জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ মজলিসে উমুমী, মজলিসে শুরা ও পরীক্ষা কমিটির যৌথসভার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন

আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ

মজলিসে উমুমী, মজলিসে শুরা ও পরীক্ষা কমিটির যৌথসভার

পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন

[অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও দেশের প্রাচীনতম কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের বার্ষিক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সহস্রাধিক কওমি মাদরাসার মুহতামিম, নাযেমে তালিমাত ও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ যৌথসভায় দেশের কওমি অঙ্গন, বিশেষত বোর্ড অধিভুক্ত মাদরাসাগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত ও আলোচনা উঠে আসে। মাসিক আত-তাওহীদের পাঠকদের সুবিধার্থে আমরা এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন নিম্নে তুলে ধরছি। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন, জামিয়া পটিয়ার উলূমুল হাদীস বিভাগের মুশরিফ মাওলানা মুহাম্মদ ত্বহা দানিশ। সহযোগিতায় ছিলেন, উলূমুল হাদীস বিভাগের ছাত্র যিয়াদ বিন সাঈদ।—সম্পাদক]

সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী

অদ্য ১০ই রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরী মোতাবেক ২৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রামে দারুল হাদীস মিলনায়তনে আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মজলিসে উমুমী, মজলিসে শুরা ও পরীক্ষা কমিটির যৌথসভা জামিয়ার কিরাত বিভাগের ছাত্র শাহাদাত হুসাইনের তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয়। আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি, শায়খুল হাদীস ও ফকীহুদ্দীন হযরত মাওলানা মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেব (দা. বা.)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ যৌথসভায় উদ্‌বোধনী বক্তব্য পেশ করেন আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের সম্মানিত মহাসচিব হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (দা. বা.)।

এ সময় তাঁর প্রদত্ত বক্তব্যে উপস্থিত ইত্তিহাদ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ইত্তিহাদের এসব আয়োজন গতানুগতিক কোনো অনুষ্ঠান নয়।’ সেই সাথে ইত্তিহাদ একক কর্মপরিচালনার মাধ্যমে পরিচালিত কোনো কর্মক্ষেত্র নয়, বরং ইত্তিহাদ সবার। তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত কোনো সফলতার কৃতিত্বে যেভাবে সবারই অংশীদারিত্ব আছে, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ব্যর্থতার দায়ও সকলের’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেসব সফলতা-ব্যর্থতাকে সামনে রেখে পরস্পর পরামর্শ আদান-প্রদানের জন্যই আমাদের আজকের এ আয়োজন।’ তিনি মাদরাসার আসাতিযা এবং সংশ্লিষ্টদেরকে যোগ্য থেকে যোগ্যতর করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদরিবুল মুআল্লিমীনসহ ইত্তিহাদের নানামুখী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন।

বক্তব্যের সমাপ্তিলগ্নে তালিমের পাশাপাশি ‘দীনি মেজাজ’ তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। উদ্‌বোধনী বক্তব্যের পর আঞ্জুমানের দফতর সম্পাদক মাওলানা সাঈদুল হক বার্ষিক হিসাববিবরণী পেশ করলে উপস্থিত সকলে এতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি যৌথসভার মূল অ্যাজেন্ডার বিষয়ে উপস্থিত সকলের উন্মুক্ত পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের সহ-সভাপতি ও জামিয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়ার নায়েবে মুদীর মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলিল। তিনি তাঁর বক্তব্যে ইত্তিহাদকে আরও বেগবান করতে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ও লিখিত প্রস্তাবনা পেশ করে আঞ্জুমানের বর্তমান মহাসচিবের সার্বিক কর্মকাণ্ডের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। যৌথসভায় আরও বক্তব্য রাখেন, মাওলানা সাইফুদ্দীন কাসেমী, মাওলানা মুসলিম, মাওলানা লোকমান হাকিম, মুফতী কেফায়েতুল্লাহ শফিক, মাওলানা আফসার, মাওলানা নিযামুদ্দীন, মাওলানা মুহসিন শরিফ, মাওলানা ফয়যুল্লাহ ও মাওলানা মুহিউদ্দীন প্রমুখ।

এছাড়াও যৌথসভায় ইত্তিহাদ অধিভুক্ত সকল মাদরাসার মুহতামিম, নাযেমে তালিমাত ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলবৃন্দ উপস্থিত থেকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত পেশ করেন। অনুষ্ঠানের শেষে বিগত১৪৪৩-৪৪ হিজরী শিক্ষা বর্ষের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বিভিন্ন মারহালায় মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নগদ পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারবিতরণী শেষে সভাপতির মোনাজাতের মাধ্যমে যৌথসভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

মহাসচিবের বক্তব্য

শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি

‘দীনি মেজাজ’ গঠন করতে হবে

মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (দা. বা.)

মহাসচিব, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ

প্রথমেই রব্বুল আলামীনের দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি, রব্বুল আলামীন তালিমের নিসবতে, দীনের নিসবতে আমাদেরকে একত্রিত হবার তওফিক দান করেছেন। উম্মতের সামগ্রিক ফিকির নিয়ে আপনারা আজ এখানে একত্রিত হয়েছেন। এটা গতানুগতিক কোনো বৈঠক নয় যে, প্রতি বছর নিয়ম মেনে একবার বসা হয়, একটি মজলিসের আয়োজন হয়, তাই বসলাম। বরং এটি সময়েরও দাবি এবং তাকাযা। তা গভীরভাবে উপলব্ধি করে সুদূরপ্রসারী চিন্তার বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মজলিস। কেননা প্রেক্ষাপট সবসময় একই গতিতে চলমান থাকেনা। নতুন নতুন অবস্থা তৈরি হয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন সামনে আসে।

মাদরাসাগুলোকে যেহেতু তালিমের পাশাপাশি উম্মতের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে হয়, প্রয়োজন অনুপাতে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হয়, তাই এ ধরনের মজলিস যেখানেই হোক না কেন, মাদরাসার আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েই সেখানে আলোচনা হয় না কেবল, বরং দেশ ও জাতির সার্বিক বিষয় নিয়ে সেখানে পরামর্শের আদান-প্রদান হয়, বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। সে কারণে আমরা অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু আগেই অনুষ্ঠানের সূচনা করেছি, যাতে করে আপনারা ইত্তিহাদ সম্পর্কে, মাদরাসা সম্পর্কে এবং সর্বোপরি উম্মাহর উন্নতি-অগ্রগতিকে কেন্দ্র করে আমাদের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলোকে সুস্থির ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

রব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায়ের পর আপনাদেরও শুকরিয়া আদায় করছি, শত ব্যস্ততা এবং প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে দূরদূরান্ত থেকে সফর করে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম জাযা দান করুন। আমীন।

