ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বরূপ সন্ধান
মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
শিক্ষা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও প্রধান সম্পদ এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত। এ শিক্ষা যে গ্রহণ করে সে হলো ছাত্র, আর যিনি এ শিক্ষা দান করেন, তিনি হলেন শিক্ষক। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে সুগভীর সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আত্মিক ও নিখুঁত। এ সম্পর্ক উভয়কে মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছায়। একজন শিক্ষকের সম্পর্ক শুধু ছাত্রের সাথে নয় বরং তার পরিবারের সাথে। ছাত্রের পরিবারের সকলেই তাঁকে সম্মানের চোখে দেখে, অন্তর দিয়ে ভালোবাসে। পৃথিবীর সবকিছুই শিক্ষার বস্তু। কবির ভাষায় “বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র। নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবা রাত্র।’
শিক্ষকের পরিচয়
শিক্ষকের পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয় আমাদের স্রষ্টা, আমাদের মালিক আল্লাহ তাআলাই প্রকৃত ও আসল শিক্ষক। আল্লাহ তাআলা মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাময়। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি মানুষকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন যা মানুষ জানত না (আল-আলাক: ৫)।’ সমস্ত নবী-রাসূল শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি (মিশকাত)।’ নবী-রাসূলদের শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তিনি তাঁর প্রেরিত পুরুষদেরকে নির্ভুল ও তাত্ত্বিক জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। উম্মত হলো তাঁদের ছাত্র। সাধারণত যে কোন অজানা বা অজ্ঞাত জিনিসের জ্ঞান যিনি দান করেন তিনিই শিক্ষক। চাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হোন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোন। একটি অক্ষর শিক্ষা দান করুক বা একাধিক বিষয় শিক্ষা দান করুক। এ হিসেবে মানুষ সকলেই শিক্ষক, সকলেই ছাত্র।
শিক্ষকরা নবীদের উত্তরাধিকারী
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী, আর নবীদের মীরাস অর্থ-সম্পদ নয়, বরং তাঁদের মীরাস হলো: ‘ইলম।’ তারা একমাত্র ইলমই মীরাস হিসেবে রেখে গেছেন (তিরমিযী ও আবু দাউদ)।’ নবীদের উত্তরাধিকারী হিসেবে শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে নবীদের আদর্শের প্রতিফলন ঘটানো আবশ্যক। ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের কথার চেয়ে তাঁদের আদর্শের অনুকরণ বেশি করে। মহানবী (সা.) হাসিমুখে উজ্জ্বল চেহারায় সবার সাথে মিলিত হতেন, সালাম দিতেন। সকলের আত্মমর্যাদার প্রতি তিনি সদা খেয়াল রাখতেন। তাঁর শিক্ষার্থী ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তিনি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা, সহমর্মিতা, নৈকট্য ও ভালোবাসার নযীর স্থাপন করেছেন। কাছে টেনে বসাতেন, বুকে বুক মিলিয়ে দোয়া করতেন। উভয় কাঁধে হাত রেখে অত্যন্ত স্নেহ-মমতা ও আন্তরিকতা সহকারে শিক্ষা দিতেন। নিজের সাথে বসিয়ে খাওয়াতেন। কেউ সামান্যতম খেদমত করলে তার শুকরিয়া আদায় করতেন, তার জন্য দোয়া করতেন। ভুল করলে বুঝিয়ে ক্ষমা করে দিতেন। বৈঠকে সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখতেন। আচরণের ক্ষেত্রে তারতম্য করতেন না। ফলে সকলেই মনে করতেন, তার সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অত্যন্ত হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা রয়েছে। আমরা যদি ছাত্রদের সাথে এরূপ আচরণ করতে পারি, তাহলে আমাদের ছাত্ররাও হবে সাহাবায়ে কেরামের ন্যায় আদর্শবান ও সোনার মানুষ। আর এসব সোনার মানুষরাই একদিন গড়ে তুলবে সোনার বাংলাদেশ।
শিক্ষকের মর্যাদা
শিক্ষকের মর্যাদা সকলের উর্ধ্বে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেছেন, যিনি আমাকে একটি অক্ষর শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি আমার মুনিব। ইচ্ছা করলে আমাকে বিক্রি করে দিতে পারেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর পাঠশালায় একদিন একজন মুচির ছেলে আসলে তিনি দাঁড়িয়ে যান। ছাত্ররা দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, সে আমার উস্তাদের ছেলে। ছাত্রগণ আশ্চার্য হয়ে বললেন! সে তো মুচির ছেলে! মুচি কীভাবে আপনার শিক্ষক হলো? ইমাম আযম বলেন, তার পিতা থেকে আমি শিখেছি কুকুর কখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়। বড় বড় মনীষীরা তাদের উস্তাদকে যথাযথ সম্মান করতেন। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘উস্তাদের কদর’ কবিতা:
‘আজ হতে চিরউন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, যারা জানে আর যারা জানে না উভয় কী সমান? মহানবী (সা.) বলেছেন, যারা বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না তারা অমার প্রকৃত উম্মত নয়। তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে কুরআন নিজে শিক্ষা করে এবং অন্যকে শেখায়।’ অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন ভালো কাজের পথ দেখায় সে ভালো কাজ সম্পাদনকারীর সমান পূণ্য প্রাপ্ত হবে।’
শিক্ষার্থীর মর্যাদা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের উদ্দেশে কোনও পথে চলে আল্লাহ তার বেহেস্তের পথ সুগম করে দেন (মুসলিম)।’ অন্যত্র বলেন, ‘কল্যাণ শিক্ষাদানকারীর জন্যে সব কিছুই আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করে (তিরমিযী)।’ আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে ঘর থেকে বের হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথেই (জিহাদেই) থাকে (তিরমিযী)।’ আরও বলেন, ‘ইলম অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য তাদের সামনে ফিরিশতারা নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন (আবু দাউদ)।’
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
মনীষীদের স্বীয় শিক্ষকদের সাথে ছিল সুগভীর সম্পর্ক। তারা শিক্ষকের আদেশ-নিষেধ গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। শিক্ষকদের সাথে কোনরকম বৈরী আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। যিনি স্বীয় শিক্ষকের সাথে যত বেশি সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছেন তিনি তত বেশি মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছেন। কারণ তাঁরা জানেন জ্ঞান হল সবচেয়ে সেরা সম্পদ, আর জ্ঞানী ব্যক্তি হলেন সেরা সম্পদের আধিকারী। চার ইমামের মধ্যে ছিল ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ছাত্র ছিলেন ইমাম মালেক (রহ.)। তাঁর ছাত্র ছিলেন ইমাম শাফেয়ী (রহ.)। তাঁর ছাত্র ছিলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)। তাঁদের সকলেরই ছিল শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁর ছাত্রদের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে আছেন। ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর উস্তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাঁদের বর্ণিত হাদীসগুলো সহীহ আল-বুখারীতে প্রথম দিকে উল্লেখ করেছেন। মনীষীদের জ্ঞানভাণ্ডার তাঁদের ছাত্ররাই পরর্বতী প্রজন্মের নিকট প্রচার ও প্রসার করেছেন। এতে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে কি ধরনের মধুর সম্পর্ক ছিল তা সহজে প্রতীয়মান।