গায়েবানা জানাযা পড়ার হুকুম কী?
মুফতি লুৎফর রহমান ফরায়েজী
লেখক: প্রধান মুফতি, জামিয়াতুস সুন্নাহ, ঢাকা
গায়েবানা জানাযা বিষয়ে ফকীহদের মতামত
ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) ও তাঁর অনুগামী সকল ইমাম এবং ইমাম মালেক (রহ.)-এর মতে গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। চাই দাফনের আগে হোক বা পরে। মাইয়্যিত শহরের ভেতরে থাক বা বাইরে। (মাবসূতে সারাখসী: ২/৬৭, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত ও মানহুল জালীল: ১/৩৭৬)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) থেকে জায়েয হওয়ার একটি উক্তি থাকলেও স্বীয় শাগরিদ ইবনে আবু মুসা তাঁর থেকে নাজায়েয হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহবিদ আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ইমাম মালেক (রহ.) ও ইমাম আবু হানিফা (রহ.) উভয়ে বলেন, গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। ইমাম আহমদ (রহ.) থেকে ইবনে আবু মুসা উক্ত ইমামদ্বয়ের অনুরূপ (নাজায়েয হওয়ার) একটি উক্তি বর্ণনা করেছেন।’ (আল-মুগনী: ২/৩৮৬)
ইমাম শাফিয়ী (রহ.) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর মতে মাইয়্যিত ভিন্ন শহরে থাকলে গায়েবানা জানাযা জায়েয। কিন্তু শহরের ভেতরে থাকার মাইয়্যেতের গায়েবানা জানাযা জায়েজ নয়। মাইয়্যেতকে উপস্থিত করতে হবে। (আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু: ১/৫০৪, মাকতাবাতুল হক্কানিয়া, পাকিস্তান, আল-মাজমু: ৫/২৫৩)
আল্লামা ইবনে আবদুল বার (রহ.) গায়েবানা জানাযা নাজায়েয হওয়ার উক্তিকে জমহুর ফুকাহা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের মতামত বলে অভিহিত করেছেন। যেমনটি উল্লেখ করেছেন বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া (রহ.)। তিনি বলেন, ‘হানাফী ও মালেকী ওলামাগণ বলেন, গায়েবানা জানাযা শরীআত সম্মত নয়। ইবনে আবদুল বার (রহ.) এ উক্তিকে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।’ (লামিউদ দারারী: ৪/৪৩২)
বিশুদ্ধতম মত
অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাজা বা গায়েবানা জানাযা বলতে কোনো শব্দ কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই। এর কোনো প্রমাণ না কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীগণ, তবে-তাবেয়ীগণ থেকে এ শব্দের কোনো জানাযার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ নেই। এটি বিদআত।
রসুল (সা.) ও খুলাফায়ে রাশেদীন কোনো
দিন কারও গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, মুসলমানদের মাঝে অনেক এমন ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন যারা রসুল (সা.) থেকে দূরে তথা গায়েব ছিলেন। কিন্তু নবীজি (সা.) কারোই গায়েবানা জানাযা পড়েননি। (যাদুল মা‘আদ: ১/৫১৯)
এমনিভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর আমলে কত কারী সাহাবীকে মুসাইলামায়ে কাজ্জাব শহীদ করেছে। আরও কত সাহাবী জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ কেউই গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি।
হযরত ওমর (রা.)-এর আমলে কত জিহাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কত হাজার হাজার সাহাবা জিহাদের ময়দানে মদীনা থেকে বহু দূরে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোনো একজনেরও গায়েবানা জানাযা হযরত ওমর (রা.) আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছে মর্মে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না।
পারবে না হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.)-এর আমলের কোনো উদাহরণ পেশ করতে। অথচ হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.) আমলেও কত হাজার হাজার সাহাবা ও তাবেয়ীগণ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোনো সাহাবীই গায়েবানা জানাযার ইলান করেছেন বা নিজে গায়েবানা জানাযার নামাজ পড়েছেন মর্মে কোনো প্রমাণ না হাদীস থেকে পেশ করতে পারবে, না ইতিহাস থেকে পেশ করতে পারবে।
