জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি-৭ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ-২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

যুবসমাজের প্রতি ইসলামের আহ্বান

 

ড. আবিদুর রহমান তালুকদার

        লেখক: সভাপতি, জাগৃতি লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম

যৌবন হলো মানবজীবনের বসন্তকাল। এর ব্যাপ্তিকাল ১৫ থেকে ৪০ বছর। পার্থিব উন্নতি, বৈষয়িক সমৃদ্ধি ও পরকালীন অগ্রগতির বর্ণাঢ্য সময় যৌবনকাল। অদম্য সাহস, অনুপম শৌর্যবীর্য ও যুঁকিপূর্ণ কাজে জীবনবাজি রাখা আদর্শ যুবকের চারিত্রিক ভূষণ। যুবমানস আল্লাহর দেয়া এই অযাচিত নেয়ামত কাজে লাগিয়ে অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়। বিশ্বজয়ের বর্ণিল ইতিহাস যুবকদের কীর্তিগাঁথায় ভাস্বর হয়ে আছে। যুগেযুগে যুবকদের তপ্ত খুনের নযরানায় উড্ডীন হয়েছে ইসলামের ঝান্ডা। আল্লাহর পথে জান-মাল উৎসর্গ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে মুসলিম দামাল যুবকেরা। ইমাম সা’লাবী আললাতায়েফ ওয়াত তারায়েফ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নুবুওয়াতের প্রাথমিককালে যুবকরাই আমার প্রতি ঈমান এনেছে, অথচ বৃদ্ধরা করেছে বিরোধিতা।’ ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, ‘গুনাহের প্রতি অনাসক্ত যুবকদের অল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন।’ যৌবন হলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন, ইচ্ছার প্রতিফলন ও মহৎকর্ম সাধনের উপযুক্ত সময় এবং জ্ঞানার্জনের মোক্ষম সুযোগ। যৌবনে জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রযি.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বান্দাকে জ্ঞান দান করেন যৌবনকালে। তদুপরি যৌবন হলো সকল কল্যাণের আধার।’ হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রযি.) বিদ্বান যুবক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রযি.)-কে অভিজ্ঞ সাবাবীদের জন্য আয়োজিত পরামর্শ সভায় আহ্বান করতেন। রসুল (সা.) যুবকদের দীনের প্রতি উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘যুবকদের কল্যাণ কামনা করো। কেননা তাদের হৃদয় থাকে সতত কোমল।’

ইসলামের ইতিহাসে যুবসমাজের অবদান

ইসলামের ইতিহাসে যুবসমাজের অবদান অতুলনীয়। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে কতিপয় যুবকের উজ্বল দৃষ্টান্ত এঁকেছেন এবং তাদেরকে যুবসমাজের আইডল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নিষ্কলুষ চরিত্র গঠনে ইউসুফ (আ.), শক্তিমত্তা ও আমানতদারিতে হযরত মুসা (আ.), ধৈর্যধারণ ও সত্যানুসন্ধিৎসায় হযরত ইবরাহীম (আ.), স্বাধীনচেতা ও উলটো স্রোতে অবগাহনের ক্ষেত্রে আসহাবে কাহফ মানব ইতিহাসের অনুপম আদর্শ। এসকল ঘটনা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাদের অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। যুগে যুগে প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা বয়োজ্যেষ্ঠদের বাগডোরে নিয়ন্ত্রিত হলেও যুবকদের অকৃত্রিম আত্মোৎসর্গের কারণে বিপ্লব সফলতা লাভ করেছে। হযরত মুসা (আ.)-এর দাওয়াতের সূচনায় যে কতিপয় ব্যক্তি সাড়া দিয়েছেন তারা ছিলেন তাগড়া যুবক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَمَاۤ اٰمَنَ لِمُوْسٰۤى اِلَّا ذُرِّيَّةٌ مِّنْ قَوْمِهٖ عَلٰى خَوْفٍ مِّنْ فِرْعَوْنَ وَمَلَاۡىِٕهِمْ اَنْ يَّفْتِنَهُمْ١ؕ وَاِنَّ فِرْعَوْنَ لَعَالٍ فِي الْاَرْضِ١ۚ وَاِنَّهٗ لَمِنَ الْمُسْرِفِيْنَ۰۰۸۳

