ড. আহমদ আলী
লেখক: প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উপনিবেশোত্তর বিভিন্ন মুসলিম দেশে একদিকে ইসলামী জাগরণের ঢেউ, অপরদিকে এর বিরুদ্ধে কুচক্রীমহলের নানা আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে প্রাচীন খারিজী সম্প্রদায়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের মতো যেসব জালিম ও পাপিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহ তাআলার দেয়া বিধান অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফির। তাদের কোনোরূপ আনুগত্য বা সমর্থন করা জায়িয নয়, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ও সশস্ত্র লড়াই করা ফরজ। অধিকন্তু যেসব নাগরিক তাদের শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নেয়, এমনকি যারা নীরবতা পালন করে তাদেরকেও তারা কাফির-মুরতাদ বলে জানে এবং তারা মনে করে যে, এ ধরনের লোকদেরকে হত্যা করা ও তাদের ধন-সম্পদ লুট করা বৈধ। তাঁদের চিন্তার সাথে যেহেতু প্রাচীন খারিজীদের অনেকাংশে মিল রয়েছে তাই অনেক গবেষক এসব ব্যক্তি ও দলকে ‘নব্য-খারিজী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
উল্লেখ্য, আধুনিক ইসলামী জাগরণের বিরুদ্ধে শত্রুদের কার্যক্রমের পাশাপাশি যে বিষয়টি মুসলিম সমাজের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো নব্য খারিজীদের উগ্র চিন্তাচেতনা। এরাও প্রাচীন খারিজীদের মতো বিভিন্ন দেশে নিজ মুসলমান ভাইদের রক্ত ঝরাচ্ছে, তাদের সম্পদসমূহ নষ্ট করছে, মুসলমানদের ধর্মীয় ও পবিত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করছে। দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যায়, এ নব্য খারিজীগোষ্ঠীর ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমগুলোকে পাশ্চাত্য মিডিয়া ইসলামী কর্মকাণ্ড হিসেবে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাশ্চাত্য মিডিয়াসমূহ ওয়াকেবহাল হলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। অধিকন্তু এই গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের শত্রুরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আধুনিক কালে এ ধরনের উগ্র চিন্তাচেতনার ওপর গড়ে ওঠা দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
২.১. ‘জামায়াতুল মুসলিমীন’
(জামায়াতুত তাকফীর ওয়াল হিজরাহ)
মিসরের কুখ্যাত জামাল আবদুন নাসিরের শাসনামলে (১৯৫৬-১৯৭০ খ্রি.) কারাগারগুলোতে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কর্মীদের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয় এবং তাদের কয়েকজন প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। এ অবস্থায় কারান্তরীণ কিছু ব্যক্তির মধ্যে এ ধরনের ধারণার উদ্ভব ঘটে যে, জামাল আবদুন নাসির যে নিকৃষ্টতম শাস্তি ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে তা এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, যার অন্তরে তিল পরিমাণ ঈমান বিদ্যমান রয়েছে। তাই তারা ভাবলো, তাকে ও তার সহযোগীদেরকে কাফির ও তাগুতই মনে করতে হবে। অধিকন্তু তারা ভাবলো যে, মিসরের বর্তমান সমাজ হলো একটি জাহেলি সমাজ। এখানে বসবাস করে প্রকৃত মুসলিমরূপে জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তাই নিজের দীন ও ঈমান রক্ষার প্রয়োজনে এ সমাজ ছেড়ে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা ছাড়া উপায় নেই। পরবর্তীকালে এ চিন্তা-ভাবাপন্ন লোকগুলো কারাগার থেকে বের হয়ে ইখওয়ান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং নিজেরা সুসংগঠিত হয়ে ‘জামায়াতুল মুসলিমীন’ নামে একটি দলের গোড়াপত্তন করে। তবে সর্বসাধারণের কাছে দলটি অত্যাচারী শাসক ও তাদের সহযোগীদের, এমনকি নীরবতা পালনকারী নিরীহ নাগরিকদেরকেও ব্যাপকহারে তাকফীর করা এবং নিজেদের দীন ও ঈমান রক্ষার প্রয়োজনে (তাদের ভাষায়) ‘জাহেলি সমাজ’ ছেড়ে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের কারণে ‘জামায়াতুত তাকফীর ওয়াল হিজরাহ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।[1]