গায়েবানা জানাযা জায়েয
প্রবক্তাদের দলিল ও তার খণ্ডন
দলিল: বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে একটি বর্ণনায় রয়েছে, ‘মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বাদশাহ নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। অতঃপর জানাযার জন্য অগ্রসর হলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পিছনে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়ালে নবীজি (সা.) চারটি তাকবীর বললেন।’ (বুখারী শরীফ, দিল্লি: ১/১৬৭) একই বর্ণনা সহীহ ইবনে হিব্বানে (১/১৬৭) হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
আর নাজাশী যেহেতু মদীনায় উপস্থিত ছিল না, অথচ রসুল (সা.) তাদের নাজাশীর জানাযা নামাজ পড়িয়েছেন, তাই বোঝা গেল যে, গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ। রসুল (সা.) থেকেই গায়েবানা জানাযা পড়ার প্রমাণ রয়েছে।
প্রথম জবাব: প্রথমে আমরা দেখে নেই উক্ত হাদীসটি কোনো রাবী বর্ণনা করেছেন? উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নাজাশীর জানাযা সংশ্লিষ্ট হাদীস থেকে গায়েবানা জানাযা জায়েজ হওয়ার দলিল হিসেবেই বুঝেছেন না ভিন্ন কিছু? উক্ত হাদীসের প্রসিদ্ধতম রাবী রয়েছেন তিনজন। যথা-
- হযরত আবু হুরায়রা (রা.),
- হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) ও
- হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.)।
বাদশা নাজাশী ইন্তেকাল করেছেন নবম হিজরীর রজব মাসে। (হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা মালিক: পৃ. ২০৮) আর হযরত আবু হুরায়রা (রা.) ইন্তেকাল করেছেন ৫৯ হিজরীতে। অর্থাৎ উক্ত ঘটনার পর হযরত আবু হুরায়রা (রা.) প্রায় ৫০ বছর জীবিত ছিলেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) ইন্তেকাল করেছেন ৭৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। সেই হিসেবে তিনি উক্ত ঘটনার পর ৭০ বছর জীবিত ছিলেন। আর হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) উক্ত ঘটনার পর জীবিত ছিলেন প্রায় ৪৩ বছর। কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা (রা.) এ ৫০ বছরের মাঝে, হযরত জাবের (রা.) পুরো ৭০ বছরের মাঝে এবং হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) তার জীবনের এ ৪৩ বছরের মাঝে কোনোদিন কারও গায়েবানা জানাযা পড়েছেন কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়তে বলেছেন কেউ প্রমাণ দেখাতে পারবে?
এত দীর্ঘ বেঁচে থাকার পরও উক্ত ঘটনা থেকে এসকল সাহাবাগণ যদি গায়েবানা জানাযা জায়েজের প্রমাণই বুঝে থাকতেন, তাহলে তাদের জমানায় ইন্তেকাল হওয়া অসংখ্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা তাদের পড়ার কথা। কিন্তু একজনের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর কোনো প্রমাণ না কোনো হাদীস গ্রন্থে আছে না কোনো ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়। যা পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, উক্ত ঘটনা দ্বারা কোনো সাহাবী গায়েবানা জানাযা জায়েজ বুঝেননি। বরং বিষয় ছিল ভিন্ন। আসলে কি হয়েছিল তখন? আমরা যদি উক্ত ঘটনার বর্ণনাসংবলিত সকল হাদীসকে সামনে রাখি, তাহলে আমাদের কাছে উক্ত বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয় জবাব: নাজাশীর ঘটনাসংবলিত হাদীসমূহ:
- হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, وَمَا نَحْسِبُ الْـجِنَازَةَ إِلَّا مَوْضُوعَةً بَيْنَ يَدَيْهِ অর্থাৎ আমরা জানাযার ব্যাপারে এটাই অনুধাবন করছিলাম যে, তা আমাদের সামনে রাখা আছে। (মুসনদে আহমদ, হাদীস: ২০০০৫)
- হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, وَهُمْ لَا يَظُنُّونَ إِلَّا أَنَّ جَنَازَتَهُ بَيْنَ يديه অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের বিশ্বাস এটাই ছিল যে, জানাযা হুযূর (সা.)-এর সামনে উপস্থিত। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস: ৩১০২)