‘ফেরআউন ও তার গোত্রের অত্যাচারের ভয়ে মুসা (আ.)-এর ওপর কয়েকজন যুবক ব্যতীত কেউ ঈমান আনেনি। নিশ্চয় ফেরআউন পৃথিবীতে উদ্ধত হয়েছে এবং সে সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’[1]

দীনের জন্য আত্মোৎসর্গের ইতিহাসে সাতজন যুবক একটি জ্বলন্ত নযির। ‘আসহাবে কাহফ’ নামাঙ্কিত যুবকদের ব্যাপারে আল-কুরআনের ভাষ্য হলো,

اِنَّهُمْ فِتْيَةٌ اٰمَنُوْا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنٰهُمْ هُدًىۗۖ۰۰۱۳

‘তারা এমন কতিপয় যুবক, যারা স্বীয় রবের প্রতি ঈমান এনেছে। আর আমি তাদের হেদায়ত বৃদ্ধি করেছি।’[2]

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রতি মূর্তি ভাঙচুরের অভিযোগ তুলে পৌত্তলিক মুশরিকগণ বললো,

قَالُوْا سَمِعْنَا فَتًى يَّذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهٗۤ اِبْرٰهِيْمُؕ۰۰۶۰

‘ইবরাহীম নামক এক যুবককে আমাদের দেবদেবী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে শুনেছি।’[3]

রসুল (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সর্বপ্রথম যারা ইসলাম কবুল করেছেন তারা ছিলেন সকলেই যুবক। হযত আবু বকর সিদ্দিক (৩৮), হযতর ওমর ইবনুল খাত্তাব (৩০), হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান (৩৮), হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (২০),হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (১৮), হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (১৫), হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (২০) ও হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (১৮) প্রমুখ।

রণাঙ্গণে মুসলিম যুবকদের ভূমিকা

যৌবন আল্লাহর এক মহা নেয়ামত। মহৎকাজে জীবন উৎসর্গ করা যৌবনেরই বৈশিষ্ঠ্য। ইসলামে যৌবনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিবেচনায় রসুল (সা.) প্রবীণদের উপস্থিতিতেই যুবকদের হাতেই জিহাদের পতাকা তুলে দিতেন। ইসলামের প্রথম জিহাদ বদরে মুসলমানদের পতাকা ছিল কুরাইশের কিংবদন্তি যুবক হযরত আলী (রযি.)-এর হাতে। কথিত আছে, যুবকদের সাহসিকতার কারণেই বদর যুদ্ধে বিজয় সূচিত হয়েছিল। এ যুদ্ধকে যুবকদের যুদ্ধও বলা হয়। তাবুক যুদ্ধে যুবকদের হাতেই ছিল স্ব স্ব গোত্রের পতাকা। প্রসিদ্ধ আল-নাজ্জার গোত্রের পতাকা ছিল বিশিষ্ট সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রযি.)-এর হাতে। উহুদের যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কা সত্ত্বেও রসুল (সা.) যুবকদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের ও জলিলুল কদর সাহাবায়ে কেরামের মতামতকে পদদলিত করে যুবকদের নিষ্ঠাপূর্ণ সাহস ও অদম্য স্পৃহাকে প্রাধান্য দেন। অথচ সমরনীতিতে একটি উক্তির বাহুল্য রয়েছে যে, ‘শত্রুকবলিত ও নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত এলাকায় যুদ্ধ করে কেউ কখনো জয়ী হতে পারেনি।’ হযরত আয়িশা (রযি.)-এর বিরুদ্ধে আরোপিত মিথ্যা অপবাদের ঘটনায় আঠারো বছরের যুবক হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রযি.)-এর নিকট রসুল (সা.) পরামর্শ করেন। তৎকালীন পরাশক্তি রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রযি.)-কে রসুল (সা.) সেনাপতি হিসেবে মনোনয়ন দান করেন। অথচ হযরত আবু বকর (রযি.), হযরত ওমর (রযি.), হযরত আবু উবাইদা (রযি.) ও হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রযি.)-এর মতো শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম তার অধীনে সাধারণ সৈনিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রযি.) যুবকদের ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে দলে দলে রসুল (সা.)-এর নিকট নিয়ে আসতেন। হিজরতের পূর্বে মদীনায় শিক্ষক হিসেবে নিযোগপ্রাপ্ত হন সুললিত কণ্ঠের অধিকারী ও সুদর্শন যুবক হযরত মুসআব ইবনে উমাইর (রযি.)। রসুল (সা.) যুবক হযরত ইতাব ইবনে আসিদ (রযি.)-এর হাতে মক্কার আমীরের দায়িত্ব প্রদান করেন।

যুবসমাজের আত্মত্যাগের অনুপম ঘটনা

ইসলাম যৌবনের কমনীয় সময়কে ভালো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং যুবসমাজের নিষ্ঠাপূর্ণ কর্মযজ্ঞ সমীহের দৃষ্টিতে দেখে। মানবজীবনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে যৌবন হলো সবার শীর্ষে। রসুল (সা.) যৌবনকে মূল্যায়ন করার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,

«اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ، شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغُلُكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ».

