জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত অধ্যায়

জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত অধ্যায়

ড. এমাজউদ্দীন আহমদ

সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে যেমন ফ্রান্সের রাজনৈতিক আকাশে সূচনা হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের; সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অন্বেষণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি যেমন আমেরিকার ব্রিটিশ কলোনিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে- তেমনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানের দাবি বাংলাদেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিল। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠার জীবনমরণ সংগ্রামে আত্মনিবেদনে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে ঘোষিত স্বাধীনতা সনদে তারই অনুরণন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

এই জাতির বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধা তথা সমগ্র জনসমষ্টির সফলতা ও গৌরবের মাস এটি। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছে এ মাসেই। তাই ডিসেম্বরে পা দিয়ে সবাই আমরা অনুভব করি শক্ত মাটির ¯পর্শ। লাভ করি এক অনির্বচনীয় আত্মবিশ্বাস। এক অনিন্দ্য সুন্দর আত্মশ্লাঘা।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এই জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। মাত্র কিছুসংখ্যক বিপথগামী ছাড়া সবাই এজন্য সংগ্রাম করেছেন। সহ্য করেছেন সীমাহীন যন্ত্রণা। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়সঙ্কল্প ছিলেন সবাই। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। বৃহৎ অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

এমন বৃহৎ অর্জনের পরেও কিন্তু জাতি সেই ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। মাত্র চার দশকের মধ্যেই জাতীয় ঐক্য খণ্ডছিন্ন হয়েছে। জাতীয় লক্ষ্যও অ¯পষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণশক্তি আজ ক্ষয়িষ্ণু। দুর্যোগে অনেকটা ম্রিয়মান। জাতিশক্তির যে অমিত তেজ বিন্ধ্যাচল টলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তা অনেকটা চলচ্ছক্তিহীন, নিশ্চল। কিন্তু কেন এমন হলো?

সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু কথা প্রচলিত হয়েছে। ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ তেমনি একটি বাক্যাংশ। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ তেমনি আর একটি। জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে একটি বিশেষ মহল থেকে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে। ডিসেম্বর মাসে এসবের প্রচার যেন আর একটু বেশি। সরকার নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন ইদানীং অনেকেই দেখেন না। যারা মাঝে মধ্যে খোলেন তাদেরও কান ঝালাপালা এই ধরনের অপপ্রচারে। কিন্তু স্বাধীনতার বিপক্ষে তো কোনো শক্তি ছিল না। তখনো ছিল না, এখনো নেই। তখন কিছুসংখ্যক চিহ্নিত ঘৃণ্য নরাধম মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল বটে; কিন্তু ‘শক্তি’ বলতে যা বোঝায় তা তখনো তাদের ছিল না। ঐসব বিভ্রান্ত, স্বার্থপর, পলায়নপর, কাপুরুষদের ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ বলে তখন কেউ তাদের চিহ্নিতও করেননি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ সম্পর্কেও একই কথা। এত কোনো ব্যক্তির চেতনা নয়, নয় কোনো গোষ্ঠীর চেতনা। নয় কোনো দলের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল সমগ্র জাতি, ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস নির্বিশেষে। এই চেতনা আত্মপ্রতিষ্ঠার। আত্মনির্ভরশীলতার। আত্মবিশ্বাসের। মর্যাদাসম্পন্ন জীবনব্যবস্থার। বলিষ্ঠ জীবনবোধের। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা’ যা ১০ এপ্রিলে ঘোষিত ঐতিহাসিক স্বাধীনতাসনদের মূল কথা, যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণে উদ্বুদ্ধ করে।

এখন সেই চেতনা বিকৃতির কবলে পড়েছে। কোনো কোনো প্রচারক বলে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী হতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী হতে হলে বিশেষ গোষ্ঠী বা বিশেষ দলের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে। এসব কারণে, তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি, কেননা সেই বিশেষ গোষ্ঠী বা দলের অন্তর্ভুক্ত তারা হতে পারেননি।

ইতিহাস সচেতনতা আমাদের তেমন প্রখর নয়। স্মৃতির ধারণক্ষমতাও তেমন সুদৃঢ় নয়। এসব কারণে মাঝে মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হই। সিরাজউদ্দৌলা বিদেশি বেনিয়াদের যতটুকু ঘৃণা করতেন, মীর কাশেমের ঘৃণাও ছিল তেমনি। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ যে সম্ভব নয়, তা অনুধাবনে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল আকাশ-পাতাল। এজন্য দুইজনকেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই নিঃশেষ হতে হয়। কেউ পাননি বিজয়ের আস্বাদ। আমরা কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরকে ধরে রাখতে চাই।

বিজয় দিবসের মূল তাৎপর্য হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাকে ধারণ করা এবং অগ্রগতির শতপথকে নির্বিঘœ করে তোলা যেন কোনো অপরিণামদর্শী চিন্তা বা উচ্চারণ বা কর্ম জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে সক্ষম না হয়। বিজয় দিবসের তাৎপর্য হলো এই ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির নিকট অর্থপূর্ণ করে তোলা। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই বিজয় সমগ্র জাতির বিজয়। কোনো ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠী বা কোনো দলের বিজয় নয়। এই সত্যে বিকৃতি ঘটানোর স্পর্ধা যেন কারো না হয়। বিজয় দিবসে ভাবতে হবে দেশের কোটি কোটি মানুষের কথা, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের আশা-আকাক্সক্ষার কথা। তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের বঞ্চনার কথা। গত বছরগুলোতে যেভাবে সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা আমাদের আড়ষ্ট করে রেখেছিল তার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ স্বার্থকভাবে মোকাবেলা করার কথা। দলীয় মানসিকতার নোংরা নর্দমা থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র সমাজব্যাপী বলিষ্ঠ জীবনবোধ প্রতিষ্ঠার কথা।

একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রকাশ ঘটে এই জাতির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন ও স্বশাসনের আশীর্বাদ দেশের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার দৃঢ়সঙ্কল্পে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হলো সমগ্র জাতি। সমগ্র জাতিই এক দীর্ঘ জীবন-মরণ সংগ্রামে বিজয়ের লাল গোলাপটি ছিনিয়ে এনে ১৬ ডিসেম্বরে এই জাতির জন্য রক্তসিক্ত পতাকা সগৌরবে স্থাপন করেছে। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের ঠিকানা। আমাদের গৌরবময় অর্জনের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। কখনো যেন আমরা একথা ভুলে না যাই।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