জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রকৃতি সংরক্ষণে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা

প্রকৃতি সংরক্ষণে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা

মুকিত মজুমদার বাবু

‘যদি তুমি মনে কর আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবুও আজ একটি গাছ লাগাও।’ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মহানবী (সা.) গাছ লাগানো প্রসঙ্গে এমনি কথা বলেছেন তাঁর সাহাবীদের। বৃক্ষ রোপণকে উৎসাহিত করতে তিনি বলেছেন, ‘বৃক্ষ রোপণ সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে পরিগণিত হবে (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)।’

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষ রোপণ করে, অতঃপর তা থেকে যদি মানুষ, পাখি বা কোনো প্রাণী কিছু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সাদাকার সওয়াব হবে।’

পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা মহানবী (সা.)-এর উপর্যুক্ত হাদীস থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনা সুস্পষ্ট। কুরআন-হাদীসে পরিবেশ সংরক্ষণকে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মিসরের প্রখ্যাত আলেমে দীন আল্লামা সাইয়েদ তানতাবী তার এক বইতে লিখেছেন, আল্লাহ কুরআনের মধ্যে ৫০০ বার পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। আরেক সূত্র থেকে জানা যায়, কুরআনে ৫৪ প্রজাতির উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে, যার ৫১ প্রজাতি পৃথিবীতে পাওয়া যায়। পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে পানি। আল্লাহ কুরআনে ৬০টি আয়াতে পানির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,

اَوَ لَمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْۤا اَنَّ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنٰهُمَا١ؕ وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَآءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّؕ ۰۰۳۰

‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল। অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি (আল্লাহ) পানি থেকে সৃষ্টি করলাম।’

দুনিয়ায় যা কিছু প্রাণ পেয়েছে তা কেবল পানি থেকেই পেয়েছে।

পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হয়েছে,

وَلَا تُلْقُوْا بِاَيْدِيْكُمْ اِلَى التَّهْلُكَةِ١ۛۖۚ ۰۰۱۹۵

‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ اَيْدِي النَّاسِ۰۰۴۱

‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’

আল্লাহ পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে,

وَالْاَرْضَ مَدَدْنٰهَا وَاَلْقَيْنَا فِيْهَا رَوَاسِيَ وَاَنْۢبَتْنَا فِيْهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍۭ بَهِيْجٍۙ۰۰۷ تَبْصِرَةً وَّذِكْرٰى لِكُلِّ عَبْدٍ مُّنِيْبٍ۰۰۸

‘আমি বিস্তৃৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।’

সূরা আল-ইনআমের ১৪১ আয়াতে এসেছে,

اِنَّهٗ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْنَۙ۰۰۱۴۱

‘আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’

এ আয়াত আরও গুরুত্ব পেয়েছে, মহানবী তাঁর এক সঙ্গীকে ভর্ৎসনা করেছিলেন কারণ, ওই সঙ্গী গোসলের পর অবশিষ্ট পানি ফেলে দিয়েছিলেন। মহানবী তাকে বলেছিলেন, উদ্বৃত্ত পানি নদীতে ফিরিয়ে দেয়া উচিত, যাতে ভাটির অন্য মানুষের চাহিদা পূরণ হয়।

পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মাটি ও পানি। মূলত মাটি থেকেই বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি দ্বারা জীবিত থাকে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,

وَاٰيَةٌ لَّهُمُ الْاَرْضُ الْمَيْتَةُ١ۖۚ اَحْيَيْنٰهَا وَاَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ يَاْكُلُوْنَ۰۰۳۳ وَ جَعَلْنَا فِيْهَا جَنّٰتٍ مِّنْ نَّخِيْلٍ وَّ اَعْنَابٍ وَّفَجَّرْنَا فِيْهَا مِنَ الْعُيُوْنِۙ۰۰۳۴

‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপাদন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপাদন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’