‘পাঁচ ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভূত হওয়ার পূর্বে পাঁচটি অবস্থার মূল্যায়ন করো। যৌবনকে প্রৌঢ়তার পূর্বে, সুস্থতাকে রুগ্ন হওয়ার পূর্বে, ধনাঢ্যতাকে দরিদ্রতার পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, হায়াতকে মৃত্যুর পূর্বে।’[4]

আল্লাহ ও তাঁর রসুলের জন্য সাহাবায়ে কেরাম সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। দীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী যুবকেরা এতই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, পুরো জীবনকেই ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রযি.) থেকে বর্ণিত,

«جَاءَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ إِلَىٰ بُيُوْتِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ ﷺ، يَسْأَلُوْنَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ ﷺ، فَلَمَّا أُخْبِرُوْا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوْهَا، فَقَالُوْا: وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ ﷺ قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ؟! قَالَ أَحَدُهُمْ: أَمَّا أَنَا فَإِنِّي أُصَلِّيْ اللَّيْلَ أَبَدًا، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلَا أُفْطِرُ، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلَا أَتَزَوَّجُ أَبَدًا، فَجَاءَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَقَالَ: أَنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا، أَمَا وَاللهِ إِنِّيْ لَأَخْشَاكُمْ لِلهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّيْ أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّيْ وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ».

‘একদিন তিনজন যুবক রসুল (সা.)-এর গৃহে আগমন করে তাঁর ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। রসুলের ইবাদতের বাস্তব খবর অবগত হওয়ার পর তারা এটিকে খুবই অল্প মনে করেন। তারা মন্তব্য করে বলেন, আমরা কখনো একজন নবির সমকক্ষ হতে পারবো না। আল্লাহ তাআলা তাঁর পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তাদের একজন মন্তব্য করলো, আমি পুরো জীবনের সারা রাত ইবাদতের মধ্যেই কাটিয়ে দেবো। আরেকজন বললো, আমি সারাজীবনই রোযা রাখবো। কখনো রোযা ভাঙবো না। অন্যজন বললো, আমি নারীসঙ্গই ছেড়ে দেবো, জীবনে কখনো বিয়ে করবো না। এ কথা শোনার পর রসুল (সা.) তাদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা কি এ ধরনের মন্তব্য করেছো? জেনে রেখো, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশিই ভয় করি। তা সত্ত্বেও আমি মাঝে-মধ্যে রোযা রাখি, আবার কখনো রোযা ভঙ্গও করি। রাতের কিয়দংশ নামাজে কাটাই, আবার নিদ্রাও যাই, বিয়ে-শাদিও করি। এটিই আমার সুন্নাহ। যে আমার সুন্নাহর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’[5]

ইসলামের ইতিহাসে যুবকদের আত্মত্যাগের অনেক ঈর্ষণীয় ঘটনার কিংবদন্তি রয়েছে। তারা অল্লাহর পথে অল্প বয়সে জীবন উৎসর্গ করার জন্য রসুল (সা.)-এর নিকট আবেদন জানিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রযি.) থেকে বর্ণিত,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ h: أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ عَرَضَهُ يَوْمَ أُحُدٍ، وَهُوَ ابْنُ أَرْبَعَ عَشْرَةَ سَنَةً، فَلَمْ يُجِزْنِيْ، ثُمَّ عَرَضَنِيْ يَوْمَ الْـخَنْدَقِ، وَأَنَا ابْنُ خَمْسَ عَشْرَةَ، فَأَجَازَنِيْ.

