খারেজিদের বিষাক্ত ছোবলে কলঙ্কিত ইসলামের সোনালি ইতিহাস
ড. আহমদ আলী
লেখক: প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
খলীফা হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে খারেজিরা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু আবু লু’লু নামক জনৈক অগ্নিপূজক বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে গোপনে মদীনায় প্রবেশ করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। হিজরী ২৩ সালের ২৬শে যিলহজ খলীফা হযরত ওমর (রা.) ফজরের সালাতে ইমামতি করছিলেন, এমন সময় সে ছদ্মবেশে প্রথম কাতারে অবস্থান নেয়। অতঃপর সুযোগ বোঝে তীক্ষ্ম তরবারি দ্বারা তিন অথবা ছয়বার তাঁর কোমরে আঘাত করে। তিন দিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। এভাবে ইসলামের ইতিহাসে চরমপন্থী তৎপরতার উত্থান ঘটে। উল্লেখ্য, সেই দিন সে আরও ১৩ জন সাহাবীকে আঘাত করে। এর মধ্যে নয়জন শাহাদত বরণ করেন। ওই ঘাতক পালিয়ে যেতে না পেরে নিজের অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে।
ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবার ষড়যন্ত্রে একদল চরমপন্থীদের হাতেই হিজরী ৩৫ সালে ১৮ই যিলহজ জুমার দিন রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জামাতা ৮২ বছর বয়সী সাইয়েদুনা হযরত উসমান (রা.) নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। এরপর নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া খারেজিরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অতঃপর তারা সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.)-কে হত্যা করার জন্য গোপনে আবদুর রহমান ইবনে মুলজামকে ঠিক করে। অনুরূপভাবে হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে হত্যা করার জন্য বকর ইবনে আবদুল্লাহকে এবং হযরত আমর ইবনুল আস (রা.)-কে হত্যা করার জন্য আমর ইবনে বাকরকে নির্বাচন করে। এভাবে তারা একই দিনে হত্যা করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম তার দুজন সহযোগী ওরদান ও শবীবকে সাথে নিয়ে হিজরী ৪০ সালের ১৭ই রমজান জুমার রাতে কূফায় গমন করে। তারা ফজরের সময় সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.)-এর বাড়ির দরজার আড়ালে অস্ত্র নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যখন ‘সালাত’ ‘সালাত’ বলে মানুষকে ডাকতে ডাকতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই তারা সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.)-এর মাথায় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এতে তাঁর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। এ সময় আলী (রা.)-কে লক্ষ করে সেই রক্তপিপাসু বলেছিল,
لَا حُكْمَ إِلَّا لِلهِ، لَيْسَ لَكَ يَا عَلِيُّ وَلَا لِأَصْحَابِكَ.
‘হে আলী! আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান নেই। তোমার জন্যও নেই এবং তোমার সাথীদের জন্যও নেই।’
তাঁকে হত্যা করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলে ওঠে,
شَحَذْتُهُ أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا وَّسَأَلْتُ اللهَ أَنْ يَقْتُلَ بِهِ شَرَّ خَلْقِهِ.
‘আমি ৪০ দিন যাবৎ তরবারিকে ধার দিয়েছি এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছি, আমি যেন এ অস্ত্র দ্বারা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারি।’ (না‘ঊযু বিল্লাহ!)
একথা শুনে সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি তো তোমাকে এ অপরাধের কারণে নিহতরূপেই দেখতে পাচ্ছি এবং তোমাকে সৃষ্টির একজন নিকৃষ্ট ব্যক্তিই মনে করি।’ এরপর তিনি আরও বললেন, ‘আমি মারা গেলে তোমরা তাকে হত্যা করবে। আর বেঁচে থাকলে আমিই যা করার করবো।’[1] কিন্তু তিন দিন পর হিজরী ৪০ হিজরীর ২১শে রমজান ৬৩ বা ৬৪ বছর বয়সে তিনি শাহাদত বরণ করেন। সেদিন একই সময় হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে আঘাত করলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আমর ইবনুল আস (রা.) ভীষণ অসুস্থ থাকায় তিনি সেদিন মসজিদে আসতে পারেননি। ফলে তিনি বেঁচে যান। তবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ইমাম খারিজা ইবনে হাবীবাকে সংশ্লিষ্ট ঘাতক হত্যা করে। এভাবে খারেজিরা খুলাফা রাশিদূনের মতো জান্নাতী ও বিশিষ্ট সাহাবীগণের প্রাণনাশ ঘটিয়ে ইসলামের সোনালি ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে।[2] খারেজিদের ভয়ানক রূপ সম্পর্কে ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন,
أَنَّهُمْ شَرٌّ عَلَى الْـمُسْلِمِيْنَ مِنْ غَيْرِهِمْ، فَإِنَّهُمْ لَـمْ يَكُنْ أَحَدٌ شَرًّا عَلَى الْـمُسْلِمِيْنَ مِنْهُمْ: لَا الْيَهُوْدُ وَلَا النَّصَارَىٰ؛ فَإِنَّهُمْ كَانُوْا مُجْتَهِدِيْنَ فِيْ قَتْلِ كُلِّ مُسْلِمٍ لَّـمْ يُوَافِقُهُمْ، مُسْتَحِلِّيْنَ لِدِمَاءِ الْـمُسْلِمِيْنَ وَأَمْوَالِـهِمْ وَقَتْلِ أَوْلَادِهِمْ، مُكَفِّرِيْنَ لَـهُمْ، وَكَانُوْا مُتَدَيِّنِيْنَ بِذَلِكَ لِعَظْمِ جَهْلِهِمْ وَبِدْعَتِهِمُ الْـمُضِلَّةِ.
