কথা বলার সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। এ নারী বলছিলেন তার স্বামী এবং তার তিন ছেলেকে তার সামনেই হত্যা করা হয়েছে। দুই ছেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে গুলি করা হয়। সেখানেই মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলছিলেন পৃথিবীতে এখন আমার কেউ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। গত ২৫ অগাস্ট হতে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজারের বেশি শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে বলে ধারণা করছে ত্রাণ সংস্থাগুলো। কিন্তু স্থানীয় মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিরা বলছে শরণার্থীর সংখ্যা আসলে আরও বেশি। এ বিপুল সংখ্যাক শরণার্থীর বড় অংশই নারী এবং শিশু।
পালিয়ে আসা এসব মানুষ বলছে তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বেশির ক্ষেত্রেই হত্যা করা হয়েছে। অথবা নিখোঁজ আছে।
মুহাদ্দেসা নামে এক নারী বলছেন তার স্বামী, এক ছেলে এবং শ্বশুরকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। তিনি বলেন সেনাবাহিনীর সন্দেহ ছিল তার স্বামী আল ইয়াকিন নামের একটি গ্রুপের সদস্য।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ওপর হামলার কারণ হিসেবে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ি করছে। এ সংগঠনটি স্থানীয়ভাবে হারাকা আল-ইয়াকিন নামে পরিচিত ছিল। তবে স্থানীয়ভাবে একটা গুঞ্জন রয়েছে বেশ কিছু পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মিয়ানমারে রয়ে গেছেন তাদের ভাষায় লড়াই এ অংশ নেয়ার জন্য। তবে এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন আবুল কালাম। তিনি অবশ্য এ তথ্যকে নাকচ করে দিলেন। তিনি বলছিলেন তাকে গুলি করার সময় তারা বলেছে এ দেশ মুসলমানদের জন্য নয়।
সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন
পঙ্গু করে দিচ্ছে মানুষকে
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম। পঙ্গু হয়ে যাওয়া কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি। ১৫ বছর বয়সী মিয়ানমারের এক কিশোরের চিকিৎসা চলছে বাংলাদেশের এক হাসপাতালে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে দুটো পা হারিয়েছে এই কিশোর। একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক নারী, যিনি জানিয়েছেন সীমান্তে গুলি খাওয়ার পর মাইনের ওপর আছড়ে পড়েন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে ওই এলাকায় মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল, কিন্তু সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর নিষিদ্ধ অ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতেছে বলে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশি বিভিন্ন সূত্র এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো। যদিও মিয়ানমারের কর্মকর্তারা এই অভিযোগও অস্বীকার করেছেন।
সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন সোমবার বলেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর-নির্মম অভিযান চলছে। পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছেন যে সেখানে যে হামলা চালানো হচ্ছে তা পাঠ্য বইয়ের জন্য জাতিগত নিধনের একটি অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আহত রোহিঙ্গাদের কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে, একটি হাসপাতালে ঘুরের বিবিসির রিতা চক্রবর্তী দেখেছেন বেশিরভাগই সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। অনেকের দেহের নানা জায়গায়, কেউ হাত আবার কেউবা পা হারিয়েছেন।
১৫ বছর বয়সী আজিজু হক, তার দুই পা হারিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, সাথে আছে তার মা। আজিজুর ভাইও অন্য এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তারও একই অবস্থা-জানালেন তাদের মা রুশিদা হক।
তাদের দেহের ক্ষত এতটাই যে আমার কাছে সেটা মৃত মানুষের মতোই। ওপরওয়ালা যদি তাদের নিয়ে যেত তাহলে ভালো হতো। ছেলেগুলো আমার অনেক কষ্ট করছে বিবিসিকে বলেন রুশিদা হক।
বিস্ফোরণে আজিজুল হকের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে, দুটো পা নেই,এছাড়া শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট।
আজিজুল হককে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে ডাক্তাররা। কিন্তু তাকে বাঁচানোর আশা ক্ষীণ বলে জানা যাচ্ছে। কারণ আজিজুল হকের রক্তের গ্রুপ বিরল, ওই গ্রুপের রক্ত কোনো ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কদিন রক্তদাতা পাওয়া গেলেও এখন আর কোনো দাতারও সন্ধান মিলছে না। অন্যদিকে আহত আরেক নারী সাবেকুর নাহার বলেন, মিয়ানমারে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজনকে লক্ষ্য করে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর তিন ছেলেকে নিয়ে নিজ গ্রাম থেকে পালান তিনি। যখন সীমান্ত পার হচ্ছিলেন তখনই গুলির আঘাতে মাইনের ওপর পড়ে যান। আমাদের গুলি ছুঁড়লো,এবং তারা মাইনও পুঁতে রেখেছিল সেটার ওপর পড়লাম। কথাগুলো বলেন ৫০ বছর বয়সী সাবেকুর নাহার। ছোটখাট দেখতে সাবেকুরের দেহেও নানা ক্ষত রয়েছে।