ইত্তেহাদ সকলের

বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিছু তো আপনাদের কাছে ইতোমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি বিষয় আছে, আপনাদের প্রত্যেকের পরামর্শক্রমে আমরা ইনশাআল্লাহ সে বিষয়গুলোতে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারবো। তাছাড়া এটি তো একটি ‘ইজতেমায়ি’ কাজ। আমরা সকলে মিলে এখানে কাজ করি, সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করি। এখানে যা কিছুই সম্পাদিত হয়, সেগুলো একক কারও কৃতিত্ব নয়। এগুলো আপনাদের প্রত্যেকের অবদান, প্রত্যেকেরই কৃতিত্ব। ইজতেমায়ি কাজে এককভাবে কাউকে কৃতিত্ব দেওয়া যায় না। কাজেই ইত্তিহাদ যদি সফলতার সাথে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে পারে, এটি আপনাদের সবার অবদান, সবারই প্রচেষ্টার ফসল। অপরদিকে ইত্তিহাদের যদি কোনো ব্যর্থতা থেকে থাকে, সেটাও হয়তো আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, সবাইকে একসাথেই সে ব্যর্থতা কাটিয়ে শূন্যতা পূরণে সচেষ্ট হতে হবে। একটি আরবি প্রবাদ আছে, ما ندم من استخار وما خاب من استشار।

নেযামে তালিমের পাশাপাশি নেযামে

তারবিয়তের প্রয়োজন এখন অনেক বেশি

মুহতারাম হাযিরীন! মাদরাসাগুলোর নেযামে তালিম, নেসাবে তালিম এবং নেযামে তারবিয়ত নিয়ে আমাদের ভেতর প্রায়শ আলোচনা হয়। আপনারাও নিজেদের পরিসরে এসব নিয়ে পরস্পরে আলোচনা করে থাকেন হয়তো। নেযামে তালিমের পাশাপাশি নেযামে তারবিয়তের প্রয়োজন এখন অনেক বেশি। নেসাবে তালিম নিয়ে নতুনভাবে ভাবনার প্রয়োজন কম। কেননা প্রণীত নেসাব আমাদের আকাবির ওলামায়ে কেরামের ‘ইলহামি’ তজরবার ফসল। একে আমূল পরিবর্তন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন শূন্যের কোঠায়। যারাই পরীক্ষামূলক বিভিন্ন নেসাবের প্রণয়ন করছেন, কোনোটিই সফলতার মানদণ্ডে শতভাগ উত্তীর্ণ নয়। কাজেই নেসাবে তালিমের তুলনায় নেযামে তারবিয়তের প্রতি গুরুত্বারোপের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি।

এখন ফিতনার জমানা। উপর্যুপরি ফিতনা দিয়ে চারদিক ভরপুর। আমাদের ইত্তেহাদের প্রাণপুরুষ ও দীর্ঘ সময়ের সফল কর্ণধার হযরত মাওলানা আবদুল হালীম বুখারী সাহেব হুযুর (রহ.) প্রায়ই একটা কথা বলতেন, ‘মাদরাসাগুলোতে এখন দুটি ফিতনা অত্যন্ত ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। একটি হচ্ছে মোবাইল, অন্যটি সিয়াসত।’ বাস্তবেই এ দুটি জিনিস আমাদের জন্য বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমাদের নিজস্ব পরিসরেই নয়, বরং বৈশ্বিকভাবে এর ভয়াবহতা এখন দৃশ্যমান। বস্তুত এ দুটি ফিতনাই আমাদের মাদরাসাগুলোর তারবিয়তি স্খলন এবং অধঃপতন ডেকে আনছে। কাজেই এ দুটি ফিতনাকে কেন্দ্র করে আমাদের কর্মকৌশল কী হবে, কীভাবে এর মূলোৎপাটন সম্ভব, সেটা নির্ধারণ করা জরুরি।

সেই সাথে আপনাদের কাছেও অনুরোধ থাকবে, যেহেতু আমাদের এখানে অনেক বড় দরসগাহ (পটিয়া), আমরা খুব সহজেই ছাত্রদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না, হিমশিম খেতে হয়, তাই আপনাদের নিবিড় পরিচর্যায় যেখানে ছাত্রদের মন-মেজাজ তৈরি হয়, তারবিয়ত হয়, সেখানে থাকা অবস্থায়ই যদি ছাত্ররা সঠিক ও সুন্দর চিন্তা-ফিকির নিয়ে বেড়ে ওঠে, পরবর্তীতে আমাদের কাছে আসলে তাদেরকে রাহনুমায়ী করা আমাদের জন্য একটু সহজ হয়। তাছাড়া এককভাবে এই ফিতনা মোকাবেলা করাও তো সম্ভব না। তাই প্রত্যেকের সহযোগিতা আশা করি আমরা। প্রত্যেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই আমাদেরকে এই ভয়াবহ ফিতনাগুলো রুখে দেওয়ার রসদ যোগাবে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, «بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْـمُظْلِمِ» (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৮)

মাদরাসার যিম্মাদারহযরাতবৃন্দ, মাদরাসাগুলো নিয়ে তো আপনারা কথা বলবেন; কীভাবে তালিমী উন্নতি করা যায়, কীভাবে শিক্ষার মান অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়। তবে আমি হযরত মাওলানা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.)-এর কথা উল্লেখ করি, হযরত বলেছিলেন, ‘মাদরাসাগুলোর তালীমি উন্নয়নের জন্য তিনটি উপাদান মৌলিকভাবে জরুরি। এক. ছাত্রের মেহনত। দুই. উস্তাযের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তিন. যথোপযোগী নেসাবে তালিম।’

অস্বীকার করার সুযোগ নেই এখন ছাত্রদের মেহনতের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। সেই মেহনত ফিরিয়ে আনতে ছাত্রের আগ্রহকে বৃদ্ধি করা জরুরি। হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) বলেছেন আগের তুলনায় এখন ছাত্রদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। ছাত্রের আগ্রহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধিতে তখন তিনি অনেকগুলো পরামর্শ দিয়েছেন। একটি পরামর্শ ছিলো, নিচের জামায়াতের ছাত্রদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক দিন সবক আদায় করে নেওয়া এবং উপরের জামায়াতগুলোতে ছাত্রদেরকে ইবারত পড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, প্রয়োজনে পড়তে বাধ্য করা। এতে করে আশা করা যায় ক্রমান্বয়ে ছাত্রদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

মাত্রাতিরিক্ত শাসন একটি ভুল প্রক্রিয়া

তবে আগ্রহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি করতে গিয়ে, বিশেষ করে ছোট ছাত্রদের ক্ষেত্রে মারধর এবং মাত্রাতিরিক্ত শাসন একটি ভুল প্রক্রিয়া। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় আইনেও এ বিষয়ক বিধি-নিষেধ অনেক কঠিন। এমনকি জাতিসংঘ প্রদত্ত আইনেও এটাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষক তো দ্বিতীয় স্তরে, পিতাও যদি সন্তানকে উপর্যুপরি শাসন করে, সেখানেও তার ওপর অভিযোগের আঙুল তোলার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কাজেই এধরনের আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে কীভাবে ছাত্রের আগ্রহ প্রবলভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সেদিকে লক্ষ রাখলে কার্যকরী সফলতা পাওয়া যাবে।

বর্তমান সময়ের প্রথিতযশা আলেম হযরত মাওলানা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী (দা. বা.) এক কিতাবে লিখেছেন, ছোট বাচ্চাদেরকে মারধর করা হলে তার ভেতর হার্টফেইলের মতো অবস্থা তৈরি হয়ে যায়। সুতরাং, আদর-স্নেহ এবং মায়া-মমতার চাদরে আবৃত করে বাচ্চাদেরকে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে তার আগ্রহ বৃদ্ধিতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে আপনারা আশা করি পরামর্শ দেবেন।

উম্মাহর জন্য যা কিছু কল্যাণকর, তা এ

ওলামায়ে কেরামের হাত ধরেই এসেছে

আসলে ইত্তেহাদুল মাদারিসসহ অন্যান্য বোর্ড এবং মাদারিসে কওমিয়া তো উম্মতের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বড় দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, গত কয়েক দশক ধরে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, আমাদের ইত্তেহাদের কথাই বলি, এ দীর্ঘ সময়ে একবারও আল-হামদু লিল্লাহ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। অন্যান্য শিক্ষা ব্যবস্থায় তো ছোটখাটো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেই দেখা যায় প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে। এই যে ওলামায়ে কেরাম একটি ক্ষেত্রে কতভাবে উম্মতের সামনে দৃষ্টান্ত পেশ করে আসছে, এতে করে স্পষ্টতই বোঝা যায় উম্মাহর জন্য যা কিছু কল্যাণকর এবং ভালোতা এই ওলামায়ে কেরামের হাত ধরেই এসেছে এবং আসছে। তাছাড়া পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইনসাফ এবং আমানতদারিতা বজায় রাখতে আমাদের বড়দের পরামর্শও তো ছিল এমন, একজন ছেলে ভালো লিখলো, কিন্তু মুমতাহিন তাকে তার প্রাপ্য নাম্বার প্রদান না করে কম দিলো, এটা তার প্রতি স্পষ্ট জুলুম। তেমনিভাবে একটা ছাত্র কিছুই লিখলো না বা অনেক অল্প লিখলো, কিন্তু তাকে তার প্রাপ্যেরও বেশি দিয়ে দেওয়া হলো, এটা তো বুখারী শরীফের হাদীসের শিক্ষার বিপরীত। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একবার হযরত যুবায়ের (রা.) এবং এক আনসারী সাহাবী বিচারপ্রার্থী হলে তিনি তাঁদের মাঝে ফয়সালা দেওয়ার পর ওই আনসারী সাহাবী বলেছিলেন, آنْ كَانَ ابْنَ عَمَّتِكَ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৫৬১)। কাজেই আমাদের ইমতিহান এবং অন্যান্য বিষয়ে আমানতদারি এবং সততা ধরে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি প্রদান করা বাঞ্ছনীয়।

যার ভেতরে হামনেই, পেরেশানি নেই, তার

ওপর মুহতামিম শব্দ প্রয়োগই তো শুদ্ধ নয়

মাদরাসার ইহতিমামের দায়িত্বে যিনি আছেন, তার বড় পেরেশানি। আমার কাছে কিছুদিন পূর্বে এক ব্যক্তি এসেছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন বিভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালনা প্রধানের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক, ভিসি, প্রিন্সিপাল এবং রেক্টরসহ নানা ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হলেও কওমি মাদরাসায় পরিচালনা প্রধানের ক্ষেত্রে ‘মুহতামিম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। এ মুহতামিমের জন্য হয়তো এ শব্দটিই প্রযোজ্য। যেহেতু এটি ‘হাম’ তথা পেরেশানির দিকেই ইঙ্গিত করে। আসলেও তাই দেখা যায়, পেরেশানি যেন একজন মুহতামিমের কাঁধে একাট্টা হয়ে বসে আছে। তার উদ্বেগ দেখে আমি বললাম, অনেক মাদরাসায় হয়তো পরিচালক আছেন, কিন্তু মুহতামিম নেই। কেননা যার ভেতরে ‘হাম’ নেই, পেরেশানি নেই, তার ওপর ‘মুহতামিম’ শব্দপ্রয়োগই তো শুদ্ধ নয়। মুহতামিম মাত্রই তার চারপাশ জুড়ে শুধুই ফিকির ঘুরপাক খেতে থাকবে, পেরেশানি জেঁকে বসবে, উন্নতি-অগ্রগতির কথা ভেবে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত অস্থিরতার সাথে কাটবে। আমি নিজেও এটি উপলব্ধি করি।

আমাদের যাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত, হিম্মত কম, তাদের জন্য অনেক সময় ছোটখাটো কাজকেও অনেক বড় মনে হতে থাকে। আল্লাহ যাদেরকে অনেক যোগ্যতা দিয়ে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে কষ্টটা হয়তো কম হতে পারে, কিন্তু আমি এই কষ্ট প্রবলভাবে অনুভব করি। তাই আপনাদের কাছে আমার করজোড় অনুরোধ থাকবে, ইহতিমামের এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে খুব বেশি আমানতদারি, সততা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে চেষ্টা করবেন। হযরত মাওলানা মনযুর নুমানী (রহ.) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। দেওবন্দ মাদরাসার একসময়ের মুহতামিম হযরত মাওলানা মুনীর আহমদ (রহ.) একবার মাদরাসার জন্য চাঁদা করতে গিয়ে অর্জিত সব টাকা হারিয়ে ফেললেন। এ হারিয়ে ফেলা টাকার ব্যাপারে ফকীহুন নফস হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ফতওয়া প্রদান করত বললেন, যেহেতু মুহতামিম সাহেব এ ব্যাপারে নির্দোষ, তাই এটির ক্ষতিপূরণ দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু হযরত মাওলানা মুনীর আহমদ (রহ.) শক্তভাবে বললেন, হযরত যদিও এ ফতওয়া প্রদান করেছেন, কিন্তু তার হাতে থাকা অবস্থায় যদি মাদরাসার অর্থ চুরি হয়ে যেত, কী করতেন তখন? নিজ জমি বিক্রি করে হলেও সেই টাকা পরিশোধ করবো আমি। আমাদের বড়দের মাঝে আমাদের জন্য অনেক অনেক শিক্ষা রয়ে গেছে এমন। কাজেই তাদের অনুসরণ করে আমাদের ভেতরেও এ রকম সততা ও দায়িত্বশীল মনোভাব পোষণ করা জরুরি।

আসাতিযায়ে কেরামকে যোগ্য থেকে

যোগ্যতর করে গড়ে তুলতে হবে

মুহতারাম হাযিরীন, আমাদের শেখার সময়ের তো আসলে শেষ নেই। যখন যেখানেই কমতি এবং ঘাটতি দেখা যাবে, তা পূরণে আমাদেরকে সচেষ্ট হতে হবে। সে নিমিত্তে আল-হামদু লিল্লাহ অনেক জায়গায় তাদরিবুল মুআল্লিমীন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইত্তিহাদের উদ্যোগেও ইনশাআল্লাহ মাদরাসার বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করার চিন্তা আমাদের আছে। আপনারা জানেন, ইত্তিহাদ ভবনের কাজ ইতোমধ্যেই পাঁচতলা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়ে গেছে। খুব শিগগির আমরা বাকি কাজও সম্পাদন করে ফেলতে পারবো বলে আশা রাখছি। কাজ শেষ হলে এ ধরনের নানামুখী প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম সেখানে অনুষ্ঠিত হবে। ইত্তেহাদুল মাদারিস আসাতিযায়ে কেরামকে যোগ্য থেকে যোগ্যতর করে তুলতে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ইনশাআল্লাহ।

তালিমের সাথে সাথে দীনি মেজাজ

তৈরিতেও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন

কওমি মাদরাসা তো সবসময় দুটি ক্ষেত্রে সমানভাবে সক্রিয় ছিলো। একটি হচ্ছে দীনের ইশাআহ তথা দীনের প্রসার এবং অন্যটি দিফায়ে আনিদ দীন বা দীনকে রক্ষা। মৌলিক এ দুটি লক্ষ্য সামনে রেখেই সকল কার্যক্রম চলমান থাকে কওমি মাদরাসায়। আমাদেরকেও এ দুটি দিকে সমানভাবে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা যা কিছু এখানে পড়াই, ছাত্রদের পেছনে মেহনত করি, এসবই ইশাআতে দীনের মধ্যে পড়ে। আবার যখনই কোনো বাতিল মতাদর্শ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তাদেরকে রুখতে এবং দীনকে হেফাজত করতে আমরা অগ্রণী ভূমিকা রাখি। আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস ইতোমধ্যেই দীনের জন্য হুমকি হয়ে আবির্ভূত বিভিন্ন ফিরকার রদে নির্ধারিত নেসাবে সংশ্লিষ্ট কিছু কিতাবাদি সংযোজন করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আল-হামদু লিল্লাহ। কেননা আমাদের ছাত্ররাই তো এ ক্ষেত্রে কাজ করবে। আর এ কাজের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট রসদ।

তাছাড়া আমরা তো একথাও বলি, যে তবলীগের মধ্যে ইলম নেই, সেটা ফলপ্রসূ হয় না। তাই আমাদের ছাত্ররা ময়দানে কীভাবে কাজ করবে, সে ব্যাপারে আমাদের ফিকির করা দরকার। তালিমের সাথে সাথে দীনি মেজাজ তৈরিতেও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। আমাদের ছাত্ররা পড়ালেখা করছে বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে দীনি মেজাজ এবং রূচিবোধের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের ইতিহাস ভুলে গেছি। আমরা দেওবন্দকে চিনি না, আমাদের আকাবির-আসলাফকে উপলব্ধি করি না।

উপরন্তু আমরা নিজেদের নামের সাথে ‘কাসেমী’ শব্দও জুড়ে দিই, কিন্তু ‘কাসেমিয়ত’ কোনো চেতনাকে ধারণ করে আছে, সেটা অনুভব করতে পারি না। তাই আমরা আমাদের ইতিহাস, আমাদের আকাবির-আসলাফ এবং আমাদের দেওবন্দী চিন্তা-চেতনাকে নিজেদের ভেতর এবং আমাদের ছাত্রদের ভেতর কীভাবে স্থির করা যায়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া দরকার। আমার মনে হয়, সুচিন্তিত পদক্ষেপ, পরস্পর মুযাকারা এবং কিতাবাদি মুতালায়ার মধ্য দিয়ে সে মেজাজ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ। কেননা এ দীনি মেজাজ ছাত্রদের মাঝে নেই বলেই প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের উদাসীনতা দেখা যায়। একজন তালিবুল ইলমকে কেন হুমকি-ধামকি দিয়ে মসজিদে জামায়াতে যেতে বাধ্য করতে হবে! কেন তার পেছন পেছন ঘুরতে হবে! দীনি মেজাযের অভাব আছে বলেই এমনটি হচ্ছে। কাজেই কীভাবে এই মেজাজ পরিশীলিতভাবে ছাত্রদের মাঝে স্থাপন করা যায়, তা গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

মোবাইল মানেই বল্গাহীন একটি জগতের উন্মোচন

এখন ফিতনা নানামুখী। মোবাইলের বেপরোয়া ব্যবহারের কথা আবারও বলছি। মেজাজ বিনষ্টসহ সার্বিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ হলো মোবাইলের ব্যবহার। কেননা মোবাইল মানেই একজন ছাত্রের সামনে বল্গাহীন একটি জগতের উন্মোচন। সে চাইলেই সিনেমা দেখতে পারছে, গান শুনতে পারছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা খুশি তাই করছে, যেকোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যেতে চাইলেও তা পারছে, কেউ তাকে বাধা দিচ্ছেনা। দীন থেকে একজন ছাত্রকে দূরে সরিয়ে রাখতে একটি মোবাইলই যথেষ্ট। এজন্য আসাতিযায়ে কেরামের প্রতিও অনুরোধ থাকবে, পরিমিতভাবে মোবাইলের ব্যবহার করবেন। ছাত্রদেরকে সামনে নিয়ে একাধারে দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করা তাদের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

অবহেলিত দিকসমূহে দৃষ্টি দিন,

শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না

কিছুদিন আগে থানাভিত্তিক একাধিক পরিদর্শকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অল্পসময়ের ব্যবধানে আল-হামদু লিল্লাহ বেশ কয়েকটি মাদরাসা পরিদর্শন সম্ভব হয়েছে। ফলাফলও আল-হামদু লিল্লাহ ইতিবাচক। পরিদর্শনের এ প্রক্রিয়া কি এভাবেই অব্যাহত থাকবে নাকি একক কোনো পরিদর্শকের মাধ্যমে মাদরাসাগুলো পরিদর্শন করা হবে, সে বিষয়ে আপনাদের কাছ থেকে পরামর্শ আশা করছি। আরও কয়েকটি বিষয়ে পরামর্শের তাকাযা এসেছে। বিশেষ করে মাদরাসাগুলোর অর্থব্যবস্থা এবং হিসাবায়নের প্রতি জোরদার নজর দেওয়া। আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে অত্যন্ত সচেতনতার সাথে এদিকে খেয়াল রাখবেন। কেউ যেন আমাদের ওপর আঙুল তুলে কথা বলতে না পারে, অভিযোগের সুরে কিছু না বলে ফেলে, সেটা সর্বাত্মকভাবে আমলে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদেরকে পছন্দ করে না, ইসলাম, মুসলমান এবং বিশেষত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘৃণা করে—এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তাই শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না। মাঝেমাঝে যখন মাদরাসার বহিরাগত কারও মুখে এসব অভিযোগ আমাদের কানে আসে, অনেক লজ্জিত বোধ হয়। আমরা আশা করবো আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা আরও স্বচ্ছ, সুন্দর এবং পরিশীলিত হবে।

এছাড়াও আরো কিছু বিষয়ে আপনারা পরামর্শ দেবেন বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করছি। গতবছর নাম্বারের ভিত্তিতে মেধা তালিকা অর্জনকারী ছাত্রদেরকে পুরস্কৃত করার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আপনাদের অনেকেই সে সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন এবং সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। যার ফলে উৎসাহিত হয়ে এ বছর আলহামদুলিল্লাহ মেধা তালিকা অর্জনকারী ছাত্রদের সংখ্যা আলহামদুলিল্লাহ বেশি। আমরা এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাক, সেটাই কামনা করি। তবে পুরস্কার প্রদানের এ সিদ্ধান্ত যেহেতু চূড়ান্ত ছিলো না, তাই এ বছর আমরা ঢালাওভাবে উত্তীর্ণ সকল শিক্ষার্থীদেরকে দুই হাজার করে নগদ অর্থপ্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করছি। পুরস্কার প্রদানের এ প্রক্রিয়া কি এভাবেই চলমান থাকবে কি-না বা চললে কীভাবে চলবে, সে ব্যাপারে আপনারা আশা করি মতামত দেবেন। এছাড়াও নেসাবে তালিম, নেযামে তালিম এবং নেযামে তারবিয়তে ইত্তেহাত কীভাবে আরও অগ্রসর হতে পারে, সে ব্যাপারে সকলেই নিজেদের মূল্যবান পরামর্শ পেশ করবেন বলে আমি আশা করছি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

সহ-সভাপতির বক্তব্য

মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলীল (দা. বা.)

নায়েবে মুদির, জামিয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম

মুরব্বিদের রেখে যাওয়া আমানত এ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ। এই আমানত রক্ষায় আমাদেরকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আগলে রাখতে হবে যথাযথভাবে এ মহান আমানত। হযরত মাওলানা আবদুল হালীম বুখারী সাহেব (রহ.) জীবনের শেষমুহূর্তে ইত্তিহাদকে নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন। আজকের মহাসচিব (দা. বা.)-কে নিজ হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে হুজুর এই ইঙ্গিত করেছিলেন,উনার অবর্তমানে মহাসচিব সাহেবই হবেন ইত্তিহাদের কর্ণধার। আল-হামদু লিল্লাহ, ইতোমধ্যেই আমরা এর সফলতা এবং অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি।

ইত্তিহাদকে আরও বেগবান করতে আমি আজকের এ মহতী সভায় কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করছি, আপনারা ভেবে দেখবেন কীভাবে এর বাস্তবায়ন করা যায়। লিখিত প্রস্তাবনা পাঠের পূর্বে আমি আরেকটি বিষয় প্রস্তাব করছি যে, ইত্তিহাদের সমস্ত কাজ সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নিতে আরও কিছু দায়িত্বশীল মানুষ বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। সে হিসেবে গত মজলিসে হযরত মাওলানা মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেব, হযরত মাওলানা আরশাদ রহমানী এবং আমাকেও সহ-সভাপতির পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এ পর্ষদ যথেষ্ট নয়। একে আরও গতিশীল করতে আমি আরও দুজনকে সহ-সভাপতি পদে নিযুক্ত করতে দুজনের নাম প্রস্তাব করছি। এক. হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (দা. বা.)। দুই. হযরত মাওলানা সাইফুদ্দীন কাসেমী (দা. বা.)। আপনারা ভেবে দেখবেন। ইনশা আল্লাহ উনাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ইত্তিহাদকে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

লিখিত প্রস্তাবনা

ছয়টি কওমি মাদরাসা বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ)-এর মাধ্যমে সরকার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যারাবিক বিষয়ে মাস্টার্সের মান দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আল-হাইয়াতুল উলয়ার স্থায়ী কমিটি গৃহীত যাবতীয় সিদ্ধান্ত মানা ও বাস্তবায়ন করা সকল বোর্ডের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সুতরাং ইত্তিহাদকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে আজকের এ মজলিসে কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করা হলো। যথা-

  1. এটা অনস্বীকার্য যে, আল-হাইয়াতুল উলয়ার অধীনে পরিচালিত ছয়টি বোর্ডের মধ্যে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সার্বিক ক্ষেত্রে ইত্তেহাদুল মাদারিসকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বেশি কাজ করা দরকার। তাই প্রস্তাব করা হচ্ছে যে, নিম্নোক্ত কমিটি ও উপ-কমিটিসমূহ গঠন করা হোক।
  • ক) মজলিসে উমুমি তথা সাধারণ পরিষদ। এর সদস্য হবে প্রত্যেক মাদরাসার মুহতামিম ও নাজিমবৃন্দ।
  • খ) মজলিসে খুসুসি তথা বিশেষ পরিষদ। এর সদস্য হবে থানা ইত্তিহাদের সভাপতি ও সেক্রেটারিগণ।
  • গ) মজলিসে আমেলা তথা কার্যনির্বাহী কমিটি। এর সদস্য হবে মজলিসে খুসুসি থেকে নির্বাচিত অনূর্ধ্ব ১১ জন।
  • ঘ) নিসাব উপ-কমিটি। এর সদস্য হবে সর্বোচ্চ সাতজন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ।

ঙ) পরিদর্শন উপ-কমিটি। এর সদস্য হবে সর্বোচ্চ পাঁচজন।

  1. আল-হাইয়াতুল উলয়া গৃহীত ১৫ বছর মেয়াদি পাঁচ স্তরে বিভক্ত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম বা নিসাব প্রত্যেক মাদরাসায় পৌঁছে দিয়ে সেভাবে বাস্তবায়নের জন্য দিক-নির্দেশনা প্রদান করা।
  2. আল-হাইয়াতুল উলয়া ও ইত্তিহাদের সংবিধান ও গঠনতন্ত্র মতে মাদরাসা পরিচালনায় প্রত্যেক মাদরাসাকে বাধ্য করা।
  3. বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অবস্থিত মাদরাসাসমূহের শুরা আমেলা ইত্তিহাদের আঞ্চলিক কমিটি কর্তৃক পরিচালনা করা। বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলগণের উপস্থিতি প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা।
  4. মাদরাসাগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে দায়িত্বশীলদের মাঝেমধ্যে সফর করা ও জরুরি দিক-নির্দেশনা প্রদান করা।
  5. শিক্ষা-দীক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
  6. ইত্তিহাদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য নিসাবভুক্ত কিতাবসমূহ মুদ্রণ ও বিপণনের প্রকল্প গ্রহণ করা এবং মাদরাসাগুলো কর্তৃক প্রদেয় চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি করা। (সানভিয়া থেকে দাওরা পর্যন্ত এবং ইবতিদাইয়া ও মুতাওয়াসসিতার মধ্যে পার্থক্য করে।)
  7. আল-হাইয়াতুল উলয়া যেহেতু ফযিলতকে দুবছর করেছে, তাই কামেলাইনকে বাদ দিয়ে ফযিলতকে দুবছর (দুয়াম ও উলা) পড়ানোর ব্যবস্থা করা।
  8. সানভিয়া উলার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র উর্দুতে সীমাবদ্ধ না রেখে আরবি ও বাংলাতেও করা। তরজমা ও ইনশার ক্ষেত্রে উর্দু থেকে আরবি ও আরবি থেকে উর্দুর পাশাপাশি আরবি থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে আরবিরও ব্যবস্থা করা।
  9. ইত্তিহাদের মাননীয় সদর ও নাজিম (পদাধিকারবলে) সানভিয়া উলার যে নিসাব প্রণয়ন করেছেন, তা অনুমোদনপূর্বক বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা।

নবনির্বাচিত সহ-সভাপতির বক্তব্য

মুফতী কিফায়াতুল্লাহ সাহেব (দা. বা.)

মুহতামিম, জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফ

হামদ ও সালাতের পর। আমাদের আকাবির ওলামায়ে কেরাম, যাদের রক্তের বিনিময়ে গড়ে তোলা আমানত আমাদের হাতে অর্পণ করে তাঁরা কবরস্থ হয়ে গেছেন, আল্লাহ তাদের কবরকে জান্নাতুল ফিরদাউসে পরিণত করুন, তাঁদের সময়ে তো আমাদের কথা বলার সাহস ছিলো না বললেই চলে, বরং নির্ধারিত প্রস্তাবনা এবং ঘোষণা শুনেই আমরা ফিরে যেতাম। ফলে সে সময়কার সভা-বৈঠকে মুহতামিম হযরতদের আনাগোনাও ছিল সীমিত। প্রতিনিধিরা আসতেন, শুনে চলে যেতেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বড় মেহেরবানি, বর্তমান সময়ের প্রথিতযশা আলেম, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সুযোগ্য মুহতামিম এবং বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষাবোর্ড আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের স্বনামধন্য মহাসচিব হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (দা. বা.)-এর কল্যাণে আজকে আমরা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে অনেক জাযা দিন। তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজকে এই জামিয়া প্রাঙ্গণ অসংখ্য মুহতামিম হযরতগণের পদচারণায় মুখর হয়ে আছে।

হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর সূত্রে বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, «خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ» (তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ তো তাঁরাই, যারা কুরআন শরীফ শেখে এবং শেখায়।) (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৭৩৯) রসুলুল্লাহ (সা.)-এর মজলিসে তো কত ধরনের মানুষ ছিল। সবাইকে উপেক্ষা করে সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্য থেকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তিনি স্বীকৃতি দিলেন কুরআনের তালিম প্রদান করা এ শ্রেণিকে। আর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এ শিক্ষাকে উপজীব্য করেই গঠিত হয়েছে মাদারেসে কওমিয়া। পৃথিবীর আর কোনো শিক্ষাব্যবস্থাতেই এ শিক্ষার আদান-প্রদান হয় না। একমাত্র কওমি মাদরাসাতেই তৈরি হয় কুরআনের এ সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষার ধারক এবং বাহক। আল-হামদু লিল্লাহ।

কথা তো অনেক দীর্ঘ, সবকিছু বলা না গেলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা না বললেই নয়। এ বছর আমাকে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের কিছু মাদরাসা পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরিদর্শনের পর ইত্তিহাদের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আযিযুল হক সাহেব (রহ.)-এর প্রতি অন্তর থেকে যে কী পরিমাণ দোয়া এসেছে, আমি তা বলে বোঝাতে পারবো না। মাদরাসাগুলো পরিদর্শন করে আমার প্রবলভাবে অনুভব হয়েছে, ইত্তিহাদের মতো একটি বোর্ড গঠন করা আমাদের আকাবিরীন ওলামায়ে কেরামের জন্য ফরজে আইন ছিল। সে কর্মপন্থার চাহিদা অনুসারে এ মুহূর্তে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ রাখছি।

  1. তাদরিবুল মুহতামিমীনের আয়োজন: পরিদর্শনকালে দেখেছি, কোনো কোনো মাদরাসায় লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হচ্ছে। আয়ের খাতাও নেই, ব্যয়ের খাতাও নেই। মাঝে কিছুদিন পরিদর্শন বন্ধ ছিল, এই সুযোগে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বেখেয়ালির বশে ভুলে বসেছে তাদের কর্মপন্থা। তাই আমি তাদরিবুল মুআল্লিমীনের পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাদরিবুল মুহতামিমীমের ব্যবস্থা করার জোরদার প্রস্তাব করছি। অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, ইত্তিহাদ যদি এই উদ্যোগ না নেয়, জবাবদিহিতার মুখোমুখি না করে, অবস্থা আরও বেগতিক হতে পারে। কোন ফান্ডের টাকা কোথায় চলে যাচ্ছে, কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, যিম্মাদাররা সে সম্পর্কে পুরোপুরি বেখবর হয়ে বসে আছে। তাদেরকে সতর্ক করা প্রয়োজন।
  2. প্রতিটি ছাত্রকে প্রয়োজনীয় ভাষায় সনদ প্রদান: দীনের স্বার্থে অনেক সময় সনদের প্রয়োজন হয়। সে প্রয়োজনীয়তা থেকে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় উত্তীর্ণ সকল ছাত্রকে বিনামূল্যে সনদ প্রদান করা হয়। আমাদের ইত্তিহাদ বোর্ডও সে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজনে উপযুক্ত ফিও নেওয়া যেতে পারে। কেননা একটা সনদের জন্য একজন ছাত্রকে যে পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হতে হয় এবং যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, সে তুলনায় এটা অতি অল্প। সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভাষায় সনদ প্রেরণ করাও জরুরি।
  3. প্রত্যেক মাদরাসায় কারী নিয়োগদান: মাদরাসার প্রতিষ্ঠাই হয়েছে কুরআনের তালিমের জন্য, অথচ বড় পরিতাপের বিষয় দাওরায়ে হাদীস পড়ুয়া একজন ছাত্রকে ইমামতির জন্য দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলে দেখা যায় তিলাওয়াতে ‘লাহনে জলী’ পড়ছেন! কিন্তু আমাদের মাদরাসাগুলোতে বিভিন্ন কিতাব পড়ানোর জন্য অনেক উস্তায নিয়োগ দেওয়া হলেও কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য একজন কারীও নিয়োগ দেওয়া হয় না। তাই আমাদের একটি ছাত্রেরও যেন কুরআন শরীফের তিলাওয়াত অশুদ্ধ না করে এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি প্রদান জরুরি। হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেছেন, তাসহীহে কুরআন, তাযীমে কুরআন এবং তাকরীমে হামেলে কুরআন, এ তিনটি কাজ করলে ইনশাআল্লাহ মাদরাসাগুলোতে এমনকি ব্যক্তিজীবনেও কোনো অভাব থাকবে না।
  4. নুরানি বিভাগগুলোর উন্নয়নের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ: নুরানি বিভাগের নানামুখী উন্নয়নমূলক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যেসব জটিলতা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে, ইনশাআল্লাহ সব দূর হয়ে যাবে।

বক্তব্য

হযরত মাওলানা লোকমান হাকিম (দা. বা.)

মুহতামিম, জামিয়া আরাবিয়া মোজাহেরুল উলূম, চট্টগ্রাম

কওমি মাদরাসার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমি শুধু একটা কথা বলেই শেষ করতে চাই, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, ‘একমাত্র মুত্তাকিদের আমলই আল্লাহ কবুল করবেন।’ কাজেই মাদরাসা পরিচালনায় আমাদেরকে সর্বপ্রথম তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হতে হবে। সবসময় এ দোয়া অব্যাহত রাখতে হবে, ইয়া রাব্বাল আলামীন, আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিদের কাতারভুক্ত করে দিন।

নবনির্বাচিত সহ-সভাপতির বক্তব্য

হযরত মাওলানা সাইফুদ্দীন কাসেমী (দা. বা.)

মুহতামিম,জামিয়া মাদানিয়া সিলোনিয়া, ফেনী

হামদ ও সালাতের পর আমি সংক্ষেপে একটি প্রস্তাবনা উল্লেখ করতে চাই, আমাদের এ দরসে নেযামীতে যেসব ভাষাকে কেন্দ্র করে ইলমের চর্চা হয়, এগুলোর মাধ্যমে ইস্তিদাদ তৈরি হচ্ছে কিনা সেটা যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি ভাষায় ছাত্ররা উপর্যুক্ত পন্থায় যথাযথভাবে যোগ্য হচ্ছে কিনা, তারা কি বাংলা, আরবি, উর্দু ও ইংরেজিতে লিখতে, পড়তে এবং অনর্গল কথা বলতে পারছে কিনা, সেটা গুরুত্বের সাথে দেখা প্রয়োজন। বড়দের পরামর্শ নিয়ে ভাষাকেন্দ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মপন্থা নির্ধারণ এখন একান্ত অপরিহার্য বিষয় হয়ে পড়েছে বলে আমি মনে করি।

বক্তব্য

মাওলানা মুহিউদ্দীন (দা. বা.)

সহকারী মুহতামিম, দাগনভূঞা আশরাফুল মাদারিস, ফেনী

হামদ ও সালাতের পর আমি যে প্রস্তাবনাটি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই যে, ইত্তিহাদ অধিভুক্ত প্রত্যেকটি মাদরাসাকে সুনির্দিষ্ট একটি নেযামের অধীনে আনার ব্যবস্থা করা। প্রশ্নপত্রসহ পরীক্ষাকেন্দ্রিক সব ব্যবস্থাপনা, বিরতি এবং অন্যান্য যেসব বিষয় পুরো বোর্ডের সবগুলো মাদরাসার পক্ষে একইসাথে পরিচালনা করা সম্ভব, সবগুলো একটি সুনির্ধারিত নেযামের অধীনে নিয়ে আসলে সামষ্টিকভাবে উত্তরোত্তর সফলতা অর্জন সম্ভব হবে। এরই মধ্য দিয়ে আমাদের সকলের মেজাজ এবং দ্বীনি ফিকির-আফকার একই গতিপথে চলমান থাকবে ইনশাআল্লাহ।

বক্তব্য

হযরত মাওলানা মুহসিন শরীফ (দা. বা.)

মুহতামিম, রাজারকুল মাদরাসা, রামু, কক্সবাজার

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি অসংখ্য শুকরিয়া, কুতবে জামান হযরত মাওলানা খতীবে আযম (রহ.)-এর হাতে গড়া আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের একক একটি ছায়ার নীচে আজকে আমরা বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ওলামায়ে কেরামের সাথে একত্রিত হয়ে শলা-পরামর্শের সুযোগ পাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, ইত্তিহাদের কর্মপন্থা এবং এর সুবিন্যস্ত রূপ আমাদের সামনে এলে, ইত্তিহাদ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় একটি বোর্ড হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেইসাথে একটি প্রস্তাবনাও বিনীতভাবে উল্লেখ করতে চাই, ইত্তিহাদের মাধ্যমে একটি বার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করা। অধীনস্ত সমস্ত মাদারিস এ ঘোষণার অনুকরণে একইভাবে পরিচালিত হবে। লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ যদি সে পরিকল্পনার অধীনে থেকে পরিচালিত হয়, আশা করি সুশৃঙ্খল একটি কর্মপদ্ধতি আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।

সহ-সভাপতির বক্তব্য

মাওলানা মুসলিমুদ্দীন (দা. বা.)

মুহতামিম, ধাউনখালি মাদরাসা, কক্সবাজার

হামদ ও সালাতের পর তালিম-তারবিয়ত আমাদের কওমি মাদরাসাসমূহের মূল প্রাণ। তালিম তো কিছু না কিছু হচ্ছে, কিন্তু আখলাক ও তারবিয়তে আমাদের ছাত্ররা অনেক গাফেল হয়ে আছে। নামাজের জন্য তাদেরকে ডাকতে হচ্ছে, যেকোনো ক্ষেত্রে তাদের চারিত্রিক অধঃপতন টের পাওয়া যাচ্ছে। আগে শিক্ষকরাও আখলাকে হাসানাহর গুণে গুণান্বিত ছিলেন, ছাত্ররাও তাদের থেকে আখলাক শিখেছে। এখন যেহেতু শিক্ষকদের থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই গুণ, ছাত্ররাও তাই বদ চরিত্রের অধিকারী হচ্ছে। এজন্য বড়দের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে, তারবিয়তি উন্নতির জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

বক্তব্য

মাওলানা নেজামুদ্দীন (দা. বা.)

মুহতামিম, জামিয়া কুরআনিয়া ইউনুসিয়া চন্দ্রঘোনা, চট্টগ্রাম

মুরব্বিদের এরকম মহান বৈঠকে নিজেকে কথা বলার যোগ্য মনে না করলেও আদেশ পালনার্থে এখানে দাঁড়িয়েছি। হযরত কারী তৈয়ব সাহেব (রহ.) লিখেছেন, ‘দীন আল্লাহ তাআলাই হেফাজত করবেন। হেফাজতের জন্য যখন যেভাবে যাকে প্রয়োজন, আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে তাদেরকে তৈরি করে দীন হেফাজতের কাজে নিয়োজিত করে দিবেন।’ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসও সেই মাকবুল জামাতের অন্তর্ভুক্ত একদল নির্বাচিত ওলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ দীনের হেফাজতকেন্দ্র। অনেক ওলামায়ে কেরাম গত হয়ে গিয়েছেন (নাউয়ারাল্লাহু মারকাদাহুম) কিন্তু তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হযরত মুহতারাম মহাসচিব সাহেব (দা. বা.)-এর মতো এখন যারা আছেন, তারাও আশার সঞ্চার করে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন।

দুয়েকটি কথা আরজ করি, আমরা যখন পড়ালেখা করি এই জামিয়া ইসলামিয়ায়, শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে পারে, লিখতে পারে এমন একজন পাওয়াও ছিল দুষ্কর। এমনকি আরবিতে পড়ালেখা করলেও আরবিতে পারদর্শী ছিলো না কেউ। হযরত মাওলানা সুলতান যওক নদভী (দা. বা.)-এর কাছে অনেক মুহতামিমগণ শুধুমাত্র একটি দরখাস্ত লিখতে দূরদূরান্ত থেকে আসতেন। এখন আল-হামদু লিল্লাহ, বাংলা-আরবিতে সমানতালে পারদর্শীর পরিমাণ অনেক হয়ে গেছে। কিন্তু তালিমের দিক দিয়ে উত্তরোত্তর সফলতা আসলেও অত্যন্ত পরিতাপ ও আফসোসের বিষয় হচ্ছে ছাত্রদের কাছ থেকে এখন হারিয়ে গেছে তারবিয়ত ও আখলাক। এর প্রধান কারণই হচ্ছে তারবিয়ত এবং আখলাক শিক্ষার প্রধান উৎস উস্তাযের মাঝেই আখলাকের কমতি। তাই আমার করজোড় অনুরোধ থাকবে, তারবিয়তের প্রতি আমরা যেন যত্নবান হই, আখলাকের মহান দৌলত অর্জনে সচেষ্ট হই।

বক্তব্য

মাওলানা ফয়যুল্লাহ (দা. বা.)