‘তারা মুসলিমদের জন্য অন্য যেকারও চেয়ে অধিক ক্ষতিকর। কারণ মুসলিমদের জন্য তাদের চেয়ে ক্ষতিকর আর কেউ ছিল না। না ইহুদি, না খ্রিস্টানরা। কেননা যে সকল মুসলিম তাদেরকে সমর্থন করতো না, তাদেরকে হত্যা করতে তারা সদা তৎপর থাকতো। তারা মুসলমানদের কাফির মনে করতো এবং এ কারণে তাদের রক্ত ও সম্পদ এবং তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করাকে বৈধ জ্ঞান করতো। তাদের মারাত্মক অজ্ঞতা ও ভ্রষ্ট বিদআতের কারণে তারা নিজেদের এ গর্হিত কাজকে দীনরূপে অবলম্বন করতো।’[3]
হাফিয ইবনে কসীর (রহ.) বলেন,
إِذْ لَوْ قَوُوا هَؤُلَاءِ لَأَفْسَدُوا الْأَرْضَ كُلَّهَا عِرَاقًا وَشَامًا، وَلَـمْ يَتْرُكُوْا طِفْلًا وَلَا طِفْلَةَ وَلَا رَجُلًا وَلَا امْرَأَةً ; لِأَنَّ النَّاسَ عِنْدَهُمْ قَدْ فَسَدُوْا فَسَادًا لَا يُصْلِحُهُمْ إِلَّا الْقَتْلُ جُمْلَةً.
‘যদি খারেজিরা শক্তিশালী হয় তথা ক্ষমতা পায়, তখন তারা ইরাক ও শামের সর্বত্র ফাসাদ সৃষ্টি করে (মুসলমানদেরকে তাকফীর ও হত্যা .. ইত্যাদি করে) বেড়াবে। তারা কোনো ছেলে শিশু, মেয়ে শিশু এবং নারী-পুরুষ কাউকে রেহাই দেবে না। কেননা তাদের আকীদা হলো, মানুষ এমনভাবে ফাসাদে লিপ্ত হয়েছে যে, তাদেরকে সামগ্রিকভাবে হত্যা করা ব্যতীত তারা সংশোধিত হবে না।’[4]
খারেজিদের অপব্যাখ্যা ও তার জবাব
খারেজিদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, কুরআন ও হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে সালাফে সালিহীনের ব্যাখ্যা ও উপলব্ধিকে উপেক্ষা করে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা করা। নিম্নোক্ত তাদের অপব্যাখ্যার কিছু নমুনা জবাবসহ আলোচনা করা হলো:
এক. আল্লাহ তাআলা বলেন, هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَّمِنْكُمْ مُّؤْمِنٌؕ ۰۰۲ (তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের কেউ কাফির এবং কেউ মুমিন।)[5] খারেজিরা মনে করে, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে কাফির ও মুমিন দুভাগে সীমাবদ্ধ করেছেন। কাজেই ফাসিকরা মুমিন নয় কাফির।
জবাব: এ আয়াত দ্বারা মানুষকে কেবল দুভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়নি। কেননা আরও এক প্রকারের মানুষ রয়েছে, তারা হলো পাপী। এখানে এ দুই প্রকারের কথা উল্লেখ করার অর্থ এ নয় যে, বাকি প্রকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে বলা হয়েছে, কিছু মানুষ কাফির, আর কিছু মুমিন। এর বাস্তবতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু তা দ্বারা এটা বোঝায় না যে, পাপী মুমিনরা কাফির, যেমনটি দাবি করছে খারেজিরা।
দুই. রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«لَا يَزْنِي الزَّانِيْ حِيْنَ يَزْنِيْ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَشْرَبُ الْـخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَنْتَهِبُ نُهْبَةً، يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ، حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ».