এ দলের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হলেন শুকরী আহমদ মুস্তফা (১৯৪২-১৯৭৮)। তিনি ছাত্র অবস্থায় ইখওয়ানের একজন সদস্য ছিলেন এবং এ অভিযোগে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর কারাভোগের পর ১৯৭১ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি ও তাঁর অনুসারীগণ দাবি করেন যে, একমাত্র তাঁদের জিহাদী কর্মকাণ্ড তথা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই দীনের বিজয় সম্ভব হবে এবং এ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত দ্রুতই তাঁরা এ বিজয় অর্জনে সক্ষম হবেন। তাঁদের এ দাবি ও দ্রুত ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগ্রহ অনেক ধর্মপ্রাণ ছাত্র ও যুবককে আকৃষ্ট করে। তাঁরা ক্রমে এতোটাই চরমপন্থা অবলম্বন করেন যে, তাদের দলভুক্ত হতে আপত্তি করে, এমন সকল লোককে তাঁরা কাফির-মুরতাদ গণ্য করতে থাকেন এবং এরূপ কাফির-মুরতাদদেরকে গুপ্তহত্যা করার জন্য দলের কর্মীদের প্রতি নির্দেশ জারি করেন। বিশেষত যে সকল আলিম ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব এদের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের বিভ্রান্তি বোঝাতে চেষ্টা করতেন বা তাঁদের বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে কথা বলতেন তাঁদেরকে তাঁরা ‘তাগুতের দালাল’ মনে করতেন এবং তাঁদেরকেও গুপ্ত হত্যা করতে শুরু করেন। এ দলের নেতাদের অধিকাংশই লোকালয় ছেড়ে বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় নিজেদের বসতি গড়ে তোলেন, আর কেউ কেউ বিভিন্ন গুহায় আশ্রয় নেন।
দলটির প্রধান প্রধান মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য
ক. তাকফীর
দলটির চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের প্রধান নীতি ও বৈশিষ্ট্য হলো ‘তাকফীর’ অর্থাৎ সাধারণভাবে পাপের কারণে মুসলিমদেরকে ‘কাফির’ বলে আখ্যায়িত করা। প্রাচীন খারিজীদের মতে, প্রত্যেক কবীরা গোনাহই কুফর এবং এ ধরনের গোনাহগার কাফির ও মুরতাদ। এ দলটির অনুসারীগণও প্রায় অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁরা একদিকে দেশের জালিম ও পাপিষ্ঠ মুসলিম সরকারকে ‘কাফির’ বলে আখ্যায়িত করেন, অপরদিকে এরূপ সরকারের অনুগত ও সমর্থক সাধারণ নাগরিকদেরকেও ব্যাপকহারে ‘কাফির’ বলে আখ্যায়িত করেন।
ক. ১. জালিম ও পাপিষ্ঠ সরকারকে কাফির বলা
প্রাচীন খারিজীগণ যেমন মানুষকে সালিসী ক্ষমতা প্রদান, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বায়তুল মালের সম্পদে শাসকের যথেচ্ছ অধিকার প্রদান ইত্যাদি ‘মানবরচিত ব্যবস্থা’ প্রচলনের কারণে সাইয়িদুনা হযরত আলী (রযি.), হযরত মুআবিয়া (রযি.) ও পরবর্তী শাসকরদেরকে কাফির বলেছেন, তেমনিভাবে এরা উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলোর, বিশেষত মিসরের শাসকদেরকে ‘ইসলাম-বিরোধী’ আইন প্রচলনের জন্য কাফির ঘোষণা করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জালিম শাসকগণ যেহেতু ইসলামী আইনে বিচার করেন না বা ইসলাম বিরোধী আইনে বিচার করেন, সেহেতু তারা সকলেই কাফির ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ।
ক. ২. সাধারণ নাগরিকদেরকে কাফির বলা