‘আমি ১৪ বছর বয়সে উহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য নিজেকে উপস্থাপন করলাম। কিন্তু রসুল (সা.) আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। আবার খন্দক যুদ্ধের প্রাক্কালে আমি নিজেকে উপস্থাপন করলাম। তখন আমার বয়স ছিল ১৫ বছর। এবার তিনি আমাকে যুদ্ধযাত্রার অনুমতি দিলেন।’[6]

কুরাইশের অন্যতম দামাল যুবক হযরত আমর ইবনুল আস (রযি.)-এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রযি.) কুরআন চর্চাকে নিজের জীবনের মহান ব্রত হিসেবে বেচে নেওয়ার সংকল্প করেছেন এবং যৌবনকে কুরআনের আলোকে উপভোগ করার যে অঙ্গীকার করেছেন, তা নিম্নহাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: جَمَعْتُ الْقُرْآنَ فَقَرَأْتُهُ كُلَّهُ فِيْ لَيْلَةٍ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «إِنِّي أَخْشَىٰ أَنْ يَطُولَ عَلَيْكَ الزَّمَانُ، وَأَنْ تَمَلَّ، فَاقْرَأْهُ فِيْ شَهْرٍ». فَقُلْتُ: دَعْنِيْ أَسْتَمْتِعْ مِنْ قُوَّتِيْ وَشَبَابِيْ، قَالَ: «فَاقْرَأْهُ فِيْ عَشْرَةٍ» قُلْتُ: دَعْنِيْ أَسْتَمْتِعْ مِنْ قُوَّتِيْ وَشَبَابِيْ، قَالَ: «فَاقْرَأْهُ فِيْ سَبْعٍ» قُلْتُ: دَعْنِيْ أَسْتَمْتِعْ مِنْ قُوَّتِيْ وَشَبَابِيْ فَأَبَىٰ.

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রযি.) বলেন, কুরআন সংকলন করার পর আমি একরাতেই পরো কুরআন তেলাওয়াত করে সমাপ্ত করেছি। এ খবর শুনে রসুল (সা.) তাকে বললেন, আমার আশঙ্কা হয় জীবনের এক পর্যায়ে আল-কুরআন তোমার জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং তুমি মাসে একবার আল-কুরআন সমাপ্ত করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমি আমার যৌবন ও শক্তিকে কাজে লাগাতে চাই। রসুল (সা.) বললেন, তবে দশদিনে একবার সমাপ্ত করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমাকে যৌবন ও শক্তি কাজে লাগাবার সুযোগ দিন। রসুল (সা.) বললেন, তবে সাতদিনে একবার সমাপ্ত করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমার যৌবন ও শক্তি উপভোগ করার সুযোগ দিন। কিন্তু রসুল (সা.) সাতদিনের কমে আল-কুরআন সমাপ্ত করার অনুমতি দেননি।’[7]

ইসলামে যুবকের মর্যাদা

রসুল (সা.) যুবসমাজের মর্যাদা যথাযথ আসনে সমুন্নত করেছেন। মুমিন যুবকদের সম্মানার্থে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের প্রৌঢ় অধিবাসীদের যুবকের মর্যাদায় ভূষিত করবেন। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: «أَهْلُ الْـجَنَّةِ شَبَابٌ، جُرْدٌ، مُرْدٌ، كُحْلٌ، لَا تَبْلَىٰ ثِيَابُهُمْ، وَلَا يَفْنَىٰ شَبَابُهُمْ».

‘হযরত আবু হুরাইরা (রযি.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, জান্নাতের অধিবাসীরা হবে যুবক, যাদের শরীরে অযাচিত লোম থাকবে না। চক্ষুযুগল হবে কৃষ্ণবর্ণের, তাদের যৌবন কখনো নিঃশেষ হবে না। পরিধেয় বস্ত্র কখনো পুরনো হবে না।’[8]

যুবকদের উৎসাহ দেওয়ার নিমিত্তে অনেক সময় রসুল (সা.) যোগ্যতা অর্জনের পূর্বে ইমামতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগদান করতেন। হযরত আমর ইবনে সালামা (রযি.) থেকে বর্ণিত,

وَكُنْتُ غُلَامًا حَافِظًا فَحَفِظْتُ مِنْ ذَلِكَ قُرْآنًا كَثِيْرًا فَانْطَلَقَ أَبِيْ وَافِدًا إِلَىٰ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فِيْ نَفَرٍ مِنْ قَوْمِهِ فَعَلَّمَهُمُ الصَّلَاةَ، فَقَالَ: «يَؤُمُّكُمْ أَقْرَؤُكُمْ» وَكُنْتُ أَقْرَأَهُمْ لِـمَا كُنْتُ أَحْفَظُ فَقَدَّمُونِيْ، فَكُنْتُ أَؤُمُّهُمْ وَأَنَا ابْنُ سَبْعِ سِنِيْنَ أَوْ ثَمَانِ سِنِيْنَ.