‘কোনো ব্যভিচারী মুমিন থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না। কোনো ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় মদ পান করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় চুরি করতে পারে না। ছিনতাইকারী যখন প্রকাশ্যে ছিনতাই করে, আর লোক অসহায় ও নিরূপায় হয়ে তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে, তখন সে মুমিন থাকে না।’[6]
খারেজিরা এ হাদীসের ভিত্তিতে একথা প্রমাণ করতে চায় যে, কবীরা গুনাহকারীরা মুমিন নয়; তারা ঈমান থেকে পুরোপুরি খারিজ।
এর জবাব হচ্ছে, বিশিষ্ট আলিমগণ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, যে ব্যক্তি হাদীসে উল্লিখিত পাপগুলোকে হালাল মনে করে করবে, তার জন্যই এ বক্তব্য প্রযোজ্য। অথবা হাদীসে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ ঈমানদার নয় বোঝানো হয়েছে।[7] এ হাদীসে উল্লিখিত পাপের কারণে যদি ঈমান থেকে খারিজ হওয়া উদ্দেশ্য হতো, তাহলে তার জন্য শুধু হদ্দ জারি করাই যথেষ্ট মনে করা হতো না। এ জন্যই বিশিষ্ট তাবিয়ী ইমাম যুহরী (রহ.) এ ধরনের হাদীস সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা এ হাদীসগুলো থেকে সেরূপ মর্ম বের করো, যেরূপ মর্ম তোমাদের পূর্ববর্তীগণ বের করতেন।’[8] অন্য হাদীসে এসেছে, সাইয়েদুনা হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো বান্দা বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া (সত্যিকার) কোনো ইলাহ নেই এবং এর ওপরই মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ আমি বললাম, যদি সে যিনা করে এবং চুরি করে তবুও? তিনি বললেন, ‘যদিও সে যিনা করে এবং চুরি করে।’ এভাবে আমি তিনবার বললাম, প্রত্যেকবারেই তিনি একই উত্তর দিলেন। চতুর্থবার বললেন, ‘যদিও আবু যর (রা.)-এর নাক ভূলুণ্ঠিত হয়…।’[9]
এ হাদীস থেকে স্পষ্টত জানা যায়, যিনা ও চুরির মতো অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিরাও মুমিন, যদি তাদের মধ্যে সত্যিকার ঈমান থাকে এবং তারা মুমিন হওয়ার কারণেই কোনো না কোনো সময় জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তিন. আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْكٰفِرُوْنَ۰۰۴۴ (যেসব ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী ফয়সলা করে না, তারা কাফির।)[10] তাদের দাবি, এ আয়াতের মধ্যে সকল প্রকার পাপীই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কেননা তারা আল্লাহ তাআলা যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী ফয়সলা করে না। সুতরাং এ আয়াত থেকে তাদের কাফির হওয়ার ব্যাপারটি সাব্যস্ত হয়ে যায়।
জবাব: এ আয়াতটি তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা আল্লাহ তাআলার বিধানকে অস্বীকার করে এবং গায়রুল্লাহর বিধান দিয়ে ফয়সলা করাকে বৈধ মনে করে। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং স্বীকার করে যে, তাঁর বিধান সত্য, তাহলে সে কাফির নয়; সে পাপী হিসেবে গণ্য হবে, যে যাবৎ না তার কথা ও কাজে কুফরির সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
চার. আল্লাহ তাআলা বলেন, اِنِ الْحُكْمُ اِلَّا لِلّٰهِؕ ۰۰۶۷ (আল্লাহ তাআলা ছাড়া কারও হুকুম নেই।)[11]
খারেজিরা অজ্ঞতাহেতু এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলে, মানুষকে সালিশ নিয়োগ করা কুরআনের পরিপন্থী এবং কুফরি। এর জবাবে সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.) বলেছিলেন, كَلِمَةُ حَقٍّ أُرِيْدَ بِهَا بَاطِلٌ (কথা সত্য; কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ।)[12] কেননা মানুষের ফয়সলা মানুষ নিজেই করবে, আর তা হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী।[13]
খারেজি আকীদা বনাম আহলুস
সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা
যদিও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে খারেজিদের উদ্ভব ঘটে; কিন্তু পরবর্তীকালে তারা ক্রমশ একটি ধর্মতাত্ত্বিক দলে পরিণত হয়। ধর্ম ও রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাদের নিজস্ব কিছু চিন্তা-দর্শন রয়েছে, এর মধ্যে কোনো কোনোটি শরীয়তসম্মত হলেও অধিকাংশই ছিল উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মতের বিপরীত সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চিন্তা, আবার কোনোটি উগ্র মত হিসেবেও পরিগণিত। নিম্নোক্ত তাঁদের কতিপয় বিশেষ আকীদা ও চিন্তাদর্শনের কথা আলোচনা করা হলো, পাশাপাশি তাদের এসব চিন্তাদর্শন প্রসঙ্গে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিশ্বাসও তোলে ধরা হলো:
ক. ঈমান প্রসঙ্গে
খারেজিদের মতে, ঈমান শুধু অন্তরে বিশ্বাস ও মুখে স্বীকৃতির নাম নয়; প্রত্যেক ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকলেই ঈমান টিকে থাকতে পারে। তারা ঈমান ও আমলের সুদৃঢ় সম্পর্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। তাদের মতে, আমল ঈমানের একটি প্রধান মৌলিক অংশ; আমল ছাড়া ঈমানের এবং ঈমান ছাড়া আমলের কোনো গুরুত্ব নেই।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে, ঈমানের মধ্যে আমলের গুরুত্ব রয়েছে বটে; তবে তা ঈমানের প্রধান মৌলিক অংশ নয়। তাদের অধিকাংশের মতে আমল ঈমানের পরিপূরক অংশ, আর হানাফীগণের মতে আমল ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্য অপরিহার্য শর্ত। এ কারণে আহলুস সুন্নাত মনে করেন, কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি দুনিয়ায় কাফির নয়; বরং দুর্বল বা ত্রুটিটিযুক্ত মুমিন।
খ. কবীরা গোনাহগার প্রসঙ্গে
