মুফতি শামসুর রহমান
বহু বিয়েপ্রথা শুধু ইসলামে নয়, ইসলাম ছাড়াও ইহুদি, খ্রিস্টান, আর্য, হিন্দু এবং গ্রিক সম্প্রদায়েও বহু বিয়ে প্রচলিত ছিল । বিশেষভাবে ইসলামের জ্যোতি উদিত হওয়ার পূর্বে আরবে একজন পুরুষ জন্য দশজন মহিলাকে বিয়ে করতে পারত। এ জন্য ইসলাম কবুলের সময় অনেক সাহাবায়ে কেরামের অধীনে একাধিক স্ত্রী থাকার প্রমাণ মিলে। যেমনÑ গাইলান ইবনে সালামা (রাযি.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার বিবাহে দশজন, নওফল ইবনে মুআবিয়ার (রাযি.) ৫জন, অনুরূপভাবে হারিস ইবনে কায়েস (রাযি.)-এর ৮জন জায়া ছিল। রাসুল (সা.) তাদেরকে চারজন রেখে বাকিগুলোকে তালাকের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী ইসলাম গ্রহণের পর তারা চারজন রেখে বাকিগুলোকে তালাক প্রদান করেন (তাফসীরে কবীর: ৫/১৩)।
ইসলামে একজন পুরুষ একত্রে চারজন মহিলাকে বিয়ে করতে পারবে। তবে এর জন্য রয়েছে কতিপয় শর্ত। যেন নারীরা তাদের নায্য প্রাপ্যতা সংরক্ষণ এবং সুশৃঙ্খল ও পরিছন্নভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে।
স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফ
ও সমতার তাগিদ
কুরআনুল করীমের সূরা আন-নিসায় আল্লাহ পাক মুসলমান পুরুষের জন্য একের অধিক চারজন অবধি বিয়ে বৈধতার ঘোষণা দেন। তবে এ অনুমতি তখনই মিলবে, যখন পুরুষগণ একাধিক স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ ও সাম্যতা প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। যদি সুবিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, বরং কোনো একজন স্ত্রীর প্রতি অধিক আসক্তি হওয়ার সম্ভবনা থাকে, তাহলে শরীয়ত সেই ব্যক্তিকে একাধিক বিয়ের অনুমোদন প্রদান করে না। বিধৃত হয়েছে, ‘সে সকল মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের পছন্দ লাগে তাদের বিয়ে কর দুই, তিন, কিংবা চারটি অবধি। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়-সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটিই’ (সূরা আন-নিসা: ৩)।
এ ছাড়া হাদীস শরীফেও স্ত্রীদের মাঝে ন্যায়পরায়ণতা ও সমতার প্রতি অধিক জোর প্রদান করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অসম ও কোনো জায়াকে প্রাধান্য দেয়াকে কঠোরারোপ করা হয়েছে। যেমনÑ হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পুরুষের দু’বধূ থাকলে তাদের সঙ্গে যদি ন্যায়ের সমতা রক্ষা না করে, তবে সে কিয়ামত দিবসে একপার্শ্ব ভঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে।’ অর্থাৎ একপাশ অবশ হয়ে যাবে’ (সুনানে আবু দাউদ: ২১৩৩)। রাসুল (সা.) ও তার জীবদ্দশায় সামাজিকতা রক্ষা এবং দ্বীনি উপকারার্থে একাধিক পরিণয় করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রত্যেক সহধর্মিণীদের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে সাম্য বজায় রেখে চলতেন। তবে তার অন্তরের আসক্তি ও প্রেমাষ্পদ আয়েশা (রাযি.)-এর প্রতি অন্যদের চেয়ে বেশি ছিল। এ জন্য তিনি প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! ভালোবাসা ইচ্ছাধীন বিষয় নয়, তাই আয়েশার প্রতি অধিক ভালোবাসার কারণে আমাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না।
এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমনীন হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, পালার ব্যাপারে আল্লাহর নবী (সা.) সর্বদা সমতা বিধান করতেন। তিনি কখনো কোনো স্ত্রীর অধিকার হরণ করে অপরকে দান করতেন না।
রাত যাপন
ফুকাহায়ে কেরাম এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করে বলেন, একাধিক জায়াদের মাঝে সর্বক্ষেত্রে সাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। আল্লামা ইবনে নুজাইম আল-মিসরী (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘যদিও প্রেমাষ্পদের ক্ষেত্রে সমতা শরয়ী দৃষ্টিকোণে জরুরি নয়, তবে রাত্রী যাপনে সমতা চাই, বধূ সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ, মুসলমান হোক বা কিতাবিয়া, কুমারী হোক বা বিধবা সর্বাস্থায় আবশ্যক’ (বাহরুর রায়িক: ৩/৩৮১)।
স্বামী অসুস্থ হলে
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, একাধিক স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার ও সমতা রক্ষা করার গুরুত্ব এতো বেশি যে, স্বামী রুগ্ণ হলেও তাদের নির্ধারিত বরাদ্দ যথাযথ আদায় জরুরি। সুতরাং যদি স্বামী অধিক অসুস্থতার কারণে কোনো স্ত্রীর কাছে থেকে যান। পালা অনুযায়ী অন্যদের কাছে যেতে না পারেন, তাহলে সুস্থতার পর তাদের নির্ধারিত বরাদ্দ পূর্ণ করা স্বামীর ওপর অপরিহার্য (শামী: ৪/৩৮২)।
সফরে গমন
পালা অনুযায়ী কাউকে সফরে নিয়ে যাওয়া জরুরি নয়, তবে মুস্তাহাব হচ্ছে, লটারির মাধ্যমে সফরসঙ্গী নির্ধারণ করা। লটারিতে যার নাম উঠবে তাকে সফরে নিয়ে যাবে। রাসুল (সা.) নিজেও সহধর্মিণীদের অন্তরের সন্তুষ্টির লক্ষে সফরে যাওয়ার সময় লটারির মাধ্যমে সফরসঙ্গী বেছে নিতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) যখন সফরের ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তার স্ত্রীগণের মধ্যে লটারি করতেন, যার নাম উঠত তাকে সঙ্গে নিতেন’ (সহীহ আল-বুখারী)।
(মাসিক আত তাওহীদ, নভেম্বর ২০১৭)