আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭
পর্দার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মাওলানা শামসুল ইসলাম (দা. বা.)
মুহতামিম, রাজঘাটা হুসাইনিয়া মাদরাসা
نَحْمُدُهُ وَنُصَلِّيْ عَلَىٰ رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ.
أَمَّا بَعْدُ! فَأَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ، [وَاِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ۠ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ١ؕ ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَ قُلُوْبِهِنَّؕ ۰۰۵۳] {الأحزاب: ৫৩}.
পর্দা শব্দের আভিধানিক অর্থ হল আবরণ বা কোন কিছু ঢেকে রাখা কোন কিছুকে দোষমুক্ত বা বিপদ মুক্ত করা। যেমনÑ বলা হয় খাবারটি ডেকে রাখা এখানে ডেকে রাখাটাই পর্দা। পর্দাকে আরবিতে حجاب বলা হয়। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ প্রদত্ত হুকুমও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত অনুযায়ী নারী-পুরুষের দেখা-শোনা, ওঠা-বসা, চলা ফেরা থেকে দূরে থাকার নামই পর্দা।
আল্লাহ সবদিক দিয়ে বড়। বান্দা সবদিক দিয়ে ছোট। আল্লাহ তাআলা যেহেতু সবদিক দিয়ে বড় সেই জন্য তার পর্দার মূল হাকীকত হলো নূর। যেমনÑ বলা হয়, حجابه نور لو كشفه لاحرقه شبهات وجهه إلىٰ منتها إليه بصره من خلقه। আল্লাহ পাকের শাহী পর্দা নূরের পর্দা। যদি তা নিয়ে নেওয়া হয় তখন আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের তাজাল্লী দ্বারা সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আসমান পর্দা হওয়ার কারণে তার উপরের জগতে ক্ষতিকর জিনিস থেকে আমরা বেঁচে যাচ্ছি। যেমন একটি কাঠাল তার কাঁটাযুক্ত আবরণ যদি না থাকতো তখন তার ভিতরের বিচিগুলো নষ্ট হয়ে যেত সুতরাং আল্লাহ তাআলা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বলেন,
وَاِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ۠ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍؕ ۰۰۵۳
হে আমার সাহাবারা! মুমিন বান্দারা আমাদের আম্মাজান, উম্মাহাতুল মুমিনীন, বিশ্ব নবী (সা.)-এর পবিত্র বিবিগণ তাদের নিকট থেকে যখন তোমরা কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। ওই নিয়ম যদি অবলম্বন করা হয় তখন তাদের হাত-মুখ, শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিছুই দেখা যাবে না। অথচ তারা উম্মাহাতুল মুমিনীন মুমিন মহিলাদের মা। অনেকেই বলে থাকে সুদৃষ্টি দিয়ে দেখা বৈধ। সাহাবায়ে কেরামগণ, তাবেয়ী, তবেতাবেয়ীগণ ও ঈমানদার ব্যক্তিগণ তাদের কি কুদৃষ্টি ছিল? না। আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী ব্যক্তিদেরকে উক্ত আয়াতে কারীমা দ্বারা খুব জোরালোভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমাদের যদি তোমাদের মাতাগণের নিকট থেকেও কিছু চাইতে হয় পর্দার বাইরে থেকে চাইবে। ভিতর থেকে চাইবে না। তৎকালীন যুগ ফিতনা-ফাসাদের যুগ ছিল না। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাদের পর্দার অর্ডার করেছেন। তারা হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম এবং ঈমানদার ব্যক্তিগণ যাদের মর্যাদা সব চেয়ে বেশি আর আমাদের যুগ হচ্ছে ফেতনার যুগ। এই যুগে বাবা নিজের মেয়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰنِسَآءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًاۚ۰۰۳۲