- এছাড়া উক্ত বর্ণনাটি হযরত আবান (রহ.) সূত্রে হযরত ইমরান ইবনে হাছীন থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, ‘যখন নবীজি (সা.)-এর পিছনে জানাযা পড়েছি, তখন নাজাশীর লাশকে আমাদের সামনে উপস্থিত দেখতে পেয়েছি।’ (উমদাতুল কারী শরহুল বুখারী: ৭/৩৩, মাকতাবায়ে তাওফীকিয়া, মিসর ও ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী: ৩/২৪৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত)
- আবু আওয়ানায় এ শব্দ এসেছে যে, نحن لا نرىٰ أن الجنازة قدمنا অর্থাৎ আমরা দেখছিলাম যে, আমাদের সামনে জানাযা রাখা।
উপরোক্ত সকল বর্ণনার দিকে তাকালে পরিস্কার হয়ে যাবে, নাজাশীর জানাযা বর্ণনাকারী সাহাবীগণ কেন উক্ত ঘটনা দ্বারা গায়েবানা জায়েজের দলিল মনে করেননি। নাজাশীর জানাযার বর্ণনা করলেও জীবনে কোনোদিন নিজে গায়েবানা জানাযা পড়েননি। কারণ তারা পরিস্কার বুঝেছিলেন নাজাশীর জানাযার নামাজটি গায়েবানা জানাযা নয়। বরং উপস্থিত ব্যক্তির জানাযা। রসুল (সা.)-এর মু’জিযাস্বরূপ নাজাশীকে নবীজি (সা.)-এর সামনে উপস্থিত করে দেওয়া হয়েছিল। আর সেই জানাযা সামনে নিয়ে নবীজি (সা.) জানাযা পড়িয়েছেন। আর সামনে নিয়ে জানাযা পড়ার নাম উপস্থিত ব্যক্তির জানাযা গায়েবানা জানাযা নয়। সাহাবাগণ এ ভেদ জানার কারণে কোনো সাহাবী জীবনে কোনোদিন গায়েবানা জানাজা পড়েননি। কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়ার দাবিও করেননি, কিংবা গায়েবানা জানাযার পক্ষে উক্ত হাদীসের দলিলও পেশ করেননি। কারণ তারা জানতেন আসলে উক্ত ঘটনাটি একটি মু’জিযা। যাতে নাজাশী গায়েব ছিল না, আল্লাহর কুদরতে নবীজি (সা.)-এর মু’জিযা স্বরূপ উপস্থিত ছিল।
দূরের বস্তু উপস্থিত হয়ে যাওয়ার মু’জিযার প্রমাণ কী?
আল্লাহ তাআলার জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। নবীদের মু’জিযা আর ওলীদের কারামত সত্য। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা। রসুল (সা.) থেকে আল্লাহ তাআলা অনেক মু’জিযা প্রকাশিত করেছেন। এর মাঝে এটাও ছিল যে, মাঝে মাঝে দূরের বস্তুকে কাছে করে দিতেন। এসব করায় রসুল (সা.)-এর নিজের কোনো ক্ষমতা ছিল না। পুরোটাই আল্লাহ প্রদত্ত। বেশ কিছু মু’জিযাপূর্ণ ঘটনায় দূরের বস্তু কাছে দেখেছেন রসুল (সা.)। যেমন-
- রসুল (সা.) মদীনায় ছিলেন। তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন মুতা প্রান্তরে। সাহাবাগণ জীবনবাজি রেখে দীনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলেন। মদীনায় বসে শত শত মাইল দূরের মুতা প্রান্তরের বর্ণনা রসুল (সা.) দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘জায়েদ ঝান্ডা নিয়েছে এবং শহীদ হয়ে গেছে। তারপর ঝান্ডা জাফর নিয়েছে সেও শহীদ হয়ে গেছে। তারপর ঝান্ডা আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা নিয়েছে সেও শহীদ হয়ে গেছে।’ এ পর্যায়ে রসুল (সা.) কেঁদে দিলেন। বলতে লাগলেন, ‘এবার ঝান্ডা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ নিয়েছে আর বিজয়ী হয়ে গেছে।’ (সহীহ বুখারী: ১/১৬৭)
- মক্কায় অবস্থান করা অবস্থায় হাজার মাইল দূরের বায়তুল মাকদিসের পূর্ণ হালাত দেখে দেখে কাফেরদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। (বুখারী শরীফ, ১/৫৪৮) হাবশা, মুতা ও বায়তুল মাকদিস তো দুনিয়ার স্থান। আমাদের নবীতো মদীনায় বসে থেকে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন। (বুখারী শরীফ, ১/৭৭, ১০৩, ১২৬, ১৪৪, ১৬৪)
