স্বদেশচেতনা সুন্নতে আম্বিয়া (আ.)
সৃষ্টির প্রথম দিবস থেকে যেসব নবী ও রসুল (সা.) মানবজাতির হেদায়েতের জন্য দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত হন তাঁরা প্রত্যেকে আপন দেশ, মাতৃভূমি ও জনগোষ্ঠীকে ভালোবেসেছেন। কোনো নবী-রসুল পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষকে পরিত্যাগ করে বন-ভাদাড়ে, গিরি-কন্দরে বা মরু প্রান্তরে ধ্যানমগ্ন সাধনায় মাসের পর মাস তন্ময় ছিলেন, এমন ইতিহাস নেই। দীন প্রচার, দীন প্রতিষ্ঠা, স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণ সাধন ও অশুভ শক্তির দমন ছিল তাঁদের নুবুওয়াতি মিশন। স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশচেতনা হচ্ছে সুন্নতে আম্বিয়া (আ.)।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন। নুবুওয়াত পরবর্তী প্রথম পর্যায়ে ১৩বছর তিনি অত্যন্ত বাধা-বিপত্তির মধ্যে মক্কায় ধর্মপ্রচারে ব্রতী ছিলেন। নিবর্তন ও সংঘাতের তাণ্ডব যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন ৬২২ খ্রিস্টাব্দে দাওয়াতের আরেক দিগন্ত উন্মোচনের উদ্দেশ্যে হিজরত করে মদীনা রওনা হন। মদীনা যাত্রাপথে তিনি জন্মভূমি মক্কার পানে তাকিয়ে অশ্রুপাত করেন বারবার। তিনি মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমার শহর কতইনা সুন্দর, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার জনগণ যদি আমাকে বের করে না দিত কখনো আমি তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতাম না (তিরমিযী শরীফ: ৩৯৫২)। ৬২২ হতে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মদীনা হয়ে উঠে মহানবী (সা.) কর্তৃক দীনপ্রচার, দীনের আরাকান-আহকাম বাস্তবায়ন, রাস্ট্র পরিচালনা, শান্তিচুক্তি সম্পাদন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন, আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ‘মদীনা সনদ’ ঘোষণার কেন্দ্রস্থল। এ মদীনায় রচিত হয় তাঁর সমাধিস্থল ‘রাওযা আকদাস’। তিনি মদীনার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করেন। মক্কার পাশাপশি মদীনার প্রতি ছিল তাঁর আজীবনের ভালোবাসা। তিনি বলেন, আমি উহুদ পর্বতমালাকে ভালোবাসি আর উহুদও আমায় ভালোবাসে (বুখারী শরীফ: ২৮৮৯)। হিজরত করে মদীনা গেলেও মক্কার সাথে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন ফলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মক্কা বিজয় সম্ভব হয়। বিজয়ের দিন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেওয়া এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার ফলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।
মদীনায় ১০ বছর অবস্থান করে তিনি জনগণের মাঝে সাম্য, মানবাধিকারও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। জনসাধারণকে ইসলামের রীতিনীতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত করেন। শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে দেশকে শত্রুমুক্ত রাখা। অভ্যন্তরীণ শত্রু ও বহিঃশত্রু মিলে দেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করে দিতে পারে। সেজন্য মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরতের অব্যাবহিত পর বিবদমান দলগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন কার্যকর পন্থায়। ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে একটি সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করেন যা ‘মদীনা সনদ’ নামে সমধিক খ্যাত। এ সনদের উল্লেখযোগ্য শর্তের মধ্যে রয়েছে ‘মদীনা প্রজাতন্ত্র যদি দেশীয় ও বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে স্ব স্ব দল ও গোত্র ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে।’
জাতীয় অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া নফল ইবাদতের চেয়েও সওয়াব বেশি। আত-তারগীব ওয়াত তারহীব নামক গ্রন্থে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদীস উল্লিখিত হয়েছে। এতে তিনি বলেন, ‘লায়লাতুল কদরের চেয়ে আরও একটি পূণ্যময় রাতের খবর তোমাদের দেব নাকি? সাহাবাগণ জবাবে দেন বলুন, ইয়া রসুলুল্লাহ! কোনো সৈনিক রাতে এমন এক কঠিন ভীতিপ্রদ চৌকিতে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে; যেকোনো মুহূর্তে শত্রুর উদ্ধত অস্ত্রের আঘাতে তার বক্ষ বিদীর্ণ হতে পারে এবং জীবনে আর স্ত্রী-সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ নাও আসতে পারে, সে রজনী লায়লাতুল কদরের চেয়ে আরও বরকতপূর্ণ।’
দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। প্রধানকর্তব্য হচ্ছে রাস্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখা, রাস্ট্রের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে চলা, রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ‘কর’ আদায়ে সচেষ্ট থাকা, নাগরিকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, নিজস্ব কৃষ্টি ও মূল্যবোধ চর্চা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও দুর্নীতির প্রতিবাদ জ্ঞাপন। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক নাগরিকের অধিকারও ব্যাপক।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন