বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও মনীষীদের দৃষ্টিতে মহানবী (সা.) ও ইসলামের প্রশংসা
শেখ আহসান উদ্দিন
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বিআইইউ, মান্ডা, ঢাকা
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), যাকে আল্লাহ তাআলা সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ তাআলা যে দীনসহ সকল মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন তা হচ্ছে ইসলাম, যা পরিপূর্ণ, জীবনের সকল দিক ও বিভাগ যার অন্তর্ভুক্ত, যা ব্যাপক, স্থায়ী ও নির্ভেজাল। পবিত্র কুরআনে মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা নিয়ে অনেক আয়াত এসেছে। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা একজন আল্লাহ তাআলা অর্থাৎ এক স্রষ্টার ইবাদত বা উপাসনা তার কোনো শরীক অংশীদার নেই অর্থাৎ তাওহীদ এবং মহানবী (সা.)-এর রিসালত ও খতমে নুবুওয়াত (মহানবী মুহাম্মদ সা.ই সর্বশেষ নবী ও রসুল)-এর আকীদা বিশ্বাস। অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহেও সৃষ্টিকর্তা একজন এ ধারণা এবং মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের বার্তা ও প্রশংসা পাওয়া যায়। বিশ্বের অনেক বড় বড় মনীষীরাও মহানবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.) ও ইসলামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। সে বিষয়ে এ প্রবন্ধ লেখা হলো।
পবিত্র কুরআনুল করীমের সুরা আল-আম্বিয়ায় আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে সমগ্র বিশ্ববাসী মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কুরআনুল করীমের অসংখ্য জায়গায় জায়গায় মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা ও পবিত্রতা মর্যাদার কথা এসেছে। কুরআনের সুরা আল-আহযাবে রসুল (সা.)-এর চরিত্রকে উসওয়াতুন হাসানাহ বা উত্তম চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেখানে এসেছে যে, ‘মুহাম্মদ (সা.) কারও পুরুষের পিতা নন, তিনি শেষ নবী ও রসুল।’ একই সুরার সপ্তপঞ্চাশৎ আয়াতে এসেছে,
اِنَّ الَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ اللّٰهَ وَرَسُوْلَهٗ لَعَنَهُمُ اللّٰهُ فِي الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَاَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِيْنًا۰۰۵۷
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের ওপর লানত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’[1]
সুরা হাশরের সপ্তম আয়াতে এসেছে,
وَمَاۤ اٰتٰىكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ١ۗ وَمَا نَهٰىكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْاۚ ۰۰۷
‘রসুল (সা.) যা আদেশ দিয়েছেন তা গ্রহণ ও মান্য করো এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।’[2]
এ আয়াতের আলোকে মহানবী (সা.)-এর হাদীস ও সুন্নাহ মানার গুরুত্ব বোঝা যায়। সুরা আন-নিসার ঊনষষ্টি আয়াতে এসেছে,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِيْعُوا اللّٰهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَاُولِي الْاَمْرِ مِنْكُمْ١ۚ فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَى اللّٰهِ وَالرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ١ؕ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّاَحْسَنُ تَاْوِيْلًاؒ۰۰۵۹
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, তাঁর রসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতিয়ারধারী বা উলিল আমর তাদেরও। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তোমরা আল্লাহ ও পরকালে সত্যিকারের বিশ্বাসী হয়ে থাকলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসুলের ওপর ন্যস্ত কর। এটাই উৎকৃষ্টতর এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ।’[3]
হাদীস শরীফে এসেছে, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হযরত সাইয়েদা আয়িশা (রযি.) বলেন,
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ.