খারেজিদের মতে, মানুষ হয় মুমিন, নয় কাফির। একই বান্দার মাঝে সওয়াব ও শাস্তি একত্র হতে পারে না। অধিকন্তু, প্রত্যেক কবীরা গোনাহই কুফর এবং এ ধরনের গোনাহগার কাফির। যে কোনো মুসলিম কবীরা গুনাহ করলে তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায় এবং সে মুরতাদ হয়ে যায় ও কুফরিতে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় তাওবা না করে মারা গেলে সে কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তারা মনে করে, যারা কবীরা গোনাহ করে তাওবা করে না, তাদেরকে হত্যা করা বৈধ।
আহলুস সুন্নাতের মতে, কবীরা গোনাহ কুফর নয় এবং এ ধরনের গুনাহগার কাফির নয়। এ কারণে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয় এবং তাকে হত্যা করাও জায়িয নয়। যদি সে তাওবা না করে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি তাকে ক্ষমাও করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয়; বরং অপরাধের শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহ তাআলার দয়ায় আবার সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে কবীরা গুনাহের কারণে ফাসিক; কিন্তু ঈমানের কারণে সে মুমিন। এ মতটি খারেজিদের চরমপন্থা এবং মুরজিয়াদের চরম শিথিলতার বিপরীতে ভারসাম্যপূর্ণ আকীদা। পবিত্র কুরআনের নানা আয়াতে আল্লাহ তাআলা কবীরা গোনাহকারীদেরকেও মুমিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
وَاِنْ طَآىِٕفَتٰنِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَاَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَاۚ ۰۰۹
‘যদি মুমিনদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে।’[14]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসির ইবনে কসীর (রহ.) বলেন,
فَسَمَّاهُمْ مُؤْمِنِينَ مَعَ الِاقْتِتَالِ، وَبِهَذَا اسْتَدَلَّ الْبُخَارِيُّ وَغَيْرُهُ عَلَىٰ أَنَّهُ لَا يَخْرُجُ مِنَ الْإِيمَانِ بِالْـمَعْصِيَةِ وَإِنْ عَظُمَتْ، لَا كَمَا يَقُولُهُ الْـخَوَارِجُ وَمَنْ تَابَعَهُمْ مِنَ الْـمُعْتَزِلَةِ وَنَحْوِهِمْ.
‘পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ আয়াত দ্বারা ইমাম বুখারী (রহ.) ও অন্যান্য বিশিষ্ট আলিমগণ দলিল গ্রহণ করেছেন যে, পাপের কারণে কেউ ঈমান থেকে বের হয়ে যায় না। বিষয়টি এমন নয় যে, যেমন খারেজি এবং তাদের অনুসারী মুতাযিলা ও অন্যরা বলে থাকে।’[15]
গ. কুরআন-সুন্নাহ প্রসঙ্গে
খারেজিদের মতে, কুরআন মাখলূক (সৃষ্ট)।[16] সুন্নাতের যেসব বিষয় তাদের নিকট তাদের বিশ্বাস অনুসারে কুরআনের বাহ্যিক অর্থের বিরোধী মনে হয়, সেসব সুন্নাতকে তারা অস্বীকার করে। হাফিয ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহ.) বলেন, ‘তারা কুরআনের অপব্যাখ্যা করে।’ তারা সুন্নাত দ্বারা সাব্যস্ত ব্যভিচারীকে রজম করার বিধান অস্বীকার করে।
আহলুস সুন্নাতের মতে, কুরআন মাখলূক নয়; বরং চিরন্তন ও শাশ্বত। এ বিষয়ে আমি বিদআত দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অধিকন্তু, সুন্নাহও কুরআনের মতোই অহীবিশেষ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, «أَلاَ إِنِّيْ أُوْتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ» (জেনে রেখো, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার ন্যায় আরেকটি বিষয়ও।)[17] তাছাড়া এ সুন্নাহ হচ্ছে কুরআনের ব্যাখ্যাস্বরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاَنْزَلْنَاۤ اِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ۰۰۴۴
‘আমরা আপনার নিকট ‘যিকর’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলো তাদের নিকট ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে।’[18]
সুতরাং এ দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ ও বৈপরীত্য নেই।
ঘ. নবী-রসুলগণ প্রসঙ্গে
খারেজিদের কোনো কোনো দল নবী-রসুলগণের দ্বারা সগীরা ও কবীরা গুনাহ সংঘটিত হওয়াকে জায়িয মনে করে। তাই তাদের মতে, কোনো নবীকেও কবীরা গুনাহের কারণে কাফির বলা যায়, যতক্ষণ না তিনি তাওবা করে ফিরে আসেন (না‘ঊযু বিল্লাহ)। আল্লামা ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন, ‘খারেজিরা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি জুলম এবং ভুলের সম্পর্ক আরোপ করা জায়িয মনে করে। উপরন্তু তারা তাঁর আনুগত্য ও ইত্তিবা করা ওয়াজিব মনে করতো না।’[19]
আহলুস সুন্নাতের মতে, নবী-রসুলগণ সম্পর্কে খারেজিদের এমন আকীদা কুফরির শামিল। নবী-রসুলগণ মাসুম (নিষ্পাপ); তাঁরা ছোট-বড় যে কোনো ধরনের পাপ থেকে মুক্ত এবং উম্মতের ওপর তাঁদের আনুগত্য করা ফরজ।
ঙ. সাহাবা কেরাম (রা.) প্রসঙ্গে
খারেজিদের মতে, সাহাবা কেরাম (রা.) কবীরা গুনাহ ও কুফরি করেছেন। তারা সাইয়েদুনা হযরত উসমান (রা.)-কে কাফির ও মুরতাদ মনে করতো এবং তাঁর হত্যাকারীদের প্রশংসা করতো। অনুরূপভাবে তারা সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.), হযরত মুয়াবিয়া (রা.), হযরত আমর ইবনুল আস (রা.), হযরত আবু মুসা আল-আশআরী (রা.)সহ যে সকল সাহাবী সালিশ নিয়োগকে সমর্থন করেছেন তাদেরকে কাফির ও মুরতাদ ঘোষণা করত তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল।[20]
আহলুস সুন্নাতের মতে, সাহাবা কেরাম (রা.) সম্পর্কে খারেজিদের এ আকীদা স্পষ্টত ফাসিকী। কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট, তাঁরাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট।[21] অধিকন্তু রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ، لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ، فَوَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَهُ».
‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করো, তবুও তা তাদের এক অঞ্জলি বা অর্ধাঞ্জলি দানের সমতুল্য হবে না।’[22]
চ. পরকালে শাফায়াত প্রসঙ্গে
খারেজিরা কবীরা গোনাহকারীর বেলায় শাফায়াতকে অস্বীকার করে। তাদের দাবি, শাফায়াত কেবল মুত্তাকীদের জন্য। তাদের মতে, যাকে একবার জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, সে চিরস্থায়ী জাহান্নামেই থাকবে।
আহলুস সুন্নাতের মতে, খারেজিদের এ আকীদা স্পষ্টত হাদীসের পরিপন্থী। কেননা রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِيْ»» (আমার শাফায়াত আমার উম্মতের মধ্যে যারা কবীরা গোনাহগার তাদের জন্য।)[23]
ছ. শাসক ও বিচারব্যবস্থা প্রসঙ্গে
খারেজিদের মতে, কোনো মুসলিম শাসক যদি ইসলামের বিধিবিধান মেনে না চলে অথবা পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং জুলম করে, তাহলে তার জন্য ক্ষমতায় থাকা বৈধ নয়। এমন শাসকের আনুগত্য করাও জায়িয নয়। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ওয়াজিব।[24] তার অধীনে সরকারি চাকরি, সরকারি বাসভবনে বসবাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা জায়িয নয়। তার অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হত্যা করা জায়িয। তাদের মতে, কোনো মুসলিম বিচারক যদি আল্লাহর বিধান মতে বিচার না করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই কাফির। তাকে হত্যা করা জায়িয, যদি তিনি তাওবা না করেন।
আহলুস সুন্নাতের মতে, আমীর ও শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়িয নয়। ইমাম তাহাবী (রহ.) বলেন,
وَلَا نَرَى الْـخُرُوْجَ عَلَىٰ أَئِمَّتِنَا وَوُلَاةِ أُمُوْرِنَا وَإِنْ جَارُوْا، وَلَا نَدْعُو عَلَيْهِمْ، وَلَا نَنْزِعُ يَدًا مِّنْ طَاعَتِهِمْ، وَنَرَىٰ طَاعَتَهُمْ مِنْ طَاعَةِ اللهِ e فَرِيضَةً، مَا لَـمْ يَأْمُرُوْا بِمَعْصِيَةٍ، وَنَدْعُوْا لَـهُمْ بِالصَّلَاح وَالْـمُعَافَاةِ.