‘আমি কিশোর বয়সেই কুরআনের অধিকাংশ সূরা মুখস্ত করেছি। আমার পিতা স্বজাতির প্রতিনিধি হিসেবে রসুল (সা.)-এর নিকট গমন করেন। রসুল (সা.) তাদেরকে নামাজের শিক্ষা প্রদানপূর্বক বলেন, তোমাদের মধ্যে কুরআন সম্পর্কে অধিকতর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি নামাজের ইমামতি করবে। কুরআন সম্পর্কে আমার জ্ঞান বেশি থাকার কারণে গোত্রের লোকেরা আমাকে ইমামতির দায়িত্ব প্রদান করতো। সাত অথবা আট বছর বয়সে আমি আমার গোত্রে নামাজের ইমামতি করতাম।’[9]

রসুল (সা.) যুবকদের প্রতি ছিলেন অতিশয় দয়ালু। তিনি তাদের আবেগ-অনুভূতি ও মনোভাব বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি যুবসমাজের পরিবার পরিজনের প্রতিও সদা সদয় থাকতেন এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন।

عَنْ أَبِي قِلَابَةَ قَالَ: حَدَّثَنَا مَالِكٌ : «أَتَيْنَا إِلَى النَّبِيِّ ﷺ وَنَحْنُ شَبَبَةٌ مُتَقَارِبُوْنَ، فَأَقَمْنَا عِنْدَهُ عِشْرِيْنَ يَوْمًا وَلَيْلَةً، وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ رَحِيْمًا رَفِيْقًا، فَلَمَّا ظَنَّ أَنَّا قَدِ اشْتَهَيْنَا أَهْلَنَا، أَوْ قَدِ اشْتَقْنَا، سَأَلَنَا عَمَّنْ تَرَكْنَا بَعْدَنَا فَأَخْبَرْنَاهُ، قَالَ: ارْجِعُوْا إِلَىٰ أَهْلِيْكُمْ، فَأَقِيْمُوْا فِيْهِمْ وَعَلِّمُوْهُمْ، وَمُرُوْهُمْ، وَذَكَرَ أَشْيَاءَ أَحْفَظُهَا، أَوْ لَا أَحْفَظُهَا: وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَاةُ، فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ».

‘হযরত মালিক ইবনুল হুআইরিস বর্ণনা করেন, আমরা রসুল (সা.)-এর নিকট আগমন করলাম। তখন আমরা ছিলাম সমবয়সি যুবক। আমরা রসুলের দরবারে বিশদিন অস্থান করেছিলাম। তিনি আমাদের প্রতি অত্যন্ত মমতাপূর্ণ আচরণ করেন। পরিবার পরিজনের প্রতি আমাদের আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়ে জানার পর তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, পরিবারে আমাদের কে কে আছে? আমরা তাঁকে পারিবারিক সব বৃত্তান্ত অবহিত করলাম। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা পরিবার পরিজনের নিকট ফিরে যাও এবং সেখানেই অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধ প্রদান করো। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি এমন কিছু বিষয় আলোচনা করলেন, যার কিছু অংশ আমার স্মরণ আছে, আর কিয়দংশ ভুলে গিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমাকে যেভাবে নামাজ আদায় করতে দেখেছো, তোমরাও সেভাবে নামাজ আদায় করবে। নামাজের সময় হলে একজন আযান দেবে এবং সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ইমামতি করবে।’[10]

কিছু মুমিন নারী-পুরুষকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ আমলের কারণে অভাবনীয় প্রতিদান দেবেন। এ ক্ষেত্রে যুবকদের মর্যাদা হলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সাত প্রকারের ব্যক্তি কিয়ামতের মহা সঙ্কটের দিন আরশের নিচে ছায়া লাভ করবেন। তারা হলেন, ন্যায়পরায়ণ শাসক, মসজিদে সর্বদা জামায়াত সহকারে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি, একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বতের সম্পর্ক স্থাপনকারী এবং বিচ্ছিন্নকারী, যে পুরুষ একমাত্র আল্লাহর ভয়ে মর্যাদাবান ও সুন্দরী নারীর অনৈতিক আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, গোপনে দান-সদকাকারী ব্যক্তি এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ে একাকী অশ্রুবিসর্জনকারী নারী-পুরুষ। এই সাত শ্রেণির সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণ শাসকদের পরে যুবকদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রযি.)-এর বর্ণনাটি প্রণিধানযোগ্য।[11]

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: «سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ: الْإِمَامُ الْعَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِيْ عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْـمَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ، أَخْفَىٰ حَتَّىٰ لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِيْنُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ».

