জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেনমোহর ইসলামী কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ

 মাওলানা শিবলী নোমানী

দেনমোহর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলামি সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ফরজ বিধান আদায়ে আমাদের সমাজ নানা ধরনের প্রান্তিকতা ও প্রতিকূলতার শিকার। এ বিষয়ে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা অনেকেরই অজানা। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, এ ফরজ বিধান আদায়ে এমন অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়; অনেক সময় হারামে পর্যবসিত হয়। একজন দায়িত্ববান সচেতন মুসলমান হিসেবে দেনমোহর বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রত্যেকেরই জন্য ফরজ পরিমাণ দীনি ইলম শেখারই অংশ।

ইসলামের দৃষ্টিতে দেনমোহর

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاُحِلَّ لَكُمْ مَّا وَرَآءَ ذٰلِكُمْ اَنْ تَبْتَغُوْا بِاَمْوَالِكُمْ مُّحْصِنِيْنَ غَيْرَ مُسٰفِحِيْنَؕ ۰۰۲۴

‘(কয়েকজন নারী ছাড়া) অন্যদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে যে স্বীয় সম্পদ দ্বারা প্রয়াসী হবে তাদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে, ব্যভিচারে নয়।’[1]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

وَاٰتُوا النِّسَآءَ صَدُقٰتِهِنَّ نِحْلَةًؕ ۰۰۴

‘নারীদেরকে খুশি মনে তাদের দেনমোহর আদায় কর।’[2]

এ আয়াতদ্বয়ে বিয়ে ও দেনমোহর সম্পর্কিত বেশ কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। যেমন-

ক. ‘মুহাররামাত’ (যাদের সঙ্গে বিয়ে হারাম করা হয়েছে) ছাড়া অন্যদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ।

খ. দেনমোহর একটি ফরজ বিধান। দেনমোহর আদায়ের নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন।

গ. স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য স্বেচ্ছায় ধার্যকৃত দেনমোহর থেকে ছেড়ে দেওয়া কিংবা বাড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি রয়েছে।

ঘ. স্বামী যদি চাপ প্রয়োগ করে কিংবা কৌশলে পূর্ণ দেনমোহর বা আংশিক মাফ করিয়ে নেয়, তাহলে আল্লাহর বিচারে মাফ হবে না।

প্রচলিত সমাজ ভাবনা

দেনমোহর নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত যেসব কালচার রয়েছে, তা হলো:

  1. নারীর মালিক বনে যাওয়া: দেনমোহর প্রকৃতপক্ষে নারীর সম্মানী; যা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদান করা হয়। দেনমোহরের মূল উদ্দেশ্য হলো, নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটি নারীর মূল্য নয় যে, এটি পরিশোধের মাধ্যমে ধরে নেওয়া হবে যে, স্ত্রী-স্বামীর কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।
  2. দেনমোহর প্রথাসর্বস্ব বিধান নয়: দেনমোহর প্রথাসর্বস্ব কোনো বিষয় নয়, যা ধরা হয় কিন্তু আদায়ের প্রয়োজন পড়ে না। আমরা দেনমোহর ধার্যের প্রয়োজন অনুভব করলেও দেনমোহর পরিশোধের প্রয়োজন অনুভব করি না। গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধানটি অনাদায় রেখে দেওয়া আমাদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। শরীয়ত দেনমোহর আদায়ের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত অন্যান্য গিফট বা হাদিয়া-তোহফার মতো দেনমোহর সাধারণ কোনো উপহার নয়। একই সঙ্গে দেনমোহর আদায় করা বা না করা স্বামীর ইচ্ছাধীন কোনো বিষয় নয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে দেনমোহর একটি স্বতন্ত্র আদায়যোগ্য আর্থিক ঋণ। অনাদায়ে ব্যক্তি মারা গেলে পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের আগে অন্যান্য ঋণের মতো স্ত্রীর দেনমোহর আদায়ে শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

«مَنْ نَكَحَ امْرَأَةً وَهُوَ يُرِيْدُ أَنْ يَّذْهَبَ بِمَهْرِهَا، فَهُوَ عِنْدَ اللهِ زَانٍ يَّوْمَ الْقِيَامَةِ».

‘কোনো ব্যক্তি বিয়ে করেছে, অথচ দেনমোহর আদায়ের ইচ্ছা করে না, সে আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন ব্যভিচারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।’[3]

সুতরাং দেনমোহর যেন কাগুজে লেনদেনের মাঝের সীমাবদ্ধ না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

  1. স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া: বাসর রাতে বা পরবর্তী সময়ে স্ত্রীর কাছে দেনমোহর ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। শুধু তাই নয়, কনের অভিভাবকরাও কনেকে দেনমোহর ক্ষমা করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ফলে কনে লজ্জা, সংকোচবোধ ও অভিভাবকদের পরামর্শের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার দ্বারা দেনমোহর আদায়ের ফরজ বিধান থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/৩১৩)

দেনমোহর ক্ষমা করে দেওয়ার পরামর্শ প্রদান অভিভাবকদের জন্য কখনোই উচিত নয়। এটি অন্যায় পরামর্শের অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে স্বামীর জন্যও স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া অত্যন্ত লজ্জা ও নীচু মানসিকতার পরিচয়াক। আত্মমর্যাদাশীল ও দায়িত্ববান স্বামীর পক্ষে কখনও স্ত্রীর থেকে দেনমোহর ক্ষমা চেয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