‘হে নবীর বিবিগণ! তোমরা অন্যান্য মহিলাদের মত নয়। তোমাদের মর্যাদা সবচেয়ে বড় যখন তোমাদের মধ্যে তাকওয়া বিদ্যমান থাকে। তোমরা কারো সাথে নম্রস্বরে কথা বলবে না। নম্রস্বরে কথা বললে যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা কুখেয়াল পোষণ করবে; বরং তোমরা ভালো কথাই বল (সূরা আল-আহযাব: ৩২)।’
আর যদি তোমরা আল্লাহর হুকুম আহকাম অনুযায়ী চলতে না পার তখন তোমাদের ওই মর্যাদা আর থাকবে না। তোমরা যদি একটি নেকী কর ওই নেকীর বিনিময়ে দশ নেকী দেওয়া হবে। অনুরূপভাবে তোমরা যদি একটি গোনাহ কর তোমাদের আমলনামায় তখন ডবল গোনাহ লেখা হবে। তোমাদের খুব বেশি তাকওয়া পরহেজগারী থাকা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ ۚ۰۰۳۲ অর্থাৎ পুরুষদের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্কশ ভাষায় জবাব দেওয়া চাই, নরমভাবে নয়।
আরো বলেন, فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ ۚ۰۰۳۲ অর্থাৎ তোমরা যদি তাদের সাথে নম্রভাষায় কথা বল যাদের হৃদয়ে ব্যধি আছে তারা লিফ্সা করবে। তোমরা তাদের সাথে কথা বলার সময় তোমাদের সতিত্ব তো রক্ষা করবেই তাদের মনে কষ্ট না আসে মত কথা বলবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বলে আমাদেরকে এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন।
وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَ لَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُوْلٰىؕ۰۰۳۳
অর্থাৎ তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে ঘুরা-ফেরা করবে না (সূরা আল-আহযাব: ৩৩)। অর্থাৎ ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগে মহিলাগণ বেপর্দায় যেখানে সেখানে চলা ফেরা করত এবং প্রকাশ্যে তারা তাদের দেহ ও পোষাকের রূপ সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়াত। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পর্দার কথা বলে আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন,
الْـمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتْ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ.
অর্থাৎ ‘নারী হচ্ছে পর্দা, নারী যখন গৃহ থেকে বের হয় তখন শয়তান তার পিছু নেয় অর্থাৎ তাকে অনিস্ট সাধনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে (সুনানে তিরমিযী, ৩/৪৬৮, হাদীস: ১১৭৩)।’
আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন,
فَاتَّخَذَتْ مِنْ دُوْنِهِمْ حِجَابًا١۪۫ ۰۰۱۷ {مريم: ১৭}.
হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতা মরিয়ম (আ.) গোসল করার সময় পর্দা করেছেন। পর্দার কারণে মূল্য বৃদ্ধি পায়, বল খেলার সময় যখন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। তখন বল খেলার মূল্য বৃদ্ধি ফেল, দর্শকরা টিকেট ক্রয় করে বল খেলা দেখতে লাগল। যদি চারদিক থেকে দেয়াল না দিত তখন পাঁচ টাকাও পাওয়া যেত না। যদি পর্দার কারণে মূল্য বৃদ্ধি পায় তাহলে আমাদের মা-বোনদের পেটকেও পর্দার আড়ালে রাখতে হবে। কেননা তাদের পেট হচ্ছে একটি মূল্যবান বস্তু। সেই পেট থেকে নবী-রাসূল ও জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা বের হয়। ব্যাংকে মূল্যবান জিনিস থাকার কারণে দরজার মধ্যে একজন দারোয়ান সদা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন,
صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَـمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْـمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْـجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا.