প্রাচীন খারিজীদের মতোই তাঁরাও এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, মুসলিম দাবিদার কোনো ব্যক্তি যদি ইসলামের কোনো অকাট্য বিধান বা অনুশাসন লঙ্ঘন করে তবে সে কাফির হয়ে যায়। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে দেশের সাধারণ নাগরিক, যারা জালিম ও পাপিষ্ঠ সরকারের আনুগত্য করে, তাদেরকেও তাঁরা ব্যাপকহারে কাফির বলেন। এক্ষেত্রে তারা মূলত রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকেই ‘কাফির’ বলেন। তারা নিজেরাই এমন অনেক প্রকার পাপে লিপ্ত হন, যেগুলো কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টতই পাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় চাকরি করা, রাষ্ট্রের আনুগত্য করা, তাদের দলে যোগ না দেওয়া, তাদের কথিত জিহাদ সমর্থন না করা, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বা ‘গণতান্ত্রিক’ কোনো দলকে সমর্থন করা ইত্যাদি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ পাপের কারণে তারা অনেক আলিম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বকে কাফির ঘোষণা করে হত্যা করেছেন।
খ. হিজরত, বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন
দলটির দ্বিতীয় প্রধান চিন্তা হলো ‘হিজরত।’ এখানে ‘হিজরত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জাহেলি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন। তাঁদের দৃষ্টিতে, বর্তমানে প্রত্যেকটি সমাজই হলো জাহেলি সমাজ। কাজেই এরূপ সমাজে বসবাস করে কারো পক্ষে প্রকৃত ইসলামী জীবন যাপন করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেককেই জীবনযাপনের এমন পরিবেশ ও অবস্থান ইখতিয়ার করতে হবে, যেখানে প্রকৃত ইসলামী জীবনযাপন করা যায়। তাঁরা মনে করেন যে, বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন দুধরনের হতে পারে, স্থানগত ও চিন্তাচেতনাগত। চিন্তাচেতনাগত বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, রসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবা কেরাম (রযি.)-এর মক্কী জীবন। সেসময় তাঁরা জাহেলি সমাজে বসবাস করেও এমনভাবে জীবনযাপন করেছেন যে, জাহিলিয়্যাতের ছিটেফোঁটাও তাঁদের গায়ে লাগেনি।[2]
তাঁদের মতে, সমাজে মুসলিমদের অবস্থা যখন দুর্বল ও পর্যদুস্ত হয়, তখন তাঁদের কর্তব্য হলো, চিন্তাচিতনাগত বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা, সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা দৃঢ় করা ও শক্তি সঞ্চয় করা। আর এ অবস্থায় যে কোনোরূপ জিহাদ থেকেও বিরত থাকা উচিত, যে যাবত না পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করা হয়।
গ. কুরআন বোঝার জন্য বুদ্ধিবিবেকই যথেষ্ট বলে দাবি করা
দলটির নেতা শুকরী দাবি করেন যে, কুরআন বোঝার জন্য কোনো মানুষের ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করাও কুফরী; কারণ এতে মানুষের কথাকে আল্লাহর কথার ওপরে স্থান দেওয়া হয়। এ যুক্তিতে তারা কুরআনের আয়াতগুলো নিজেদের উপলব্ধি ও আবেগ অনুসারে ব্যাখ্যা করতো। এক্ষেত্রে তারা সাহাবীগণ বা অন্য কারো মতের কোনো গুরুত্ব আছে বলে স্বীকার করে না।
ঘ. হাদীসের ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দের ওপর নির্ভর করা
তাঁরা হাদীস মানলেও তা গ্রহণ করার বিষয়ে নিজেদের পছন্দের ওপর নির্ভর করে। যদি কোনো হাদীস তাঁদের কথা মোতাবেক হয়, তাহলে সেটা তাঁরা গ্রহণ করে, অন্যথায় হয় তা খণ্ডন করে বা মনগড়া ব্যাখ্যা করে। তাদের মতে, কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি আকল (বুদ্ধিবিবেচনা)ও ইসলামের মূল উৎস।
ঙ. সাহাবীগণসহ পূর্ববর্তী সকল মুসলিম প্রজন্মকে ঘৃণা করা
সাহাবীগণের যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিম প্রজন্মকে তাঁরা ইসলামচ্যুত বলে মনে করে। কারণ তারা সঠিক ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা না করে আল্লাহদ্রোহী তাগুতী রাষ্ট্রশক্তির সাথে আপস করে চলেছেন। সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের আলিমদের ব্যাখ্যা বা মতামতকে তারা কোনোরূপ মূল্যায়ন করে না। তাঁদের মতে, সাহাবীগণের কথা ও কর্ম হুজ্জত নয়।[3]