‘তাঁর চরিত্র হল কুরআন।’[4]
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ, গীতা ও উপনিষদ। হিন্দুদের এ প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোতেও শুধু এক সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করা এবং ইসলামের মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের বার্তা ও প্রশংসা পাওয়া যায়।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদের মধ্যে মহানবী (সা.)-এর আগমন ও প্রশংসা বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বর (আল্লাহ) ছাড়া কোনো উপাস্য নেই—একথার ওপর বিশ্বাস ছাড়া পাপ মুক্তির কোনো রাস্তা নেই। আল্লাহর আশ্রয়ই হলো প্রকৃত আশ্রয়। বৈকুণ্ঠে জন্মলাভের প্রত্যাশা করলে রবের আশ্রয় ব্যতীত কোনো উপায় নেই। সে কারণে মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শের অনুসরণ জরুরি (উত্তরায়ণ বেদ, আনকাহি, পঞ্চম অধ্যায়)।’ তাদের ঋগ্বেদে এসেছে যে, ‘আহমদ (মুহাম্মদ) নিজের প্রভুর হিকমতের দ্বারা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা অর্জন করেছেন। আমি সূর্যের মতো আলোকিত হয়ে যাচ্ছি।’ তাদের ভগবৎ গীতায় এসেছে, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র মুহাম্মদই সেই ব্যক্তি, যিনি মক্কা বিজয়ের পর কাবাগৃহ থেকে অসংখ্য মূর্তি ধ্বংস করেছেন, যার সংখ্যা ৩৬০টি ছিল (গীতা: ৭/২০)।’
হিন্দুদের ভবিষ্য পুরাণে একইভাবে বলা আছে যে, ‘ঠিক সেই সময় মহামদ নামক এক ব্যক্তি, যার বাস মরুস্থলে (আরব) আপন সাঙ্গপাঙ্গসহ আবির্ভূত হবেন। হে আরবের প্রভু, জগতগুরু তোমর প্রতি আমার স্তুতিবাদ। হে পবিত্র পুরুষ আমি তোমার দাস। আমাকে তোমার চরণতলে স্থান দাও।’ ড. এমএ শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘বেদের মধ্যে যে উষ্টারোহী (উট আরোহণকারী) আসার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তিনি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। বেদ অনুযায়ী সেই উষ্টারোহীর নাম হবে ‘নরাশংস’। ‘নরাশংস’ শব্দের আরবি অনুবাদ হচ্ছে ‘মুহাম্মদ’। ‘নরাশংস’ এর ব্যাপারে বর্ণিত কার্যকলাপ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আচরণের সঙ্গে এবং ব্যবহারিকভাবে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।’
খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা
খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো বাইবেল। তাদের অন্যান্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে, Apocrypha (বাইবেলের অপ্রামাণিক অংশসমূহ) ও Didache (দ্বিতীয় শতাব্দীর সময়ে মিসর ও সিরিয়ায় রচিত খ্রিস্টানদের ১২ প্রেরিত ব্যক্তিদের শিক্ষা)। ইসলামের অনুসারীরা অর্থাৎ মুসলিম বা মুসলমানরা হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-কে নবী ও রসুল বলে বিশ্বাস করেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে যিশুখ্রিস্ট বলে অভিহিত করেন। ইসলামে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে ‘বাইবেল’ বলে কোনো ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং উল্লেখ পাওয়া যায়, আল্লাহর বার্তাবাহক নবী হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘ইনজীল’ নামক ধর্মগ্রন্থের। অর্থাৎ ইনজীল শরীফ।