‘আমাদের ইমাম ও শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে আমরা জায়িয মনে করি না, যদিও তারা জুলম করে। আমরা তাদের অভিশাপও করি না, আনুগত্য হতে হাত গুটিয়ে নিই না। তাদের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য সাপেক্ষে ফরজ, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ দেয়। আমরা তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য দোয়া করবো।’[25]
জ. রাজনীতিবিষয়ক
- গণসমর্থন: খারেজিরা গণসমর্থনে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিল। তাদের মতে, খলীফাকে অবশ্যই সমগ্র মুসলিম সমাজ কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে। খিলাফত কোনো বিশেষ গোত্র, শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারবে না। যোগ্য ব্যক্তি হলে যে কোনো মুসলিম, এমনকি হাবশী গোলাম ও নারীও খলীফা নির্বাচিত হতে পারবে।
- খলীফার যোগ্যতা: খারেজিদের মতে যোগ্যতাই হলো খলীফা নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি। খলীফাকে অবশ্যই খাঁটি মুসলিম হতে হবে। তাকে ইসলাম নির্ধারিত অন্যান্য যোগ্যতা ও গুণের অধিকারী হতে হবে।
- খলীফার মেয়াদ: খারেজিরা বিশ্বাস করতো, খলীফা তাঁর যোগ্যতা দ্বারা যতদিন জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারবেন, ততদিনই কেবল খিলাফতে অধিষ্ঠিত থাকবেন। এর ন্যূনতম বা সর্বোচ্চ কোনো মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকবে না।
- খলীফার অপসারণ: খারেজিরা বিশ্বাস করতো যে, খলীফা তার যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে তাকে অপসারিত করে যোগ্যতর ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। খলীফা পদত্যাগে অসম্মতি প্রকাশ করলে প্রয়োজনে তাকে হত্যা করা যাবে।
- মুসলিম খলীফা: খারেজিদের মতে, সাইয়েদুনা হযরত আবু বকর (রা.) ও সাইয়েদুনা হযরত ওমর (রা.) হলেন ইসলামের আইনসংগত খলীফা। বাকিরা সকলেই খিলাফতের অবৈধ দাবিদার ও দখলদার।
- খলীফাদের সমালোচনা: খারেজিরা (তাদের ধারণা মতো) পবিত্র কুরআনকে অসম্মান করার জন্য এবং কুরআনের কর্তৃত্ব পরিত্যাগ করার জন্য সাইয়েদুনা হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.)-এর প্রকাশ্য সমালোচনা করতো।
- খলীফা না থাকা: খারেজিদের মধ্যে এমন মতও প্রচলিত ছিল যে, মুসলিম সমাজের জন্য খলীফা নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন নেই। মুসলিম সমাজ নিজ থেকেই পরিচালিত হবে।
- উমাইয়া-আব্বাসীয় শাসক: খারেজিরা উমাইয়া শাসকদের মথ্যে কেবল ওমর ইবনে আবদিল আযীয (রা.) এবং আব্বাসীয় শাসকদের মধ্যে আল-মামূনকেই কেবল মেনে নিয়েছিলো।
- মাওয়ালী[26] নীতি: খারেজিরা নির্যাতিত মাওয়ালীদের পক্ষ সমর্থন করে এবং সমাজে তাদের মানোন্নয়নের নীতি গ্রহণ করে। ফলে মাওয়ালীরা দলে দলে খারেজিদের দলে যোগদান করে।
- অমুসলিমদের মর্যাদা: অমুসলিমদের মধ্যে যারা সাক্ষ্য দিতো যে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আবরদের প্রতি প্রেরিত নবী; কিন্তু আমাদের প্রতি প্রেরিত নন’ খারেজিরা তাদেরকে মুসলিমদের সমান মর্যাদাসম্পন্ন মনে করতো।
উল্লেখ্য যে, খারেজিদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা সময়ের বিবেচনায় নিঃসন্দেহে অনেক বেশি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ছিল। কিন্তু তাদের কার্যাবলি ছিল অত্যন্ত উগ্র এবং ধ্বংসাত্মক। তারা রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষকে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব প্রদান করতো। তারা নিজেদের মতবাদ ও কার্যাবলি যুগ ও সমাজের সাথে সঙ্গতি রেখে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজনৈতিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
খারেজিদের ব্যাপারে আলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি
উম্মতের আলিমগণ সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, খারেজিরা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অবাধ্য ও বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন একটি চরমপন্থী সম্প্রদায় ও ইসলামের নামে নিকৃষ্টতম দল, যদিও তারা সালাত আদায় করে, রোযা রাখে এবং ইবাদতের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টাও ব্যয় করে। এ আমলগুলো তাদের উপকারে আসবে না। কারণ তারা পবিত্র কুরআনের অপব্যাখ্যা করে এবং এভাবে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে। হাদীসে তাদেরকে «كِلَابُ النَّارِ» (জাহান্নামের কুকুর)[27] বলা হয়েছে।[28] রসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর পরবর্তী খলীফাগণ সকলেই তাদের ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। তবে তাদেরকে কাফির বলা যাবে কিনা এ ব্যাপারে আলিমগণের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন যে, তারা কাফির। তাদের দলিলগুলো হলো: যুল খুওয়াইসিরার ঘটনা, তাদের দীন থেকে বের হয়ে যাওয়া মর্মে বর্ণিত হাদীসসমূহ এবং সাইয়েদুনা হযরত আলী (রা.) ও হযরত মুয়াবিয়া (রা.)সহ বিশিষ্ট সাহাবীগণের সাথে তাদের ন্যক্কারজনক আচরণ। আবার অনেকেই বলেন, তারা ফাসিক ও বিদআতী। কারণ কাউকে ইসলাম বহির্ভূত বলা সহজ বিষয় নয়। তবে স্পষ্ট কুফরি প্রমাণিত হলে ভিন্ন কথা। হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) বলেন,
وَذَهَبَ أَكْثَرُ أَهْلِ الْأُصُوْلِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ إِلَىٰ أَنَّ الْـخَوَارِجَ فُسَّاقٌ وَأَنَّ حُكْمَ الْإِسْلَامِ يَجْرِيْ عَلَيْهِمْ.
‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশ আকীদা বিশেষজ্ঞের মতে খারেজিরা ফাসিক (পাপিষ্ঠ)। তাদের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধান প্রযোজ্য হবে।’[29]
ইমাম আবু সুলাইমান আল-খত্তাবী (৩১৯-৩৮৮ হি.) (রহ.) বলেন,
أَجْمَعَ عُلَمَاءُ الْـمُسْلِمِيْنَ عَلَىٰ أَنَّ الْـخَوَارِجَ مَعَ ضَلَالَتِهِمْ فِرْقَةٌ مِنْ فِرَقِ الْـمُسْلِمِيْنَ، وَأَجَازُوْا مُنَاكَحَتَهُمْ وَأَكْلَ ذَبَائِحِهِمْ، وَأَنَّهُمْ لَا يُكَفَّرُوْنَ مَا دَامُوا مُتَمَسِّكِيْنَ بِأَصْلِ الْإِسْلَامِ.
‘সকল আলিম এ বিষয়ে একমত যে, খারেজিরা তাদের ভ্রষ্টতা সত্ত্বেও মুসলিমদের একটি দল। তাঁদের মতে খারেজিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও তাদের জবাইকৃত প্রাণি ভক্ষণ করা বৈধ। তাদেরকে ‘কাফির’ আখ্যা দেওয়া যাবে না, যে যাবৎ তারা ইসলামের মৌল বিধানের ছায়ায় অবস্থান করবে।’[30]
মোটকথা হলো, তাদের কথা, কর্ম ও আকীদার ভিত্তিতে তাদের ওপর হুকুম প্রযোজ্য হবে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন, ‘তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত থেকে বহির্ভূত।’[31] ইমাম শাতিবী (রহ.) বলেন, ‘ফিরকা নাজিয়া ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিরোধিতা করায় তাদেরকে ভ্রষ্ট দল হিসেবে ধরা হয়।’[32] সালাফে সালিহীন যদিও তাদেরকে ‘কাফির’ বলে আখ্যায়িত করেননি; তবে তাদেরকে হাদীসে বর্ণিত ৭২টি ভ্রান্ত দলের অন্তর্ভুক্ত একটি দলরূপে গণ্য করেন।
পরিশেষে আমরা এ উপসংহারে পৌঁছতে পারি, খারেজিদের অধিকাংশ চিন্তা-দর্শনে উগ্রতা ও চরম পন্থার প্রকট প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। এ কারণেই সমকালীন রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে তাদের গণতান্ত্রিক চেতনা অধিকতর ইসলাম সমর্থিত হলেও তা সর্বসাধারণের নিকট সমাদর লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও ইসলামের ইতিহাসের রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক পথপরিক্রমায় খারেজিরা আহলুস সুন্নাতের বহির্ভূত একটি প্রধান গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
[1] তাবারী, তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূক, খ. ৩, পৃ. ১৫৭; ইবনে কসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৭, পৃ. ৩৬২; ইবনুল আসীর, আল-কামিল, খ. ২, পৃ. ১০২
[2] মীযানুর রহমান, খারেজীদের আকীদা ও ইতিহাস, (মাসিক) আত তাহরীক, মার্চ ২০১৭, https://at-tahreek.com/article_details/1030
[3] ইবনে তায়মিয়া, মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়া, খ. ৫, পৃ. ১৬৯
[4] https://i-onlinemedia.net/11295 (খারিজী মতবাদ ও ইতিহাস)
[5] আল-কুরআন, ৬৪ (সূরা আত-তাগাবুন): ২
[6] বুখারী, আস-সহীহ: ৬৭৭২ ও মুসলিম, আস-সহীহ: ৫৭
[7] ইবনে বাত্তাল, শারহু সহীহিল বুখারী, খ. ৬, পৃ. ৩৭ ও নববী, শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ২, পৃ. ৪১-৪২
[8] সুয়ূতী, আদ-দীবাজ আলা সহীহি মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৭৬
[9] বুখারী, আস-সহীহ: ৫৮২৭ ও মুসলিম, আস-সহীহ: ২৮৩
«مَا مِنْ عَبْدٍ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، ثُمَّ مَاتَ عَلَىٰ ذَلِكَ إِلَّا دَخَلَ الْـجَنَّةَ»، قُلْتُ: وَإِنْ زَنَىٰ وَإِنْ سَرَقَ؟ قَالَ: «وَإِنْ زَنَىٰ وَإِنْ سَرَقَ»، قُلْتُ: وَإِنْ زَنَىٰ وَإِنْ سَرَقَ؟ قَالَ: «وَإِنْ زَنَىٰ وَإِنْ سَرَقَ»، قُلْتُ: وَإِنْ زَنَىٰ وَإِنْ سَرَقَ؟ قَالَ: «وَإِنْ زَنَىٰ وَإِنْ سَرَقَ عَلَىٰ رَغْمِ أَنْفِ أَبِيْ ذَرٍّ».