চ. অতীত-বর্তমান সকল আলিমের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ
শুকরী ও তার অনুসারীগণ অতীত ও বর্তমান সকল যুগের প্রায় সকল আলিমের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করতেন। সাহাবীগণের যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের আলিম, ইমাম, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস ও সমকালীন সকল আলিমকে তারা মূর্খ, স্বার্থপর, আপসকামী, তাগুতের অনুসারী ইত্যাদি বলে অভিহিত করতেন। কোনো আলিমের বইপুস্তক পড়তে বা কাউকে প্রশ্ন করতে তাঁরা তাঁদের অনুসারীদের কঠোরভাবে নিষেধ করতেন।[4]
ছ. তাকলীদ বর্জন করা
তাঁদের মতে, ‘তাকলীদ’ একটি চরম গর্হিত বিষয়; দীনের কোনো বিষয়েই তাকলীদ করা জায়িয নেই; প্রত্যেক মুসলিমের একান্ত কর্তব্য হলো, সে নিজেই দলীলের ভিত্তিতে বিধিবিধানগুলো জেনে নেবে। যেহেতু হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরবর্তী সময়গুলোতে জাহিল-আলিম নির্বিশেষে সকলেই তাকলীদ ও পরানুকরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং একে অত্যন্ত ন্যায্য ও নির্দোষ রীতি মনে করা হয়, তাই তাঁরা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরবর্তী সময়গুলোতে জন্ম নেয়া আলিমগণকে সাধারণভাবে অনির্ভরযোগ্য মনে করেন এবং তাকলীদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পরবর্তী সমাজগুলোকেও একান্তই জাহেলি সমাজরূপে গণ্য করেন।[5]
জ. জামায়াত ও বায়আতের তত্ত্ব প্রদান করা
তাঁরা দাবি করেন যে, কেবল জামায়াত ও বায়আতের মাধ্যমেই একজন মুসলিমকে অমুসলিম থেকে পৃথক করা যাবে। এই দাবির পক্ষে তাঁরা কুরআন ও হাদীসের বায়আত ও জামায়াত বিষয়ক নির্দেশনাগুলোকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। তাঁদের এই দাবিতে তাঁদের চরম মূর্খতা ও বিভ্রান্তির বিষয় স্পষ্ট ফুটে ওঠে। কারণ তাঁদের পেশ করা দলীলের কোনোটিতেই বায়আত ও জামায়াতকে ঈমানের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। তদুপরি তাঁরা এই পরিভাষাদুটির মর্মও সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হননি।
ঝ. বড় ফরজ ও ছোট ফরজের তত্ত্ব প্রদান
প্রাচীন খারিজীগণের মতো তাঁরাও জালিম ও পাপিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও জিহাদ করাকে ফরজে আইন বলে দাবি করেন। পাশাপাশি তাঁরা দাবি করেন যে, ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে মুসলিমদের ওপর সবচেয়ে বড় ও প্রথম ফরজ হলো ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। এই ফরজ পালন করতে যেয়ে যদি অন্যান্য ফরজ ইবাদত বাদ দিতে হয়, তবে তাও দিতে হবে।
এটিও তাদের মনগড়া একটি মতামত ছিল। কোনো ফরজকে বড় বলতে হলে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন। দাওয়াত, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এবং জিহাদ ইত্যাদি কর্ম কুরআন ও হাদীস নির্দেশিত ফরজ ইবাদত বটে; কিন্তু কুরআন ও হাদীসে কোথাও এগুলোকে সবচেয়ে বড় ফরজ বলা হয়নি। বরং কুরআন-হাদীস থেকে সুস্পষ্ট যে, এ সকল ইবাদত ফরজে আইন নয়, বরং তা ফরজে কিফায়া। আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ওযর ছাড়াও যাঁরা জিহাদ না করে বসে থাকেন তবে তাঁদের মর্যাদা কিছু কমলেও কোনো পাপ হবে না। হাদীসে প্রয়োজনে পিতামাতার খিদমতের জন্য জিহাদ পরিত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের আবেগ এবং কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের কর্মধারা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অভাব তাঁদেরকে এ বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত করেছে।[6]