খ্রিস্টানদের বাইবেল দুভাগে বিভক্ত। (১) ওল্ড টেস্টামেন্ট বা আদিপুস্তক ও (২) দ্য নিউ টেস্টামেন্ট। ওল্ড টেস্টামেন্ট বা আদিপুস্তক হিব্রু ও সুরিয়ানি বা সিরীয় আরামাইক ভাষায় লিখিত যা ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ই তা মানতো। আর নিউ টেস্টামেন্ট গ্রিক ও সুরিয়ানি বা আরামাইক ভাষায় লিখিত। তবে ওল্ড টেস্টামেন্ট আর ইহুদিদের তাওরাত পুরোপুরি এক নয়। অনেক মনীষী ও ইতিহাসবিদরা বাইবেলের সুসমাচারের অংশকে ইনজীল হিসেবে সনাক্ত করেছেন। মুসলিমদের মতে, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা আল্লাহর কিতাব তাওরাত ও ইনজীলের পরিবর্তন ও বিকৃতি করেছে। তাই বর্তমান বাইবেলকে তারা আল্লাহর কিতাব হিসেবে মানে না, বরং আল্লাহর কিতাবের পরিবর্তিত ও বিকৃত রূপ বলে মনে করে।
ইতিহাস বলে প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু সেন্ট পল তাওরাত এবং ওল্ড টেস্টামেন্টকে অস্বীকার করে মানুষকে ইনজীলের নাম ব্যবহার করে ইনজীল বিকৃত করে পথচ্যুত করেছিলেন। এ পল-ই খ্রিস্টানধর্মে ত্রিত্ববাদের দর্শন শুরু করেন। যেকারণে বড় বড় হাওয়ারি অর্থাৎ হযরত ঈসা (আ.)-এর সহচর যেমন ইউহেন্না, পিটার্স ও বারনাবাস তারা পলের এসব মতবাদের বিরুদ্ধে। এজন্য দেখা যায়, বাইবেলের পৃথক পৃথক সংস্করণ ও পৃথক পৃথক লেখক দেখা যায়। এক বাইবেলের সাথে আরেক বাইবেল মিলে না। লেবানন ও ইরাকসহ অনেক আরব দেশগুলোতে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার খ্রিস্টান মিশনারিরা এগুলোকেই বিশেষত নিউ টেস্টামেন্ট ও নতুন নিয়মের সমষ্টি বা আল-আহদুল জাদীদকে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে ‘ইনজীল শরীফ’ ও ‘কিতাবুল মুকাদ্দাস’ (বাংলাদেশে এগুলো বাইবেল সোসাইটি বিবিএস ও সমমনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে), উর্দুতে কিতাবে মুকাদ্দাস আহাদনামায়ে জাদীদ ও আরবিতে কিতাবুল মুকাদ্দাস কিতাব আল-হায়াত নামে প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করছে তারা। তবে বার্নাবাসের ইনজীল নিয়ে ভিন্ন কথা শোনা যায়। এটাকেই অনেকে বিশুদ্ধ ইনজীল বলেছেন।
ওল্ড টেস্টামেন্টের Book of Deuteronomy-এর ১৮ অধ্যায় ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মহান ঈশ্বর বলেছেন, আমি তোমার মতো করে তোমার ভাইদের মধ্য হতে একজন নবীকে পাঠাবো। আমি তাকে ধর্মপ্রচার করতে বলবো। সে আমার আদেশে সব কথা বলবে।’ এ ভবিষ্যদ্বাণীটি সবচেয়ে বেশি মিলে যায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে।
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখ আছে, ‘তোমাদেরকে বলার আমার আরও অনেক কথা আছে কিন্তু তোমরা এখন সে সকল সহ্য করতে পারবে না। পরন্তু সে সত্যের আত্মা যখন আসবেন তখন তিনি তোমাদেরকে সত্যের সন্ধান দেবেন। কারণ তিনি নিজ থেকে কিছু বলবেন না, যা যা শুনবেন তাই বলবেন এবং ভবিষ্যতের ঘটনাও জানাবেন (যোহন: অধ্যায় ১৪)।’ ইনজীল বা বাইবেলে বর্ণিত বাক্যগুলোতে হযরত ঈসা (আ.) বারবার প্রিয়নবী (সা.)-এর আগমনের সংবাদ দিয়েছেন। প্রিয়নবী (সা.)-কে তিনি ‘ফারাক্লিত’ (Paraclete) বলে অভিহিত করেছেন। এ শব্দটি সুরিয়ানি ভাষার। এর আরবি অনুবাদ মুহাম্মদ ও আহম্মদ অর্থাৎ প্রশংসিত, পরম প্রশংসাকারী অথবা পরম প্রশংসিত। প্রাচীন ইউনানি (গ্রিক) ভাষায় এর অনুবাদ করা হয়েছে, ‘পাইরিকিলইউটাস’। এর অর্থ অত্যন্ত প্রশংসাকারী বা প্রশংসিত। কিন্তু পরবর্তী খ্রিস্টানরা যখন দেখতে পেল, এর দ্বারা ইসলামের সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে, তখন তারা শব্দটি পরিবর্তন করে, ‘পাইরকিলিটাস’ অর্থাৎ শান্তিদাতা করে নেয়। খ্রিস্টান পাদরি এবং মুসলমান আলেমসমাজের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ এ শব্দটি নিয়ে চলে আসছে তর্কযুদ্ধ। আলেমরা প্রাচীন খ্রিস্টানদের লিখিত প্রমাণ দ্বারা অনেকবার প্রমাণ করে দিয়েছেন, এ শব্দটি ‘পাইরিকিলইউটাস’ অর্থাৎ মুহাম্মদ ও আহম্মদ।