[10] আল-কুরআন, ৫ (সূরা আল-মায়িদা): ৪৪
[11] আল-কুরআন, ১২ (সূরা ইউসুফ): ৬৭
[12] মুসলিম, আস-সহীহ: ২৫১৭
[13] আল-কুরআন, ৪ (সূরা আন-নিসা): ৩৫ ও ৫ (সূরা আল-মায়িদা): ৯৫
[14] আল-কুরআন, ৪৯ (সূরা আল-হুজুরাত): ৯
[15] ইবনে কসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, খ. ৭, পৃ. ৩৭৪
[16] আশআরী, মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন, খ. ২, পৃ. ২০৩-২০৪
[17] আবু দাউদ, আস সুনান: ৪৬০৬
[18] আল-কুরআন, ১৬ (সূরা আন-নাহল): ৪৪
[19] মীযানুর রহমান, খারেজীদের আকীদা ও ইতিহাস, (মাসিক) আত তাহরীক, মার্চ ২০১৭, https://at-tahreek.com/article_details/1030
[20] বাগদাদী, আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক, পৃ. ৭৩; ইসফিরায়িনী, আত-তাবসীর ফিদদীন, পৃ. ৩৮; শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, খ. ১, পৃ. ১০৭; তবে খারেজি উপদল ইবাদিয়্যারা এ মতের সাথে সম্পূর্ণ একমত নয়। আমরা পরে এ বিষয়ে আলোচনা করবো, ইনশা আল্লাহ।
[21] আল-কুরআন, ৫ (সূরা আল-মায়িদা): ১১৯
[22] মুসলিম, আস-সহীহ: ৬৬৫১
[23] আবু দাউদ, আস-সুনান: ৪২৭১
[24] বাগদাদী, আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক, পৃ. ৭৩; ইসফিরায়িনী, আত্তাবসীর ফিদদীন, পৃ. ৩৮; শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, খ. ১, পৃ. ১০৭, আল-মাকদিসী, আল-বাদউ ওয়াত তারীখু, খ. ৫, পৃ. ১৩৫
[25] তাহাভী, আল-আকীদাতুত তাহাভিয়্যা, পৃ. ৪৭
[26] ‘মাওয়ালী’ দ্বারা অনারব মুসলিমদের বোঝানো হয়। উমাইয়া শাসনামলে বিপুল সংখ্যক অনারব যেমন পারসিয়ান, আফ্রিকান, তুর্কি ও কুর্দি ইসলাম গ্রহণ করলে এ পরিভাষাটি খুব পরিচিত হয়ে ওঠে। ইসলাম গ্রহণ করার পর আইনত তারা আরব মুসলিমদের মতো সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হলেও কার্যত বহু অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়। উমাইয়া শাসনামলে এ অবস্থা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এ সময় মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে অমুসলিমদের ন্যায় জিযিয়া দিতে হতো।
[27] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান: ১৭৩; শায়খ আলবানী (রহ.) বলেন, হাদীসটি সহীহ।
[28] খারিজীদের ‘জাহান্নামের কুকুর’ বলার কারণ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মুনাভী (রহ.) বলেন,
وذلك لأنهم دأبوا ونصبوا في العبادة، وفي قلوبهم زيغ فمرقوا من الدين بإغواء شيطانهم حتىٰ كفروا الموحدين بذنب واحد وتأولوا التنزيل علىٰ غير وجهه فخذلوا بعد ما أيدوا حتىٰ صاروا كلاب النار، فالـمؤمن يستر ويرحم ويرجو المغفرة والرحمة والـمفتون الـخارجي يهتك ويعير ويقنط وهذه أخلاق الكلاب وأفعالـهم، فلما كلبوا علىٰ عباد الله ونظروا لـهم بعين النقص والعداوة ودخلوا النار صاروا في هيئة أعمالـهم كلابا كما كانوا علىٰ أهل السنة في الدنيا كلابا بالمعنى الـمذكور.
‘এর কারণ হচ্ছে, খারিজীরা ইবাদতে খুবই পরিশ্রমী ও তৎপর। কিন্তু তাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তারা দীন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। এমনকি তাওহীদের অনুসারীদেরকে যে কোনো একটি অপরাধের কারণে তারা ‘কাফির’ আখ্যা দিয়ে থাকে এবং পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলোকে যথেচ্ছ অপব্যাখ্যা করে। তারা আগে (মুমিনদের) সাহায্য করতো, এখন তা ত্যাগ করেছে। এভাবে তারা জাহান্নামের কুকুরে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা অপরের দোষ-ক্রটি গোপন রাখে, মানুষের প্রতি দয়া করে, মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও অনুগ্রহ কামনা করে। আর বিভ্রান্ত খারেজি মানুষের মর্যাদাহানি করে, লজ্জিত করে, অবশেষে নিজেরাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এগুলো কুকুরের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ। যেহেতু তারা আল্লাহ তাআলার বান্দাদের ওপর কুকুরের মত আগ্রাসী হয় এবং তাদের প্রতি তুচ্ছজ্ঞান ও শক্রতার ভাব নিয়ে তাকায়, তাই তারা জাহান্নামে প্রবেশকালে তাদের কৃতকর্মের অনুরূপ কুকুরের রূপ ধারণ করবে, যেমনভাবে তারা ছিল দুনিয়ার বুকে আহলে সুন্নাতের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণে কুকুরের স্বভাববিশিষ্ট।’ (মুনাভী, ফায়যুল কদীর, খ. ৩, পৃ. ৩৬৭)
[29] ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, খ. ১২, পৃ. ৩০০
[30] ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, খ. ১২, পৃ. ৩০০ ও মুনাভী, ফায়যুল কদীর, খ. ৪, পৃ. ১৬৭
[31] ইবনে তায়মিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ, খ. ৫, পৃ. ১৬৩
[32] শাতিবী, আল-ইতিসাম, খ. ১, পৃ. ৩৩৭ ও ৪৮১