  1. বিজোড় সংখ্যায় দেনমোহর নির্ধারণ: ইসলামে মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত। তবে সর্বোচ্চ দেনমোহর নির্ধারিত নয়। (শরহু মুখতাসারিত তাহাভী: ৪/৩৯৮)

ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন বিজোড় সংখ্যায় দেনমোহর নির্ধারণের প্রথা রয়েছে। যেমন- এক টাকা দেনমোহর ধার্য করা কিংবা এক লাখ এক টাকা ইত্যাদি। এটিকে জরুরি মনে করা সঠিক নয়।

শরীয়তের দৃষ্টিতে বেশি দেনমোহর নির্ধারণ

মোটা অঙ্কে দেনমোহর ধার্য করা হারাম নয়। কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি সঠিক নিয়তে আদায়ের উদ্দেশ্যে মোটা অঙ্কের দেনমোহর ধার্য করেন, তাহলে তার বিয়ে বরকতশূন্য হয়ে যাবে, এ কথা সঠিক নয়। সুরা নিসার ২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা অধিক দেনমোহর প্রসঙ্গে ‘কিনতার’ শব্দ উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই অধিক দেনমোহরে বিয়ে করেছেন। যেমন- হযরত ওমর (রাযি.) হযরত উম্মে কুলসুম (রাযি.)-কে ৪০ হাজার দিরহামে বিয়ে করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) ১০ হাজার দিরহামে বিয়ে করেছেন। (তাবয়ীনুল হাকায়িক: ৩/১৩১)

তবে আমাদের সমাজে অধিক পরিমাণে দেনমোহর ধার্যের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও লোক দেখানোর মানসিকতা থেকে মোটা অঙ্কের দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেখানে দেনমোহর আদায়ের ইচ্ছে থাকে না, সে ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের দেনমোহর নির্ধারণ নাজায়েজ। বেশি দেনমোহর নির্ধারণের জন্য তিনটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, লৌকিকতার উদ্দেশ্যে না হওয়া, দেনমোহর আদায়ের সদিচ্ছা ও পরিশোধে সামর্থ্যবান হওয়া। (ইমদাদুল মুফতীন: ২/৪৭১)

শরীয়তের দৃষ্টিতে কম দেনমোহর নির্ধারণ

ইসলাম নারীর সম্মান রক্ষা করে কম দেনমোহর নির্ধারণে উৎসাহ প্রদান করেছে। সর্বোত্তম পরিমাণের দেনমোহর হচ্ছে তা, যা পরিশোধ করা সহজসাধ্য। (সুনানে বায়হাকী: ১৪৭২১)

রসুলুল্লাহ (সা.) অল্প দেনমোহরকে উত্তম ও বিয়েতে বরকতের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া দেনমোহর পরিমাণে কম হলে সমাজে বিয়েশাদি সহজলভ্য হয়ে যাবে। ফলে যুবকদের জন্য বিয়ের রাস্তা মসৃণ হবে। যে সমাজে বিয়ে যত বেশি সহজ, সে সমাজে পাপাচার ও অশ্লীলতার চর্চা ততটাই কম। এ জন্য নারীর সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রেখে যথাসাধ্য অল্প পরিমাণে দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিত।

মোহরে ফাতেমি

রসুলুল্লাহ (সা.)-এর অধিকাংশ স্ত্রী ও হযরত ফাতেমা (রাযি.)-এর দেনমোহর ছিল পাঁচশ দিরহাম; যা বর্তমানে ১৩১.২৫ তোলা বা ১.৫৩০৯ কিলোগ্রাম রুপা। (শরহু মুখতাসারিত তাহাভী: ৪/৩৯৮)

উভয় পক্ষ যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করে এ নিয়তে যে, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যার ধার্যকৃত মোহরের পরিমাণটি বরকতপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধায় তা গ্রহণ করা ভালো এবং এর মাধ্যমে সুন্নতের সওয়াব লাভের প্রত্যাশা রয়েছে; তবে এ আবেগ ও অনুভূতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয় যে, মোহরে ফাতেমি শরীয়ত নির্ধারিত দেনমোহর। তার চেয়ে কমবেশি করা অপছন্দনীয়। (রদ্দুল মুহতার: ৩/১০০)

দেনমোহর নির্ধারণে ইসলামের শিক্ষা

একজন নারীর প্রকৃত দেনমোহর ‘মহরে মিছিল’। সেটি হলো, স্ত্রীর পিতার দিকের বিবাহিতা নারী আত্মীয় অর্থাৎ বোন, ফুফু ও চাচাতো বোনদের মধ্যে যারা দীনদারি, বয়স, সৌন্দর্য, গুণাবলি, বংশমর্যাদা ও জ্ঞান-গরিমা ইত্যাদিতে তার মতো হয়, তাদের মোহরের অনুপাতে অনুরূপ দেনমোহর নির্ধারণ করা। (বাদায়িউস সানায়ি: ২/৫৫৯)    (এরপর ৩০ পৃষ্ঠার প্রথম কলাম দেখুন)

[1] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:২৪

[2] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:৪

[3] ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৪, হাদীস: ১৭৪১০, হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রাযি.) থেকে বর্ণিত

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