রসুল (সা.) যুবকদের অত্যন্ত সমীহ করতেন এবং তাদের অধিকার ও আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। যুব সমাজের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাদের আবেগ অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নিম্নের হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য।

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ السَّاعِدِيِّ h: «أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أُتِيَ بِشَرَابٍ فَشَرِبَ مِنْهُ، وَعَنْ يَمِيْنِهِ غُلَامٌ، وَعَنْ يَسَارِهِ الْأَشْيَاخُ، فَقَالَ لِلْغُلَامِ: أَتَأْذَنُ لِي أَنْ أُعْطِيَ هَؤُلَاءِ، فَقَالَ الْغُلَامُ: لَا وَاللهِ يَا رَسُوْلَ اللهِ، لَا أُوثِرُ بِنَصِيْبِيْ مِنْكَ أَحَدًا. قَالَ: فَتَلَّهُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فِيْ يَدِهِ».

‘হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রযি.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.)-এর নিকট একদিন কিছু সুপেয় পানি হাদিয়া আসলো। তাঁর ডানপাশে ছিল এক যুবক। বামপাশে ছিলেন বর্ষীয়ান ব্যক্তিবর্গ। রসুল (সা.) যুবকটির উদ্দেশে বললেন, তুমি অনুমতি দিলে আমি এ পানীয়ের বণ্টন বয়স্কদের দ্বারা শুরু করতে পারি। যুবকটি বললো, আল্লাহর কসম! আপনার পরে পান করার যে অধিকার আমি সৌভাগ্যক্রমে লাভ করেছি, তাতে কাউকে অগ্রাধিকার দিতে রাজি নই। অতঃপর রসুল (সা.) পানির পাত্রটি তাকে দিয়ে বণ্টন শুরু করলেন।’[12]

যুবসমাজের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা

সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণে সচ্চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চরিত্রমাধুর্য সমাজবিপ্লবে প্রভাবক ভূমিকা পালন করে। যুবসমাজ হলো সমাজ পরিবর্ততের মূল চাবিকাটি। চরিত্রবান যুবক সুশীল সমাজ বিনির্মাণের মূল কারিগর। যুবসমাজের উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠনে রসুল (সা.) বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। তিনি যুবকদের উদ্দেশ করে বলেন,

«يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ. فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ. وَمَنْ لَـمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ».

‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যাদের বিয়ে করার সামর্থ্য আছে তারা যেন বিয়ে করে। কেননা এটি দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই তারা যেন রোযা রাখে। কেননা এটি কামভাব নিয়ন্ত্রণ করে।’[13]

আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ঈমান, অবিচল আস্থা ও সুদৃঢ় বিশ্বাস মুমিন জীবনের প্রধান অবলম্বন। তিনি যুবক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রযি.)-কে আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস স্থাপনের উপদেশ দিয়ে বলেন,

«يَا غُلَامُ إِنِّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ، احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ، احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ، إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ، وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ، وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَىٰ أَنْ يَنْفَعُوْكَ بِشَيْءٍ لَـمْ يَنْفَعُوْكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ للهُ لَكَ، وَلَوْ اجْتَمَعُوْا عَلَىٰ أَنْ يَضُرُّوْكَ بِشَيْءٍ لَـمْ يَضُرُّوْكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ».

‘হে বালক! তুমি আল্লাহর বিধি-নিষেধ অনুযায়ী জীবন যাপন করলে আল্লাহ তোমার হেফাজতের দায়িত্ব নেবেন। কোনো কিছু প্রার্থনা করলে আল্লাহর কাছেই করবে। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে আল্লাহর নিকট চাইবে। হে বালক! জেনে রেখো, সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একত্রিত হয়ে তোমার কোনো উপকার করতে চাইলে আল্লাহর সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কোনো উপকার করতে পারবে না। আর পৃথিবীর সকল শক্তি একজোট হয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলেও আল্লাহর ফয়সলার বাইরে কোনা ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না।’[14]

সাধারণ মানুষের সঙ্গে মুমিনের আচরণ হবে শালীন ও মাধুর্যপূর্ণ। আল্লাহভীরু ও পাপাচারমুক্ত যুবকদের সদাচরণ সমাজে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করে। যুবক হযরত আবু যর (রযি.) ও হযরত আবু মুসা আশআরী (রযি.)-কে রসুল (সা.) উপদেশ দিয়ে বলেন,

«اتَّقِ اللهِ حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْـحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ».