হাদীসে রাসূল (সা.) থেকে আরও জানা যায়, মৃত প্রাণীর কোনো অংশ মহানবী (সা.) যত্রতত্র ফেলতেন না, কারণ তা একসময় শুকিয়ে বাতাসে মিশে যেতে পারে, পুঁতে না ফেললে তা কোনো প্রাণী বা পাখি ছড়িয়ে পরিবেশ দূষিত করতে পারে। এ জন্য রাসূল (সা.) রক্ত বা মাংস মাটিতে পুঁতে ফেলতেন বা পুঁতে ফেলার নির্দেশ দিতেন।

মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের অযথা কোনো প্রাণীকে হত্যা বা কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমনÑ বৃক্ষ, নদী, পাহাড়, সাগর ইত্যাদির ক্ষতি হয়, এমন কোনো কাজ থেকেও নিজেদের বিরত রাখতে বলেছেন। কুরবানির সময় হালাল পশু যেমনÑ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র কুরআন বিভিন্ন প্রাণী যেমনÑ বাদুড়, কাক, হুদহুদ, আবাবিল ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে, যার কারণে মানুষ এদের না মেরে সংরক্ষণ করছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ ও ঔষধি গাছের কথাও বলা হয়েছে ইসলামে। মৌমাছি ফুল থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে মধুর চাক তৈরি করে, যার মধু ঔষধিগুণসমৃদ্ধ এবং অত্যন্ত উপকারী। কুরআন ও হাদীসেও মধুর ঔষধিগুণের কথা উল্লেখ আছে। বিভিন্ন প্রাণী ছাড়াও ইসলাম ধর্মে উদ্ভিদ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসেও বিভিন্ন উদ্ভিদের নাম উল্লেখ রয়েছে, যার মধ্যে খেজুর, জলপাই, জয়তুন অন্যতম।

মেহেদি গাছ মুসলমানদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গাছ। বিয়েসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে মেহেদি পাতার ব্যবহার রয়েছে। মহানবী (সা.) নিজে মেহেদি পাতার রস ব্যবহার করতেন বলে মুসলমানরা আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

নবী-পয়গম্বর, পীর-আউলিয়াদের সঙ্গে বিভিন্ন পশুপাখির সংশ্লিষ্টতার কারণে মানুষ তাদের সংরক্ষণ করে। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সময় শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে জাবালে সওর গুহায় আশ্রয়কালে মাকড়সা সেই গুহামুখ জাল তৈরি করে বন্ধ করে দেয় এবং তিনি শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পান। এ কারণে মুসলমানরা মাকড়সা মারেন না।

স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণে আমরা ধর্মের নিয়ম-কানুন অনেকাংশে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। নদীকে দূষণ আর দখল করে তাকে বিপন্ন করে তুলছি, বন উজাড় করছি, বায়ু দূষণ করছি, শব্দ দূষণ করছি… ফলে আমাদের ওপর নেমে আসছে সর্বনাশা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালো ছায়া।

ইসলাম ধর্মে প্রসঙ্গক্রমে গাছপালা, প্রাণিজগৎ, পাহাড়-নদী সর্বোপরি প্রকৃতি সংরক্ষণের কথা উঠে এসেছে বারবার। ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব আর অসচেতনতার কারণে প্রকৃতি সংরক্ষণের চেয়ে আমরা প্রকৃতির ক্ষতি করছি বেশি। সেই সঙ্গে অনিশ্চিত করে তুলছি আমাদের ভবিষ্যৎ। দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ও এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই রক্ষা করা সম্ভব আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ। গড়ে তোলা সম্ভব সুন্দর পরিবেশে সুস্থ জীবন।


আল-কুরআন, সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৩০

আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারা, ২:১৯৫

আল-কুরআন, সূরা আর-রূম, ৩০:৪১

আল-কুরআন, সূরা কাফ, ৫০:৭-৮

আল-কুরআন, সূরা আল-ইনআম, ৬:১৪১

আল-কুরআন, সূরা ইয়াসীন, ৩৬:৩৩

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