তৃতীয় জবাব: এ ঘটনা রসুল (সা.)-এর সাথে বৈশিষ্টমণ্ডিত। যদি রসুল (সা.)-এর সাথেই বৈশিষ্টমণ্ডিত না হতো, তাহলে রসুল (সা.) পরবর্তীতে অন্যান্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা পড়তেন। খুলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবাগণও পড়তেন। অথচ কারও থেকেই গায়েবানা জানাযা পড়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। মালেকী মাযহাবের ইমাম আল্লামা ইল্লিশ (রহ.) লিখেছেন, ‘মদীনায় নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়ার বিষয়টি রসুলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। কেননা উম্মত রসুলের জানাযা আদায় করার প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেনি। এবং নাজাশীর লাশকে অলৌকিকভাবে রসুলের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে রসুল (সা.) নাজাশীর লাশ সামনে দেখেই তার জানাযা পড়েছেন। যেমন- মাইয়্যিত ইমামের সামনে থাকা অবস্থায় ইমাম মাইয়িতকে দেখতে পায়, কিন্তু অনেক মুক্তাদী দেখতে পায় না। আর এ ক্ষেত্রে নামাজ সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই।’ (মানহুল জালীল: ১/৩১৬-৩১৭)
চতুর্থ জবাব: শায়েখ যাকারিয়া (রহ.) লিখেন, ‘আমার নিকট সঠিক এটাই মনে হয় যে, ইমাম বুখারী (রহ.) এ মাসআলাটিতে হানাফী ও মালেকী মতকে সমর্থন করেছেন এবং ‘আল-জানাযাতু আলাস সুফূফ’ তথা ‘জানাযায় কাতারবন্দি হওয়া’ শিরোনাম স্থাপন করে ইঙ্গিত করেছেন যে, নাজাশীর জানাযা দৃশ্যমান ছিল; গায়েব ছিল না। আর এটাই উক্ত মাযহাবদ্বয়ের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা (যা আলোচ্য বিষয়কে সমর্থন করে)। তাইতো হাদীস থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘আল-গায়েবু আলাস সফূফ’ তথা ‘অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা’ অধ্যায় স্থাপন করেননি। তাছাড়া বুখারী শরীফে শিরোনাম স্থাপনের নীতিমালার ৬৫ নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, ‘কোনো মাসআলা ইমাম বুখারী (রহ.)-এর মতামতের পরিপন্থী হলে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করেন না।’ (হাশিয়া লামিউদ দারারী শরহুল বুখারী: ২/১২২, মাকতাবাতুল আশরাফিয়া দিল্লি) সুতরাং বোঝা গেল যে, ইমাম বুখারী (রহ.) নিজেই উক্ত হাদীসকে গায়েবানা জানাযা জায়েজের দলিল মনে করেননি।
একটি হাস্যকর দলিল ও জবাব
অনেক ভাই গায়েবানা জানাযাকে জায়েজ প্রমাণ করার জন্য একটি হাস্যকর দলিল পেশ করে থাকেন। তারা বলে থাকেন, গায়েবানা জানাযা পড়া যে, জায়েজ হওয়ার পরিস্কার দলিল হল, জানাযার নামাজে যে দোয়া পড়া হয়, তাতে বলা হয়, ‘শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা’ তথা উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই দোয়া করা হয়ে থাকে। আর জানাযা নামাজ যেহেতু দোয়া। আর তাতে উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই মাগফিরাতের কথা এসেছে, তাই বুঝা যাচ্ছে অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযাও জায়েজ আছে। অর্থাৎ গায়েবানা জানাযা বৈধ।
জবাব: আসলে এ দলিলটি খুবই হাস্যকর দলিল। যদি গায়িবিনা তথা অনুপস্থিত ব্যক্তির মাগফিরাতের কথা উল্লেখ থাকায় গায়েবানা জানাযা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে তো একই যুক্তিতেই জীবিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যাবে। কারণ জানাযার নামাজের দোয়ায় পড়া হয়: ‘আল্লাহুম্মাগফিরলী হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা’ তথা হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জীবিত ও মৃতদের মাফ করে দাও।
লক্ষ করুন, মাফ চাওয়া হয় প্রথমে জীবিতদের ব্যাপারে। তারপর বলা হয় ‘ওয়া শাহিদিনা ও গায়িবিনা’। যদি ‘গায়িবিনা’ শব্দ থাকায় অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে ‘হাইয়্যিানা’ শব্দ থাকায় জীবিত ব্যক্তির জানাযা কেন জায়েজ হবে না? আসলে এ দলিলটি খুবই হাস্যকর ও বোকামিপূর্ণ।
যা হোক উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, গায়েবানা জানাযা পড়ার কোনো দলিল কুরআন ও হাদীস এবং সাহাবাগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই একাজটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব রসম-রেওয়াজ থেকে মুক্ত হয়ে সঠিকভাবে দীন পালন করার তওফিক দান করুন। আমীন।