‘তুমি যেখানেই থেকো আল্লাহকে ভয় করে চলবে। কোনো গুনাহের কাজ সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত পর একটি ভালো কাজ করে নেবে। এতে সেই গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করবে।’[15]

রসুল (সা.) যৌবনের সূচনাপর্বেই যুবকদের সামাজিক রীতিনীতি ও শিষ্ঠাচার শিক্ষা দিতেন। ব্যক্তিচরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গঠনে তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতার প্রধান শিক্ষক। তিনি বালক হযরত ওমর ইবনে আবু সালামা (রযি.)-কে নিজের সঙ্গে পানাহারের সুযোগ দিয়ে বাধিত করতেন এবং পানাহারের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিতেন। প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দীক্ষা ও শিষ্ঠাচার তালিম দিতেন। হযরত ওমর ইবনে আবু সালামার (রযি.) বর্ণনা করেন,

«كُنْتُ غُلَامًا فِيْ حِجْرِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَكَانَتْ يَدِي تَطِيشُ فِي الصَّحْفَةِ، فَقَالَ لِيْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: يَا غُلَامُ، سَمِّ اللهَ، وَكُلْ بِيَمِيْنِكَ، وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ. فَمَا زَالَتْ تِلْكَ طِعْمَتِيْ بَعْدُ».

‘আমি রসুল (সা.)-এর গৃহে একজন অল্পবয়স্ক বালক হিসেবে বসবাস করতাম। আমি খাবারের পাত্রে এলোমেলোভাবে এদিক সেদিক থেকে আহার করতাম। রসুল (সা.) আমাকে বললেন, হে বালক! আল্লাহর নাম সহকারে খাবার গ্রহণ করবে এবং ডানপাশ থেকে তোমার সামনে রক্ষিত খাবার আহার করবে। হযরত ওমর ইবনে আবু সালামা (রযি.) বর্ণনা করেন, এরপর থেকে আমি এই পদ্ধতিতেই আহার করতাম।’[16]

মদীনায় একদল যুবক সাহাবী শাহাদতবরণ করেন। বয়সে তরুণ ও আল-কুরআনে অভিজ্ঞ এ কাফেলার শাহাদতে রসুল (সা.) অত্যন্ত মর্মাহত হন। শত্রুদের হাজারো নির্যাতন দয়াল নবী মুখ বুঝে সহ্য করতেন। চরম শত্রুর জন্যও তিনি ছিলেন রহমতের আধার। তিনি কখনো কাউকে অভিশাপ দিতেন না। তা সত্ত্বেও যুবক কারি সাহাবীদের শাহাদতের কারণে পনেরো দিন পর্যন্ত নামাজরত অবস্থায় শত্রুদের জন্য বদদোয় করেন।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: كَانَ شَبَابٌ مِنَ الْأَنْصَارِ سَبْعِيْنَ رَجُلًا يُسَمَّوْنَ الْقُرَّاءَ قَالَ: كَانُوْا يَكُوْنُوْنَ فِي الْـمَسْجِدِ فَإِذَا أَمْسَوْا انْتَحَوْا نَاحِيَةً مِنَ الْـمَدِيْنَةِ، فَيَتَدَارَسُونَ وَيُصَلُّوْنَ يَحْسِبُ أَهْلُوْهُمْ أَنَّهُمْ فِي الْـمَسْجِدِ، وَيَحْسِبُ أَهْلُ الْـمَسْجِدِ أَنَّهُمْ عِنْدَ أَهْلِيهِمْ، حَتَّىٰ إِذَا كَانُوْا فِيْ وَجْهِ الصُّبْحِ اسْتَعْذَبُوا مِنَ الْـمَاءِ، وَاحْتَطَبُوْا مِنَ الْـحَطَبِ، فَجَاءُوْا بِهِ فَأَسْنَدُوْهُ إِلَىٰ حُجْرَةِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، فَبَعَثَهُمُ النَّبِيُّ ﷺ جَمِيْعًا، فَأُصِيْبُوْا يَوْمَ بِئْرِ مَعُونَةَ، فَدَعَا النَّبِيُّ ﷺ عَلَىٰ قَتَلَتِهِمْ خَمْسَةَ عَشَرَ يَوْمًا فِيْ صَلَاةِ الْغَدَاةِ.