বার্নাবাসের ইনজীল বা বারনাবাসের বাইবেলে বারনাবাস রসুল (সা.)-এর আগমন সস্পর্কে হযরত ঈসা (আ.)-এর যেসব ভবিষ্যদ্বাণী তুলে ধরেছেন সেসব বাণীতে হযরত ঈসা (আ.) কোথাও নবী করীম (সা.)-এর নাম উল্লেখ করেছেন, কোথাও শুধু রসুলুল্লাহ বলেছেন (বার্নাবাসের সুসমাচার ২২০ অধ্যায়)। এছাড়া এ ইনজীলের আরও কয়েকটি স্থানে যিশু মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম উল্লেখ করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন (দেখুন: ১১২, ১৩৬ ও ১৬৩ অধ্যায়)।
ইহুদি ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা
ইহুদি ধর্ম এসেছিল প্রাচীনযুগে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যিহূদার ধর্ম থেকে। বর্তমানে ইহুদিরা তারা নিজেদেরকে বলে থাকে যে, তারা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত মুসা (আ.)-এর অনুসারী জাতি। অনেক ইহুদিরা বলে থাকে যে, ইহুদি ধর্ম নাকি হযরত ইবরাহীম (আ.) শুরু করেছেন। ইহুদি ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো তাওরাত (ইহুদি ও খ্রিস্টানরা একে তোরাহ বলে) ও তানাখ। ওল্ড টেস্টামেন্টকেও ইহুদিরা তাদের ধর্মগ্রন্থ মনে করে। তাদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ হলো তালমূদ, মিশনাহ, যোহার ও তাদের প্রার্থনা গ্রন্থ সিদ্দুর। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থগুলো মূলত হিব্রু ভাষায় রচিত। ইসলামের দৃষ্টিতে হযরত মুসা (আ.) বৃষ্টি ওপর আসমানি গ্রন্থ তাওরাত নাযিল হয়েছিল। কিন্তু তাওরাতকে পরবর্তীতে ইহুদি ধর্মগুরুরা বিকৃত করেছে।
ইহুদিদের তাওরাতে মহানবী (সা.) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ আছে যে, A prophet from among you, from your brothers, like me, the Lord, your God will set up for you; you shall hearken to him. অর্থাৎ আমি তাদের মধ্য থেকে তাদের ভাইদের মত একজন নবীর, আবির্ভাব করবো এবং আমার আদেশ তার কাছে যাবে সে অনুযায়ী যারা চলবে না তাদের হিসাব নেবো (তাওরাতে পঞ্চম Dcutronomy ১৮:১৫-১৯)।
ইহুদিদের ওল্ড টেস্টামেন্টের সং অফ সোলোমনে এসেছে, Hikko Mamittakim we kullo Muhammadim Zehdoodeh wa Zehraee Bayna Jerusalem. ইংরেজি অর্থ: His mouth is sweetness itself; he is altogether lovely. This is my beloved; this is my friend, daughters of Jerusalem. অর্থাৎ ‘তার কণ্ঠ খুব মিষ্টি, সে খুব প্রিয়পাত্র সে আমার প্রিয়জন, সে আমার বন্ধু, শোন জেরুজালেমের কন্যারা (Song of Solomon, Chapter 5, Verse 16)। হিব্রু মুহাম্মদিম শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে খুব প্রিয়পাত্র। তবে সেমেটিক হিব্রুতে হুম দিয়ে সম্মান বোঝানো হয় যেমন তারা আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে বলে ‘এলোহিম’ যার অর্থ সম্মান দেখানো। সে হিসেবে ওল্ড টেস্টামেন্টে মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম উল্লেখ এসেছে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা
বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল প্রাচীনযুগে গৌতম বুদ্ধের নীতি শিক্ষা থেকে। বলা হয় গৌতম বৌদ্ধই এ ধর্মের প্রবর্তক। বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো ত্রিপিটক ও ধম্মপদ। তাদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ হলো দিগনিশিকায়া বা দিঘা-নিকায়া ও সদ্ধর্ম সূত্র। প্রায় সব বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থে আছে ভবিষ্যতে একজন মায়িত্রি বা মৈত্রেয় আসবেন, চক্কভাতি সিহানন্দ সুতানতার বলেছেন আরেকজন বুদ্ধ আসবেন তিনি মাইত্রি। Sacred Book of The East গ্রন্থের একাদশ খণ্ডের আলোকে জানা যায় বৌদ্ধদের ত্রিপিটকে বলা হয়েছে যে, ‘গৌতম বুদ্ধের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো গুপ্ত অথবা প্রকাশ্য শিক্ষা ছিল না, হে আনন্দ তথাগতরা অথবা শিক্ষকরা মুঠোবন্ধ করে রাখবে না, জ্ঞান নিজের কাছে রাখবে না, এটা প্রচার করতে হবে (ত্রিপিটক: মহাপরিনিব্বান সুত্তা, দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩২ নং অনুচ্ছেদ)।’ আমরা জানি মুহাম্মদ (সা.) অহী হিসেবে যা পেয়েছিলেন তা সঙ্গে সঙ্গে সবার কাছে প্রচার করেছেন আর সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন, এগুলো মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখো না, এগুলো প্রচার করো।
বৌদ্ধদের প্রামাণ্য গ্রন্থ দিঘা-নিকায়া বা দিগনিশিকায়ায় বর্ণিত হয়েছে, ‘আনন্দ বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার মৃত্যুর পর কে আমাদেরকে উপদেশ দান করবে? তখন বুদ্ধ বলেন, মানুষ যখন গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ভুলে যাবে, তখন আর একজন বুদ্ধ আসবেন, তার নাম ‘মৈত্রেয়’ (সংস্কৃত শব্দ মৈত্রেয়)। অর্থাৎ শান্তি ও করুণার বুদ্ধ। এখানে মাইত্রে বা মৈত্রেয় শব্দের অর্থ হচ্ছে, ক্ষমাশীল যার আরবি করলে হবে রাহমা। কুরআনে মুহাম্মদ (সা.)-কে রাহমাতুল্লিল আলামীন বলা হয়েছে। তাই বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে মৈত্রেয় সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা হচ্ছেন মহানবী মুহাম্মদ (সা.)।
পার্সি ও শিখ ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা
পার্সি বা জরথুস্ত্রীয় জোরাস্ট্রান্ট ধর্ম একটা প্রাচীন একটা ধর্ম যার উৎপত্তি হয় জরথুস্ত্রের মাধ্যমে। পার্সি ধর্মের ধর্মগ্রন্থ হল দাশাতির ও আবেস্তা। দাশাতির দুভাগ এবং আবেস্তাও দুভাগে বিভক্ত। শিখ ধর্ম মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাবে গুরুনানকের মাধ্যমে এই ধর্মের উৎপত্তি হয়। ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের কিছু চিন্তাধারার সমন্বয় থেকে এই ধর্মের উৎপত্তি। শিখ ধর্মের ধর্মগ্রন্থ হলো গুরু গ্রন্থসাহেব ও তাদের উপাসনালয় হলো গুরুদুয়ারা। শিখ ধর্মাবলম্বীরা এক সৃষ্টিকর্তার উপাসনায় বিশ্বাসী, মূর্তিপূজার বিরোধিতা করে।
পার্সি ধর্মগ্রন্থ জিন্দাবেস্তায় প্রিয়নবী (সা.)-এর আগমনের সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। এমনকি আহমদ নামটিও উল্লেখ আছে। সেখানে এসেছে, ‘আমি ঘোষণা করছি, হে স্পিতাম জরথুস্ট্রু, পবিত্র আহমদ (ন্যায়বানদের আশীর্বাদি) নিশ্চয় আসবেন, যার কাছ থেকে তোমরা সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কাজ এবং বিশুদ্ধ ধর্ম লাভ করবে (জেন্দাবেস্তা, প্রথম খণ্ড)।’