ঞ. মসজিদে জামায়াতসহকারে সালাত আদায় না করা
তাঁরা কোনো মসজিদে জুমুআর নামাজ ও জামায়াতসহকারে নামাজ আদায় করতেন না। তাঁরা মনে করতেন যে, বর্তমানে প্রত্যেক মসজিদই হলো ‘মসজিদে দিরার’, আর ইমামগণ হলেন কাফির ও তাগুতের দোসর। তবে চারটি মসজিদের কথা ভিন্ন। এগুলো হলো, মসজিদে হারাম, মসজিদে নবভী, মসজিদে কুবা ও মসজিদে আকসা। এগুলোতে তাঁরা নামাজ আদায় করতো, যদি ইমাম তাঁদের একান্ত মতাবলম্বী হয়।[7]
ট. শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ
তাঁরা শিক্ষার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখান না। তাঁরা মনে করেন যে, বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যলয়গুলো- ইসলামী হোক বা অনৈসলামিক, সবই তাগুত বা তাদের দোসর কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং এগুলো মসজিদে দিরারের পর্যায়ভুক্ত। তাঁরা আরও মনে করেন, বর্তমানে অজ্ঞতা দূরীকরণের যে দাওয়াত দেয়া হয় এবং এতদুদ্দেশ্যে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তা মূলত ইহুদি পরিকল্পনারই অংশ। এর লক্ষ্য হলো, লোকদেরকে কাফিরদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত করে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা-দীক্ষা থেকে দূরে রাখা। তাঁদের মতে, প্রকৃত ইলম হলো, যা তাঁরা কেবল তাঁদের নির্দিষ্ট হালকাগুলোতে অর্জন করে থাকেন।[8]
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দলটির নানা সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ডের অজুহাতে মিসরীয় সরকার অগণিত আলিম ও ধর্মপ্রাণ যুবককে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এছাড়া প্রচার মাধ্যমগুলো এদের কর্মকাণ্ডকে সাধারণভাবে ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মপ্রাণ মানুষ ও ইসলাম প্রচারকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৭৮ সালে এদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বাকি অনেককে দীর্ঘ মেয়াদি সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এরপর এ দলের ব্যাহ্যিক কর্মকাণ্ড দেখা যায় না; তবে মাঝে মাঝে তাঁরা তাঁদের অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড দাবি করেন। এছাড়া তাদের চিন্তাচেতনা পরবর্তীকালে অনেক আবেগী মুসলিমের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে।[9] উল্লেখ্য, এ দলটির উৎপত্তি ও বিস্তার যদিও প্রথমে মিসরেই ঘটে; কিন্তু পরে তা ক্রমে অন্যান্য আরবদেশেও, বিশেষ করে ইয়েমেন, জর্দান, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এ দলের চিন্তা ও নানা কর্মকাণ্ড আরব-অনারব নির্বিশেষে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশেও বিস্তার লাভ করেছে। কোথাও এসব চিন্তার অনুসারীরা সুসংগঠিতভভাবে বিভিন্ন নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কোথাও প্রকাশ্যে, আবার কোথাও গোপনে। কোথাও আবার তারা সুসংগঠিত নয় এবং তাদের কোনো কার্যক্রমও প্রকাশ্যে চোখে পড়ে না।
[1] আল-মাওসূআতুল মুওয়াসসারা, প্রবন্ধ: জামায়াতুল মুসলিমীন
[2] আল-মাওসূআতুল মুওয়াসসারা, প্রবন্ধ: জামায়াতুল মুসলিমীন
[3] মুহাম্মদ সুরূর, আল-হুকমু বিগাইরি মা আনযালাল্লাহু, পৃ. ১২৩
[4] মুহাম্মদ সুরূর, আল-হুকমু বিগাইরি মা আনযালাল্লাহু, পৃ. ৫৬
[5] আল-মাওসূআতুল মুওয়াসসারা, প্রবন্ধ: জামায়াতুল মুসলিমীন
[6] জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৬২১-৬২৩
[7] আল-মাওসূআতুল মুওয়াসসারা, প্রবন্ধ: জামায়াতুল মুসলিমীন
[8] আল-মাওসূআতুল মুওয়াসসারা, প্রবন্ধ: জামায়াতুল মুসলিমীন
[9] মুহাম্মদ সুরূর, আল-হুকমু বিগাইরি মা আনযালাল্লাহু, পৃ. ৯-১১