‘হযরত আনাস ইবনে মালিক (রযি.) বর্ণনা করেন, আনসারি সাহাবীদের মধ্যে সত্তরজন ব্যক্তি কারি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারা মসজিদেই অবস্থান করতেন। সন্ধ্যা হলেও মসজিদের এক কোণে গিয়ে শিক্ষ-দীক্ষায় নিয়োজিত থাকতেন অথবা নামাজ আদায় করতেন। তাদের পরিবারের সদস্যগণ মনে করতেন যে, তারা মসজিদে অবস্থান করছেন। মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি সাহাবীগণ মনে করতেন, তারা পরিবার-পরিজনের নিকট ফিরে গেছেন। এ সকল যুবক ভোর হবার পর স্বাভাবিক নিয়মে সুপেয় পানি পান করতেন এবং লাকড়ি সংগ্রহ করে তা রসুলের হুজরা মোবারকের সঙ্গে টেক দিয়ে রেখে দিতেন। রসুল (সা.) তাদেরকে আরবের এক গোত্রের শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেন। কিন্তু মাউনা কূপের পাদদেশে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রসুল (সা.) পনেরো দিন পর্যন্ত নামাজরত অবস্থায় শত্রুদের জন্য বদ-দোয় করেন।’[17]

বন্ধু নির্বাচনে যুবসমাজের সতর্কতা

বন্ধু নির্বাচনে যুবকদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। কেননা বন্ধু স্বীয় বন্ধুর আদর্শে পরিচালিত হয়। রসূল (সা.) ইরশাদ করেন,

«الْـمَرْءُ عَلَىٰ دِيْنِ خَلِيْلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلْ».

‘মানুষ বন্ধুর নীতি-আদর্শ গ্রহণ করে। সুতরাং বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।’[18]

কিয়ামতের দিন বন্ধুত্ব বড় আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং দুনিয়াবি স্বার্থে গঠিত বন্ধুত্ব শত্রুতায় রূপ নেবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰى يَدَيْهِ يَقُوْلُ يٰلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا۰۰۲۷ يٰوَيْلَتٰى لَيْتَنِيْ لَمْ اَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيْلًا۰۰۲۸

‘মুত্তাকীগণ ব্যতীত কিয়ামতের দিন সকল বন্ধুত্ব শত্রুতায় পর্যবসিত হবে। সেদিন জালেমগণ আপসোসবশত হাতের আঙ্গুল কামড়ে ধরবে। তারা বলবে, হায়রে আপসোস! যদি রসুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতাম। হায়রে আপসোস! যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।’[19]

[1] আল-কুরআনুল করীম, সূরা ইউনুস, ১০:৮৩

[2] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-কাহফ, ১৮:১৩

[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৬০

[4] আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ১২, পৃ. ৪৭৬, হাদীস: ৯৭৬৭

[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ২, হাদীস: ৫০৬৩

[6] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ১৭৭, হাদীস: ২৬৬৪

[7] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ৪২৮, হাদীস: ১৩৪৬

[8] আদ-দারিমী, আস-সুনান = আল-মুসনাদ, দারুল মুগনী লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০০ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ১৮৬৬, হাদীস: ২৮৬৮

[9] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ১৫৯, হাদীস: ৫৮৫

[10] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ১২৮-১২৯, হাদীস: ৬৩১

[11] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ১৩৩, হাদীস: ৬৬০

[12] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৩০, হাদীস: ২৪৫১

[13] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১০১৯, হাদীস: ১৪০০

[14] আত-তিরমিযী, আল-জামিউস সহীহ = আস-সুনান, মুস্তফা মুস্তফা আল-বাবী আল-হালাবী অ্যান্ড সন্স লাইব্রেরি অ্যান্ড প্রিন্টিং কোম্পানি, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৬৬৭, হাদীস: ২৫১৬

[15] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৩৫৫, হাদীস: ১৯৮৭

[16] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৭, পৃ. ৬৮, হাদীস: ৩৫৬৭

[17] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২১, পৃ. ১২৬-১২৭, হাদীস: ১৩৪৬২

[18] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, খ. ১৪, পৃ. ১৪২, হাদীস: ৮৪১৭

[19] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-ফুরকান, ২৫:২৭-২৮

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