‘দসাতির’ গ্রন্থে অনরূপ আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী আছে। তার সারমর্ম হলো, ‘যখন পার্সিরা নিজেদের ধর্ম ভুলে যেয়ে নৈতিক অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত হবে, তখন আরবদেশে একজন মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করবেন। যার শিষ্যরা পারস্যদেশ এবং দুর্ধর্ষ পারসিক জাতিকে পরাজিত করবে। নিজেদের মন্দিরে অগ্নিপূজা করবে না। তারা ইবরাহীমের কাবা ঘরের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করবে। সেই কাবা ঘরও প্রতিমামুক্ত হবে। সেই মহা পুরুষের শিষ্যরা বিশ্ববাসীর পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ হবে।’
শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেব ও গুরবাণী দাশামগ্রন্থের ২৬ ও ২৭ তম স্তবকে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা এসেছে। বিশ্বের অনেক বড় বড় মনীষীরা মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা করেছেন। এখানে তাদের উক্তি দেওয়া হলো:
স্যার জর্জ বার্নার্ড শ, তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সব সময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবন যাত্রার সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। (The Genuine Islam, 1936 ও দ্যা জেনুইন ইসলাম, প্রথম খণ্ড, ১৯৩৬)
বিশ্ববিখ্যাত মাইকেল এইচ হার্ট তার ১০০ মনীষীর জীবনী বইয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রথম স্থানে রেখেছেন।
লন্ডনের বিখ্যাত The Dayily Express পত্রিকায় ১০ নভেম্বর ১৯২৫ সালে সম্পাদকীয় লেখা হয় ঠিক এভাবেই, ‘যদি কোনো মহান মানুষের উৎসাহ আর উদ্দীপনার স্বাদ পাওয়া যায় আসমানি উদ্বোধন বিশ্বাসী মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধা আর সম্মান নিবেদনের প্রতি উৎসাহী বাক্য উচ্চারণের মাঝে তবে সেক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা.)-কে অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ বলতে হবে। কারণ এটা শুধু মুহাম্মদি চরিত্রের এক অনন্য ভূষণ যা জগতের অন্য কোনো নবী, রসুল, সংস্কারক কিংবা দার্শনিকের মাঝে পাওয়া যায় না। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তার অনুসারীদের যতটা ভক্তি আর অপরিসীম ভালোবাসা ছিলো তা জগতের মানবীয় ইতিহাসে বিরল।’
ভারতের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘আমি শ্রেষ্ঠতম সেই মানুষের জীবন সম্পর্কে আরও জানতে চাই, যিনি আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছেন। আমি নিশ্চিত যে, এর নেপথ্যে তরবারি বা গায়ের জোরে নয়; বরং মহানবী (সা.)-এর সারল্য, আত্মত্যাগ, দৃঢ়সঙ্কল্প, ভক্ত ও অনুসারীদের প্রতি মমত্ববোধ, সৎসাহস সর্বোপরি নিজের উদ্দেশ্য ও সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ আস্থা তাঁকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল।’
উপমহাদেশের অন্যতম হিন্দু কবি দিল্লু রাম কাওসারী নবীজি (সা.)-এর প্রশংসায় লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ ‘হিন্দু কি নাত।’
মি. ইরভিং তা বিখ্যাত গ্রন্থ Muhammad-এর ২০ পৃষ্ঠায় ঐতিহাসিক আবুল ফিদার সূত্রে লিখেন, ‘একজন মানুষ পরিপূর্ণ সৎ ও পুণ্যবান হতে যতগুলো গুণে তাঁকে গুণান্বিত হতে হয় মহান প্রভু তার মধ্যে সবকয়টি গুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি এতটাই বিশুদ্ধ ও নির্মল প্রকৃতির অধিকারী ছিলেন, স্বাভাবিকভাবে তিনি সকলের কাছে ‘আল-আমিন’ নামে পরিচিত ছিলেন। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস যা বিচারের ক্ষেত্রে তার মাঝে স্থিতি লাভ করেছিলো আর তার নম্রতা তাকে বারবারই তর্ক-বিতর্ক সালিশির ক্ষেত্রে বিচারক ও মীমাংসাকারীর আসনে সমাসীন করেছিল।’