নায়েবে মুহতামিম, ঝাপুয়া মাদরাসা, মহেশখালী

মুরব্বিয়ানে কেরামের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ সব কথাই এসে গেছে, আল-হামদু লিল্লাহ। এর মধ্য থেকেই কিছু কিছু পরামর্শ অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় দ্বিরুক্তি করছি।

  1. আমাদের মাদরাসাগুলোতে তালিমের দিক দিয়ে আশানুরূপ সফলতা এবং অগ্রগতি আসলেও আমরা তারবিয়তের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছি। এই তারবিয়তের দিকটিকে উন্নত করতে প্রত্যেক থানাভিত্তিক তারবিয়তি প্রোগ্রামের আয়োজন করার অনুরোধ থাকবে বড়দের কাছে।
  2. কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্বারোপ। এর জন্য নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মারকাযী হোক অথবা মাদরাসার পরীক্ষাগুলোতে হোক। পরীক্ষার আয়োজন তিলাওয়াত বিশুদ্ধকরণে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে।
  3. নুরানি পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার যে সিলেবাস এখন বাংলাদেশে চলমান আছে, আমার একান্ত দাবি থাকবে ইত্তিহাদের নিজস্ব উদ্যোগে এই সিলেবাসকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজানো। ইত্তেহাদ কর্তৃক পরিকল্পিত এই পদ্ধতি ইনশাআল্লাহ অনেক বেশি সুশৃঙ্খল এবং সুন্দর হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

একনজরে প্রস্তাবনাসমূহ

  1. নিম্নোক্ত ধারায় কমিটি ও উপ-কমিটিসমূহ গঠন।
  • ক) মজলিসে উমুমি তথা সাধারণ পরিষদ। এর সদস্য হবে প্রত্যেক মাদরাসার মুহতামিম নাজিমবৃন্দ।
  • খ) মজলিসে খুসুসি তথা বিশেষ পরিষদ। এর সদস্য হবে থানা ইত্তিহাদের সভাপতি ও সেক্রেটারিগণ।গ) মজলিসে আমেলা তথা কার্যনির্বাহী কমিটি। এর সদস্য হবে মজলিসে খুসুসি থেকে নির্বাচিত অনূর্ধ্ব ১১ জন।
  • ঘ) নিসাব উপ-কমিটি। এর সদস্য হবে সর্বোচ্চ সাতজন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ।
  • ঙ) পরিদর্শন উপ-কমিটি। এর সদস্য হবে সর্বোচ্চ পাঁচজন।
  1. আল-হাইয়াতুল উলয়া গৃহীত ১৫ বছর মেয়াদি পাঁচ স্তরে বিভক্ত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম নিসাব প্রত্যেক মাদরাসায় পৌঁছে দিয়ে সেভাবে বাস্তবায়নের জন্য দিক-নির্দেশনা প্রদান।
  2. শিক্ষা-দীক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে তাদরিবুল মুআল্লিমীনের (শিক্ষক প্রশিক্ষণ) ব্যবস্থা করা।
  3. ইত্তিহাদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য নিসাবভুক্ত কিতাবসমূহ মুদ্রণ ও বিপণনের প্রকল্প গ্রহণ।
  4. মাদরাসাগুলো কর্তৃক প্রদেয় চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধিকরণ। (সানভিয়া থেকে দাওরা পর্যন্ত এবং ইবতিদাইয়া ও মুতাওয়াসসিতর মধ্যে পার্থক্য করে)।
  5. আল-হাইয়াতুল উলয়া যেহেতু ফযিলতকে দুবছর করেছে, তাই কামেলাইনকে বাদ দিয়ে ফযিলতকে দুবছর (দুয়াম ও উলা) পড়ানোর ব্যবস্থা।
  6. সানভিয়া উলার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র উর্দুতে সীমাবদ্ধ না রেখে আরবি ও বাংলাতেও করা। তরজমা ও ইনশার ক্ষেত্রে উর্দু থেকে আরবি ও আরবি থেকে উর্দুর পাশাপাশি আরবি থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে আরবিরও ব্যবস্থা করা।
  7. মুহতামিমদের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধিতে তাদরিবুল মুহতামিমীনের আয়োজন।
  8. ইত্তিহাদ অধিভুক্ত সকল মাদরাসার উত্তীর্ণ প্রত্যেক ছাত্রকে প্রয়োজনীয় ভাষায় সনদ প্রদান।
  9. কুরআন তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করতে প্রত্যেক মাদরাসায় কারী নিয়োগ। ছাত্রদের কুরআন তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করতে তিলাওয়াতের উপর পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা।
  10. নুরানি বিভাগগুলোর উন্নয়নের জন্য ইত্তিহাদের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ইত্তিহাদের নিজস্ব উদ্যোগে নুরানি পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র সিলেবাস প্রণয়ন।
  11. দরসে নেযামীতে পঠিত প্রত্যেকটি ভাষায় ছাত্ররা যথাযথভাবে যোগ্য হচ্ছে কিনা, তা যাচাই-বাছাইপূর্বক ভাষাকেন্দ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মপন্থা নির্ধারণ।
  12. তালিমের পাশাপাশি তারবিয়তের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ। আখলাক ও তারবিয়ত উন্নত করতে প্রত্যেক থানাভিত্তিক তারবিয়তি প্রোগ্রামের আয়োজন।

যৌথসভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ

  1. বার্ষিক হিসাব বিবরণী অনুমোদন করা হলো।
  2. ইত্তিহাদের কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য আরও দুজন সহ-সভাপতি নির্বাচন করা হলো। তাঁরা হলেন যথাক্রমে জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফের মুহতামিম মুফতি কেফায়েতুল্লাহ শফিক ও ফেনী জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মাওলানা সাইফুদ্দীন কাসেমী।
  3. ইত্তিহাদ অধিভুক্ত সকল মাদরাসার ছুটি ও পরীক্ষাসহ যাবতীয় কার্যক্রম অভিন্ন সময়ে সম্পাদনের জন্য ইত্তিহাদের পক্ষ থেকে একক ‘শিক্ষাবর্ষ পরিকল্পনা’ নির্ধারণ করা হবে।
  4. পরীক্ষা সংক্রান্ত:
  • ক) চলতি ১৪৪৪/৪৫ হিজরী সনের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা আগামী ১৬ই শাবান ১৪৪৫ হিজরী শুরু হয়ে ২৩ই শাবান ১৪৪৫ হিজরীতে শেষ হবে।
  • খ) মারহালাওয়ারি পরীক্ষার ফি নির্ধারণ যথাক্রমে:
মারহালা ফি মারহালা ফি
আলামিয়্যা (দাওরা) ১২০০ সানবিয়া আম্মা (শাশুম) ৭০০
আলিয়া উলা/কামেলাইন) ১০০০ মুতাওয়াসসিতাহ (হাস্তম) ৬০০
সানবিয়া খাসসা (চাহারম) ৮০০ ইবতাদিইয়া (দাহম) ৪০০
  • গ) পাঁচটি নতুন হল অনুমোদন করা হলো, যথাক্রমে জামিয়া আবু বকর সিদ্দীক ভূজপুর, জামিয়াতুল উলূম রামু কক্সবাজার, মদিনাতুল উলূম চা-বাগান মাদরাসা চকরিয়া, জামিয়া ইবনে আব্বাস লোহাগাড়া ও আযিযুল উলূম পুরান রামগড়।
  • নাযুর ও মুরাকিবদের তালিকা অনুমোদনপূর্বক তাদের ভাতা যথাক্রমে: ৪০০০ ও ৩০০০ টাকা করে নির্ধারণ করা হলো।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