অর্থাৎ দু’প্রকার মানুষ জাহান্নামী এখন পর্যন্ত সেই দু’প্রকারের মানুষ দেখা যাচ্ছে না। প্রথম প্রকার সেসব লোকেরা যারা জমিন বিক্রি করে করে মানুষদেরকে অত্যাচার করবে। দ্বিতীয় প্রকার সেসব মহিলারা যারা কাপড়ের নামে পাতলা কাপড় পরিধান করে।
কাপড় পরিধান করার পরও তাদের সবকিছু দেখা যায়। তারা পুরুষদেরকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে চায়। তারা নিজেরা পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হতে ইচ্ছুক । তারা তাদের মাথাকে বুখতে নছর এর উটের পীঠের ন্যায় উঁচু করে সাজিয়ে পুরুষের সামনে চলা-ফেরা করে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করা তো দূরের কথা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ বেহেস্তের সুগন্ধি ৫০০ বছরের রাস্তা থেকে পাওয়া যাবে। তারা এর চেয়েও বেশি দূরে থাকবে (সহীহ মুসলিম, ৩/১৬৮০, হাদীস: ২১২৮)।’
পর্দাহীনতার কারণে দুনিয়া আখেরাত উভয় জাহানে ক্ষতি। বেপর্দার কারণে দুনিয়ার ক্ষতি। মেয়েদের কসমের ভিতর টক জাতীয় জিনিস আছে। পুরুষের কসমের ভিতর মিষ্টি জাতীয় জিনিস আছে। আর মিষ্টি জাতীয় জিনিসকে টক জাতীয় জিনিস ধ্বংস করে। যখন পর পুরুষের দৃষ্টি পর মহিলার উপর পড়ে ওই মহিলার টক জাতীয় জিনিস ধ্বংস হয়ে যায়। বৃদ্ধা মহিলাদেরকেও সাধারণ মহিলার মতো লাগে তাদের মধ্যে টক জাতীয় জিনিস বিদ্যমান থাকার কারণে। যখন টক জাতীয় জিনিস ধ্বংস হয়ে যায় তখন মেয়েদের মধ্যে লজ্জা-শরম কিছুই থাকে না। মেয়ে-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করার কারণে। যখন মেয়ে পুরুষ অবাধে মেলামেশা করে তখন মেয়েদের আকার আকৃতি পুরুষের মত হয়ে যায়।
মেয়েদের আকার আকৃতি মেয়েদের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে তখন মেয়েদের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ওই আকার আকৃতি যদি পুরুষের আকার আকৃতির সাথে মিশে যায় তখন তাদের মূল্য কিভাবে বৃদ্ধি পাবে? সেই জন্য পূর্ববর্তী যুগে কালো কালো মেয়েদের বিবাহ বন্ধন সম্পন্ন হতে কোন ধরণের অসুবিধা হতো না। ইদানিং সুন্দর সুন্দর মেয়েদেরও বিবাহ হচ্ছে না। মেয়েদের আকার আকৃতি পুরুষের অধিক হারে দৃষ্টি পড়ার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। পূর্ববর্তী যুগে চৌধুরী সাহেব ও সিকদার সাহেবের কালো কালো মেয়ে পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনের ক্ষেত্রে কোন ধরণের অসুবিধা হয়নি।
বর্তমানে কাউকে যদি বলা হয় আমার ছেলের সাথে অমুক মেয়েটির বিবাহে আবদ্ধ করার জন্য আমি আশাবাদী। তখন ওই ব্যক্তি বলবে ওই মেয়েটিতো দেখার জন্য তার বাড়িতে যেতে হবে না, ওই মেয়েটিকে রাস্তা ঘাটে দেখা যায়। আপনি যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তাহলে ওই মেয়েটিকে দেখতে পাবেন। তখন আপনি বলুন বেপর্দার কারণে তাদের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে? নাকি মূল্য হ্রাস পেয়েছে?
সময়ের সংকীর্ণতার কারণে আমি আজ এখানেই আমার বক্তব্যের ইতি টানছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন-হাদীস বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
অনুলিখন: মুহাম্মদ মামুন
ছাত্র: আদব বিভাগ, জামিয়া পটিয়া-২০১৭