ভারতের জওহরলাল নেহেরু বলেন, ‘এমন এক জনগণের এ বিজয়ী কর্মজীবন, যাদের আবাসভূমি ছিল আরবের মরুভূমি এবং যারা এখনও পর্যন্ত ইতিহাসে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনি, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তারা নিশ্চয়ই তাদের মহানবীর গতিশীল ও বিপ্লবী চরিত্র এবং তাঁর মানব ভ্রাতৃত্বের বাণী থেকে তাদের বিশাল শক্তি অর্জন করেছে। ইসলামের নবী তাঁর জনগণকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন এবং তাদের বিশ্বাস ও উৎসাহে পূর্ণ করেছিলেন।’
জনপ্রিয় গ্রন্থ দ্য প্রফেটের রচয়িতা লেজলি হ্যাজেলটন যিনি একজন অজ্ঞেয়বাদী ইহুদি মহিলা সাংবাদিক তিনি বলেছেন, Muhammad’s is one of those rare lives that is more dramatic in reality than in legend. In fact the less one invokes the miraculous, the more extraordinary his life becomes. অর্থাৎ মুহাম্মদের সেই বিরল জীবনগুলির মধ্যে একটি যা কিংবদন্তির চেয়ে বাস্তবে বেশি নাটকীয়। আসলে একজন অলৌকিককে যত কম ডাকে, তার জীবন ততই অসাধারণ হয়ে ওঠে।
অতীত যুগ থেকে বর্তমান সময় হাজার হাজার মুসলিম লেখক কবি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদগণ মহানবী (সা.)-এর জীবনী ও তার প্রশংসা নিয়ে অজস্র বই পুস্তক প্রবন্ধ কবিতা কাসিদা লিখেছেন। হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রযি.) থেকে ইরানের কবি শেখ সাদী (রহ.), হাফিজ শিরাজী (রহ.), আবদুর রহমান জামী (রহ.) থেকে ইমাম বুসিরী (রহ.), আবদুল কাদের জিলানী (রহ.), ইমাম আবু হানিফা (রহ.), খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.), আমির খসরু (রহ.), শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানিরী (রহ.), খাজা মাসুম (রহ.) থেকে ইমাম আল হাদ্দাদ (রহ.), বুল্লেহ শাহ (রহ.), ইরাকের বাহাউদ্দিন আল-রাওয়াস (রহ.) থেকে মিসরের কবি আহমদ শাওকী, উপমহাদেশে মহাকবি আল্লামা ইকবাল (রহ.), আবদুল আলিম সিদ্দিকী (রহ.), আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী (রহ.), কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শান্তিপুরের মোজাম্মেল হক, গোলাম মোস্তফা (রহ.), ফররুখ আহমদ (রহ.), আল্লামা মানযুর উয়েসী (রহ.), কবি রুহুল আমিন খান, তাঁরা প্রিয়নবী (সা.)-এর শানে অসংখ্য কসিদা কবিতা গজল লিখেছেন।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন ও আমাদের প্রতি রহম করুন (আমিন)।
তথ্যসূত্র
- দৈনিক ইনকিলাব, কালেরকন্ঠ ও নয়াদিগন্ত,
- উইকিপিডিয়া,
- info ওয়েবসাইট,
- ড. আহমদ দিদাতের বক্তব্য ও লেকচারসমূহ,
- ইসলামিয়া কুতুবখানা ঢাকার মাসিক ইসলামী পয়গামের সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় মাওলানা ইসমাইল রেহানের প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ ও
- ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বই কিতাবুল মুকাদ্দাস, ইনজীল ও ঈসায়ী ধর্ম।
[1] আল-কুরআনুল করীম, ৩৩ (সূরা আল-আহযাব): ৫৭
[2] আল-কুরআনুল করীম, ৫৯ (সূরা আল-হাশর): ৭
[3] আল-কুরআনুল করীম, ৪ (সূরা আন-নিসা): ৫৯
[4] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৪১, পৃ. ১৪৮, হাদীস: ২৪৬০১